মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত, সুস্থ ধারার সংস্কৃতি চর্চায় আগ্রহী প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে সারাদেশে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত রণেশ দাশগুপ্ত পাঠ প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ীদের মাঝে সনদ এবং পুরস্কার বিতরণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে গত ০৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বিকাল ৪টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সেমিনার কক্ষে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান এবং সেমিনার আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।
সেমিনারে “প্রগতি সাহিত্য চর্চার বাতিঘর রণেশ দাশগুপ্ত” শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। তাঁর পক্ষে প্রবন্ধটি পাঠ করেন রণেশ দাশগুপ্ত পাঠ প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের আহবায়ক এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন। এছাড়া, আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্য সৈয়দ মোহাম্মদ সাহেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক মাসুম, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ড. রতন সিদ্দিকী এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা ইয়ুথ কয়্যার-এর শিল্পী এবং উত্তরপাড়ার সমতট সংস্কৃতি-এর ডিরেক্টর বাসুদেব হুই। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ‘সুখচর পঞ্চম’ দলের প্রধান মলয় মিত্র। সেমিনারটি সঞ্চালনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, “একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনীতি নিয়ে ভাবনা-চর্চার এক দৃঢ়-বলিষ্ঠ পথিকৃত রণেশ দাশগুপ্ত (১৯১২-১৯৯৭)। এই পথ চলায় রণেশ দাশগুপ্ত আলোর পথ দেখিয়েছেন প্রগতির পথে চলমান মানুষদের। উদার মানসিকতা, সামগ্রিক মানবকল্যাণ, সার্বিক মানবমুক্তি, উদার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, শোষণ-বঞ্চনাহীন অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছিল রণেশ দাশগুপ্ত-র পথ চলার ভিত্তি। সেই ভিত্তি ছিল কঠিন কংক্রিটে গাঁথা। ফলে আমৃত্যু তিনি অবিচল থেকেছেন তাঁর আদর্শিক পথচলায়। আলোর পথে চলেছেন, আর আলো ছড়িয়েছেন, তাই আঁধার হটানিয়া এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। আলো খুঁজেওছেন তিনি বিশ্বময়। বিচরণ করেছেন বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতির ভাণ্ডারে। নির্যাস গ্রহণ করেছেন বিশ্বভাণ্ডারের বিচিত্র সংগ্রহশালা থেকে। মন্থন করেছেন আপন ঐতিহ্যভাণ্ডার। হয়ে উঠেছেন এক ঋদ্ধ ভাণ্ডারী। সমৃদ্ধ সেই ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন ভবিষ্যতের পথে। আলোকচ্ছটায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে সেই আলো-আঁধারী পথ। এ যেন এক ‘আলোর শিখা’। স্বীয় ভাবনা-বিবেচনা-মেধা, সত্যের পথে অবিচল সংগ্রাম আর দৃঢ় প্রত্যয়ে রণেশ দাশগুপ্ত হয়ে উঠেছেন বাঙালির প্রগতির পথে পথ চলার মস্তিষ্ক বা ‘নৌস’ যেমনটি এরিস্টটল ছিলেন প্লেটোর একাডেমিতে।”
তিনি আরো বলেন, “রণেশ দাশগুপ্ত-র পথচলা বিচিত্রতর। শিল্প-সাহিত্য চর্চা-অনুধ্যান, জীবিকার অন্বেষায় চাকরি, সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দ্বারে দ্বারে ভোট ভিক্ষা, সংগঠন গড়ে তোলা, দৃঢ়তার সঙ্গে নিজ ভাবনার লেখ্য ও বাচ্য উপস্থাপনা, কারাভোগ, কারাগারে আন্দোলন গড়ে তোলা, বিশ্বসাহিত্য মন্থন করে তার নির্যাস নিজ সাহিত্যে সংযুক্ত করা কিংবা হুবহু অনুবাদের মাধ্যমে বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরা ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ যায়নি রণেশ দাশগুপ্তর জীবন সংগ্রাম থেকে। বাদ গিয়েছে কেবল নিজের সুখ-শান্তি আর বিলাসীতার অধ্যায়। চির অকৃতদার রণেশ দাশগুপ্ত তাই হয়ে উঠেছেন নিখাঁদ জীবন সংগ্রামী।”
সেমিনারের পরে, রণেশ দাশগুপ্ত পাঠ প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায়ের বিজয়ীদের মাঝে সনদ এবং পুরস্কার বিতরণ করেন অতিথিরা। এবারের প্রতিযোগিতায় যারা জাতীয়ভাবে ‘ক’ বিভাগে দুইজন প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। তারা হলেন- রাজশাহীর অরুণিমা ধর এবং জামালপুরের রফাইদা আনজুম আরিয়া। এই বিভাগে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে যৌথভাবে ৭ জন। তারা হলেন- কুমিল্লার তাসনিম মোস্তফা মিফতা ও নওরিন নাওয়ার যুথীকা, খুলনার কথা বৈরাগী ও তিশা দাশ, ময়মনসিংহের মাহুদীইয়া ইসলাম রাইদা, মেহেরপুরের তানজীমা আফরোজা রওজা এবং মাগুরার মৃন্ময়ী রহমান। এছাড়া, তৃতীয় হয়েছেন নেত্রকোনার আনিফা মহতাসিনা, মেহেরপুরের পূর্ণজ্যোতি পাল ঐশী, সিলেটের সম্বাদি রয় এবং ময়মনসিংহের ফারহান হাসিন নাহিয়ান।
রণেশ দাশগুপ্ত পাঠ প্রতিযোগিতায় ‘খ’ বিভাগে জাতীয়ভাবে প্রথম স্থান পেয়েছেন গাইবান্ধার মোছাঃ নুসরাত জাহান নিঝুম। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন নোয়াখালীর রামিসা ইবনাত এবং তৃতীয় হয়েছেন ময়মনসিংহের তানহা তাসনিয়া হোসেন রাা। ‘গ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন রংপুরের তানজিলা তাসনিম অনিমা, দ্বিতীয় হয়েছেন মানিকগঞ্জের অনুশ্রী রাজবংশী এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছেন নোয়াখালীর আনিকা ইবনাত। ‘ঘ’ বিভাগে প্রথম হয়েছেন নেত্রকোনার আয়েশা ফাহমিদা, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন নেত্রকোনার তানজিবা আফরিন খুকুমনি এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন রাজশাহীর শৌমী আচার্য্য। এছাড়া, ‘ঙ’ বিভাগ তথা উন্মুক্ত বিভাগের প্রতিযোগিতায় জাতীয়ভাবে প্রথম স্থান অর্জন করেছেন মাগুরার মিশু রাণী বিশ্বাস। দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন বরগুনার রীতা রাণী এবং যুগ্মভাবে তৃতীয় হয়েছেন নেত্রকোনার হাফসা আক্তার এবং মাগুরার কৌশিক শরমা।
উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশগুপ্ত-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও গত ৭ জানুয়ারি শনিবার সকাল ১১টায় সারাদেশে উদীচীর ৩০টির বেশি জেলা সংসদের উদ্যোগে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে একযোগে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা পর্যায়ে প্রতিটি বিষয়ভিত্তিক বিভাগের প্রথম তিনজন বিজয়ীকে ১৫ জানুয়ারি রণেশ দাশগুপ্ত-এর ১১১তম জন্মবার্ষিকীতে জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরষ্কার দেয়া হয়। পরবর্তীতে তাদের খাতা পাঠিয়ে দেয়া হয় উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের কাছে। সেগুলো আবারো যাচাই-বাছাই শেষে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিটি বয়সভিত্তিক বিভাগের তিনজন করে বিজয়ী নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদেরকেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয়ভাবে সেমিনারের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়।
এবারের প্রতিযোগিতায় ৫টি বয়সভিত্তিক বিভাগে অংশ নেয় কয়েক হাজার প্রতিযোগী। এগুলো ছিলো তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি (ক বিভাগ), ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি (খ বিভাগ), নবম থেকে দশম শ্রেণি (গ বিভাগ), একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি (ঘ বিভাগ) এবং উন্মুক্ত (ঙ বিভাগ)। প্রতিযোগিতার জন্য যেসব লেখা নির্বাচন করা হয় সেগুলো হলো ক বিভাগের জন্য সত্যেন সেন রচিত ‘এটম বোমা’ এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটক। খ বিভাগের জন্য সত্যেন সেনের ‘লালগরুটা’ গল্প এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্প। গ বিভাগের জন্য ছিল রণেশ দাশগুপ্ত-এর ‘মাল্যদান’ গল্প এবং কাজী নজরুল ইসলামের ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধ। ঘ বিভাগের জন্য রণেশ দাশগুপ্ত রচিত ‘রহমানের মা’ গল্প এবং সোমেন চন্দ-এর ‘ইঁদুর’ গল্প। এছাড়া, ঙ বিভাগের জন্য নির্বাচন করা হয় অধ্যাপক বদিউর রহমান রচিত ‘বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ’ এবং অধ্যাপক যতীন সরকার রচিত ‘বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্যে সমাজতান্ত্রিক উপাদান’ প্রবন্ধ দুটি। সবগুলো লেখা সংকলন করে ‘মননের পাঠশালা’ নামের একটি বই সারাদেশে উদীচীর জেলা সংসদগুলোর কাছে পাঠানো হয়। সেই বই পাঠ করেই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় প্রতিযোগীরা।