সেকুলার সংস্কৃতি: সৈয়দ আজিজুল হক

সংস্কৃতি বিষয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর এক বাক্যের বিশ্লেষণাত্মক বক্তব্যটি কিংবদন্তিতুল্য, চিরায়ত কালের আবেদনবাহী। কথাটি এরকম: ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত, মার্জিত লোকের ধর্ম।’ কালচার্ড বা সংস্কৃতিবান হওয়ার মধ্যে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের বিষয়টি গভীরভাবে বিজড়িত। সংস্কৃতির কাজ হলো, মানুষের চেতনাকে প্রতিনিয়ত পরিমার্জিত করা, পরিশীলিত করা, উন্নত অভিরুচিতে মণ্ডিত করা। সংস্কৃতিবান হওয়ার মধ্যে রয়েছে মানবিক বোধের জাগরণ, মনুষ্যধর্মের নিরবচ্ছিন্ন বিকাশসাধন। অন্য প্রাণী থেকে আমরা মানবপ্রজাতি যে অনন্য স্বাতন্ত্র্যময় বৈশিষ্ট্যটি ধারণ করি তা হলো, রূপগত দিক থেকে মনুষ্য-আকারের অন্তরালে অন্তর্গতভাবে আমরা দ্বিবিধ সত্তার অধিকারী।

এর একটি জীবসত্তা, আরেকটি মানবসত্তা; একটির মধ্যে রয়েছে পাশবপ্রবৃত্তি, আরেকটির মধ্যে মহৎ গুণসহ সুকুমারবৃত্তির ব্যাপ্তি। জীবসত্তাটি প্রাথমিক, মূলগত; তাকে প্রতিনিয়ত পরিচর্যা ও পরিশীলন করেই মানবিক বৃত্তিগুলোকে বিকশিত করে তুলতে হয়। এই পরিমার্জনায় যদি কোনো ত্রুটি ঘটে তাহলে মানবিক বোধের স্ফুরণও বাধাগ্রস্ত হয়, পাশবপ্রবৃত্তিই প্রাধান্য বিস্তার করে। এই পরিশীলনের কাজটি করে সংস্কৃতি। প্রকৃত ও যথার্থ মানুষ হিসেবে আমাদের চেতনাকে শানিত রাখার জন্য সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর সংযোগ সাধনসহ সংস্কৃতিবান হয়ে-ওঠার বিকল্প নেই।
মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা নিশ্চিতভাবে লক্ষ করি যে, মনুষ্যত্বের বিকাশে প্রথাগত ধর্ম সর্বপ্রথম অসামান্য এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। আরো লক্ষণীয় যে, প্রতিটি ধর্মেরই প্রবর্তনলগ্নে তার ভূমিকা ছিল বিপুলভাবে মানবিক, বৈপ্লবিক, প্রগতিমুখী; এবং পশ্চাৎপদ-অন্ধকারাচ্ছন্ন-রক্ষণশীল পরিস্থিতি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দারুণভাবে আলো-প্রত্যাশী। আবির্ভাবলগ্নে প্রথাগত ধর্মের এই অসাধারণ ইতিবাচক ও পরিবর্তনকামী ভূমিকা মনুষ্যধর্মের বিকাশের পাশাপাশি সভ্যতার অগ্রসরতায় রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু দুঃখজনক হলো, প্রথাগত ধর্ম পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে রক্ষণশীল স্বার্থান্বেষীদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে নিজ গুণাবলি বিসর্জন দিতে থাকে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভুবনে বিরাট পরিবর্তনের মাধ্যমেই ঘটেছিল যার আগমন, সে-ই হয়ে ওঠে পরিবর্তনবিমুখ, পরিবর্তনশীলতার চেতনাবিরোধী এবং পরিবর্তনে বাধাদানকারী। ফলে প্রথাগত ধর্মের মহত্তর চেতনা কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তার স্থলে রক্ষণশীল ধর্মতন্ত্র হয়ে ওঠে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। পরিণামে সভ্যতার গতিশীলতাকে অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে গত সহস্রাব্দে ইওরোপব্যাপী এই ধর্মতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের যে জাগরণ ঘটে সেটাই রেনেসাঁর আন্দোলন নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রতন্ত্রকে ধর্মতন্ত্রের জোয়ালমুক্ত করে সভ্যতার অগ্রগতিকে বাধাহীন করে তোলা হয়। অতঃপর ধর্মীয় সংস্কৃতির স্থলে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিই মানবিক বোধের জাগরণে পৃথিবীকে নতুনভাবে মুক্তির পথ দেখায়।
রেনেসাঁ-পরবর্তী বিশ্ব মানুষের চিন্তা-চেতনাগত শক্তির বিপুল ঐশ্বর্যকে নানাভাবে প্রত্যক্ষ করেছে। প্রকৃতিজগতের ওপর প্রতিষ্ঠা করেছে মানুষের সর্বময় কর্তৃত্ব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সীমাহীন অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত করার মাধ্যমে রেনেসাঁই এটা সম্ভবপর করে তুলেছে। প্রথাগত ধর্ম যেহেতু ক্রমান্বয়ে আচারসর্বস্ব হয়ে ধর্মতন্ত্রের রক্ষণশীল শৃক্সখলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে, সেহেতু মনুষ্যত্বের বিকাশে বা মানুষকে সংস্কৃতিবান করে তোলার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা হয়ে পড়ছে স্বভাবতই সীমিত। ফলে মানুষের সুকুমার বৃত্তিসমূহের নান্দনিক বিকাশ সাধনে সেকুলার সংস্কৃতির উপাদানগুলোই হয়ে উঠছে ব্যাপক, বিস্তৃত ও কার্যকর। চিত্রশিল্প, সংগীত, নৃত্য ও অভিনয়কলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে সাহিত্যের সকল শাখা-প্রশাখা আধুনিককালে সৃষ্টি করেছে সংস্কৃতির এক বিপুল ঐশ্বর্যময় ভুবন।

আধুনিক শিক্ষিত মানুষের জীবনের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্বন্ধ অচ্ছেদ্যভাবে নিবিড়। প্রতিনিয়ত পরিশীলনের মাধ্যমেই যেহেতু তার আধুনিক মন পরিশুদ্ধি অর্জনে উন্মুখ থাকে সেহেতু সংস্কৃতির উষ্ণ বাতাবরণ থেকে তার উত্তাপ গ্রহণ হয়ে ওঠে অনিবার্য। কালের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে এ সত্য স্পষ্ট হবে যে, একটি জাতির সংস্কৃতি গ্রহণ-বর্জনের গতিশীল প্রক্রিয়ায় নিয়ত সমৃদ্ধি অর্জন করে। এই সমৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত সমন্বয়ের চেতনা, সমীকৃত বা সংশ্লেষিত হওয়ার এক নিরন্তর প্রয়াসের ইতিহাস। এই ভারতবর্ষীয় ও বাংলার সংস্কৃতিতে অনার্য ও আর্য, দক্ষিণ এশীয় এবং পশ্চিম ও মধ্য এশীয়, এবং সবশেষে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্যের এক গভীর ও বিরামহীন মিশ্রণ ও সংশ্লেষণ আমরা লক্ষ করি। বাংলার এই অঞ্চল সর্বদাই বহিরাগতদের স্বাগত জানিয়েছে, নবাগতের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়ে নিজ সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার উপায় বের করেছে। তবে সবটাই যে সহজসাধ্য ও আনন্দময় হয়েছে তা হয়ত বলা যাবে না; আমি শুধু প্রধান প্রবণতার কথাই বলছি। এইরূপ সমন্বয়ধর্মিতার সঙ্গেই যুক্ত পরিবর্তনশীলতার প্রবণতাটি।
যাঁরা বাঙালি সংস্কৃতি অভিধাটির সঙ্গে ‘আবহমান’, ‘চিরকালীন’, ‘শাশ^ত’ এসব বিশেষণ ব্যবহার করেন তাঁরা এর মৌল প্রবণতাকেই আসলে অস্বীকার করতে চান। কেননা, এই সংস্কৃতি কখনোই একইরূপে প্রতিভাত হয়নি। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টি স্বচ্ছ হবে। যেমন, আমাদের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একুশের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, নগ্নপায়ে প্রভাতফেরি সহযোগে শহিদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, যেটি বাংলাদেশের সেকুলার সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান একটি উপাদান, এর সঙ্গে আবহমান শব্দটি কি সংগতিপূর্ণ? কিংবা যদি ষাটের দশকে শুরু-হওয়া ঢাকার রমনা বটমূলকে কেন্দ্র করে ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের কথা বলি, এখন দেশব্যাপী যা বিস্তৃত, তার সঙ্গে হালখাতা নামক বাংলা বর্ষবরণের ব্যবসাকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানটির আদৌ কোনো যোগ আছে? আবার নব্বইয়ের দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে বাংলা নববর্ষে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হচ্ছে তা তো সবকিছুকে ছাড়িয়ে বিশ্বঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। এই যে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়ে সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে এটাই সংস্কৃতির শক্তির দিক। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে একটা অপরিবর্তনীয় চিরায়ত আয়োজনক্রিয়ার উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। কিন্তু মূলধারার সংস্কৃতিতে তা হওয়ার নয়। মূলধারার সংস্কৃতিও অবশ্য একেকটি জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অবলম্বনে স্বাতন্ত্র্য অর্জন করে। তবে প্রতিনিয়ত গ্রহণ-বর্জন ও রূপান্তরশীল প্রবণতাকে ধারণ করেই তা সমৃদ্ধ, বিকশিত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

সংস্কৃতির সমন্বয়ধর্মী ও পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি স্মরণীয় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথা। একটি সবল সংস্কৃতি সবসময় একটি দুর্বল সংস্কৃতির উপর প্রাধান্য বা আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এই সবলতা-দুর্বলতার মাপকাঠি সবসময় সংস্কৃতির নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না; রাজনীতি ও অর্থনীতি এক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রাখে; ভূমিকা রাখে জ্ঞানকাণ্ডের ওপর দখল-শক্তি। অর্থাৎ, একটি জনগোষ্ঠী যখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখনই তার মধ্যে জন্মলাভ করে একপ্রকার দখলদারি মানসিকতা। এর ফলে সে তার ভোগবৃত্তির বাসনাকে স্থায়ীরূপ দিতে পররাজ্যগ্রাসী মানসিকতা নিয়ে আশ্রয় নেয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েমের। ইতাালির মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি এরূপ মনোভঙ্গিরই ব্যাখ্যায় যথার্থভাবেই বলেছেন সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য (কালচারাল হেজিমনি) সৃষ্টির কথা। পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের শাসন-শোষণকে আড়াল বা যুক্তিযুক্ত করার জন্য কালচারাল হেজিমনির আশ্রয় নিয়েছে। এই হেজিমনি উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর মনোজগৎকে আরেক ধরনের উপনিবেশে পরিণত করেছে। ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে উন্নত বলে প্রচার করে আমাদের ওপর সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করেছে। অন্যদিকে উপনিবেশবাদীদের দ্বারা শিক্ষিত হয়ে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কাঠামোতেও অগ্রসর একটি শ্রেণির মধ্যে অন্য অনগ্রসর শ্রেণির ওপর কালচারাল হেজিমনি সৃষ্টির প্রয়াস আমরা লক্ষ করি।
এই সাংস্কৃতিক আধিপত্য সৃষ্টির প্রয়াসে প্রথাগত ধর্মও কখনো হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেটা যেমন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের কৌশল-পরিকল্পনার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তেমনি তাদের প্রত্যক্ষ সাহচর্যে এ অঞ্চলের শিক্ষা ও সম্পদের দিক থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণিটির মধ্যেও একইভাবে ক্রিয়াশীল। নিজ ধর্মীয় সংস্কৃতিকে সার্বজনীন সংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে তাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে একপ্রকার বুদ্ধিদীপ্ত প্রচারণার আশ্রয় নিতে তারাও পরিকল্পিতভাবে নিবিষ্ট। এক্ষেত্রে স্মরণীয় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের প্রচারণার ওই ধরনটি, যেখানে তারা বলেছে, উপনিবেশিতদের নেই কোনো শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, জ্ঞান; এসব কিছুরই অধিকারী কেবল তারাই। এই প্রচারণায় আমরা উপনিবেশিত মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগেছি, এখনও ভুগছি।
একই প্রক্রিয়ায় ভারতবর্ষীয় পরিমণ্ডলেও ঔপনিবেশিক শাসনের সুযোগ নিয়ে আধুনিক শিক্ষা ও অর্থনীতিতে অগ্রসর সুবিধাভোগী একটি শ্রেণি নিজেদের সংস্কৃতিবান দাবি করে ঔপনিবেশিক শাসনের বিভেদমূলক নীতির আশ্রয় নিয়ে সর্বতোভাবে পশ্চাৎপদ অপর শ্রেণিটির ওপর হেজিমনির জোয়াল চাপিয়ে তাদের মধ্যে কৌশলে হীনম্মন্যতা অনুপ্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। দুঃখের বিষয়, এই পশ্চাৎপদ শ্রেণির ভেতরকার শিক্ষিত-সংস্কৃতিবান অংশটি, যারা প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত, এই প্রচারণা ও হীনমন্যতা বিষয়ে সচেতন নয়, বরং তারাই এর নিষ্ঠুর শিকার হয়ে নিজেরাই হীনমন্যতায় আচ্ছন্ন। এই আচ্ছন্নতার কারণে তারা অগ্রসর শ্রেণিটির ধর্মীয় সংস্কৃতিকে সেকুলার সংস্কৃতির মর্যাদা দেওয়ার পরিকল্পিত প্রচারণার ফাঁদে পড়েছে। ফলে এই প্রগতিশীল অংশটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রসারে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল হতে পারে না। বরং মাঝেমাঝে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।
সংস্কৃতি যেখানে একটি জনগোষ্ঠীকে বা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেখানে তার সেকুলার বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা অতীব জরুরি। তাই কেউ নিজ ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে অপর জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে তা জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সে-কারণে এসব প্রচারণা সম্বন্ধে সচেতন থাকা, সংস্কৃতিবান হওয়ার পথকে নিষ্কণ্টক রাখার স্বার্থেই, জরুরি।

বাঙালি সংস্কৃতির দুটি রূপ আমরা লক্ষ করি। এর একটির কেন্দ্র কলকাতা, আরেকটির কেন্দ্র ঢাকা। একটির জন্ম কলকাতাকেন্দ্রিক উনিশ শতকীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে; আরেকটির জন্ম ঢাকাকেন্দ্রিক বিশ শতকীয় নবজাগরণের মাধ্যমে। কলকাতায় পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে যে রেনেসাঁর সৃষ্টি হয় তার একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো, তা ছিল একটিমাত্র সম্প্রদায়কেন্দ্রিক; দ্বিতীয়ত, তা ছিল সমস্ত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন, কেবল নগরের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সীমিত। আর সে-কারণে কলকাতা বাঙালি বলতে সকল বাংলাভাষীকে বোঝে না, শুধু একটি সম্প্রদায়কেই বোঝে; বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বড় অংশকেই সে বাঙালিত্বের সীমানা থেকে বাইরে রাখে। সে-কারণেই কলকাতা দুর্গা পূজার অনুষ্ঠানকে বাঙালির সর্ববৃহৎ উৎসব বলে অহমিকাপূর্ণ ঘোষণা দেয়,এবং এর মধ্য দিয়ে বাঙালির বৃহদংশকেই অস্বীকার করে। কলকাতার এই উদ্যোগ সুস্পষ্টভাবেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন, ভেদবুদ্ধিতাড়িত। অথচ শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট বিশ্বভারতী যে সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, বসন্তোৎসব, বাংলা বর্ষবরণোৎসব, হলকর্ষণোৎসব, এমনকি পৌষোৎসব পর্যন্ত, একান্তভাবেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঋদ্ধ।
অন্যদিকে, ঢাকায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিল্প-সাহিত্যসহ সংস্কৃতির পুরো অধ্যায় জুড়ে নবজাগরণের যে সূচনা ঘটল তা রক্তে-মাংসে-বৈশিষ্ট্যে মূলগত স্বভাবে অসাম্প্রদায়িক, সেকুলার চেতনায় উজ্জীবিত। ঢাকাকেন্দ্রিক এই রেনেসাঁ বাংলাভাষী সকলকেই বাঙালি বলে আপন করে নিয়েছে, কাউকে অস্বীকার করেনি। তাছাড়া এই আন্দোলন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ব্যাপ্ত হয়ে বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে শহিদ মিনার। একুশে ফেব্রুয়ারি নগ্নপদে প্রভাতফেরির মাধ্যমে শহিদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের যে অনুষ্ঠান তা সকল বাংলাভাষীকে একত্র ও একাত্ম করে। এটাকেই আমরা বলতে পারি বাঙালি সংস্কৃতির সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠান। এটি কালক্রমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ঢাকাই এর জন্মদাতা। এই ঢাকাই ষাটের দশকে জন্ম দিল আরেকটি সেকুলার উৎসবের। রমনা বটমূলকেন্দ্রিক ছায়ানটের বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি ক্রমাš^য়ে দেশজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে এবং বাংলা বর্ষবরণকে ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক বাতাবরণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে একটি বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করেছে। লক্ষণীয় এই উৎসবের সর্বমানবিক ও সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্যটি। জাতীয় পর্যায়ে পালিত সেকুলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে একে দ্বিতীয় বৃহত্তম হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তৃতীয় যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দৃষ্টান্ত আমরা দেব সেটিও বাংলা বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হচ্ছে। ঢাকার চারুকলা থেকে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন জাতীয় অনুষ্ঠানের মর্যাদা পাচ্ছে, বিস্তৃত হয়েছে দেশব্যাপী। ইউনেস্কো কর্তৃক অর্জন করেছে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। এভাবে আমরা লক্ষ্য করব, ঢাকা কেন্দ্র হিসেবে যেসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে তার মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক, সেকুলার, কল্যাণকর, ভ্রাতৃত্বময় এবং দেশের সকল অংশের মানুষের জন্য ইতিবাচক আবেদনবাহী।

আমাদের সংস্কৃতির মৌল প্রবণতা হিসেবে এর সেকুলার বৈশিষ্ট্যটি মোটেই আকস্মিক কিছু নয়। এর সঙ্গে আমাদের অঞ্চলগত, ভৌগোলিক ও নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্যের রয়েছে নিবিড় যোগ। প্রথমত, স্মরণীয় যে, বাংলার এই পূর্বাঞ্চল অনার্য মানুষের বসতিতে সমৃদ্ধ। আর্য বসতি গড়ে উঠেছে গঙ্গার তীর ধরে; তাদের বিবেচনায় পূর্বাঞ্চল ছিল বর্বর শূদ্রজাতীয় নিচশ্রেণির লোকে পূর্ণ। আর্য-অনার্যের এই বিভাজনটি গঙ্গা-পদ্মার নামকরণেও স্পষ্ট। জলের একই প্রবাহ থাকা সত্তে¡ও গঙ্গাজলের পবিত্রতা যে পদ্মাজল ধারণ করতে পারল না তার মূলেও সক্রিয় আর্যসৃষ্ট পৌরাণিক আখ্যান। গঙ্গার জন্মগত পৌরাণিক আখ্যানের সঙ্গে সম্পর্ক পৌরাণিক শিবের; অন্যদিকে পদ্মা বা মনসা শিবের ঔরসজাত কন্যা হওয়া সত্তে¡ও তার জন্মকাহিনিটি সম্মানজনক না-হওয়ায় পরিচয়গত সংকট বিদ্যমান। আর্য-অনার্য বিভেদটি এভাবে গঙ্গা-পদ্মার নামকরণসহ এর জলের পবিত্রতা-অপবিত্রতা পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয়ত, বাংলার পূর্বাঞ্চল অনেক বেশি নদী-বিধৌত, যে নদী আবার অনেক বেশি ভাঙনপ্রবণ; একই সঙ্গে এ অঞ্চল অনেক বেশি বন্যাপ্রবণ; সবমিলে যেখানে রয়েছে পলিমাটির প্রাধান্য।
তৃতীয়ত, এই অনার্য জীবনধারা অঞ্চলগত এসব বৈশিষ্ট্যকে অবলম্বন করে কতকগুলো স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করেছে। যেমন, এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শাস্ত্রগত কাঠিন্য নেই; আছে নরম কোমল স্বভাব; যে মন অতিথিপরায়ণ, অনেক বেশি পরার্থপর, উদার মনোভঙ্গির ধারক; যে মন পরিবর্তনবিমুখ নয়, নতুনকে গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত। এরূপ মনোবৈশিষ্ট্যের কারণেই এ অঞ্চলের মানুষ নতুন নতুন ধর্মের উদারতায় আকৃষ্ট হয়ে একাধিকবার ধর্ম পরিবর্তন করেছে। বর্ণপ্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য একসময় আকৃষ্ট হয়েছে অহিংসার ধর্মে; কিন্তু সেখানেও যখন বর্ণবাদীদের থাবা প্রসারিত দেখেছে তখন বর্ণবাদমুক্ত ভ্রাতৃত্ববোধের ধর্মপরায়ণতায় হয়েছে আকৃষ্ট। নদীপ্রবাহের ভাঙনপ্রবণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই এ অঞ্চলের মানুষ অনেক বেশি সহনশীল ও সংগ্রামশীল। প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যে কোনো বিপর্যয়ে বারবার পর্যুদস্ত হয়েও সে ওই বৈশিষ্ট্যের কারণেই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে না, দ্রুত উঠে দাঁড়ায় এবং শুরু করে জীবনের নতুনতর সংগ্রাম। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও তার প্রতিফলন আমরা লক্ষ করি। ১৯৪৭-এর বিশাল পরিবর্তনের রেশ কাটতে-না-কাটতেই ১৯৪৮ ও ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে সে রক্ত দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়, আর ১৯৫৪’র নির্বাচনে এমন রায় দেয় যা ১৯৪৬-এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আর এসব সহই ১৯৭১-এ ৩০ লাখ লোকের জীবনের বিনিময়ে হলেও সে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার ব্যাপারে থাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এসব দৃষ্টান্তমূলক তথ্য ও সত্যকে বিবেচনায় নিলেই বাঙালি সংস্কৃতির ঢাকা ও কলকাতা ধারা অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিমের ভেদরেখাটি স্পষ্ট হবে।

এ প্রসঙ্গেই আমাদের লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির অন্তর্নিহিত সেকুলার বৈশিষ্ট্যের কথা স্মরণীয়। মৈমনসিংহ ও পূর্ব্ববঙ্গ-গীতিকার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে যে প্রণয়াকাক্সক্ষা তার মধ্যে মানবিক, উদারনৈতিক ও শাস্ত্রাচারের বন্ধনমুক্ত বর্ণবাদবিরোধী মনোভঙ্গির প্রকাশ বেশ তীব্র। এসব গীতিকায় জীবনদীপ্ত বাসনায় উচ্চকিত নরনারী তাদের প্রণয়সঙ্গী নির্বাচনে ধর্মীয়-সামাজিক বাধা অতিক্রম করে যে স্বাধীন মনোভঙ্গির পরিচয় দিয়ে আমৃত্যু কষ্ট স্বীকার করে সেটাই তাদের ব্যক্তিত্বনির্ণায়ক, সেটাই বাংলাদেশের অন্তঃসত্তারও পরিচায়ক। আর কুষ্টিয়া ও সিলেটকেন্দ্রিক বাউল গানের ধারার সঙ্গে ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি যুক্ত করে সমগ্র বাংলাদেশের লোকসংগীতের দিকে যদি তাকাই তাহলে ওই একই ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির বিপুল বিস্তারে সমৃদ্ধ একটি বিশাল জগৎ আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। আমাদের লোকগানের পৃথিবী, এমনকি আধ্যাত্মিক গানের বিশাল ক্ষেত্রটিও অনেকাংশে, জীবনেরই গভীর সত্য উন্মোচনে সদা তৎপর। তারপর বাংলাদেশের লোকশিল্পের ভাণ্ডার সম্বন্ধে যদি বলি, যেখানে রয়েছে নকশি কাঁথা, নকশি পিঠা, শখের হাড়ি, জামদানির নকশা, মাটির পুতুল আর খেলনার এক সমৃদ্ধ সম্ভার, সেখানেও সবই তো সেকুলার চেতনার ধারক, গভীরতর জীবনবাদী অনুষঙ্গে অনুরণিত। লোকশিল্পের মধ্যে লোকায়ত জীবনের সৃজনশীল ধারার যে অনুশীলন ঘটে সেখানে বাস্তব জীবন-পরিবেশ থেকে উপাদান সংগ্রহ অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে দেখলে, আমাদের লোকসংস্কৃতির পুরো জগৎটিই বংশানুক্রমিক পরম্পরাতাড়িত সৃষ্টিশীলতার এক বিশাল প্রান্তর, যেখানে জীবন-বাস্তবতাই প্রতিনিয়ত অনুশীলনে সার্থকতা খোঁজে। সেখানে নিত্যদিনের জীবন ঘষে জীবনের উত্তাপ থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমাদের জাতশিল্পী-সাহিত্যিকরা সৃষ্টি করেন জীবনেরই শিল্প। লোকায়ত সেই জীবনের আখ্যান কোনো ধর্ম বা কোনো তত্ত্ব দ্বারা আচ্ছন্ন নয়, তা সর্বাংশে সেকুলার, জীবনজয়ী সুরে আচ্ছন্ন। সুতরাং সেকুলার সংস্কৃতির অন্বেষায় আমাদের লোকজীবনের সৃষ্টিশীলতার দিকে দৃষ্টি ফেরানো জরুরি।

বাংলাদেশে বর্তমানে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে সংকট চলছে, সে-সম্বন্ধে নানা মত আছে। এ নিয়ে সংবেদনশীল প্রগতিকামী মানুষের উদ্বেগ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এই সংকটের প্রকৃতি ও তার কারণ বিশ্লেষণে আমরা যে যথাযথ অবস্থানে আছি তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বিশদ ব্যাখ্যায় না-গিয়েও বলা যায়, আমাদের দৃষ্টি মূলত কেন্দ্রীভূত থাকছে একটি ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা ও তা দ্বারা প্রভাবিত ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মাসক্তি বৃদ্ধির ওপর। আমরা তার সঙ্গে সহজেই মিলিয়ে ফেলি ধর্মের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তির জঘন্য সব অপরাধের সঙ্গে এর যোগসাজসকে। সংস্কৃতির এই সংকটকে আমরা শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের বিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে ওইরূপ বিরোধিতার মধ্যেই এর সমাধান খুঁজি। ব্যাখ্যার এই সরলীকরণের কারণেই সমাধান হয়ে ওঠে সুদূরপরাহত। এরূপ বিশ্লেষণের মধ্যে যে বাস্তবতা নেই তা না, তবে এটি একটি দিক মাত্র; সংকটের রয়েছে আরো নানা মাত্রা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বা তার পূর্বে রাজনীতি ও সংস্কৃতির শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণের বিষয়টি যত সহজ ছিল, এখন তা নেই। বিশ্ব পরিসরে ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসানে তা আরো ব্যাপক আর জটিল আকার ধারণ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে ধর্মীয় মৌলবাদের পরবর্তীকালের উত্থান প্রসঙ্গে বলা যায় যে, পঁচাত্তরের আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তন তাদের পুনর্বাসন ও উত্থানে সহায়তা করেছে এবং পরবর্তী পনেরো বছর বিচিত্র আনুকূল্যে তারা বিপুল শক্তির অধিকারী হয়েছে। কিন্তু ১৯৯০ সালটিকে বিশেষভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণতন্ত্রের সংগ্রাম জয়যুক্ত হওয়ার ওই বছরটিতেই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন হওয়ার পটভূমিতে ঠাণ্ডাযুদ্ধের অবসান ও এক পরাশক্তির বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদ বিশ্বজুড়েই ব্যাপক হয়ে উঠেছে। এ উগ্রপন্থা শুধু একটি ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা গত তিন দশক জুড়ে একটি বৈশ্বিক প্রবণতা হিসেবে ক্রমবর্ধমান। শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মাটিতে আমেরিকার সহায়তায় একটি ধর্মীয় শক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার প্রক্রিয়ায়। সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের পর উগ্র ওই ধর্মীয় শক্তিই আমেরিকার স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। আমেরিকা আবার নিজের স্বার্থে আরেক উগ্রবাদী শক্তির জন্ম দেয়। আমেরিকার সরাসরি মদদে পশ্চিম এশিয়ায় গড়ে-ওঠা এই ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রভাবে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছে বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় উগ্রপন্থি শক্তি, যা সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে গ্রাস করেছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে গত এক দশকে কী ঘটছে সেদিকে দৃষ্টি দিলেই এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার ক্ষেত্রকে কেবল উৎস ধরে বিচার করে আমরা বর্তমান উগ্রপন্থার যথাযথ পরিমাপ করতে পারব না। আর আমাদের দেশেও উগ্রপন্থা ও ধর্মাসক্তি উভয়ই বৃদ্ধির ক্ষেত্র শুধু সংখ্যাগুরুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এ সত্যও বিবেচনায় রাখা আবশ্যক।
কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক হিসেবে পরিচয়দাতা আমাদের দেশেরই একটি অংশ একমাত্র ইসলাম ধর্মের মধ্যেই উগ্রপন্থার সকল উপাদান খুঁজে পান, এবং সে-কারণে আমাদের বায়ান্ন-একাত্তরসহ সংস্কৃতির সকল গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে বিবেচনায়ই নেন না। তাদের বিবেচনার মধ্যে কেবল ১৯৪৭ই প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। যে সাতচল্লিশকে আমরা অতিদ্রুতই পেছনে ফেলে বায়ান্ন আর চুয়ান্নর এবং সর্বশেষ একাত্তরের জন্ম দিয়েছি, সেই বিবর্তনধর্মী বিশাল অর্জনকে তারা প্রকারান্তরে অস্বীকার করতে চান। আমাদের দেশের প্রগতিশীল শিবিরের একটি বড়ো অংশ এদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হওয়ায় ওইরূপ বিভ্রান্তিকর বিবেচনার পেছনেই শুধু ছোটেন। এটাও সংস্কৃতির একটি সংকট। আরেকটি সংকট হলো, সংখ্যাগুরুর মধ্যেই শুধু সাম্প্রদায়িকতার বিষ খোঁজা আর সংখ্যালঘুকে এ ব্যাপারে দায়মুক্তি দেওয়া। সংখ্যালঘুর মধ্যেও যে কখনো কখনো সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপক ও গভীর হয়ে উঠতে পারে সেটা আমরা প্রগতিশীলরা বিবেচনায়ই নেই না। আমরা যখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলি তখন কেবল সংখ্যাগুরুই উদ্দীষ্ট হয় । ফলে এ সমস্যার সমাধান আর হয় না। সাম্প্রদায়িকতা যে উভয়ের মধ্যে আছে, এবং উভয়কেই এ থেকে মুক্ত হতে হবে এই বিবেচনাটা মুখ্য হতে পারছে না।
সংস্কৃতির আরেকটি সংকট হলো, সবকিছু বিবেচনা করা হয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। মনে করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতাসীন থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। রাজনৈতিক ক্ষমতাই যে সব সমস্যার সমাধান নয়, বিশেষ করে সংস্কৃতির, তা আমরা গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি। একটা ইতিবাচক কল্যাণকর প্রগতিমুখী সংস্কৃতিকে সমগ্র দেশজুড়ে প্রধান করে তুলতে হলে এই লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের পাশাপাশি জনগণের সাংস্কৃতিক চেতনাকে উন্নীত করার অভিযান নিরবচ্ছিন্নভাবে জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই।
দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কৃতি সার্বিক সংস্কৃতির ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছে সেটাও বর্তমান সংকটের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আমরা মুখে বলছি, কিন্তু প্রতিনিয়ত ভূলুণ্ঠিত করছি সেই চেতনাকেই। গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসমূহ নস্যাৎ করছি; মানবাধিকার লক্সঘন আর পরমতসহিষ্ণুতার অভাব সমাজের সর্বত্র ব্যাধির আকার ধারণ করছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, আইনপ্রণেতারাই আইন লক্সঘন করছেন সবচেয়ে বেশি। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় কার্যক্রম প্রসারের লক্ষ্যেই সকল ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে প্রতিটি ধর্মানুসারীদের মধ্যে ব্যবধান বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেম এখন ক্ষীণতর পর্যায়ে পৌঁছেছে; পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থতাসহ দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেওয়ার মহোৎসব চলছে। কথা ছিল, সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো হবে; তা তো হয়ইনি, বরং স্বল্পসংখ্যকের অতিদ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম স্থান অধিকার করেছে। সমাজের সর্বত্র মহামারির আকার ধারণ করেছে দুর্নীতি, উচ্চাভিলাষ, লোভ আর ভোগবাসনা। অর্থলোভ, পদলোভ আর পদক-পুরস্কারের লোভ সমগ্র জাতির নৈতিকতাকে ক্রমশ শূন্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অসততা, দায়িত্বহীনতা, কথা ও কাজের ব্যবধান, সর্বোপরি অসহিষ্ণুতা। একটি বর্গের প্রতি অন্য বর্গের মানুষের অবিশ্বাস, অনাস্থা ও অসম্মান তীব্র করে তুলছে এই অসহিষ্ণুতাকে। সামাজিক মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের মতো আধুনিক প্রযুক্তিসহায়ক সমাজমাধ্যম কখনো কখনো জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও মতপ্রকাশে প্রায়শই অসহিষ্ণুতার পাশাপাশি চিন্তাহীনতা ও অশিক্ষিত উপায়ে তাৎক্ষণিক ভাবাবেগ প্রদর্শনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সমাজের এইরূপ অসুস্থ প্রবণতা সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশেও সৃষ্টি করছে গভীরতর অন্তরায়।

ধর্মীয় সংস্কৃতি ও সেকুলার সংস্কৃতির পার্থক্য নিরূপণ করার ক্ষেত্রেও আমাদের সংকট রয়েছে। আমরা সংখ্যাগুরুর ধর্মাচারকে ধর্মাচার হিসেবে বিবেচনা করি অথচ সংখ্যালঘুর ধর্মাচারকে বিবেচনা করি সংস্কৃতি হিসেবে। এরূপ বিভ্রান্তিকর বিবেচনার অবসান ঘটিয়ে দুটোই যে ধর্মীয় সংস্কৃতি এই বোধ প্রতিষ্ঠা করাও জরুরি। যার যার ধর্মীয় সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করার মধ্যে দোষের কিছু নেই; যদি তা পরধর্মবিদ্বেষ কিংবা শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ মানসিকতা দ্বারা আচ্ছন্ন না হয়। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের একটা ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। সেজন্য যার যার ধর্মীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিলে সুফল পাওয়া যাবে না। এমনকি নিজ ধর্মীয় সংস্কৃতিকে উদারনৈতিক সার্বজনীন আখ্যা দিয়ে অন্যদের আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টায়ও সুফল মিলবে সামান্যই। বরং উভয়ের মিলিত হওয়ার জায়গা হলো সেকুলার সংস্কৃতি। ধর্মীয় সংস্কৃতির পরিসর ক্রমান্বয়ে ছোট করে সেকুলার সংস্কৃতির পরিসর বাড়িয়ে তুলতে পারলেই জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত হবে।

সুস্থ ও সেকুলার সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের মাধ্যমেই বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি মিলতে পারে। সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই অসততা, অসহিষ্ণুতা, দুর্নীতি আর সীমাহীন লোভের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব। সুস্থ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমেই তা করতে হবে; রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগে এর সমাধান করা দুরূহ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়ে যদি অসততা, দুর্নীতি আর লোভের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকি, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা সুদূরপরাহত হবে, এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সমালোচনা করে কোনো ফলই পাওয়া যাবে না। পশ্চাৎপদ কুসংস্কারাচ্ছন্ন রক্ষণশীল মানসিকতাসহ উগ্রপন্থি ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সমালোচনা নিরবচ্ছিন্নভাবে জোরদার রাখা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু তা যেন কেবল একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেই কেবল পরিচালিত না হয় সেদিকেও সচেতন থাকা জরুরি।
সেকুলার সংস্কৃতির উপাদান সংগ্রহের জন্য লোকসংস্কৃতির দিকে, দেশীয় উপাদানের দিকে, দৃষ্টি ফেরাতে হবে। নতুন কালের উপযোগী করে এসব উপাদানকে নতুন ভঙ্গিতে সৃজনশীলভাবে উপস্থাপন করতে পারলেই তা কার্যকর হবে। নাগরিক মধ্যবিত্তের সঙ্গে গ্রামীণ সমাজের মেলবন্ধন জরুরি। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিটি জাতির আপন সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কাজটি কঠিন হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই কঠিন কাজটি করাই প্রগতিশীলদের সামনে বড়ো কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশের প্রভাতফেরি, বাংলা বর্ষবরণ, লোকশিল্প মেলা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বসন্তোৎসব, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলাসহ অঞ্চলভিত্তিক নানা ঐতিহ্যবাহী খেলার আয়োজন প্রভৃতির মতো জাতীয়ভিত্তিক সেকুলার সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের পরিধি আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। অঞ্চলভিত্তিক লোকগানের উৎসব আয়োজনসহ তাকে একটি জাতীয় উৎসবে রূপদান এক্ষেত্রে সুফলদায়ক হতে পারে। মৎস্য চাষকে কেন্দ্র করে, বিশেষ করে ইলিশ মৌসুম বা হালদা নদীর পোনা সংগ্রহ অভিযানকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আয়োজনের কথা ভাবা যায়।
সর্বোপরি কালের পরিবর্তনশীলতার কথা বিবেচনায় রাখা খুবই জরুরি। ১৯৫২ আর ১৯৭১এর পরিস্থিতি এখন নেই, নেই ষাটের দশকের রবীন্দ্রবিরোধীদের প্রতিহত করার লক্ষ্যে আয়োজিত আন্দোলনের পরিবেশও। রবীন্দ্রবিরোধিতা এখনও আছে, কিন্তু তার ধরন পাল্টে গেছে; নতুন পরিস্থিতিতে এসব প্রতিহত করার ধরনও নিশ্চিতভাবে পাল্টাতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, জনগণের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধের, দেশাত্মবোধের জাগরণ ঘটানো, একটি ত্যাগধর্মী নির্লোভ পরার্থপর মানুষের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা। কালের পটভূমি বিবেচনায় নিয়েই অনুকূল সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন খুবই জরুরিভাবে প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *