বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী চুয়াল্লিশ বছরের পথ পাড়ি দিয়েছে। মেহনতী জনতার মুক্তির গণমিছিল গণসঙ্গীতের তরঙ্গে তরঙ্গায়িত করার ব্রত নিয়ে শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেন ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর মহাঅভ্যুত্থানের প্রাকপর্বে পাকিস্তানী নির্যাতন আর জুলুমের বিরুদ্ধে ধ্রুবতারার মত সৃষ্টি করেছিলো উদীচীকে। উনসত্তুরের গণ অভ্যুত্থান থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে, ৭২’র এর সংবিধান অনুসারে শোষণমুক্ত মেহনতী মানুষের সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণে, অসাম্প্রদায়িক দেশগঠনে নিরন্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বিবেকের ভুমিকা পালন করেছে উদীচী। ৭৫ এর বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর প্রতিবাদে অগ্রনী থেকেছে। ৭৬ সালে মঞ্চে এনেছে বাংলার ইতিহাস আর লড়াই এর গীতিআলেখ্য ‘ইতিহাস কথা কও’। নির্যাতন এসেছে তাই বারবার। উচ্ছেদ করা হয়েছে কার্যালয় থেকে। তবুও থেমে থাকানি সংগ্রাম। শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমজীবি মেহনতী মানুষের পাশে থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে বারবার উদীচী দাঁড়িয়েছে নাটকে আর গানে। সাংস্কৃতিক এ সংগ্রাম মৌলবাদী, ধর্মান্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির চক্ষুশুল হয়েছে। তাই ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে দেশের ইতিহাসের প্রথম মৌলবাদী-জঙ্গী গোষ্ঠীর বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে উদীচীকে। প্রাণ দিতে হয়েছে দশ নিবেদিত শিল্পীকর্মীকে। চির দিনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেক প্রতিভাবান শিল্পী ও সংস্কৃতিপ্রেমী দর্শক। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জামাত-বিএনপির নরপশুদের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ঠিক তখন সর্বপ্রথম এর প্রতিবাদে নগ্নপায়ে পথে নেমেছে উদীচী। আবারো হামলা ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায়। উদীচীর কার্যালয়ে সেদিন পরিকল্পিত আতœঘাতি হামলা চালায় মৌলবাদীরা। প্রাণ হারায় উদীচীর নিবেদিত প্রাণ শিল্পীকর্মীরা। এরই মধ্যদিয়ে শেষ হয় জঙ্গী হামলার আপাত ইতিহাস।
১৯৯৯ এর ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বর্বর বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এদেশে শুরু হয় বোমা হামালার মতো ঘৃণ্য অপসংস্কৃতি। আর ২০০৫ এ নেত্রকোনা উদীচীতে হামলার মধ্য দিয়ে আপাত শেষ হয় জঙ্গী-মৌলবাদীদের হত্যা-সন্ত্রাসের তান্ডব। দীর্ঘ ৭ বছর ক্রমাগত ঘৃন্য জঙ্গী হামলা হয়েছে সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, মাজার, ও সিনেমা হলসহ খেটে খাওয়ার মানুষের সম্মিলনে; রক্তাক্ত হয়েছে সারা দেশ। ১৪ দলের ক্ষমতা গ্রহনের পর ৭২’ এর সংবিধান প্রশ্নে আবারো পথে নামতে হয়েছে উদীচীকে এবং গড়ে তুলতে হয়েছে ৭২’ এর সংবিধান পূনঃপ্রতিষ্ঠা জাতীয় কমিটি। আবারো প্রমাণ দিতে হয়েছে বাংলাদেশের জন্মদর্শনের প্রশ্নে উদীচী আপোষ করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দাবিদার মহাজোট ও তার অনুসারি জোট সমূহ যখনি আপোষরফা লিখেছে ঠিক তখনই বিপরীতে দাঁড়াতে হয়েছে উদীচীকে। ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালন করে চলেছে সারাদেশে। প্রতিষ্ঠার ৪৪ বছর পরে নতুন করে নিতে হচ্ছে সাংস্কৃতিক মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য, শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ কায়েমের জন্য। পরিবর্তিত সা¤্রাজ্যবাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে পণ্যসংস্কৃতির মনোজাগতিক আধিপত্যের বিপরীতে নতুন মাত্রার আন্দোলনের সূচনা করতে হচ্ছে ।
প্রতিষ্ঠার চুয়াল্লিশ বছর পরে আবারো শপথ নিতে হচ্ছে এমনই এক লড়াই সংগ্রামের, যখন হতাশা নৈরাজ্য শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে দেশবাসী। চেতনায় শক্তি যোগাতে গণমানুষের আন্দোলনে সাংস্কৃতিক শক্তির যোগান দিতে হচ্ছে উদীচীকেই। আর তাই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য বারবার যেতে হয় গণমানুষের কাছে। দরিদ্র-মধ্যবিত্ত-শ্রমজীবি মানুষের শ্রমমুখর সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে সেই অপ্রতিরোধ্য সাহস, যা আজও ধারণ করে আছে উদীচী। আবহমান বাংলার লোক সংস্কৃতির অভ্যন্তরে যে শ্রেণিসংগ্রামের স্রোত নিহিত রয়েছে সেই শক্তির বোধন হয়েছে সারা দেশের উদীচীর দেহে। তাই মাটির সাথে মিশে থাকা এই সংগঠনের শক্তি আজ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। শাশ্বত বাঙালি সংস্কৃতির যে ধারা হাজার বছর ধরে লালন করে চলেছে বাঙালি, যার উৎসমূল রয়েছে কৃষি আর শ্রমে, জেলে আর তাঁতির ঘামে, সেই প্রান্তিক মানুষের অধিকার আদায়ের বার্তা বহন করে চলেছে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে। হয়তো লড়তে হবে আরও হাজার বছর। কেননা শেষ হয়ে যায়নি শোষণ বঞ্চনা; বরং পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী নতুন নতুন শোষণ আর বঞ্চনার কৌশল সৃষ্টি ও প্রযোগ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তনের পথে প্রয়োজন সেই প্রস্তুতি, যা বিপ্লবের শিশুটিকে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করবে উদীচীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আমরা পরিবর্তনের মধ্যেই আছি। একদিকে রয়েছে দেশবাসীকে বিবেক বর্জিত ভোতা পুতুলে পরিণত করার প্রয়াস আর অন্যদিকে বহুজাতিক পণ্য বিপননের চ্যানেল সংস্কৃতি। লুটেরাগোষ্ঠী লুটে নিয়ে যায় আমাদের জাতীয় সম্পদ, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় আর পুঁজিবাদের দালালেরা সংস্কৃতির ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে তা কল্যাণকর বলে প্রচার করে চলেছে। এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণমানুষের পক্ষে উদীচীকে লড়তে হচ্ছে চেতনার নবজাগরণ সৃষ্টির লড়াইয়ে। স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে শ্রেণীশোষণের চেহারা উন্মোচন করতেও উদীচী তার সংগ্রামে অবিচল। একইসঙ্গে দেশের সকল সংস্কৃতি কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে সমাজ বিপ্লবের দিকে অগ্রসর করানোর কাজও করে যেতে হচ্ছে। কেননা দেশে বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে যাদের কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে হয়তো প্রান্তিক মানুষের প্রাণের কথা উঠে আসবেনা, অথবা কোননা কোনোভাবে তারা ব্যাস্ত থাকবে শোষক শ্রেণীর কর্মকান্ডকে মাহত্ব দিতে। আজ এও সত্য যে দেশের বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহ এনজিও কর্মকান্ডের হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে অথবা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব বরণ করে নিচ্ছে। বাঙালি সংস্কৃতি চলে যাচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ‘স্পন্সর’ আধিপত্যের কবলে। তাই গণমানুষের শক্তির উপরই দাঁড়িয়ে একটি বৈপ্লবিক আন্দোলনের পথে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি করে চলছে উদীচী।
যে সুনিপুণ শিল্পী¯্রষ্টার হাতে এর অবয়ব সেই সংগ্রামী সত্যেন সেনকে আমরা জানাই স্বশ্রদ্ধ সম্মান; যাঁর মাধ্যমে গোটা জাতি পেয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। দেশের কোটি মানুষের প্রাণের উচ্চারণ প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। জীবনের দীর্ঘ সময় কারানির্যাতন আর সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে এ জাতীকে তিনি দিয়েছেন মুক্তিসংগ্রামের জন্য সাংস্কৃতিক জীবনদর্শন। আমরা স্মরণ করছি সংগ্রামী সাহিত্যিক ও বিপ্লবী রণেশ দাশগুপ্তকে; যাঁর মেধার স্পর্শে তরঙ্গায়িত হয়েছে এ সংগঠন এবং প্রথম লিখিত হয়েছে সংগঠনের ঘোষনাপত্র ও গঠনতন্ত্র। শ্রদ্ধা জানাই শিল্পী আমিন উদ্দিনকে যিনি শ্রম আর শিল্পের সমন্বয়ে এঁকেছিলেন কাস্তে হাতুড়ি আর একতারা খচিত উদীচী’র প্রতীক। শান্তি ও সংগ্রামের সাদা জমিনে লাল সূর্য এঁকে যিনি দিয়েছেন সংগঠনের দলীয় পতাকা- সেই শিল্পী আনোয়ার হোসেনকেও শ্রদ্ধা। প্রতিষ্ঠার এই ক্ষণে বিপ্লবী অভিবাদন সেইসব মহৎ সব ব্যক্তিকে যারা বিভিন্ন পর্বে নেতৃত্ব ও শ্রম দিয়ে সুদীর্ঘ চুয়াল্লিশটি বছরে নিয়ে এসেছেন গণমানুষের মুক্তির মন্ত্রে উদ্দীপ্ত উদীচীকে ; চুয়াল্লিশ বছরের এ পথচলা একইসঙ্গে সংগ্রামমুখর ও গৌরবের। জয় উদীচী। জয় হোক মেহনতি মানুষের।