সদাপ্রত্যক্ষ এই জীবনযাপনের বাইরেও তো মানুষের আরো একটি জগৎ থাকে- ভাবনার পরিম-ল! এখানে কিন্তু অন্যের হাত সামান্য, এর স্বয়ম্ভু বিশ্বকর্মা সে নিজেই; ওই মানুষটি। তিনি যদি হন শিল্পী অথবা কোনো এক মহান আদর্শে বুক বেঁধে জীবনের সিঁড়ি ভেঙে সামনে এগিয়ে যাওয়া প্রত্যয়ী ধীমান-তাঁর ক্ষেত্রে এ জগৎটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। রণেশ দাশগুপ্তর ক্ষেত্রেও ঘটেছে ঠিক এ-রকম একটা কিছু। তিনি একাধারে ছিলেন সাংবাদিক, তাত্ত্বিক-রাজনীতিক, সৎ-সংগঠক, সাহিত্যবোদ্ধা ও সমালোচক। বহুক্ষেত্র-বিচরিত মানুষ হলেও তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের আত্মপ্রণোদনার উৎস কিন্তু চিন্তার নির্দিষ্টতা থেকে, আদর্শের নিগূঢ় আন্তঃপ্রেরণায়। সে-অর্থে ‘সাহিত্যশিল্পী’ হয়তো তিনি নন, তবে সাহিত্য-বিবেচক নিশ্চয়। এ বিবেচনা কোনো বৃশ্চিক-বিষ্ঠাজাত নয়; নিজস্ব চিন্তনের উর্বর ভূমিতেই প্রোথিত এর মূল-রসের অমিত উৎস যেখানে দ্বান্দ্বিক বন্তুবাদী দর্শন। শুদ্ধতর অর্থে বাংলা সাহিত্যচিন্তার প্রকাশটা বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই শুরু- রবীন্দ্রনাথে সৌন্দর্য, মনুষ্যত্ব আর ব্যাপকতার প্রতিষ্ঠা। প্রমথ চৌধুরী-বুদ্ধদেব বসু-আবু সায়ীদ আইয়ুব প্রমুখ একে নিয়ে এলেন বিকাশশীলতার মোহনায়, ব্যক্তি-জিজ্ঞাসার অম্বুজে। এরপর এই সাহিত্যচিন্তার দিকটি বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো আমাদের বোধে।
ক.
তিনি; -রণেশ দাশগুপ্ত, প্রথম গ্রন্থ উপন্যাসের শিল্পরূপ (১৯৫৯) প্রকাশের আগেই পাকিস্তানশাসিত বাংলাদেশে সাহিত্য-বিষয়ক রচনার মাধ্যমে অনুসন্ধানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ‘সাহিত্য’ কী-তা নিয়ে ভেবেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। এ-কি শুধুই ‘অন্তর হতে আহরি বচনে’র ফলে আনন্দলোক সৃষ্টি, নাকি মেহনতি মানুষের সেøাগান আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মধ্যে হাতুড়ির প্রতীক-কল্পনা? তিনি এ-দুটো মতের কোনোটিকেই হুবহু সাহিত্য হিসেবে গ্রহণ করেন নি। এ-প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত পাওয়া যাবে শিল্পীর স্বাধীনতা প্রশ্নে গ্রন্থের ‘সাহিত্য’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন :
‘সাহিত্যকার প্রধানত শব্দশিল্পী। আর শব্দশিল্পী শিল্পী হিসাবে আমাদের মানবীয় প্রবৃত্তি, আবেগ এবং অনুভূতির কারবারী, আমাদের মানবিকতা কথাকে আশ্রয় করে মেঘ দর্শনে ময়ূরের মতো আত্মপ্রকাশ করে তাকেই বলবো সাহিত্য।’
লক্ষ্য করার বিষয়, মানবীয় গুণাবলিই প্রধান তাঁর বিবেচিত সাহিত্যে-আমাদের আবেগ, অনুভূতি আর প্রবৃত্তি-তাড়নার অধিবাস এর অন্তরস্থিত ফেনিল-জোয়ারে। কিন্তু এতেই সম্পূর্ণ নয় তাঁর ভাবনা। রূপলোকের বহুবর্ণিল প্রণোদনা আত্তীকৃত এই সাহিত্য-বিবেচনায়।
এর শিল্পরূপকল্পনার মূল প্রোথিত আবার বাস্তবের আপাত কঠিন সুফলা মেদিনীবক্ষে। তাই বলে বাস্তবের হুবহু অনুকৃতি যেমন সাহিত্য বা শিল্প নয়, তেমনি অবাস্তবের যেটুকু সদাপ্রত্যক্ষত, তাতেও বাস্তবতার পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায় না। বাস্তবতার পরিবর্তনশীলতা এবং এর গতিধারায় নিহিত থাকে সম্ভাবনার সমস্ত উপাদান। রণেশ দাশগুপ্তর অনুসন্ধান এই সম্ভাবনাÑ যে সম্ভাবনা শিল্পীর অধরালোকের স্বপ্নকল্পনা। পরিবর্তনশীল বাস্তবতা ও এর গতিধারা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন :
‘মানুষ আপন প্রয়োজনানুসারে এই নিহিত সত্তায় পৌঁছাতে না পারা পর্যন্ত বাস্তব পরিবেশকে অনুকূলে আনতে পারে না । বাস্তব পরিবেশ বলতে আমরা বুঝবো, সম্ভাবনার উপাদান সমেত বাস্তব। এই সম্ভাবনাই রূপলোকের কাঠামো। শিল্পীর মায়ালোকের স্বপ্নকল্পনা এই বাস্তব সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। এই সম্ভাবনা কর্মে প্রতিফলিত হয়ে শ্রেয় ও প্রেয়কে দেয় আকৃতি।’
দেখা যাচ্ছে, সাহিত্য-শিল্পে রূপ-কল্পনাকে রণেশ দাশগুপ্ত বাতিল করে দেন নি। তবে তাঁর মতে, এই রূপলোক বাস্তবতাকে ভিত্তি করে উত্থিত, কোনো ইউটোপিয়ান প্রতীতি নয়। বাস্তবতা থেকেই সঞ্জীবনী সুরস আহরণ করে সাহিত্য-শিল্পে রূপকল্পনার বিস্তার। আঙ্গিকবাদীদের মতের সঙ্গে এখানেই বোধকরি এর পার্থক্য যে, তাঁরা যেখানে মনে করেন শিল্পীর রূপলোকে বিহার অধ্যাত্ম বা বিশেষ আত্মানুভবজাত কোনো অর্জন, সেখানে রণেশ দাশগুপ্ত মনে করেন নির্মম বাস্তবতার নিকষিত হেম শোধনজাত প্রতিক্রিয়াই এর ভিত্তি। তারপরও সাহিত্য-বিচারের ক্ষেত্রে রণেশ দাশগুপ্ত ‘সমাজতন্ত্রী বাস্তববাদ’-এর পক্ষেÑ একথা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন তাঁর শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে গ্রন্থে। কারণ, তাঁর মতে, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সাহিত্য এবং এর সংজ্ঞারোপও শ্রেণী-আওতামুক্ত হতে পারে না। প্রচলিত সাহিত্যধারা এবং এর বিচার-পদ্ধতি বিশ্লে¬ষণ করে তিনি উলে¬খ করেছেন:
‘শ্রেণী সমাজের সাহিত্য চেতনা একদিকে এক চেটিয়া, অন্যদিকে মেহনতের ভার। একদিকে ভাব, অন্যদিকে অভাব। […] […] একদিকে অমৃত, অন্যদিকে গরল। শ্রেণী সমাজের সাহিত্য সংজ্ঞা একদেশদর্শী না হয়ে পারে? সংজ্ঞা দেবার অধিকারীও তো অবনত শ্রেণীগুলির চৌহদ্দির মধ্যে ছিল না।’
রণেশ দাশগুপ্ত চিহ্নিত সাহিত্যের এই ধরনের শ্রেণীকরণের সঙ্গে ভ. ই. লেনিনের বক্তব্যের মিল লক্ষ্য করা যায়। ‘পার্টি সংগঠন ও পার্টি সাহিত্য’ শিরোনামে (মস্কোর প্রগতি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত পুস্তকে) শ্রেণীবিভক্ত সমাজে লেখকের স্বাধীনতা ও সাহিত্যের রূপ-প্রসঙ্গে লেনিনের অভিমতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন:
‘যে-সমাজ অর্থাধিপত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে মেহনতি জনগণ দারিদ্র্যে ভোগে আর পরজীবী হয়ে দিন কাটায় মুষ্টিমেয় ধনী, সেখানে বাস্তব ও সত্যকারের ‘স্বাধীনতা’ থাকতে পারে না। লেখক মহাশয়, আপনার বুর্জোয়া প্রকাশকের কাছ থেকে কি আপনি স্বাধীন? আপনার বুর্জোয়া পাঠকের কাছ থেকে, যারা উপন্যাসে ও চিত্রে আপনার কাছ থেকে চায় যৌনকুরুচি, ‘পবিত্র’ অভিনয়কলার ‘পরিপূরণ’ হিসেবে চায় বেশ্যাবৃত্তি? এই পরম স্বাধীনতাটা হল বুর্জোয়া অথবা নৈরাজ্যবাদী ফাঁকা বুলি।’
লেনিনের এই ভাবনার সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তর বক্তব্য মিলে যাবার কারণ-রণেশ দাশগুপ্তও বিশ্বাস করতেন, সুস্থ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। পরিশীলিত সংস্কৃতির ধারক একটি সুশীল সমাজ এবং প্রগতিমুখী সংস্কৃতিই জন্ম দিতে পারে সৎ শিল্পকলার। আর এই শিল্পকলা থেকে ক্রমবিকশিত হয় প্রকৃত সাহিত্য। রণেশ দাশগুপ্তর ভাষায় বক্তব্যটি তুলে ধরা যেতে পারে: ‘কুঁড়ির মধ্য দিয়ে যেমন পাঁপড়ি বেরিয়ে আসে, তেমনি সংস্কৃতির মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে শিল্পকলা। আর শিল্পকলার ক্রমবিকাশের মধ্য থেকে এসেছে সাহিত্য।’ -এই বক্তব্যটি কিন্তু ক্রিস্টোফার কডওয়েলের অভিমতের সঙ্গে তুলিত হতে পারে। কডওয়েল তাঁর Illusion and Reality (First published in 1937 by Macmillan) গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন : ‘Art is the product of society, as the pearl is the product of the oyster, and to stand outside art is to stand inside society.’ কডওয়েলের সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তর বক্তব্যের এই মিলের কথা মনে রেখেও খানিকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। কারণ তিনি সমাজ, জীবন, অভিজ্ঞতা- এ-সবের বাইরেও কিছু বলতে চেয়েছেন। তাঁর মন্তব্য:
‘সমস্ত শব্দ ও পদবিন্যাসই সাহিত্য নয়। মানব-সমাজের অভিজ্ঞতা শব্দ ও পদবিন্যাসে লিপিবদ্ধ হলেই সাহিত্য হয়ে যায় না। মানব-সমাজের অগ্রগতির পথে, জীবনের সৌন্দর্য সাধনার প্রতিক্রিয়ার মধ্য থেকে এসেছে শিল্পকলা। বিশেষ একটি ক্রিয়াকলাপ হিসাবে তার উৎপত্তি ও বিকাশ।’
এখানে ‘সৌন্দর্য সাধনার প্রক্রিয়া’ এবং ‘বিশেষ একটি ক্রিয়াকলাপ’ এই প্রতীতিদ্বয় বিশ্লেষণ করলে সম্ভবত এই বোধই আমাদের জন্মাবে, যা অতুলচন্দ্র গুপ্ত তাঁর কাব্য-জিজ্ঞাসা গ্রন্থে লিখেছেন একটি সংস্কৃত শ্লোকের উল্লে¬খ করে; এবং সে-টি হলো: রমণী দেহের লাবণ্য যেমন তার অবয়ব সংস্থানের বাইরের জিনিস, তেমনি মহাকবিদের বাণীতেও এমন বস্তু আছে যা ভাব-শব্দ-বাক্যের অতিরিক্ত আর কিছু। অব্যাখ্যাত এই ‘বাইরের জিনিসি’ এবং ‘অতিরিক্ত আর কিছু’ উপরিউক্ত প্রতীতিদ্বয়ের সমভাবাপন্ন। আর এ-কারণেই সাহিত্য সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্তর অভিমতে যেমন লক্ষ্য করা যায় কডওয়েলের বিষয়-চিন্তার প্রতিফলন, তেমনি এর সঙ্গে অতুলচন্দ্র গুপ্তর নন্দনতাত্ত্বিক আলংকরিক মতের দূর-স্পর্শও আবিষ্কার করা যেতে পারে।
খ.
পরিব্যাপ্ত জীবনের চালচিত্র সুচারু উপস্থাপনা ঘটে উপন্যাসে। সাহিত্যের শিল্প-মাধ্যমগুলোর সঙ্গে উপন্যাসের আন্তঃসংযোগ নিশ্চয়ই আছে; তবে, বিচ্ছিন্নতা না থাকুকÑ বিভিন্নতাও রয়েছে। আর এই শিল্পটির রূপগত বিবর্তন তো ঘটছেই অনবরত। রণেশ দাশগুপ্ত বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন এই পর্যায়গুলো অনুসন্ধানে এবং এতদ্বিষয়ে তাঁর ব্যক্তি-মত প্রদান অতঃপর। উপন্যাসের শিল্পরূপ (১৯৫৯) গ্রন্থ প্রকাশের আগেই, ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরণ নামক সাময়িকীতে ‘উপন্যাসের শিল্পকলাগত গতিপরিণতি’ শীর্ষনামে তাঁর একটি প্রবন্ধ বের হয়, যেখানে রণেশ দাশগুপ্ত উপন্যাস-বিচারের ক্ষেত্রে রাল্ফ ফক্সের নভেল এন্ড দ্য পিপ্ল এবং ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ইলিউশ্যন এ্যান্ড রিয়ালিটি গ্রন্থ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। তবে এ-কথাও সত্য যে, ঐ প্রবন্ধেই তিনি অনেক ক্ষেত্রে ফক্স ও কডওয়েলের বক্তব্যকে জিজ্ঞাসার সম্মুখীন করে নিজের অভিমত প্রদান করেছেন। উপন্যাস-বিষয়ে এর বাইরেও যে চিন্তা-ভাবনা তেমন হয় নি, তা নয়। যেমন ধরি-না কেন-ই.এম.ফর্স্টর, পার্শি লাবক, লর্ড ডেভিড সেসিল, কিউ ডি লেভিস প্রমুখ উপন্যাস বিচারের কয়েকটি মানদ- দাঁড় করিয়েছেন। ফর্স্টর উপন্যাসে পাঁচটি অপরিহার্য লক্ষণের কথা বলেছেন: গল্প, আখ্যান, চরিত্র, ফ্যান্টাসি ও রিদম্ । এইচ জি ওয়েলস্-এর মতে উপন্যাসে থাকবে বিষয়-বৈচিত্র্য ও বহু বর্ণিল শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনের পূর্ণবৃত্ত অঙ্কিত হবে উপন্যাস-কম্পাসে, আর মানব মন ও আচরণ সম্পর্কে থাকবে পর্যবেক্ষণ। এ-রকম বহুমত পাওয়া যায় উপন্যাস-বিচারে। কিন্তু ফক্স ও কডওয়েল প্রভাবিত রণেশ দাশগুপ্ত বহির্বাস্তবের বিস্মৃতি, চরিত্রাবলির পরিপূর্ণতা ও লোকগদ্যের উচ্ছল উপস্থিতি খুঁজেছেন একটি শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ উপন্যাসে। তাঁর মতে এই ত্রয়ীগুণের ব্যত্যয় ঘটলে উপন্যাস তার স্বাভাবিকত্ব হারাবে। ফক্স কিংবা কডওয়েলের মতো তিনিও লক্ষ্য করেছেন যে, মহাকব্যের ধারাই একদিন উপন্যাসের শিল্পরূপকে প্রতিবিম্বত করেছিল।
আলো দিয়ে আলো জ্বালা গ্রন্থের ‘উপন্যাসের শিল্পকলাগত মূলসূত্র’ প্রবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, মেহনতি মানুষ যখন থেকে বিপ্লবী কর্মকা-ের অঙ্গ হিসেবে উপন্যাসকে উচ্চমূল্য দিতে শুরু করেছে, তখন থেকেই এতে ‘আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকতা’র নামে মাকড়সার জালের মতো একটি বিভ্রম সৃষ্টি করে উপন্যাসের শিল্পকলাকে ধরা ছোঁয়ার অতীত বলে প্রচার করা হচ্ছে। এই প্রচারটা আসছে মূলতÑ তাঁর ভাষায়, ‘পরজীবী পুঁজিবাদীমহলগুলো’ থেকে এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো মেহনতি মানুষের উপন্যাস সংক্রান্ত জাগ্রত আগ্রহকে নসাৎ করা। প্রাবন্ধিক এ-ধরনের হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ক্রিস্টোফার কডওয়েলের গ্রন্থ ইলিউশ্যন এ্যান্ড রিয়্যালিটির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, সঙ্গীত কবিতা ইত্যাদি থেকে উপন্যাস পৃথক; আর পৃথক বলেই এর শিল্পকলার সূত্রগুলোও অন্যরকম। তাঁর মতে, কবিতা ও গানের মতো উপন্যাসও ধ্বনি-প্রতীকের সাহায্যেই সৃষ্টি হয়, হবে তা বহির্বাস্তবে অবস্থিত বিষয়বস্তুর প্রতীক, যা কি-না উঠে আসে ঔপন্যাসিকের প্রতিভায়, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পরিপক্বতায়। এখানে প্রধান বিবেচনা হচ্ছে লেখকের ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’-যা সুপরিপক্ব এবং অবশ্যই তাঁর ‘প্রতিভা’র অমৃত শিখায় পরিশুদ্ধ। তবে এই প্রতিভার খেলা দেখাতে গিয়ে তথাকথিত ‘নন্দনতাত্ত্বিক আত্মকেন্দ্রিকতার প্রসার’কে তিনি মেনে নেন নি। মনস্তাত্ত্বিকতার মাকড়সার জালের বিস্তারে এর বৃদ্ধি জেনেও মনস্তত্ত্বের সংযোগকে তিনি আহ্বান করেছেন। তবে তাঁর এ-কথাও বিশেষভাবে উল্লে¬খ্য যে, অতিমনোকেন্দ্রিকতা উপন্যাস-শিল্পের মৌলিকতার দিক দিয়ে বিয়োগাত্মক ও বিপর্যয়মূলক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি ফ্রয়েডের তত্ত্ব ও ডি এইচ লরেন্সের প্রয়োগ-বিষয়ে তাঁর উপন্যাসের শিল্পরূপ গ্রন্থে প্রশ্ন তোলেন : ‘ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে যে আদিম অতীন্দ্রিয়বাদের রহস্য প্রচ্ছন্নভাবে মিশ্রিত রয়েছে, তা ডি এইচ লরেন্সে প্রকাশ্য ও প্রগাঢ়তর। ফ্রয়েডের তত্ত্বে যে প্রামাণ্যের গাঁথুনি আছে ডি এইচ লরেন্সের উপন্যাসে তা অনুপস্থিত।’ লরেন্স লেনিনকে ব্যক্তিত্ব বিনাশের ধারক বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, রণেশ দাশগুপ্ত সে-প্রসঙ্গে বলেছেন: লরেন্স ‘নিজে নির্গলিত অভিপ্রায়ের তিমির প্রবাহেও আদিম সূর্য-জ্বালার জৈয়ন্তী উড়িয়ে ব্যক্তিবাদের বিরোধিতাই করেছেন। যা থেকে জার্মানির নাৎসিরা উৎসাহী হয়েছিলো।’ জেমস জায়েসের উপন্যাসকে এ-ক্ষেত্রে তিনি বাস্তবাবলম্বী মনস্রোতের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত: ‘উপন্যাস-শিল্পে মনস্তত্ত্বের সঠিক স্থান ও মূল্য নির্ণয় অত্যন্ত কঠিন।’
উপন্যাসে বরং তিনি গণমানুষের উপস্থিতিই কামনা করেছেন বেশি। তিনি জানতেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রথম প্রভাবে সৃষ্টি হয়েছিল উপন্যাস এবং তাতে ‘ব্যক্তির কথা’ই মুখ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা ও বিষয়বস্তুতে কাল আর সমাজের পরিবর্তন ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। তবে পুঁজিবাদী সমাজে যা-হয়, বুর্জোয়া ব্যক্তি ও সর্বহারা জনসাধারণ একইভাবে সমাজ অন্তর্গত মানুষ হিসেবে উপন্যাসে উঠে আসায় উপন্যাস জগতে উভয়ের অবস্থান কিছু দিনের জন্যে হলেও পাশাপাশি থাকে। রণেশ দাশগুপ্ত এ-অবস্থায় প্রশ্ন রেখেছেন যে, উপন্যাসে জনসাধারণকে পাওয়া যায় কি-না। যদি পাওয়া যায় তবে কোন অবস্থায় এবং সে-গুলো প্রকৃত চিত্র সত্যি কি ফুটিয়ে তোলে? এই প্রশ্নকে সামনে রেখে ‘বিপ্লবী গণশিল্পবোধের আলোকে উপন্যাস’ প্রবন্ধে উপন্যাস বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অভিমত প্রদান করেছেন:
‘উপন্যাস-পাঠকের জানা প্রয়োজন-কোন সামাজিক পরিবেষ্টনে, কোন শ্রেণী সন্নিবেশে কোন মানসিক ঘাত প্রতিঘাতে ঔপন্যাসিক কলম ধরেছিলেন অথবা ধরেছেন। প্রথম দিকটিতে আমরা দেখি, উপন্যাসে গণজীবন তরঙ্গিত কি-না, অথবা জীবন্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে কি-না। দ্বিতীয় দিকটিতে দেখি, সামাজিক জীবন-প্রবাহের ভিতর থেকে উপন্যাস কত রকমে কতভাবে বেরিয়ে এসেছে।’
রণেশ দাশগুপ্ত জানতেন যে, উপন্যাস যেমন ইতিহাস নয়, তেমনি নয় সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব-পাঠ। এখানে চরিত্রের আধারে সমাজ ও সময়ের চালচিত্র উদ্ভাসিত হবে যতোটা সম্ভব বিশ্বস্তভাবে। উপন্যাসে আলাদা আলাদা চরিত্র-বিশ্লে¬ষণ পদ্ধতিকে তিনি গ্রহণ করেন নি। নিশ্চয়ই বিকাশশীল চরিত্র উপন্যাসের পটরচনার অত্যাবশ্যক উপদান, কিন্তু সামগ্রিকতাকে বাদ দিয়ে শুধু চরিত্র-কেন্দ্রিক আলোচনা হতে পারে না। কারণ, ‘এইভাবে দেখলে সমাজের ক্রিয়াকলাপ চোখে পড়ে শুধু চরিত্রগুলির জীবন সংগ্রাম অথবা জীবন উপভোগের ব্যাপক ক্ষেত্র রূপে। আজ কিন্তু খুঁজতে হবে সমাজচিত্রের মাঝখানে গণজীবনকে। চরিত্রগুলিকে চরিত্র হিসেবে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সমাজ-জীবনের বিভিন্নমুখী গতিপরিণতির প্রতীক বা প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে হবে। সমাজকে এ-জন্য জনসমাজের নামে অভিহিত করে নেয়া যেতে পারে। সমাজকে এখানে পটভূমিকা থেকে সরিয়ে সামনা-সামনি হাজির করে উপন্যাসের সঠিক সামজিক বিচার করা সম্ভব।’ ‘ব্যক্তির কথা’ নিয়ে যে-উপন্যাসের যাত্রা শুরু, তাতে শুধু ব্যক্তি-চরিত্র-বিশ্লে¬ষণ পদ্ধতি নাকচ করে দেয়ার আর একটি কারণ হলো, পুঁজিবাদী সমাজের প্রতিনিধিদের ফ্রয়েড বা ঐ শ্রেণীর দার্শনিকদের তত্ত্ব নিয়ে ব্যক্তিভাবের অতলস্পর্শতা ও শিল্প সৃষ্টির নামে স্থূল প্রচার কার্যে ব্যাপৃত হওয়া। উপন্যাসের আঙ্গিক বিবেচনার ক্ষেত্রেও তিনি এই ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতার বিরোধিতা করেছেন প্রচ-ভাবে। এই শিল্পমাধ্যমটির রূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে তিনি সমাদর করেছেন সত্যি; কিন্তু বলেছেন: ‘আজকের মূল কথাটা এই যে, জনসাধারণ এবং জনসমাজের গতিপথ ও সম্ভাবনাকে সামনে রেখে উপন্যাস লিখতে ও পড়তে হবে, বিশে¬ষণ করতে হবে, মূল্য নিরূপণ করতে হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ অর্থাৎ আঙ্গিক হতে হবে বিষয় সম্পূরক, যে বিষয়ের নির্ভরতা সমাজ ও জনজীবনের বাস্তবতায়। রণেশ দাশগুপ্তর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বোধ করি বলা চলে, জন-নন্দনতাত্ত্বিক-পরিমিতিবোধ নিয়ন্ত্রিত অভিজ্ঞান।
গ.
সত্যের-কবিতাই তাঁর কাছে ছিলো কবিতার-সত্য। তিনি, অর্থাৎ রণেশ দাশগুপ্ত মনে করতেন যে, সত্য নিশ্চিতভাবে অন্বিষ্ট হবে কবিরÑ যেমন দার্শনিক অন্বেষণ করেন; কিন্তু কবির সত্য উদ্ভাসিত হবে কথাকে অবলম্বন করে। কথাকে ছাড়িয়ে নিরালম্ব সত্যের দিকে ধাবিত হতে পারেন দার্শনিক, তবে কবিতায় সত্য-‘কবির বাকসজ্জার মধ্য থেকেই উৎসারিত হয় এবং তাকে কথা থেকে কোনকালেই ছাড়িয়ে নেবার কথা উঠতে পারে না।’ কবিতা রচনায় ভাষার গুরুত্ব সর্বাধিক বলে মনে করেন রণেশ দাশগুপ্ত। ‘কবিতা ভাষা মাতৃভাষা’ প্রবন্ধে এ-প্রসঙ্গ আলোচনাক্রমে তিনি মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ থেকে এলিয়ট-লুই আরগঁ-ইকবাল প্রমুখ কবির কবিতা-ভাবনা তুলে ধরেছেন। আসলে মানব মনের আবেগ ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত শিল্প ভাবনা যখন বুদ্ধি ও অনুভূতির রাগে রঞ্জিত হয়ে যথাবিহিত শব্দ সম্ভারে বাস্তব সুষমাম-িত চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় রূপলাভ করে তখনই একটি কবিতা নির্মিত হয়। এবং এ-কারণেই সম্ভবত ইংরেজি কবি কোলরিজ বলেছেন : ÔPoetry is the best words in the best order.’ এই শব্দস্পন্দ নিয়েই গড়ে ওঠে কবিভাষা; রণেশ দাশগুপ্তর মতে এই ভাষা আসলে লোকভাষা। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন : ‘কবির অভিজ্ঞতা কিংবা নিরীক্ষাতে আরও একটি সত্য বেরিয়ে এসেছে। সেটি এই যে, কবিতার ভাষা মূলত মাতৃভাষা।’ এই মাতৃভাষারই অপর নাম সংশি¬ষ্ট কবির দেশ বা অঞ্চলের লোকভাষা। এ-মত নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে; বিশেষ করে যারা শব্দের চেয়ে ‘আইডিয়া’কে কবিতার প্রাণ ভাবেন, কিংবা বলেন যে, শব্দের স্বভাব টাকার মতো, বহু ব্যবহারে তা ক্ষয়ে যায়, হস্তান্তরে তাতে কলঙ্ক জন্মে-তারা এ-সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারেন।
কবিতার ভাষা নিয়ে রণেশ দাশগুপ্তর অভিমতের সঙ্গে তাঁর উপন্যাস-ভাবনার একটা ঐক্য পাওয়া যায়। দুটো ক্ষেত্রেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন লোকভাষার। এই ভাষার শব্দাবলি উত্থিত হয় প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনচর্চার মধ্য থেকে। ইকবাল দর্শননির্ভর উর্দু কবিতায় প্রচুর ফার্সি শব্দ ব্যবহার করলেও সত্যের-কবিতার দিকে যখন তিনি ঝুঁকে পড়েছেন তখন তাঁর ভাষা নিখাত উর্দু। অন্যদিকে, ফিরদৌসিও কবিতায় মাতৃভাষা ফার্সি ব্যবহারে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন; পারতপক্ষে আরবি ভাষা তিনি বর্জনই করেছেন। এই মাতৃভাষা অর্থাৎ লোকভাষাকে রণেশ দাশগুপ্ত কবিতার প্রাণ হিসেবে মনে করতেন। তার কারণ- ‘কবিতা ও মাতৃভাষাকে একত্রীভূতভাবে দেখার যে তাগিদ সেটি হচ্ছে মানবসমাজের মুক্তি সংগ্রামের অদম্য বিকাশের তাগিদ। মাতৃভাষা কবিতার সত্যের পদক্ষেপের প্রাণশক্তি। মাতৃভাষা অপহ্নবে কবিতার অপহ্নব। মাতৃভাষার স্বাচ্ছন্দ্যে কবিতার স্বাচ্ছন্দ্য। মাতৃভাষার মুক্তি জনগণের ম্ুিক্ত। সুতরাং কবিতার এবং সত্যের মুক্তি।’ ‘অব্যাহত কবিতার জন্য’ প্রবন্ধেও তিনি কবিতার শিল্পাধারের প্রশ্নে মাতৃভাষাকে কবিতার অন্যতম উপাদান হিসেবে চূড়ান্ত মূল্য দিয়েছেন। তবে এখানে ‘বিপ্লবী মানবতাবাদ’কে অন্যতম প্রধান বলে মনে করেন তিনি। ফরাসি সাহিত্যের লুই আরগঁ, পল এলুয়ার প্রমুখের সঙ্গে নবীন ফ্রাঁসোয়া সাগাঁর সাহিত্য-সৃষ্টি আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে, বিপ্ল¬বী মানবতাবাদ এঁদের সৃষ্টিকে কতটুকু অগ্রবর্তী করেছিল।
ঘ.
বহির্বিশ্বের সাহিত্যরচয়িতা, বিশেষ করে তাঁদের রচিত উপন্যাস সম্পর্কে রণেশ দাশগুপ্তর আলোচনা মূল্যবান। ফ্লবেয়র ও মোপাসাঁকে সার্ত্রে তাঁর সাহিত্য কী গ্রন্থে ‘কায়েমি স্বার্থের তল্পীবাহক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। রণেশ দাশগুপ্ত এর সঙ্গে একমত পোষণ না করে দেখিয়েছেন, কিভাবে উল্লিখিত দুজন মুক্তমানবতার আবহাওয়াকে শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত রেখেছিলেন। সেই সঙ্গে সার্ত্রের উপন্যাসকেও অবশ্য তিনি বাতিল করে দেন নি। কারণ সার্ত্রের উপন্যাসের- এক. সামাজিক বাস্তবতা ও শিল্পীর স্বাধীনতার সমন্বয় এবং পুনর্বিন্যাস; দুই. মনোবাস্তবতা, বহির্বাস্তবতা এবং ভাবলৌকিকতার এক উন্নত পর্যায়ের ঐক্যে উত্তীর্ণ; তিন. ‘কাঁচের মতো স্বচ্ছ যা বিষয়কে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেন’-এমন ব্যবহার; -এই বৈশিষ্ট্য তিনটি উপন্যাস-শিল্পের মৌলিক সম্প্রসারণকে মদদ দেয়। রুশ উপন্যাস আলোচনা প্রসঙ্গে দেখা যায়, রণেশ দাশগুপ্ত র্যাল্ফ ফক্সের বিশেষ অভিমতের সঙ্গে ক্ষেত্র বিশেষে একমত যেমন হতে পারেন নি তেমনি আবার রুশ উপন্যাস ডা. জিভাগো সম্পর্কে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রায় বাতিল করে দিয়েছেন। রুশ উপন্যাস সম্পর্কে ফক্সের মন্তব্য: ‘যদিও এখনো মাত্র নতুন এবং অপরিণত’। রণেশ দাশগুপ্ত এই অভিমত মেনে নেন নি, বরং ফক্সের নভেল এ্য- দ্য পিপল গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে ‘দ্বৈত বক্তব্য’ আবিষ্কার করেছেন। সোভিয়েত উপন্যাস সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত:
১. কোনো পর্যায়েই ইউরোপীয় উপন্যাসের মৌলিক বাস্তববাদী বা মহাকাব্যিক ধারাকে ভেঙে দিয়ে সোভিয়েত উপন্যাস ফিরে যায় নি আদিম বা প্রাক-ইউরোপীয় কোনো পদ্ধতিতে।
২. নির্দিষ্ট সমাজ পরিবেশে চরিত্র সৃষ্টিতেই রয়েছে সোভিয়েত উপন্যাসের মানবিক উপকরণের রূপায়ণের বিশেষত্ব।
৩. সোভিয়েত উপন্যাস লোকভাষাকে অটুট রেখেছে তার সারল্য ও ব্যঞ্জনায়।
বহির্দেশ থেকে প্রকাশিত ও ১৯৫৮-তে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রুশ উপন্যাস ডা. জিভাগো নিয়ে যখন মার্কসবাদীদের মধ্যে বিরূপ সমালোচনা, ঐ সময় রণেশ দশগুপ্ত লিখেছেন যে, অতিবাস্তববাদী ধারার কবি পাস্তেরনাক তাঁর রচিত উপন্যাসে যথেষ্ট বাস্তব। বিশেষত ইউরো-মার্কিন এক ঔপন্যাসিক গোষ্ঠী যেভাবে মনোবিকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে, পাস্তেরনাক যে সে ধারায় গা ভাসান নি তা আমাদের মনে রাখতে হবে। রণেশ দাশগুপ্ত এই উপন্যাস-বিতর্কের চরম মুহূর্তেও ডা. জিভাগোর উপন্যাস হিসেবে ‘স্থায়ী মূল্য’ বাতিল করে দেন নি।
বাংলা উপন্যাস বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য সমকালে যথেষ্ট প্রথাবিরোধী বলে মনে হয়। তিনি লক্ষ্য করেছেন বঙ্কিমী গদ্যে ‘সাধু ও লোকগদ্যের মিশ্রণ’। আর আনন্দমঠ উপন্যাসে বাস্তবতা অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি যার সন্ধান পেয়েছেন তাতে মাকর্সবাদী মূল্যায়নে বঙ্কিমচন্দ্রকে বিশেষ স্থান দিতে হয়। রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন: ‘আনন্দমঠের মধ্যে বিশেষ একটি ধর্মীয় মন্ত্রোচ্চারণে গঠিত পৌরাণিক প্রলয় ও সৃষ্টির পটভূমি একদিকে যেমন প্রবল হয়ে উঠেছে, তেমনি আরেক দিকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের যে ছবি দেওয়া হয়েছে এতে তার বাস্তবধর্মিতার তুলনা বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেও সচরাচর পাওয়া যায় নি।’ তিনি আনন্দমঠ, গোরা, পথের দাবী, পঞ্চগ্রামকে সমপর্যায়ভুক্ত করে এগুলোতে আবিষ্কার করেছেন চরিত্রকথার ধারাবাহিকতা, কথোপকথন-পদ্ধতির লৌকিকতা ও মনোবাস্তবতা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল্যায়নেও বেশ ব্যতিক্রমী তিনি। প্রথম জীবনে ফ্রয়েডীয় ধারা অবলম্বনকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘নানাভাবে বঞ্চিত মানবমানবীর আশাহত, ক্ষতবিক্ষত অন্তর্মুখী ক্ষুধার কু-লিনী’ বা ইপ্সিতকে না পেয়ে ‘অতৃপ্ত অন্তরাত্মার মাথা খুঁড়া’ হিসেবে। দর্পণ উপন্যাস সম্পর্কে তাই তাঁর বক্তব্য এ-রকম যে, এখানে ফ্রয়েড ও মার্কসীয় তত্ত্বের যৌথ উপস্থাপনায় ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব পেছনে পড়ে গেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁর চূড়ান্ত অভিমত: ‘ফ্রয়েডীয় ভাবধারার প্রাধান্যের আমলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এমন উপন্যাস লিখেছেন, যার মধ্যে মার্কসীয় প্রভাব অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। কিংবা এ কথাও বলা যেতে পারে যে, মার্কসবাদের প্রভাব শিল্পীর মনে অন্তঃশীল ছিল।’ মানিক-উপন্যাসের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত চরিত্রের সন্নিবেশ আর তাদের জীবনযাপন বিশ্লে¬¬ষণ করেই রণেশ দাশগুপ্তর এ মন্তব্য। আসলে মানবসমাজে সংগ্রামশীলতা ও অগ্রবর্তী হবার মানবীয় কামনাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে এর ইন্ধন আছে বলে তিনি মনে করেন। অপরাজিততে অপূর্ব ও কম্যুনিস্ট প্রণবের মধ্যে যোগাযোগ, বিশেষ করে মেহনতি মানুষকে নিয়ে অপূর্বর চিন্তাভাবনা ইঙ্গিতবহ এবং তাই গুরুত্বপূর্ণ। রণেশ দাশগুপ্ত এই সব সম্ভাবনা ইতিবাচকভাবে গ্রহণের পক্ষে ছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন: ‘বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার এই দিকটাকে সাধারণ আলোচনায় কোনো আমলই দেয়া হয় নি। এই দিকটাকে বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার নিরীক্ষায় আনা দরকার তাঁর সমস্ত সাহিত্যকৃতি সম্বন্ধে ধারণার জন্যে।’ একইভাবে তিনি রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী, শরৎচন্দ্রের পথের দাবীতে শ্রমজীবী জনগণের বিদ্রোহের ব্যাপারটাতে ‘শ্রেণীসংগ্রাম প্রতিফলিত হয়েছে’ বলে মনে করেন। তাঁর ভাষায়: ‘এরা সকলেই জীবনশিল্পী হিসেবে জীবনসত্যকে সমস্ত অন্তর ঢেলে প্রকাশ করেছেন।’ রণেশ দাশগুপ্তর সাহিত্যচিন্তা এ-সব ক্ষেত্রে মার্কসীয় তত্ত্বান্ধ সমালোচকদের মূল্যায়ন থেকে পৃথক। তিনি শুধু তত্ত্বের প্রয়োগ বা বাস্তবতার সুনিপুণ চিত্রায়ণকেই গুরুত্ব দেন নিÑ বরং খুঁজে ফিরেছেন ‘সম্ভাবনা’কে। এ-সম্ভাবনা ফলবতী বৃক্ষের মধ্যে সুপুষ্ট ফলের, সন্তানবতী নারীতে স্বাস্থ্যবান শিশুর। মার্কসবাদীদের চোখে প্রায় খারিজ হয়ে যাওয়া তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে রণেশ দাশগুপ্ত তুলে আনেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে; উচ্চমূল্য দেন গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম বা মন্বন্তরের। তাঁর মূল্যায়ন: তিরিশ দশকে মার্কসীয় বাতাবরণে তারাশঙ্কর যে কঠিন কাজটি করেছিলেন সেটিই চল্লি¬¬শের দশকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এগিয়ে নেন। ‘মার্কসীয় বাতাবরণ: শতাব্দীকালের সাহিত্য’ প্রবন্ধে এ-প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য: ‘তিরিশের দশকের শুরুতে তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্ট হবার ব্যাপার নিয়ে তর্কবিতর্ক ছিল। তিনি দেখিয়েছিলেন প্রাচীন ও নবীনের সংঘাত মতাদর্শের সংঘাত। চল্লিশের দশকে এই মতাদর্শের সংঘাতকে পুরোভাগে রাখার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।’ বিভূতিভূষণের উপন্যাসে যে সম্ভাবনার কথা রণেশ দাশগুপ্ত উল্লেখ করেছেন, তারাশঙ্করের ব্যক্তি ও সৃষ্টির মধ্যে আরও গভীর করে সে অন্বেষা চলেছে। তিনি বাতিল করে দেন নি তারাশঙ্করকে, বরং অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ঔপন্যাসিকের ‘অন্তর্জ্বালা’ এবং ‘অসন্তোষে’র উৎস অনুসন্ধানের কথা বলেছেন। এই চিন্তা মার্কসবাদী প্রথাগততা থেকে ভিন্নতরÑ অতিমাত্রায় মানববাদীগণ সম্ভবত এতে তুষ্টি পেতে পারেন। বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা এক সময় রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ভাববাদ আপ্লুতার অভিযোগ তুলে রবীন্দ্র-বিরোধিতায় মত্ত ছিলেন। কিন্তু রণেশ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রসাহিত্যে লক্ষ করেছেন জীবনের প্রতি শিল্পীর আনুগত্য এবং ‘মৃত্যুকে জয় করার দৃঢ়তম প্রতীতি’। আর এ কারণেই তার মন্তব্য: ‘রবীন্দ্রনাথের কাব্যের মৃত্যু নেই, কারণ বহুমানবের মৃত্যু নেই।’ সুকান্ত ভট্টাচার্যও ‘সব সময়েই মৃত্যুর ছায়াতে বসে জীবনের জয়গান গেয়েছে’ বলে মনে করেন তিনি। জীবনানন্দ দাশকে প্রকৃতির কবি, ধূসরতার কবি, নৈরাশ্যেবাদী কবি ইত্যাদি বলা হলেও রণেশ দাশগুপ্তর বিশ্লে¬¬ষণে জীবনানন্দ উদ্দেশ্যহীন বা উত্তরণহীন নন। তিনি স্বদেশে ও বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে মানবিক সামাজিক উত্তরণকেই আমল দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় অন্ধকার আছে, আছে মৃত্যু; কিন্তু জীবনের পরম প্রাপ্তি এটাই -একথা তিনি মনে করেন নি। আসলে জীবনানন্দ দাশের জীবন জিজ্ঞাসায় দ্বন্দ্ব ছিলো, ক্রান্তিকালের ঘাত-প্রতিঘাত ও বৈচিত্র্যে এটা অস্বাভাবিক নয়। এই দ্বন্দ্বের জন্যে যে কবিমনে আক্ষেপ কম এ-কারণে বরং সমালোচিত হতে পারেন তিনি। কিন্তু তাঁকে বাতিল করা হবে ভুল। রণেশ দাশগুপ্ত এ-প্রসঙ্গে ‘মাকর্সবাদীর চোখে জীবনানন্দ দাশ’ প্রবন্ধে অভিমত ব্যক্ত করেছেন:
‘মার্কসবাদীরা জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে সমাজবিপ্ল¬¬বের অন্যতম উপকরণ হিসেবেই গ্রহণ করবে। কারণ তাঁর কবিতার মধ্যে রয়েছে লোভ ও নীচতাকে অতিক্রম করে মানুষের এগিয়ে চলার তাগিদ। মার্কসবাদীরা যে নতুন জগৎ গড়ে তুলতে চাইছে তার অঙ্গীকার জীবনানন্দ দাশের কবিতায় উপস্থিত। কাঁটার ঝোপে ফুলের মতো।’
কণ্টকে রক্তাক্ত হবার সম্ভাবনাকে স্বীকার করেও স্নিগ্ধতা আর সৌন্দর্যের জন্যে রণেশ দাশগুপ্তর যে পিপাসা তার মূল্য কম নয়।
ঙ.
অর্জিত শিক্ষা ও অধিগত বোধ-নির্মিত স্বপ্নমহলে মানুষের ভাবনা নিশ্চিতভাবে সদা-সঞ্চরণশীল। তার শিল্প-সৃষ্টি ও শিল্প-বিবেচনা কোনোভাবেই এ-থেকে বাইরে বেরুতে পারে না। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে যেহেতু পরিবর্তমান মানুষের শিক্ষা; এবং অবশ্যই বোধ -সেহেতু এই ভাবনায় এর প্রতিচ্ছায়া অনিবার্য। রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন মূলত কার্ল মার্কসের চিন্তাশ্রয়ী দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দর্শনের অনুসারী। তাঁর জীবনযাপন ও মূল্যায়ন দৃষ্টিভঙ্গিতে এই আদর্শের প্রভাব প্রত্যক্ষভাবে কার্যকর। সাহিত্য-বিবেচনাতেও তাঁর ভাবনা মার্কসীয় গতি অতিক্রম করে নি। তবে তিনি সংবেদনশীল মন নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের পরিমণ্ডল , সংকট ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছেন। মার্কসপন্থী সমালোচকগণ যেখানে প্রায়শ শিল্প-সাহিত্যের বহিরঙ্গ আলোচনায় আগ্রহী এবং মেহনতের সঙ্গে এর যোগসূত্র কতটুকু সুদৃঢ় তা আবিষ্কারেই অগ্রবর্তী; রণেশ দাশগুপ্ত সেখানে তত্ত্বের আপাত পরিবেষ্টন ছিন্ন করে এর রূপচিন্তা ও নন্দন-বিবেচনায় অপেক্ষকৃত অধিক মনোযোগী। এ-কারণে বাস্তবের হুবহু অনুকৃতিই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য নয় তাঁর বিবেচনায়। মূলত মানবজীবনের সংকটমুক্তি, বিশেষত মেহনতি মানুষের আত্মমুক্তি তাঁর প্রার্থিত বটে, কিন্তু তা কোনোভাবেই শিল্প-সাহিত্যের প্রাণবায়ু রুদ্ধ করে নয়। ‘সৌন্দর্য সাধনার প্রক্রিয়া’র কথা তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। জীবন-জিজ্ঞাসায় যেমন, তেমনি সাহিত্য-বিবেচনাতেও রণেশ দাশগুপ্ত নির্দিষ্ট তত্ত্বাশ্রয়ী, সন্দেহ নেই; কিন্তু হৃদয়বৃত্তির সংশ্লে¬ষে জারিত নিজের অনুভব এবং প্রত্যাশা-এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।
ড. সৌমিত্র শেখর : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; [email protected]