শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতের সার্ক তৈরি করতে হবে- যতীন সরকার
শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিতের সার্ক গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন প্রবীণ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক যতীন সরকার। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত “সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক কনভেনশন”-এর দ্বিতীয় দিনে তিনি এ আহবান জানান। তিনি বলেন, বাংলার আবহমান সংস্কৃতিতে ধর্মবিশ্বাস যেভাবে শক্তপোক্তভাবে জায়গা নিয়ে রয়েছে, ঠিক একইভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বা পরমত সহিষ্ণুতাও তাদের মননের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলার কৃষক-শ্রমিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ একইসাথে ধর্মভীরু এবং অসাম্প্রদায়িক। আর মৌলবাদীরা নানা অপকৌশলে মানুষের মনে অসাম্প্রদায়িকতার এই ভিত্তিটিকেই দুর্বল করে দিতে চাইছে। ওদেরকে রুখতে হবে বলে জানান অধ্যাপক যতীন সরকার।
উদীচীর সাংস্কৃতিক কনভেনশনের দ্বিতীয় দিন সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় নানা ধরনের সেমিনার আয়োজন। প্রথম পর্বে ছিল অংশগ্রহণকারী সংগঠনসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। এ পর্বের শুরুতে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উদীচীর লড়াই সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের প্রচার বিষয়ক সম্পাদক কংকন নাগ। এরপর একে একে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর সাংস্কৃতিক কর্মীরা সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এসময় ভারতের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী অঞ্জন বেড়া বলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী শান্তি ও সংহতি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানুষের কথা বলবে। সাংস্কৃতিক সংগঠক রতন বসু মজুমদার সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি ভাষিক অধিকারের বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসার আহবান জানান। পশ্চিমবঙ্গের আরেক প্রখ্যাত সংস্কৃতি কর্মী রজত বন্দোপাধ্যায় বলেন, বর্তমানের এই অবক্ষয়ের সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া বিজয় অসম্ভব। এজন্য কালাচারাল ফোরাম গঠন করতে হবে, যা গ্রাম-শহরের ছড়িয়ে থাকা শিল্পী-সাহিত্যিক-লেখককে সম্পৃক্ত করে লক্ষ্য অর্জন করবে। এছাড়া, সাম্প্রদায়িকতা দূর করার জন্য বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজ এগিয়ে নেয়ার আহবান জানান শ্যামল চক্রবর্তী। এ পর্বের সভাপতি ও উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব জায়গায় একই লক্ষ্য নিয়ে লড়াই করার আহবান জানান।
দ্বিতীয় পর্বের সেমিনারে কনভেনশনের ‘কী নোট’ বা ‘মূল প্রবন্ধ’ উপস্থাপন করেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম। এতে তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার স্বরুপ তুলে ধরে এ দু’টির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন। এরপর সেই প্রবন্ধের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লড়াই-সংগ্রামের ধরণ ও পদ্ধতি নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। কীভাবে সমন্বিতভাবে এ দুই বিশ্ববাপী অপশক্তিকে মোকাবিলা করা যায়, পরাজিত করা যায়, সে সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণমূলক আলোচনাও করেন তারা। পরে, সন্ধ্যায় ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এদিন সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে মাদল ও জলের গান। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন কিরণ চন্দ্র রায়, তিমির নন্দী, লিনা তাপসী, দেবাশীষ দেবু এবং ভারত থেকে আগত শিল্পী সুচরিতা ভৌমিক ও অসীম বন্দোপাধ্যায়। আবৃত্তি পরিবেশন করেন বাচিক শিল্পী রূপা চক্রবর্তী ও ভারত থেকে আগত শিল্পী রজত বন্দোপাধ্যায়। শ্রীলঙ্কা থেকে আগত শিল্পীরা পরিবেশন করেন যন্ত্রসঙ্গীত। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন। আর, ছিল প্রাচ্যনাটের পরিবেশনায় নাটক।
এর আগে, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একই সময়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম অব্যাহত রাখার প্রত্যয় নিয়ে গত ১৯ ফেব্র“য়ারি বিকালে শুরু হয় উদীচী আয়োজিত “সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক কনভেনশন”। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী কনভেনশনের উদ্বোধন করেন তিন প্রবীণ বিপ¬বী কামাক্ষ্যা রায়চৌধুরী, কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডল এবং অধ্যাপক যতীন সরকার। ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্র“য়ারি- এই তিন দিন চলবে এ কনভেনশন। এতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন ও জাপান।
কনভেনশনের তৃতীয় দিন, অমর একুশের দিন সকালে আমন্ত্রিত বিদেশি অতিথিদের নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন উদীচী নেতৃবৃন্দ। এরপর দুপুরে মধ্যাহ্ন বিরতির পর অনুষ্ঠিত হবে কনভেনশনের চূড়ান্ত প-্যানারি সেশন। তিনদিন ধরে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা “ঢাকা ঘোষণা” উপস্থাপন করা হবে কনভেনশনের শেষ দিন, ২১ ফেব্র“য়ারি বিকেলে। ওইদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি টানা হবে উদীচী আয়োজিত তিন দিনব্যাপী “সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক কনভেনশন”-এর।