‘মানুষের মৃত্যুদিন হচ্ছে তাঁর সত্যিকারের জন্মদিন। কারণ জন্ম থেকে শুরু হওয়া সার্কিটটা সম্পূর্ণ হয় মৃত্যুতে এসে। মৃত্যুর পর একজন মানুষের পুরো পোর্ট্রটেটা সামনে দৃশ্যমান হয়, তাই মৃত্যুই তাঁর আসল জন্মদিন’। কথাগুলো সরদার ফজলুল করিমের। তিনি ছিলেন আজীবন সংগ্রামী, বরেণ্য দার্শনিক, লেখক, শিক্ষাবিদ এবং রাজনীতিবিদ। তিনি মানবিক সংগ্রামী আদর্শ, উঁচু মানের রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক দর্শন চিন্তায় আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাঙালিদের আলোকিত করেছেন।
সরদার ফজলুল করিমের জন্ম ১৯২৫ সালের মে মাসে, বরিশাল জেলার উজিতপুর থানার আটিপাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। বাবা খবিরউদ্দিন সরদার কৃষিকাজ করতেন। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তাঁরা দুই ভাই তিন বোন। সরদার ফজলুল করিমের শৈশবকাল কেটেছে গ্রামে। ছেলেবেলায় বড় ভাইয়ের ঘাড়ে চড়ে তাঁর কর্মস্থলে যাওয়ার বায়না ধরতেন। ফজলুল করিমের পীড়াপীড়িতে মাঝেমধ্যেই তিনি মাথায় করে তাঁকে কর্মস্থল নাজিরপুরে নিয়ে যান।
তাঁর প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় মামাবাড়ি আটিপাড়া গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৩৫ সালে রহমতপুর বয়েজ হাইস্কুলে সরদার ফজলুল করিম চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪০ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকায় গিয়ে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ইংরেজি বিভাগে বি.এ. অনার্স ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন ইংরেজি বিভাগে থাকলেও পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে সরদার ফজলুল করিম দর্শনশাস্ত্রে বি.এ. অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৪৬ সালে এম.এ.-তে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
ছাত্রাবস্থায়ই সাম্যবাদী আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে সরদার ফজলুল করিমের। সে দলের নাম ছিল Revolutionary Socialist Party of India (RSPI)। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ার পর একটা স্কলারশিপের প্রস্তাব আসে লন্ডন থেকে। যেটি দর্শনের এবং শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ছিলো। আনুষ্ঠানিকতা ছিলো শুধু কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিঙে গিয়ে ইন্টারভিউতে অংশ নিতে হবে। সরদার ফজলুল করিম কলকাতা গিয়ে প্রথমে রাইটার্স বিল্ডিঙে না গিয়ে সরাসরি যান কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টারে। সেখানে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমেদ, নৃপেন চক্রবর্তী (পরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী) প্রমুখের সামনে সরদার হাসতে হাসতে বললেন ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি’। জবাবে হাসতে হাসতে তাঁরা বলেন ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে বসে ভেরেণ্ডা ভাজবো?’ সরদার ফজলুল করিম বলেন ‘আমাকে কী করতে হবে?’ ‘কাঁথা কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন, বুঝেন না কী করতে হবে?’ পার্টি নেতাদের উত্তর। সরদার আর ইন্টারভিউ দিতে গেলেন না। ছিঁড়ে ফেললেন ইন্টারভিউ লেটার। কাজ শুরু করলেন পার্টির হয়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এন রায়ের ভাই বিনয় রায় ছিলেন দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। সরদার ফজলুল করিমের এম.এ. পরীক্ষার ফল বেরুতেই বিনয় রায় তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিতে বলেন। তিনি পরদিন থেকে লেকচারার হিসেবে ক্লাস নিতে শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে রাজনীতির কারণে স্বেচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ইস্তফা দেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখায় যোগ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি শাখার বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে তিনি আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কারাগারে থেকে পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এই বরেণ্য দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ২০১৪ সালের ১৫ জুন মধ্যরাতে ৮৯ বছর বয়সে ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।