বাংলাদেশের গণসংগীত: বিষয় ও সুরবৈচিত্র্য তরুণ গবেষক সাইম রানার বইটির শীর্ষনামেই এর পরিচয় পরস্ফুিট হয়ে উঠেছে। এ দেশের মনন সাহিত্যে এই বাণীসাধকের অভ্যুদয়কে আমি সর্বান্তঃকরণে অভিনন্দন জানাই।
বইটির ‘মুখবন্ধ’র প্রথম অনুচ্ছেদেই তিনি লিখেছেন, “…অস্ত্রই একমাত্র প্রতিরোধের ভাষা হতে পারে না। যে-কোনো সৃজন, মনন, সাধন কিংবা তান্ত্রিক জ্ঞান দিয়েও প্রতিরোধ করা সম্ভব জগতের যত পঙ্কিলতা। তা গানে হোক, দেহভঙ্গিমায় কিংবা ইশারা-ইঙ্গিতে হোক, চিত্রে বা ফসলের আবাদে হোক—নিষ্পেষিত মানুষেরা যুগে যুগে, কালে কালে কখনোই ঠগেত বসে থাকেনি। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ব্যাপ্তি সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ কিংবা লোকগীতি ‘ভাওয়াইয়া’, লোকনাট্য ‘গম্ভীরা’, তেমনি একেকটি জনপদের অধিকারের ভাষা। গণসংগীতও বিংশ শতাব্দীর অভিনব এক শিল্পদর্শন, যা সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগরণের প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিক হিসেবে মূল্যায়নযোগ্য।”
অনেক প্রস্তুতি নিয়ে ও আটঘাট বেঁধেই যে বাংলাদেশের গণসংগীতের স্বরূপ-উদ্ঘাটনে তিনি ব্রতী হয়েছেন—বইটির পাঠ-সমাপনান্তে যেকোনো পাঠককেই তা স্বীকার করতে হবে। সাইম রানা শুধু কৃতী গবেষকই নন, একজন কুশলী সংগীতরচয়িতা ও সংগীতশিল্পীও। তিনি তো ‘এক যুগ ধরে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মঞ্চ, টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিওতে নিজের লেখা ও সুর করা গান নিয়মিত পরিবেশন করে আসছেন।’ এ কারণেই যথাযথ কাণ্ডজ্ঞান, তত্ত্বজ্ঞান ও রসজ্ঞানের সমন্বয়ে গণসংগীতের সংজ্ঞার্থ নির্ণয়, বিষয়ের স্বরূপ-সন্ধান ও সুরবৈচিত্র্যের বিশ্লেষণে তিনি সমান দক্ষতা প্রদর্শন করতে পেরেছেন।
সূচনালগ্ন থেকেই আমাদের দেশে গণসংগীত যে ‘বাংলা গানের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা এবং বিদেশি সংগীতকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে’ সেসবের বিস্তৃত আলোচনা এ বইয়ে ঠাঁই পেয়েছে। বাংলা গণসংগীতের অনুপুঙ্খসমেত সব বিষয়কেই লেখক স্পর্শ করেছেন। স্বাধীনতা-পূর্বকাল থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী একাল পর্যন্ত রচিত ও গীত সব ধরনের গণসংগীতের প্রতি মনোযোগ দেওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। সাইম রানা সেই কঠিন কাজেই প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং সিদ্ধিকে করতলগত করতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনটি অধ্যায় ও পরিশিষ্টে সাতটি ক্রোড়পঞ্জীসংবলিত এই বইয়ের দ্বিতীয় ক্রোড়পঞ্জীতে নির্বাচিত নয়টি গানের আন্তর্জাতিক পদ্ধতিসম্মত স্বরলিপি সংযোজন করায় শিল্পী-গবেষক সাইম রানা অবশ্যই গণসংগীতশিল্পীদের কৃতজ্ঞতাভাজন হবেন।
বইয়ের উপসংহারে তিনি দাবি করেছেন, ‘এই গ্রন্থটি সংগীতবিষয়ক হলেও তার ক্ষেত্র মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক ইতিহাস, প্রগতিশীল আন্দোলনের ইতিহাস এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শন। উপযুক্ত তিনটি বাহনের ওপর ভর করে বিশ্লেষিত হয়েছে বলে বিষয়বৈচিত্র্যের নান্দনিকতা বা সাহিত্যমূল্য ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের ওপর ভিত্তি করে দাঁড় করানো হয়েছে। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে তুলনামূলক অবস্থানও প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে এসেছে বিভিন্ন অঞ্চলে। এই গ্রন্থের সার্থকতা যেমন পূর্ববর্তী গবেষকদের গভীর অনুসন্ধান ও প্রেরণার ফসল…অপরদিকে লেখকের নিজস্ব ধরনে বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে উঠে এসেছে আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রের ইঙ্গিত।’
লেখকের এই দাবির যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশ নেই বটে, কিন্তু ভাষা ব্যবহারে সর্বত্র তিনি আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলেই আমার মনে হয়েছে। এ ধরনের বইয়ের রচনারীতিতে আরও স্বচ্ছতা ও প্রাঞ্জলতা কাঙ্ক্ষিত।