বাংলার আবহমান সংস্কৃতির মূল ভিত্তি অসাম্প্রদায়িক চেতনা গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে ছড়িয়ে দেয়ার শপথ নিয়ে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী উদযাপন করলো লোক-সাংস্কৃতিক উৎসব’১৪২২। “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম”- এই শ্লোগানকে ধারণ করে গত ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের আয়োজনে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ঢাকার অদূরে নবাবগঞ্জের বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। ওইদিন বিকাল চারটায় উৎসবের উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহম্মদ খসরু। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মুহাম্মদ খসরু এবং উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ। এছাড়া, সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোলাম মোহাম্মদ ইদু। এরপর বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান উদীচী নেতৃবৃন্দ। এরপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার, স্থানীয় গুণী ব্যক্তিত্ব আব্দুল বাতেন মিয়া, সংস্কৃতি জন মফিদ খান, মহসিন আহমেদ এবং জামিলুর রহমান শাখা। এসময় উদীচীর পক্ষ থেকে মুহাম্মদ খসরুর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন উদীচীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোলাম মোহাম্মদ ইদু।
এরপর শুরু হয় লোকজ পরিবেশনা পর্ব। এ পর্ব শুরু হয় উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের গীতিআলেখ্য “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম” দিয়ে। আলেখ্যটি গ্রন্থনা করেছেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম। এরপর একে একে নানা পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসে উদীচী কাফরুল শাখা, উদীচী মিরপুর শাখা, উদীচী সাভার শাখার শিল্পী-কর্মীরা। এছাড়াও, একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন মোয়াজ্জেম হোসেন, সরদার আফসার উদ্দিন, শিল্পী আখতার, ডা. তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, বিপ্লব রায়হান, সিদ্দিক মোল্লা, অবিনাশ বাউল, আনসার বাউল। এছাড়া, নাটক “জাহান আলী রে ধর” পরিবেশন করে নবাবগঞ্জ থিয়েটার। নাটকটি রচনা করেছেন সালাম সাকলাইন এবং পরিচালনা করেছেন ইদ্রিস হায়দার। এছাড়াও, ছিল উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা। শিল্পীদের পরিবেশিত লোক-গান, নাচ ও নাটক মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হাজারো দর্শক। মাঠে ছিল লোকজ বাদ্য ও লোকশিল্পের প্রদর্শনী।
বাংলার লোক-সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। ফসল বোনার গান, ফসল তোলার গান, মাঝি-মাল্লার গান, নকিশকাঁথা, গ্রাম্য মেলা, পালা-পার্বন প্রভৃতি সবকিছুই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সম্পদ ছিল। ফলে, সম্প্রদায়গত বিভেদ থাকলেও তা কখনোই আগ্রাসী বা বিদ্বেষপূর্ণ ছিল না। কিন্তু, পুঁজির ক্রমবিকাশ এবং বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার কারণে গ্রামীন সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। গ্রামীণ জনজীবন ও আবহে গড়ে ওঠা লোকজ সংস্কৃতির চর্চাও ক্ষীয়মান। এ সুযোগে, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনোজগতকে দখল করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। গ্রামীণ জীবনের অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে লোক-সংস্কৃতির সচেতন চর্চা এবং প্রয়োগের মাধ্যমে মৌলবাদ-জঙ্গীবাদকে প্রতিহত করা সম্ভব বলে মনে করে উদীচী। লোক-সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের চিন্তাকাঠামো থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পকে দূর করা এবং মৌলবাদ-জঙ্গীবাদকে প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ এ উৎসব আয়োজন করতে যাচ্ছে। এ উৎসবের মাধ্যমে গ্রাম ও নগরের মানুষের মেলবন্ধন আরো দৃঢ় হবে বলে উদীচীর বিশ্বাস।