আমার নেতা সত্যেন সেন: জসিম উদ্দিন মন্ডল

অবিভক্ত বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে এবং এদশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা হিসাবে পরিচিত নাম সত্যেন সেন। সবচেয়ে বেশি পরিচিত তাঁর এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দীর্ঘ কালের সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। এবছর সত্যেন সেনের জন্ম শতবার্ষিকী। সত্যেন সেনের সাথে আমার প্রথম দেখা কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডার গ্রাউন্ডের থাকার সময় এক গোপন মিটিংয়ে, মিটিংয়ে আসল নামে চিনতে পারিনি পরে জেনেছি ইনিই সত্যেন সেন। কারণ পার্টি আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকার সময় প্রায় সকল পার্টি সদস্য …… ব্যবহার করতেন। এটাই নিয়ম ছিল। এর বেশি কিছু পরে রাজশাহী জেল থেকে আমাকে যখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা হল তখন ঢাকা জেলে আমাকে থাকতে দিল ২৬ সেলে। ২৬জন কয়েদি এখানে থা তো বলে নাম ২৬ সেল। যুক্তফ্রন্ট সরকারের পর তখন মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায় সম্ভবত ১৯৫৬ সাল। আমি এখানে এসে পেলাম সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ ব্যানার্জী, অজয় রায়, শহীদুল্লাহ কায়সার, ধীরেন ভট্রাচার্য্য, ময়মনসিংহের আলতাব আলী, আওয়ামী লীগের মনিসহ আরো অনেককে, আজ আর সবার কথা মনে নেই। আমি অনেকের থেকে অনেক ছোট এবং নতুন হওয়ায় সত্যেনদা আমাকে তার পাশে নিয়েছিলেন। তাঁর নং ছিল ৬ আর আমার নং ছিল ৫। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে অনেক নেতাকর্মী বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতাকর্মী তখন জেলে, তাদের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে কারো কারো বন্ড সই নিয়ে জেল খানা থেকে ছেড়ে দিতো। সত্যেনদার বা রণেশ দাশসহ আরো অনেকের মধ্যে এরকম কোনো লক্ষন দেখিনি। তারা বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছেন কিন্তু বন্ড সই দিয়ে জেল থেকে বেরুনোকে তাঁরা সবাই ঘৃণার চোখে দেখতেন।
সত্যেনদার সাথে জেলখানায় এক বছর ছিলাম। এই এক বছরে অনেক স্তৃতি। সত্যেনদা নিজে গান করতেন। খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তার গাওয়া অনেক গানের মধ্যে ‘যাও যাও রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও’ গানটি আমার খুব ভালো লাগতো। আমার সেলে কেউ ছাড়া পেলে বা অন্য জেলে চলে যাওয়া সময় সত্যেনদা বিদায়ের আয়োজন করতেন। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে সত্যেনদা গান ধরতেন আমরা গলা মেলাতাম। নিরান্দ জেলবন্দী জীবনে শত আনন্দ ও কাজের মাঝে দিয়ে সবাইকে ভুলিয়ে রাখতেন। যারা ভালো করে পড়তে জানতো না তাদের খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন। পড়ার পর ঘটনার ব্যাখ্যা দিতেন। এই সময়ে জেলখানায় বসে সত্যেনদা ‘গ্রামবাংলার পথেপথে’ বইটি লেখেন। এই বইটি প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাতেম আলীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি গল্প লেখার পর আমাদের পড়ে শোনাতেন। মতামত নিতেন সবার। আমাকেও অনেকবার জিজ্ঞাসা করতেন। আমি আমার বোধ ও বুদ্ধি থেকে মতামত দিতাম। তিনি প্রত্যেকের মতামতের গুরুত্ব দিতেন। এক্ষেত্রে রণেশদার কথাও বলতে হয়, রণেশদাও লিখতেন। তিনিও প্রত্যেকের মতামত জানতে চাইতেন। মতামতের ভিত্তিতে লেখা পরিবর্তন করতেন। শহীদুল্লাহ কায়সারও লিখতেন।
সত্যেনদার কথায় আসি। আমাদের সেলের কারো কোন চিঠি এলে এবং সে চিঠিতে বাড়ির কোন খারাপ খবর থাকলে আগেই তাঁর হাতে চিঠি দেয়া হতনা। ধীরে সুস্থে তাঁর মনমেজাজ বুঝে খবর জানানো হত। মন খারাপ হলে তাকে বুঝানো হত। এক্ষেত্রে সত্যেনদার ভূমিকা ছিল প্রধান। একবার আমার স্ত্রীর চিঠি এলো চিঠিতে বাড়ির মানুষের অনেক দুর্দশার কথা লেখা ছিল। সন্তানের অসুখ-বিসুখ, খাবারের সমস্যা। এসব নিয়ে আমার মনটা খুব খারাপ ছিল। সত্যেনদা এসে গান ধরলেন ‘যাও যাও রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও’। আমাকে গাইতে বললেন, তখন কি আর মন ভার করে বসে থাকা যায়?
এই সময় জেলখানায় বসে সত্যেনদা পৃথক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার কথা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং সে লক্ষ্যে সংগঠন গড়ে তোলা জন্য সবার সাথে পরামর্শ শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে পরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জন্ম। যদিও উদীচীর জন্ম অনেক পরে ১৯৬৮ তো কিন্তু এর প্রাথমিক কাজ শুরু করেছিলেন আরো অনেক আগে থেকে। সত্যেনদাকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন তারা জানেন তিনি কি রকম দরদী মনের মানুষ ছিলেন। তাঁর বিশাল …….. দরদের বিষয়ে বলি, ঢাকা জেলখানার কয়েদীদের ভেতর থেকেই বাচাই করে জেলখানার বিভিন্ন কাজ করানো হত। সে রকম একজন ছিল রহমত, সে মেথরের কাজ করত। এরা জেলখানার সব জায়গায় যেতে পারতো। তার কাজে আমাদের ওয়ার্ডেও আসতো। মাঝে মাঝে বকশিশ চাইতো। একদিন এসে বকশিশ চাচ্ছে, সত্যেনদাকে ডেকে বললাম দাদা মেথর এসে বসে আছে আমার মুখে মেথর শুনে সত্যেনদা প্রচন্ড রেগে গেলেন আমাকে বললেন আপনি কেন ‘মেথর’ বললেন ও তো মানুষ। আপনি কমিউনিস্ট হয়ে কেন মেথর বললেন এভাবে বার বার মাথা কুটতে লাগলেন। এবারে জেলখানার বাইরের ঘটনা, আমার স্ত্রী অসুস্থ হাসপাতালে। আমার স্ত্রীর অপারেশন হয়েছিল এসময় তিনি খুব সাহায্য করেছিলেন। আমার মেয়ে ১০ বছরের আলোর মামা ছিলোনা বলে মামার জন্য তার খুব দুঃখ ছিলো। সে সময় একদিন সত্যেনদা ও রণেশদা ফলমূল নিয়ে বিকালে আমার স্ত্রীকে দেখত এলেন। এরা দুইজন সবসময় জুড়িদার ছিলেন। এরা এল আমার মেয়ে দুঃখ করে বলেছিল আমার কোনো মামা নেই সাথে সাথে সত্যেনদারা বললেন কে বলে তোমার মামা নেই। আমরা দুইজন তোমার আপন মামা। আমার স্ত্রীকে সাক্ষী মেনে বললেন, আমরা তোমার মায়ের আপন ভাই সে সাথে বানিয়ে দুজনের মুসলমান নামও বলেছিলেন আজ আর সে নাম মনে নেই। তার পর থেকে আমার স্ত্রী ও মেয়েকে আপন জানতেন। একবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, আমার স্ত্রী পরিবার কোলকাতায়। একদিন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপার নিয়ে জয়বাংলার অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি ও আমার স্ত্রী মেয়ে নিয়ে জয় বাংলার অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছি। মঞ্চে সত্যেনদা সভাপতি। হঠাৎ সত্যেনদার নজরে পড়লো আমার স্তী সামনে বসে আছে। তখনি তিনি মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমার স্ত্রীকে হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে সবার মাঝে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন এই আমার বোন, আপন বোন। এই ছিলেন সত্যেনদা পরেও আমার ছেলে মেয়েকে প্রয়ই টাকা দিতেন, খোজ খবর করতেন।
জেলের আরেক দিনের ঘটনা। জেলের ভিতরে ধীরেন ভট্টাচার্য্য ফুলগাছ লাগিয়ে ছিলেন। সত্যেনদা ফুল খুব পছন্দ করতেন। একাদ আমার মন খুব খারাপ হঠাৎ কি মনে করে একটা গোলাপ তুলেছিলাম, তুলে গেলাসের পানিতে রেখেছিলাম। সত্যেনদা জানতে পেরে আমাকে বঝিয়ে ফুল ছেঁড়ার ব্যাপারে অনেক নিষেধ করেছিলেন। কিছুটা রাগও করেছিলেন। ফুল ছেঁড়া তিনি একদম পছন্দ করতেন না।
আমাদের ২৬ সেলে পর্যায়ক্রমে প্রতিমাসে একজন করে ম্যানেজার হতো। প্রত্যেককে এই ম্যানেজারের দায়িত্ব নিতে হতো। সত্যেনদাও জেলখানায় আমাদের ম্যানেজার হলেন। তার ম্যানেজারের সময়টা আমাদের জন্য খুব আনন্দের সময় ছিল। তার সময়ে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব হতো না। খাবারে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতেন। আমাদের জিজ্ঞেস করতেন আমরা কে কি খাবো। সাধ্যমত চেষ্টা করতেন সে রকম খাবার দিতে। জেলখানার বাইরে সত্যেনদার সাথে আমি দুই জায়গায় পার্টির মিটিং করেছি। প্রথমবার নওগাঁয় দ্বিতীয়বার দিনাজপুরের কাহারোলে। এইসব জনসভায় তিনি গান করতেন, বক্তৃতাও করতেন তখন কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় একবার খড়গপুরে রেলের মিটিংএ গেলে সেখানে সত্যেনদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।
সত্যেনদার কর্মজীবন নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে অনেকে আমার চাইতে ভালো বলতে বা লিখতে পারবেন। যারা আমার খুব কাছে থেকে বেশি দিন দেখেছেন তারা। তবে তার কাছ থেকে আমি যে শিক্ষা পেয়েছি তা হল কমিউনিস্ট হতে হলে পড়ালেখা করতে হয়। সাংস্কৃতিক চর্চাও করতে হয়। কমিউনিস্ট আন্দোলনে জীবন জীবিকা আর অধিকারের লড়াই করতে হয়। এর জন্য বক্তৃতার যেমন দরকার তেমনি মেহনতি মানুষের জাগরণের জন্য চাই উদ্দীপনামূলক গান, নাটক, কবিতা। যা হবে মেহনতি মানুষের মনের কথা, মনের খোরাক। এই জন্য ময়মনসিংহের মতো সত্যেন সেনও আমার নেতা। জীবন ও সংস্কৃতিক আন্দোলনের জানা-বোঝার নেতা।
সত্যেন সেনকে যেভাবে দেখেছি
ডা. সারওয়ার আলী
সত্যেন সেন একাধারে একজন কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা এবং সুসাহিত্যক। যুবক বয়সে সমাজতন্ত্রের তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে তিনি এ অঞ্চলের প্রথম প্রজন্মের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে নিজেকে কৃষক আন্দোলনে যুক্ত করে। এই প্রজন্মের হিন্দু ধর্মাবলম্বী কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের অনেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করণ ও দমন-পীড়নে অতিষ্ট হয়ে দেশ ত্যাগ করেন কিন্তুু সত্যেন সেন মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি। পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ সময় তাকে কারাগারে কালাতিপাত করতে হয়েছে। কারাবাসকালে কিছুটা পরিণত বয়সে সত্যেন সেন নিজেকে সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত করেন এবং অনবধ্য উপন্যাস ও গীতিকবিতা রচনা করেছেন। শেষ বয়সে তিনি অসুস্থতার কারণে তিনি প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন, এতদসত্ত্বেও সাহিত্য রচনা পরিত্যাগ করেননি, বিকল্প পথের সন্ধান করেছেন। শান্তি নিকেতনে দিদির বাসায় থাকা অবস্থায় সন্জীদা খাতুনকে যে চিঠিপত্র লিখেছেন, তাতে লক্ষ করা যায় যে, বাংলাদেশে তার মন পড়ে ছিল এবং পত্রাদির উচ্চ সাহিত্যমূল্য রয়েছে। উপরোক্ত তিনটি পরিচয়ের মধ্যে কোনটি প্রধান তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে আমার বিবেচনায় তিনি সাহিত্যিক হিসেবেই পাঠককুলের কাছে সুপরিচিত হয়েছেন এবং বিশেষ অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ‘অভিশপ্ত নগরী’ গ্রন্থে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া, সেয়ানা উপন্যাস সমাজের বঞ্চিত মানুষের জীবন আশা-আকাক্সক্ষার মূর্তরুপ প্রকাশ প্রায়।
আমার সাথে সত্যেনদার স্বল্প সময়ের পরিচয় ছিল, সেখানে মানুষ সত্যেন সে পরিচিতিটি প্রধান হয়ে উঠেছে। তার সমবয়সী যে সব আতœগোপনকারী কিংবা প্রকাশ্যে রাজনীতি করেন এমন কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, তাদের সাথে সত্যেন সেনের জীবনধারন, কথাবার্তা কিংবা ব্যবহারের পার্থক্যটি বেশ স্পষ্ট। অন্যরা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সম্ভবত: সমাজ বিপ্লবে নিবেদিত প্রাণ এবং বিপ্লবের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার প্রেরণার কারণে মূলত নীতি ও কৌশলের নিয়ে সাধারণভাবে আলোচনা করেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে আবেগ শূন্য। অন্যদিকে সত্যেন সেন কোমল …….. আবেগপ্রবণ ভাবুক প্রকৃতির মানুষ, যা একজন কবি গীতিকারকে মানায়। আমার জানা মতে তিনি দলের উচ্চ পর্যায়ের কোন পদ গ্রহণ করেন নি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী পর্যায়ে সদস্য ছিলেন না। চীন-রুশ দ্বন্দের ফলে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি হওয়ার পর এই ভাবুক মানুষটি চরম অবসাদ গ্রস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হন।
ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির মেডিকেল কলেজের কর্মীদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, রাজবন্দীদের হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কারাগার থেকে কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, শ্রমিক নেতা সুনীল রায়ের সাথে সত্যেন সেনও দীর্ঘ সময় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কারা মুক্তির পরও তাদের চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করতে হয়েছে। তখন অসুস্থ শরীরেও তারা সূত্রাপুরের কমিউন থেকে সারা পথ হেটে হাসপাতালে আসতেন। প্রায় প্রতিদিন তাদের শয্যাপাশে নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের ভীড়, তাদের দুজনের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তারা তারা তাদের দাদু ডাকে এবং কবে আবার ভর্তি হবেন সেজন্য অপেক্ষা করে। বস্তুত:পক্ষে আমাদের চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন পড়ে না।
কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে চীন-রুশ দ্বন্দ্বের জেরে ছাত্র ইউনিয়নে মতপার্থক্য চরমে উঠলে, সম্মেলনের আগে সুনীল রায় ও সাংবাদিক সিরাজুল হোসেন খানের সাথে সত্যেন সেন ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ রাখার বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। প্রথমে সূত্রাপুরের কমিউনে ও পরে সিরাজুল হোসেন খানের বাসায়। এ আলোচনায় সুনীল রায় যতটা সক্রিয়, সত্যেন সেন তেমনি নিরব। তিনি এখন এই দ্বন্দ্বের কারণে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
এর পর সত্যেন সেন প্রধানত: সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করেছেন। অধিকাংশ সাক্ষাৎ হয়েছে ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনের আজিমপুর কোয়ার্টারে, আলোচ্য বিষয় শিল্প ও সাহিত্য। রণেশ দাশগুপ্তর সাথে গড়ে তুলেছেন উদীচী; নিজে সঙ্গীত রচনায় ব্যস্ত। তখন দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে আসছে, স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে, শেষাবধি পাড়ি জমালেন শান্তিনিকেতনে দিদির বাসায়। সেখানেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

আমাদের সত্যেন দা
সাংবাদিক জি. এম ইয়াকুব
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক, অনুজ মাহমুদ সেলিম দিন কয়েক আগে আমাকে ফোন করে জানালো উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেনদার জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ জানালে স্মারক গ্রন্থে জন্য। আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম সেলিমের প্রস্তাবে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবনায় পরে গেলাম। কারণ সাহিত্যিক সাংবাদিক, দার্শনিক সত্যেনদার মত একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব আজীবন বিপ্লবী সম্পর্কে আমি কতটুকুই বা জানি। যা হোক সেলিমের অনুরোধ আমাকে রাখতেই হবে।
বিশাল পান্ডিত্যের অধিকারী সত্যেনদা আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে বহু বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী সাহিত্যিক, সাংবাদিক আজীন বিপ্লবী সত্যেনদা মহা বিদ্রোহের কাহিনী, মানব সভ্যতার উষালগ্নে সরলাদি, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমাদের ভূমিকা, মনোরমা মাসিমা, বিপ্লবী রহমান মাস্টার, আল বেরুনী, মা, সীমান্ত সূর্য-আবদুল গফফার খান, শেয়ানা কুমারজিত, বিদ্রোহী কৈবর্ত সহ অসংখ্য বই লিখে গেছেন সত্যেনদাকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবেন না যে এই লোকটি এত বিপ্লবী ও দার্শনিক। আজীবন বিপ্লবী সত্যেনদার অন্তর ছিল শিশুর মত অত্যন্ত কোমল।
আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনীতিকরা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আমার মনে হয় সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমাদের দেশের সদ্য নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যে ঢালাওভাবে রাজনীতিকদের একহাত নিলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী ও অন্যান্য রাজনৈতিকদের অংশগ্রহণ তথা তাদের অবদানের কথা নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুস সাহেবের জানার কথা নয়। কারণ তিনি একজন লগ্নী ব্যবসায়ী। যাক ড. সাহেবের কপাল ভালো তিনি এখন একাই খোলামাঠে রাজনীতি করে বেড়াচ্ছেন নির্বিঘেœ। রাজনৈতিক দল করবার সুযোগ পেলেন।
যাক ফিরে আসা যাক আমার পরম শ্রদ্ধেয় সত্যেন দা সর্ম্পকে। সত্যেন দা রাজনৈতিক, সাংবাদিক এবং উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিবারের ছোট বড় প্রত্যেক সদস্যের কাছে ছিলেন একজন আপনজন হিসেবে।
আমি ও আমার ছোট বোন অধ্যাপিকা রাজিয়া বেগম সত্যেন দার প্রতিষ্ঠিত উদীচীর সঙ্গে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিলাম। সে সুবাদে আমাদের বেচারাম দেউরীর বাসায় প্রায়ই যেতেন। বাবা সত্যেনদাকে ¯েœহ করে সত্যেন বলে ডাকতেন। বাবা ছোট বোন রাজিয়াকে পড়ানোর কথা বললেন তাকে। সত্যেনদা বিনে পারিশ্রমিকে পড়ানোর জন্য সহাস্য রাজি হলেন। সত্যেনদা কোনদিন কখন পড়াবেন তা আগে থেকেই বলে যেতেন। সময় নিয়মানুবর্তীতা ছিল তার আর একটি বৈশিষ্ট্য। যদি বলতেন অমোকদিন রাত ৭.০০ টায় আসব ঠিক ঘড়ির কাটায় যখন রাত ৭.০০ তখনই দরজায় কড়া নড়ে উঠত, বুঝা যায় সত্যেনদার আগমন। ঝড় বৃষ্টি কোনটাই তার সময়ানুবর্তীতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারেনি। সত্যেনদা মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় রাতের খাবার খেতেন। তার খাবারের মেনু ছিল নগন্য, তিনি একটু দুধ,একটা কলা আর একটা ডিম ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। রাজিয়া পড়ার সময় সত্যেনদাকে অনেক ফাঁকি দিত। যেমন ইংরেজী বানান লিখতে ‘ই’ না ‘আই’ লিখেছে রাজিয়া জিজ্ঞস করলে বলত আই লিখেছি, সত্যেনদা বলতেন াখোনেতো ‘ই’ হবে, রাজিয়া কলম দিয়ে ঘষে বলতো আমিতো ‘ই’ ই লিখেছি। সত্যেনদা হাসি দিতেন এবং বলতেন ঠিক আছে। সত্যেনদা রাজিয়াকে খুব ¯েœহ করতেন, কোন দিন রাগ করতে দেখিনি তাকে। মাঝে মধ্যে সত্যেনদার চশমায় ধুলো ময়লা জমে কিছুই দেখতেন না তিনি, তখন রাজিয়া পরিস্কার করে দিত। তিনি বলতেন রাজিয়া তুমি ঐ গানটি কর, রাজিয়া খুব দরদ দিয়ে গাইত, “আমি মানুষেরে ভালবাসি…………….এই মোর অপরাধ” আরেকটা গান সত্যেনদার পছন্দ “আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দ্বীবস……………..জ্বেলে দিবস”। সত্যেনদার এক দুর্ঘটনার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সেবা করার। সত্যেনদার সঙ্গে আমি অনেকদিন অনেক বাসায় গিয়েছি, এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে মহান ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী সত্যেনদা সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। আজ সত্যেন দা ও নেই আমার ছোট বোন রাজিয়া ও আর ইহ জগতে নেই।
উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন দা
মোনায়েম সরকার
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দুটি বছর ইতিহাসের আলোকে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই আমরা বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করতে শুরু করেছিলাম, পাকিস্তান কাঠামোয় থাকা আমাদের অসম্ভব। হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির গৌরব, স্বাতন্ত্রবোধকে স্বকীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করার প্রয়োজনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম ছিল অপরিহার্য। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৬৯ গণঅভ্যূথান সংগঠিত হয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মের মূলমন্ত্র ছিলো বাঙালিত্বের অহংকার। ভাষা আন্দোলন থেকে ‘৬৯-এর গণঅভ্যত্থান, এরপর ‘ ৭০-এর নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ- এ সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা অবিস্মরনীয়। বিশেষ করে ষাট এবং সত্তরের দশকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের পরিচয়ে আমরা রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে গেছি। আইয়ূব সরকার যখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে তখন আমরা বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠক গড়ে তুলি, এ সংগঠনগুলোকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছি কাঙ্খিত গন্তব্যে। বঙ্গবন্ধু ৬-দফা পেশের পর আমরা ‘নির্ঝর’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি যার সভাপতি ছিলেন কবি জসিম উদ্দীন। বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কয়েকজন নেতা নির্ঝরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা আমেনা বেগম, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, ন্যাপের পীর হাবিবুর রহমান এবং আমিসহ আরো অনেকে। ঐ সংগঠনের আড়ালে আমরা রাজনৈতিক বৈঠক ও করতাম। নির্ঝর নামে একটি একুশে সংকলনও বের করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। গান, নাটক, গীতি-নকশার মাধ্যমে গণমানুষের চেতনা শাণিত হয়েছে, মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। সত্যেন সেন এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বহু গনসঙ্গীত রচনা করেন। যা সেই সময় বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হতো।
সত্যেন দা প্রথমে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং কিছু সংখ্যক সংস্কৃতিমনা লোকের সঙ্গে আলোচনা করেন, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। বাঙালীর আবহমান সংস্কৃতির ধারক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আমি এখন ২৩, চামেলী বাগের যে বাড়িতে থাকি, সে সময় এ বাড়ির আঙ্গিনায় একটি টিনের ঘর ছিলো আমাদের আস্তানা। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে এ বাড়ির ভূমিকা কি পরিমান গুরুত্বপূর্ন ছিলো, তা দেশের সব রাজনৈতিক নেতাই কম বেশী জানেন। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই বাড়ি। উনিশ’শ আটষট্রি সালের ২৯ সে অক্টোবর সেই টিন সেডের বাড়িতে সৃষ্টি হয় উদীচী’র। এই সংগঠনটি শুধু সেই সময়েই নয়, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পূনরুত্থান-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে উদীচী। আজো তা অব্যাহত রয়েছে।
উদীচীর জন্মলগ্নে আমাদের জন্য এ ধরনের একটি সংগঠন খুব জরুরি হয়ে পড়ে। ছোট-খাটো সংগঠনের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আমাদের কাজ চলছিলো ঠিকই, তা সত্ত্বেও আমরা উপলব্ধি করছিলাম আরো বড় একটি গণসংগঠন প্রয়োজন। সে সময় আমাদের ডেরায় নিয়মিত আসতেন সত্যেন সেন, রণেশ দাস গুপ্ত, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মনজুরুল আহসান খান, কামরুল আহসান খান, মোস্তফা ওয়াহিদ, একরাম আহমদ, হেলেন করিম, রিজিয়া, তাজিম প্রমুখ। ‘৬৯-এর অক্টোবরে ন্যাপের সহযোগী সংগঠন কৃষক সমিতির একটা অনুষ্ঠান হয় মুন্সিগঞ্জে। সেখানে গনসঙ্গীত পরিবেশনের পরিবেশনের জন্য শিল্পী দরকার। এমনিতে শিল্পীর অভাব ছিলো না। সে সময়কার শিল্পীরা আমাদের আমন্ত্রনে অংশ নিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, কোনো সন্মানি ছাড়াই। কিন্তু সংগঠিত কোন দল ছিলো না। মুন্সিগঞ্জের সে অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে সত্যেন দা প্রস্তাব দিলেন শিল্পীদের একটা দল গড়ে তোলার। আর সে দলের নাম হলো উদীচী। এর নামকরন নিয়ে মজার এক ঘটনা ঘটে।
আমাদের আস্তানাকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছিলো, সে আন্দোলনের কর্মীদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকার উত্তর অংশের। ভোরে উত্তরের আকাশে এক তারা উঠে, যার নাম উদীচী। সত্যেন দা এ আলোকেই সংগঠনের নাম রাখলেন উদীচী। কামরুল আহসান খানকে আহ্বায়ক করে সত্যেন দা সহ কয়েকজনকে সদস্য করে উদীচীর প্রথম আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। পরবর্তীতে সত্যেন সেনকে সভাপতি এবং মোস্তফা ওয়াহিদকে সাধারন সম্পাদক করে উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয়। তারপর পর সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন একরাম আহমেদ, যিনি বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান। এই উদীচীর কার্যক্রম চালাতে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। আমাদের টিনের ঘরে শিল্পীরা মহড়া দিতেন, তাতে বাধ সাধলো আমাদের পাড়ার মসজিদের মোল্লারা। আশেপাশের বাড়ির লোকদের দিয়ে তারা বলাতে লাগলো, আমরা নাকি ইসলাম বিরোধী কাজ করছি। তারা বহু চেষ্টা করেছে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার, কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তাদের অপচেষ্টা নশ্যাৎ করেছি আমরা। আর তা করার মতো মনোবল এবং দৃঢ়তা আমাদের ছিলো। গোটা দেশ তখন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তপ্ত উনুনের মতো হয়ে আছে। অনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে চলছে রাজধানী সহ সারাদেশের মানুষ। মোল্লাদের ভন্ডামি আর ধর্ম ব্যবসার কাছে পরাজিত হবার কোনো সুযোগ আমাদের ছিলো না। অত্যাধুনিক অস্ত্র তাক করে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা ভয় পাইনি, লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস সহ্য করে অটল ছিলাম পাকিস্তানি দু:শাসনের বিরুদ্ধে। স্লোগানে প্রকম্পিত করেছি রাজপথ। সেই নিবেদিত প্রান কর্মীদের মোল্লারা কি ঠেকিয়ে রাখতে পারে? হাজারো তরুন-যুবকের বুকে আগুন, হৃদয়ের আশা- আকাঙ্খা জ্বালাময়ী স্লোগান হয়ে ঝড়ে পড়ার দিন ছিলো তখন। একপর্যায়ে বাড়ির মালিক রহিমা চৌধুরানী অনুরোধ করলেন, বাবারা আমারতো পাড়ার লোকদের সঙ্গে থাকতে হবে, তোমরা রিহার্সেল অন্য জায়গায় করার ব্যবস্থা করো। আমরা বাধ্য হয়ে তৎকালীন ন্যাপের কেন্দ্রীয় অফিস ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে নিতে বাধ্য হলাম। সেখানেই রিহার্সেলের কাজ চলতো পাকিস্তান আমলে। স্বাধীনতার পর ন্যাপের কেন্দ্রীয় অফিস উশ্রী বিল্ডিং ( প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকে)-এ উদীচীর অফিস ও রিহার্সেলের কাজ চলতে থাকে। পরবর্তীতে উশ্রীর পূর্বপাশের বিল্ডিংয়ে সরকারের অনুমোদন নিয়ে বর্তমান ঠিকানায় অফিস স্থানান্তরিত হয়।
এই দীর্ঘ কাল পর্বে উদীচীর সভাপতির পদ অলন্কিত করেছেন বহু গুণীজন। তাদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত, কলীম শরাফী, পান্না কায়সার, হায়াৎ মাহমুদ, হাসান ইমাম, যতীন সরকার, গোলাম মোহাম্মদ ইদু এবং কামাল লোহানী। সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাহমুদ সেলিম তার লেখা ‘ইতিহাস কথা কও’ গীতি আলেখ্য বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। এমনকি সিডিতেও ধারণ করা হয়েছে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠন গড়ে তুলেছে এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে সংগঠনের শাখার সংখ্যা প্রায় চারশত…..। আজ সত্যেন দা বেচে নেই কিন্তু তার অমর সৃষ্টি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সগৌরবে পৃথিবীর দেশে দেশে সংস্কৃতিতে অনন্য ভুমিকা রেখে চলেছেন। এই সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। উদীচীর কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ সত্যেন দার জীবন ও কর্ম সম্বলিত স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে জেনে অসুস্থ শরীরে আমার সামান্য কিছু বক্তব্য তুলে ধরলাম। সত্যেন দার অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার লেখা শেষ করছি।

আমাদের সত্যেন দা
কাজী মোহাম্মদ শীশ
সত্যেন দা আমার। সত্যেন দা আপনার। সত্যেন দা সবার। সবার মাঝে কথাটা সত্য বটে। তবে বেশি ভাবে কথাটা বিরাজ করছে তাদের মাঝে, য়ারা উদীচী করেছেন, উদীচী করছেন, উদীচী করবেন। সময়ের আবর্তনে এঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন সত্যেন দার সহকর্মী ও সাথী। তাদের সুযোগ ঘটেছে তার সান্নিধ্য লাভ করায়। ঘনিষ্টভাবে তার সাথে পরিচিত হওয়ার। আবার কারও কারও সৌভাগ্য হয়েছে তাকে দেখার; সল্পভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় লাভের। আর যারা নতুন প্রজন্ম তারা যেমন নিজের প্রচেষ্টায় তেমনি উদীচীর মাধ্যমে এই মহান ব্যক্তিকে জানার কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে উদীচী সাথে জড়িত নন তেমন সুধীজনেরাও এই সংগ্রামী মানুষটির নিরলস কর্মকে, দর্শন ও আদর্শকে জানার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাই অবশ্যই উদীচী এবং উদীচীর বাইরে বাংলাদেশের সকল প্রগতি ও চিন্তাশীল মানুষের কাছে একটি প্রিয় নাম সত্যেন সেন। মানুষের হৃদয়ের মাঝে সত্যেনদার পৌঁছে যাওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া জীবনের সে কথা জানার সামান্য প্রয়াস আমরা নিতে পারি।
বিভাগপূর্ব এই উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, মানব মুক্তির এক্গ্র সন্ধানী, প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, বাংলাদেশ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা সোনা রং নামে বাংলাদেশের এক গ্রামে। বাংলাদেশে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যের অধিকারী বিক্রমপুর জনপদ। এটি ছিল প্রাচীন বঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এক সময় দক্ষিন-পূব বঙ্গের প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। পশ্চিমে প….., উওর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিনে আড়িয়াল ও মেঘনার সংযোগ স্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে নিয়ে বিক্রমপুর গঠিত ছিল। তবে প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুর প্রায় ধ্বংশ হয়ে গেছে। বর্তমানে যা আছে তা হল ঢাকা বিভাগের মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রাচীন বিক্রমপুর জেলা অংশ। এই মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি থানার সোনারং গ্রামে শান্তিকুটির নামে এক বাড়িতে বিখ্যাত সেন পরিবারে সত্যেন সেনের জন্ম। তার বাবা ধরিত্রী মোহন সেন, মা মৃণালিনী সেন চার ভাই-বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সত্যেন সেন। অন্যরা হলেন ইন্দুবালা সেন, প্রতিভা সেন ও জিতেন্দ্র মোহন সেন। সোনারং গ্রামটি যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি সেন পরিবারও এক বিখ্যাত পরিবার। উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত ব্যক্তি এই পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন। প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক খোকার দপ্তর এবং মোহন ভোগের লেখক মনেমহন সেন হচ্ছেন সত্যেন সেনের বড় ঠাকুরদার ছেলে। বিশ্বভারতীর একসময়ের আচায্য ক্ষিতি মোহন ছিলেন তার কাকা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ভাগ্নে। এছাড়া শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে এই পরিবার অনেক কৃতি সন্তান বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সোনারং গ্রামের স্কুলটি সেন পরিবারের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এমন একটি জন্ম নেয়া সত্যেন সেনের জীবন কালে স্বদেশে ও বিশ্বে ঘটে গেছে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উথান পতনের ঘটনা। সেই সব ঘটনার সাযুজ্য যেমন সত্যেন সেনের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলে, তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায় মানব মুক্তির আন্দোলনে শরীক হওয়ার। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী মুক্তি সংগ্রামের দিকটার প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখব, ১৯০৭-১৯৩৫ সময়ে অর্থাৎ ক্ষুদিরাম থেকে মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি পর্যন্ত বাংলার তরুণ সমাজ সশস্ত্র সংগ্রামের (তখন এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী অভ্যুদয় নামে আখ্যা দেয়া হয়েছে) মাধ্যমে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রায় সমসাময়িককালে (১৯১৬, ১৯২০ এবং ১৯২২ সালে) এই পৃথিবীর আর এক প্রান্তে আয়ারল্যান্ডে একই ইংরেজ শাসক শক্তির বিরুদ্ধে আয়রিশ অভ্যুদয়ের রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে। আবারও প্রমাণিত হয়, অত্যাচারীর খড়গ সাদা, কালো, বাদামিÑ সব রঙের মানুষের লাল রক্তে কলুষিত হয়েছে বার বার। এমনকি কারাগারে আবদ্ধ বন্দীদের ওপর অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এই ভারতবর্ষে ও আয়ারল্যান্ডে একই রকম ছিল। এ প্রসঙ্গে মুক্তি সন্ধানী চিন্তাবিদ রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর ‘আইরিশ, বাংলা, সিয়ান ও ক্যাসি’ নিবন্ধে লিখেছেনÑ ‘(আইরিশ) স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক টেরেন্স ম্যাকসুইনি কারাগারে রাজনৈতিক মর্যাদা আর দেশের মুক্তির দাবীতে পঁচাত্তর দিন অনশন করে প্রাণ দিয়েছিলেন। ইংরেজ রাজত্ব উচ্ছেদের প্রচেষ্টায় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বাংলার যতীন দাস একই ধরনের দাবিতে কারাগারে চৌষট্টি দিন অনশন করে যখন প্রাণ দিলেন, তখন বাংলার যৌবনের মর্মভূমিতে যতীন দাস-ম্যাকসুইনি যমজ ভাইয়ের মত আসীন হয়েছিলেন।’ এমনই এক পরিস্থিতিতে-পরিবেশে গত শতাব্দীর বিশ দশকের শেষের দিকে সত্যেন সেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী যুগান্তর দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। আরও সব বড় ঘটনা যা তাঁর উপলব্ধিতে নাড়া দিয়েছে, বিবেককে তীক্ষè করেছে, মর্মে পীড়া দিয়েছে, কর্মে উৎসাহিত করেছে, সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেছে, প্রতিবাদ করার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলেছে তারও ব্যাপ্তি বিশাল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বিশ্বজুড়ে প্রগতিশীর শিল্পী-সাহিত্যিক ও সচেতন মানুষের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশে ইংরেজি ১৯৪৩ বাংলা ১৩৫০ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ, পাকিস্তানী শাসকদের ২৩ বছরের অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাÑ এসবের মধ্য দিয়ে খাঁটি সোনার মানুষ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন সত্যেন দা। রাশিয়ার স্বেচ্ছাচারী জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার প্রস্তুতি পর্বে ছিল রুশ তরুণ-তরুণীর বোমা ও ডিনামাইট আক্রমণের একটি অধ্যায়। আয়ারল্যান্ডের মতো এই আন্দোলনও বাংলার যুব সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করেছিল। তবে ১৯১৭ সালের অক্টোবরের রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। একইভাবে বিশ দশকের সশস্ত্র অভ্যুদয়ে অনুপ্রাণিত যুগান্তর দলের সত্যেন সেন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রাম ও প্রগতিশীল আন্দোলন করার জন্য তাঁকে নানা নিগ্রহ সহ্য করতে হয় এবং বার বার তিনি কারাবরণ করেন। প্রথমবার কারারুদ্ধ হন তিন মাসের জন্য, ১৯৩১ সালে। দ্বিতীয়বার টানা পাঁচ বছর ১৯৩৩-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। এই কারাবাসের সময় তিনি কমিউনিজমে দীক্ষিত হন। কারামুক্তির পর তাঁর কাকা ক্ষিতিমোহন সেন শান্তি নিকেতনে, বিশ্বভারতীতে ভাষাতত্ত্বের ওপর গবেষণার জন্য একটি স্কলারশীপ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। সত্যেন সেন তখন কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ নিয়ে সংগঠনের স্বপ্নে বিভোর। তিনি এই স্কলারশীপ গ্রহণ না করে নিজ গ্রামে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিশ্বপটে তখন ফ্যাসিস্ট শক্তি উত্থান ঘটেছে। সেটা ১৯৩৫ সাল। বিশ্বমানবকে ধাওয়া করেছে এক মহা দুর্যোগ। হিটলার জার্মানিতে হত্যা-বই পোড়ানোর মতো প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি ইতালিতে প্রগতিকামী গণতান্ত্রিক শক্তির কণ্ঠরোধ করে আবিসিনিয়া আক্রমণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। জাপানও ভয়াবহ আক্রমণাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৩৬ সালেন মাঝামাঝি সময় স্পেন প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেনারেল ফ্রাংকো বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিশ্ববাসী আরও এক ফ্যাসিস্ট আক্রমণের নগ্নরূপ দেখতে পাই। মানবজাতিকে হিটলার মুসোলিনির ঘৃণ্য থাবা থেকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবীর অগ্রগণ্য শিল্পী-সাহিত্যিকরা ১৯৩৫ সালে প্যারিস শহরে অনুষ্ঠিত এক মহাসম্মেলনে ‘ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন অব রাইটার্স ফর দ্য ডিফেন্স অব কালচার এগেইনস্ট ফ্যাসিজম’ গঠন করেন। অন্যদিকে স্পেনে গড়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট বিরোধী পপুলার ফ্রন্ট। বিশ্বজুড়ে এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ভারতবর্ষেও লাগে। গঠিত হয় সর্ব ভারতীয় এবং বিভিন্ন অঞ্চল পর্যায় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’। ঢাকাতেও ‘ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ গঠিত হয়। এই সংগঠনের অন্যতম সংগঠন ও সম্পাদক সোমেন চন্দ ঢাকার সূত্রাপুরে আয়োজিত ফ্যাসি-বিরোধী সম্মেলনে যোগ দানের উদ্দেশ্যে একটি মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষীবাজারের কাছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে নিহত হন ১৯৪২ সালে। সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সংগঠক হিসেবে যাদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাদের পুরোধাদের অন্যতম ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন প্রমুখ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে ইংরেজ রাজত্বে বাংলাদেশে মনুষ্যসৃষ্ট এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। পঞ্চাশের সেই (বাংলা ১৩৫০ সাল) মন্বন্তর খাদ্যাভাব ও অসুখ-বিসুখে বহু লোক মারা যান। দুর্গত মানুষের সেবায় সত্যেন দা ত্রাণকাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। গান লিখে, গান গেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করেন। তাঁর লেখা গান জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁর কর্মজীবনের এক পর্যায়ে সত্যেন দা গড়ে তুলেছিলেন একটি গানের দল। ১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘ দশ বছর বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে, শ্রমিক জমায়েতে এই দলটি দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করত। আরও পরে ১৯৬৮ সালে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সত্যেন সেন প্রতিষ্ঠা করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। দেশে-বিদেশে নানা শাখা বিস্তৃত সত্যেন দা’র চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল চিন্তাধারায় সম্পৃক্ত সংগঠনটি বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক চর্চা ও প্রসারের কেন্দ্র। চল্লিশ দশকে সত্যেন দা প্রচুর গান রচনা করেন। সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে সত্যেন সেন অনেক জনপ্রিয় গণসংগীত রচনা করেন। সত্যেন সেনের গানগুলো সঠিকভাবে আজও সংগৃহীত হয়নি। তাঁর লেখা স্বল্প সংখ্যক গান কেবল আমরা শুনতে পাইÑ এটা বড়ই দুঃখের বিষয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মী বিশেষ করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের ওপর শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার-নিপীড়ন বেড়ে যায়। সত্যেন সেনকে বার বার কারারুদ্ধ করা হয়। কখনো বা তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হয়। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান পর্যায়ে সত্যেন সেনের কারাবন্দী জীবন শুরু হয়। এভাবে পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলে তিনি ১৩ বছরেরও বেশি সময় কারাভোগ করেন।
ছেলেবেলা থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় সত্যেন সেন নিয়োজিত ছিলেন। তবে তাঁর সাহিত্য সম্ভারের এক বিপুল অংশই তিনি কারাগারে অবস্থানকালে সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে কারাবাসকালে প্রথম উপন্যাস ‘ভোরের বিহঙ্গী’ রচনা করেন। তবে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘মহাবিদ্রোহের কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। ‘ভোরের বিহঙ্গী’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। সত্যেন সেনের এই পর্যন্ত প্রকাশিত ৪১টি গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালের দিকে। গভীর মননশীল মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে জীবনমুখী সাহিত্য রচনা করে গেছেন তিনি। সাহিত্য কর্মে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬৯ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৬ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) পান।
সত্যেন সেনের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ ও কর্মবহুল। স্বল্প পরিসরে তার খুব সামান্য অংশ উল্লেখ করা সম্ভব। তাঁর জীবন চর্চাকে উপলব্ধির মধ্যে ধারণ করাই মানুষটাকে জানা-চেনার অন্যতম উপায়। সদাব্যস্ত, মুক্তিসন্ধানে অবিরাম পথচলা সত্যেন দা কোন নির্দিষ্ট পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেননি। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা করেছেন, তবে তা বিরতিহীন নয়Ñকয়েক পর্যায়ে। অকৃতদার সত্যেন দা অবশ্য নিজের পেশা সম্বন্ধে লিখেছেন, “লেখা আমার পেশা, আমার জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায়।” তিনি তাঁর এন পেশায় আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন।
কারাবাসকালে সত্যেন সেনের চোখের পীড়া দেখা দেয়। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময় জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার চোখের জ্যোতি ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। সেই অবস্থায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে নিয়োজিত হন। চোখের পীড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭২ সালে চিকিৎসার জন্য মস্কো গমন করেন। সেখানে সত্যেন সেনের সাথে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাদের সাথে দেশ-সমাজ-বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। দেশে ফেরার পর তার সে অভিজ্ঞতা কলাম আকারে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি উদীচী পুনর্গঠনের কাজ ও সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত হন। কিন্তু ক্রমশ তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তিনি অন্ধত্বের দিকে যেতে থাকেন। এই অবস্থায়, সবার অনুরোধে এবং তাঁর মেজদিদি প্রতিভা সেনের আমন্ত্রণে ১৯৭৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। তবে দৃষ্টিহীন অবস্থায় শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে তিনি লেখার কাজ চালিয়ে যান। দীর্ঘদিন পরবাসে থাকাকালে প্রতিভা সেনের আশ্রয়ে শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে অকৃতদার সত্যেন সেন আমাদের ছেড়ে চলে যান। শিল্পী, সংগ্রামী, ত্যাগী এই মানুষটির কথা বাংলার মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। খ- ৯, প্রকাশক: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ৫, ওল্ড সেক্রেটারিয়েট রোড নিমতলী, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১ পৃষ্ঠা: ২৯৬-২৯৮
২. প্রাগুক্ত: খ- ১৪, পৃষ্ঠা ৬১-৬২
৩. সত্যেন সেন মহাজীবনের রূপকার, সত্যেন সেন জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি: প্রকাশকাল ২০০৬, রচনা: মাহাবুবুর রহমান, প্রকাশনায়: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদ

সত্যেনদার কিছু স্মৃতি
আমেনা আক্তার
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আজীবন বিপ্লবী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেনের জীবন ও কর্ম সমন্দে আগে কিছুই জানা ছিলনা আমার। তবে অল্পকিছুদিন সত্যেনদা যেভাবে দেখার বা জানার সৌভাগ্য হয়েছিল তারই দু, একটি স্মৃতি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
১৯৫৬ সালের সুখ-দুঃখের স্মৃতি লক্ষ্রীবাজারের গোপন আস্তানায় কমিউনিস্ট পরিবারের ভাই-বোনেরা ঐ আস্তানা বদল করে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলেগেলেন। এর পর ঘরে টুকটাক জিনিসপত্র যা ছিল তা নিয়ে পাতলা খান লেনে দেড় রুমের একটি বাসা ভাড়া করে আমরা সেখানে চলে গেলাম। সেখানে কিছু দিন থাকার পার্টি থেকে নির্দেশ আসলো পার্টি থেকে এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় সেল্টার নিতে হবে। এখন বাড়ির মালিক খালাম্মাকে বলা হল জানুয়ারির এক তারিখে বাসা ছেড়ে দিন বাসা ছাড়ার কথা শনে তিনি বললেন তোমরা কোথায় বাসা বাড়া নিয়েছগো, “বললাম মালিবাগের দিকে হবে হয় তো? তিনি তখন বললেন “ওমা অত দুর; সে তো গ্রাম ওখানে শুধু ধানক্ষেত আর জঙ্গলে ভর্তি রাত হলেই শিয়াল ডাকে। তুমি ঐ বন জঙ্গলের মধ্যে থাকতে পারবে তো? বললাম থাকতে পারবো আপনি দোয়া করবেন”। কমরেড আফজাল হোসেন প্রামনিক (চাচা) তিনি তার পুরানো খবরের কাগজের বস্তা ও খুটিনাটি জিনিসপত্র ঠেলা গাড়িতে তুলে দিলেন, এর পর আমরা রিকসা করে চলে এলাম মালিবাগের রাস্তা থেকে ভিতরে এক নির্জন গ্রামে। রাত্রি হলেই জঙ্গলে শিয়ালের ডাকাডাকি শোনা যেত, এই বাড়ির চার কোণায় চাটি টিনের চৌরি চার ছিল মধ্যেখানে উঠোন ছিল আর ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে আম-কাঠালের বাগান ছিল। ঘরগুলোর মাটির মেঝে……………. অপরিস্কার মাটির চুলা তা ভেঙ্গে রেখে গেছে কেউ। এসব ঘর-দোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে নেয়াহল। গোসলখানা ছিল একবারে খোলা জায়গায় এক চিলতা খলপার ভেড়া দেয়া ছিল। কাপড় দিয়ে আড়াল না করলে সেখানে গোসল করা সুবিধা হত। ল্যাটিন ছিল ঘর ছেড়ে অনেক দুরে জঙ্গলের ভিতর সেখানে যেতেও ভয় লাগত ঐ পরিবেশের মধ্যে অন্যকমরেডদের সঙ্গে আরও যে দু,জন নতুন কমরেড আসলেন তখন দেখলাম একজনের মাথায় ধবধবে সাদা চুল পরিচ্ছন্ন লুঙ্গি গেঞ্জী পরা, অন্য জন খুবই সাধারণ লুঙ্গি পরা, খালি গা, খালি পা কতদিন মাথায় চিরুনী পড়েনি, তিনি গুন গুন করে গান করতে করতে রান্না ঘরে নাস্তা খেতে বসে কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বললেন না চুপচাপ নাস্তা খেয়ে রুমে চলে গেলেন।
এর পর কমরেড নেপাল নাগ ‘রহমান ভাই’ তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন আমিন ভাই অন্যজন শাহাজান ভাই। নেপালদা আরও বললেন ওনারা এখন থেকে তোমাদের সঙ্গেই থাকবেন, তিনি ………… …….. বললেন অনারা খুবই ভালো মানুষ, আমার থেকেও ভালো। এ কিছু দিন পর জানতে পারলাম একজন কমরেড অনিল মুখার্জী, অন্যজন কমরেড সত্যেন সেন। তখন থেকে জেনেছিলাম সত্যেন দা সারা জীবন গ্রাম থেকে গ্রামের মেঠো পথের দুরন্ত ছিলেন, তিনি শুধু দেশ আর দেশের দিনহীন মানুষের জন্য ছিলেন নিবেতি প্রাণ। নিজের আরাম আয়েসের কোনো রকম ভাবনা করেননি এর পরও তাকে জেলজুলুম পোহাতে হয়েছে এবং আন্দামনে নির্যাসিত হয়েছিলেন তিনি। সত্যেনদার খাবারের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। ইচ্ছা থাকলেও ব্যবস্থা করার মত উপায় ছিল না। তিনি প্রায় সময় আমলকির আচার দিয়ে ডাল ভাত খেতেই পছন্দ করতেন, দেখতাম সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়ার সময় ঢিলাঢালা শার্ট পায়জামা এবং কতদিনের সেন্ডেল পড়ে কাপড়ের থলে কাধে ঝুলিয়ে তিনি তার কর্মস্থলে বের হয়ে যেতেন। দেখতাম ডেরার ভিতরে সরু গলি পথ ছিল ঐ পথেই সকাল বিকাল তিনি আমার বাচ্চার হাত ধরে পায়চারী করতেন আর গুন গুন করে গান করতেন দাদার চলা-ফেরা, পোশাক আশাক দেখে কখনই বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি জনমানুষের এত বড় নেতা। এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করলাম তা হল এশিয়া সর্বপ্রথম অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী হন তিনি হলেন কমরেড সত্যেন সেনের জীবিত মামা ড.অমত্য সেন। সত্যেন দা একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন তুমি কোথা থেকে পড়ালেখা করেছ? তখন আমি কি বলব কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না, দাদা তখন বললেন, কোন অসুবিধা নেই তুমি বল। আমি তখন বললাম, চুপিচুপি গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যেতাম, ও পাঠশালার সবদের পন্ডিত আমাকে পড়াতেন। আর ঘরে বাবা পড়াতেন তখন দাদা প্রশ্ন করলে চুপিচুপি পড়তে যেতে? তখন আমি তো রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে সে কারণে স্কুলে যাওয়া কারণ ছিল। তখনই সত্যেন দা আমাকে বললেন, তোমাকে এখন থেকে আরও ভালো করে পড়ালেখা শিখতে হবে। তা না হলে পৃথিবী সমন্ধে জানতে ও বুঝতে পারবে না। এখন থেকে লেখা পড়া শুরূ করবে, তুমি আর গফুর সময় করে আমার কাছে বসবে। তারপর থেকে দাদার কাছে মাঝে মাঝে বসতাম। তিনি তখন বুঝাতেন ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য কি এবং সমাজতন্ত্রে কীভাবে অগ্রসর হব তিনি সে কথা আমাকে বুঝাতেন, দেশের সব মানুষ যখন সুযোগ-সুবিধা, অধিকার সমানভাবে ভোগ করে কেউ কারো চেয়ে ছোট বড়, উচু নিচু থাকে না তখনই দেশে সমাজতন্ত্র আসে। এখন গণতন্ত্রের সিড়ি বেয়ে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি লক্ষ্যে আমরা পৌছাবোই। দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম সমাজতন্ত্র আমরা কি দেখে যেতে পারবো ? তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমরা দেখতে না পারলেও তোমাদের নাতির ঘরের পুতিরা তো আশা করি অবশ্যই দেখতে পারবে। তিনি আরও বুঝালে, জানো আমার এক বোন ছিল সে কিন্তু অনেক বয়সেও উননের (ফুলার) পাশে বই রেখে পড়ালেখা করে এম. এ পাশ করেছিলে, ইচ্ছা থাকলে সব বয়সেই লেখাপড়া করা যায়। তুমি কেন পড়বেনা। এর পর তিনি বললেন, এখন থেকে তোমার কোন স্মরণীয় ঘটনা যা তোমার মনে আসে তাই লিখে আমাকে দেখাবে। চেষ্টা করলে মানুষ অনেক কিছু শিখতে ও জানতে পারে। তুমি কেন পারবেনা। লেখা দেখানোর সৌভাগ্য আমার আর হয়নি, দুরভাগ্য আমার।
১৯৫৭ সালের আইয়ুব খানের শাসন আমলে দেশে তখন খাদ্য সংকট। পার্টির পরিবার গুলো মধ্যেও অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে গেল ফলে শুরু হলো সকালে এবং রাতে আটার রুটি খাওয়া। সন্ধ্যা বেলা রুটি গুলো ভাজা হতো বলে অধিক রাতে রুটি গুলো শক্ত হয়ে যেত। ফলে কমরেডদের এগুলো খেতে খুব কষ্ট হতো। একদিন সত্যেনদা কমরেড সত্যেন সেন, রুটি সেকার নতুন নিয়মটি সেখালেন। যেমন গরম তাওয়াতে রুটি এপিঠ ওপিঠ অল্প সেকে খুন্তির মাথায় গেথে চুলার আগুনের উপর ধরলে রুটি ফুলে উঠবে এবং রুটিও নরম থাকবে। এ নিয়মে পাতা পোড়ানো আগুনে সেকতে গেলেই রুটি কালো হয়ে যেত। তথাপি ঐ কালো রুটি দাদারা খেতেন। দু, বেলা রুটি কি দিয়ে খাবেন সেটাও একটা ব্যাপার ছিলো অবএব ঐ বাড়ির ভিতরে অনেক ঝংলী কচু ছিল। ঐ কচু শাক কেটে এনে রান্না করা হত তাই দিয়ে রুটি খেতে সবাই। এখানে একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ না করে পারছিনা। আমাদের পাশেই থাকতেন ক্যালকেশিয়ান পরিবার। ভদ্রমহিলা কচু কাটতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন এ শাক দিয়ে কি করব। তাকে জানালাম এগুলো রান্নআ করে খাব। শুনে তিনি অবাক হলেন। এর পর একদিন শাক রান্না করেও পাঠালাম। তারপর তিনি জেনে নিলেন রান্নার পদ্ধতি। এরপর তিনিসহ আরও কয়েকজন মিলে কচুশাক কেটে নিয়ে গেলেন। এরপর আমিন ভাই সত্যেনদার শূন্য কচু ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন তোমার বন্ধুদের কি রান্না শেখালে যে তোমার শাকের ক্ষেতে একেবারে বিরানভূমিতে পরিণতি করে দিয়ে গেলেন ঐ সময় আমাদের খাদ্য তালিকায় ছিল কচুশাক লাউ ঘন পাতলা মশুরে ডাল। তবে বিভিন্ন জেলার নেতারা এলে মাছ বা মাংসের ব্যবস্থা থাকত। সত্যেনদা আমাকে একটি গান লিখে দিয়ে তোমরা মেয়েরা যখন আন্দোলন করতে রাস্তায় নামবে তখন হারমোনিয়াটা গলায় ঝুলিয়ে রাজপথে ঐ গানটি গাইবে, দেখবে তোমাদের মিছিলে অনেক লোক জড়ো হবে। অবশ্য পুরোটা গান আমার মনে নেই ভুলভ্রান্তি আছে। তার পরেও লিখে দিলাম।
মেয়েরা জাগো জাগে
মেয়েরা জাগো জাগে,
পুরুষের হাতে গড়া …… বিধানে
কাড়া গৃহে নন্দিনী নারী,
মেয়েরা জাগো জাগো,
তোমাদের পাদ ভারে কেঁপে যাক ধরণী
ভেঙ্গে জাক জীর্ণ একাড়া
ভেঙ্গে জাক জীর্ণ একাড়া
মেয়েরা জাগো জাগে
মেয়েরা জাগো জাগে,
এভাবেই কমরেড সত্যেনদাকে দেখার ও জানার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

আমাকে তুমি অশেষ করেছ
মালেকা বেগম
প্রিয় সত্যেন দা, আজ আপনি নেই বলে আমার মতো অনেকেরই শান্তির আশ্রয় নেই। আপনি কেন জানি ‘তুমি’ বলেননি প্রথমে। একচোট চেচাঁমেচি করে সেই যে ‘তুমি’ আর ‘বোনটি’ আদায় করলাম সে আর ঘোচেনি জীবনভর। দাদা বলে ছুটে গিয়েছি আপনার কাছে নানা পরামর্শের জন্য। নারী আন্দোলনের কর্মকা-ে আপনার অনেক সহায়তা পেয়েছি। হেলেন আপনার কথা বলেছে নানা সময়ে। আপনার কথা জেনেছি হেনা আলম-এর কাছে। মনোরমা মাসিমা বলেছেন। সুফিয়া কামাল খালাম্মা বলেছেন। সবই আপনাকে ঘিরে, আপনার জীবিত সময়ের স্মৃতি চারণের কথা। আপনার বইগুলো সংগ্রহ করে পড়েছি। সেতো কোন আলের হরফ পড়া নয়। সে পড়া পড়েছি আপনার হৃদয়ের হীরা-দ্যুতির ছটায় দীপ্ত জীবন সংগ্রামের কথা। সজীব হয়ে আছে আজও। কারাগারে বসে লেখাগুলোর মধ্যে যে জীবন দীপ্তির ছটা আপনি ছড়িয়েছেন, যে বিদ্রোহ-বিপ্লবের কাহিনী আপনি শুনিয়েছেন, যে শোনিতধারা আপনি নাটকের হৃদস্পদনের মধ্যে বইয়ে দিয়েছেন আপনি; তা বয়ে চলেছে আজও প্রজন্ম-উত্তর প্রজন্মের হৃদয়ে। যেদিন জানলাম আপনি জন্মেছেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ বিক্রমপুরের সোনারঙ গ্রামে ‘শান্তিকুটির’ নামে একান্নবর্তী পরিবারের বাড়িতে। আপনার বাবা ধরণীমোহন সেন প্রত্মতত্ত্ব চর্চা করতেন। আপনি পড়তেন ‘সোনারঙ’ স্কুলে। আপনাদের বাড়িটি ছিল গ্রামের বাইরে। ভাই-বোনরাই পরস্পরের খেলার সঙ্গী ছিলেন। কি চমৎকার শৈশব ছিল, কৈশোর ছিল আপনার। চালতা গাছের ওপরে মাচা বেঁধে পড়াশুনা করতেন, গানের চর্চা করতেন- সেসব স্মৃতিকাতর আপনাকে দেখেছি নারিন্দার এক শহুরে আলিন্দে, এক চিলতে ঘরে নিমগ্ন হয়ে লিখতেন, কথা বলতেন, হেলেনকে সাহায্য করতেন, পরামর্শ দিতেন, কোন না কোন ছোট খাটো গৃহস্থালী কাজে। যেমন বাড়িই হোক না কেন; থাকার জন্য; বাস করার জন্য যত ছোট হোক না কেন, -ছিল বইয়ে ভরা বিছানা, আলমারিতে ছিল ঠাসাঠাসা বই, পা-ুলিপি। স্মৃতি হাতড়ে বলেছিলেন; সেই শৈশবেই গ্রামের বাড়িতে ঠাকুরদা, কাকা, বাবাদের সংগ্রহকৃত ‘অনেক কাব্য-কবিতা-উপন্যাস ও জীবনী’ ভরা আলমারির প্রভাবের কথা।
কত সুন্দর উন্মুক্ত শৈশব, কৈশোর ছিল আপনার। কাকা-ভাই-বোন, বই-গান তো ছিলই আর ছিলেন ‘মাহাঙ্গু বানিয়া’ নামের সঙ্গী। আপনার বিপ্লবী দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠার জন্য মাহাঙ্গু বানিয়ার প্রতি ছিলেন ঋণী। আমরা যেমন আপনার এবং আরও অনেকের কাছে ঋণী- নতুন এক সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শক রূপে।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছিলেন ১৯২১ সালে। সেই সময় আপনি এক রাজনৈতিক সভায় যোগ দিয়েছিলেন ‘মাহাঙ্গু বানিয়া’র সাহচর্যে। তাঁকে কথাও দিয়েছিলেন দেশের জন্য কাজ করবেন। কীভাবে যে কখন কার মনে কে সোনার জীয়নকাঠির ছোঁয়া দেয়! আপনিও তো হাজার-লক্ষ তরুণের প্রাণে ‘উদীচী’র ছোঁয়া দিলেন। সেই সময়কাল ছিল ১৯৬৮। ‘উত্তর আকাশের নক্ষত্র’ উদীচী- নামকরণ আপনিই করেছিলেন।
কি বিস্ময় জেগেছিল আমাদের তারুণ্যের মনে। ছেলে-মেয়েদের চিত্ত উন্মোচন ঘটেছিল। মাত্র যখন বয়স আপনার ২৪ ছিল, ১৯৩১ সালে, আপনাকে ‘যুগান্তর’ দলের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে জেলে বন্দী হতে হয়। তিন মাস পরে মুক্ত হন। রাজনৈতিক সাম্যবাদী মতাদর্শে তখন আপনি বিশ্বাসী হতে থাকেন। কিন্তু আবারও ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। জেলে আবদ্ধ থাকেন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত।
বড় কষ্ট, বড় দুঃখ বহন করেছেন আপনার মা এবং আপনিও। মা-ছেলের চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেলে ১৯৩৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পর। আপনি ছাড়া পেলেন ১৯৩৮ সালে। কি অসহনীয় কারা-অন্তরীণ যন্ত্রণা সহ্য করেছেন আপনি ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। অবাক হতে হয়। এর মধ্যেই কারান্তরালেই এম.এ পাশ করেছেন, কত বইয়ের পা-ুলিপি লিখেছেন- এসব জেনেছি আপনার সহযোগী বিপ্লবী-দেশপ্রেমিক বন্ধুদের কাছ থেকে। আপনি কখনো বলতে চাননি। মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বলতেন, সেসব কোন কাজের কথা হলো?
বইয়ের নাম ‘রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ’- হাতে নিয়েই চমকে গিয়েছিলাম। রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে বসে লেখা ১৯৫৯ সালে। এর আগে, তৈরি করা পা-ুলিপি ছিল ‘মহাবিদ্রোহের কাহিনী’। সিপাহী বিপ্লবের একশত বছর (১৮৫৭-১৯৫৭)-এর পূর্তিতে লেখা বইটি বেরিয়েছিল ১৯৫৮ সালে। আমার-আমাদের মনে আছে সেই বছরটা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল সেনাশাসন শুরুর বছর। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ হলেও পাঠকের হৃদয়ে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান আপনি পরোক্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
‘রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ’ বইটির বিষয়ে বলেছেন, এটি কল্পকাহিনী নয়। নারীর মুক্তির কাহিনী কি? নারীর জীবনের রুদ্ধদ্বার কি? প্রেম-চাঞ্চল্য-প্রতীক্ষার অনবদ্য কাহিনী। আপনি নায়কের জবানীতে প্রেমিকাকে বললেন, ‘তুমি মুক্ত হও’। নায়িকা বললেন, ‘তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই’। এই তো চির পুরাতন, চির নতুন, নারীর প্রেম বেষ্টনির বাঁধন। শুনে নায়কের জবানীতে আপনি ধিক্কার জানালেন, ‘মানুষ নয়, এ যেন ষোল আনা মেয়ে’। সমাজ কাঠামোতে, সংসার-পরিবারের বেষ্টনিতে মেয়েরা তো মানুষ নয়। সে নিজেও বুঝতে চায় না ষোল আনা ‘মেয়ে’ হওয়ার দোষ কি? ‘মানুষ’ হলেই বা কি লাভ? পুরুষ তো মানুষ বলেই সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্রে স্বীকৃত। তা সে কি ‘ষোল আনাই পুরুষ নয়?’ পুরুষ অহমিকা, আধিপত্য, কি ‘মানুষ’ হওয়ার লক্ষণ? এসব কথা নিয়ে কত না বিরক্ত করেছি আপনাকে। বুঝেছি আপনার আদর্শগত অবস্থান। নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে বৈশ্বিক-দেশীয় প্রেক্ষাপটে আপনি আধুনিক মুক্ত মনের দার্শনিক ছিলেন।
প্রতিটি বই আমাকে আমাদের আলোড়িত করেছে। পদচিহ্ন, মসলার যুদ্ধ, সেয়ানা, মাসিমা, গ্রামবাংলার পথে পথে- সব বইই মানুষের কথায় পূর্ণ। গ্রামের নারী-পুরুষ, ইতিহাসের উত্তাল সময়, সমকালীন কৃষক-সমাজের কথা, গণসঙ্গীতের কথা, সবই লিখেছেন। আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, এখনও অনুপ্রাণিত করছেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ মাত্র শেষ হলো। একুশে পদক-এর খবর পড়তে পড়তে মনে পড়লো আপনি ১৯৭০ সালে একুশে পদক অর্জন করেছেন। এ আমাদের দেশের গৌরব, আপনার এ অর্জনে দেশবাসী গর্বিত হয়েছে।
সত্যেন দা, আপনার সঙ্গে সাংগঠনিক যোগাযোগের বাইরেও ছিল ব্যক্তিগত পারিবারিক যোগাযোগ। আমার মা ফাহিমা বেগম-এর বিশেষ অনুরোধে আপনি নারিন্দা থেকে বাইরের কাজে যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিন ওয়ারির ১৫ লারমিনিস্ট্রিটে আমাদের বাসায় এসে পদধূলি দিতেন। মায়ের তৈরি ‘চা আর একটি ডিম পোচ’ আপনাকে প্রতিদিন-অনেক দিন খেতে হয়েছে। আমরা ধন্য, আমার মা ধন্য হয়েছেন।
‘আজ ‘মা’ নেই, আপনি নেই’ কিন্তু সেই সব স্মৃতি সৌরভ আমাদের ভরিয়ে রেখেছে।
আপনি এরকম অন্দর মহলের বহু মা-মাসীমার শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন। আপনার স্মরণে আমি আজ সেই সব কথার ঝাঁপি খুলতে পেরে কৃতার্থ হোলাম।

০৩.০৩.২০১৪

সত্যেন সেন স্মরণে : তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে
ভোরের কাগজ : ২২/০৩/২০১৪

সেকালে কারাগার ছিল বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রায় স্থায়ী আবাসস্থল। সেই সূত্রে কারাগারগুলো বিশেষ করে তৎকালীন ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার দুটি পরিণত হয়েছিল মার্কসবাদীদের ব্যাপক মিলনকেন্দ্রে আর সেই সুবাদে ঐ দুটি কেন্দ্রীয় কারাগারে সমৃদ্ধ পাঠাগারও। দেশে আরো গোটা দুয়েক কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল বটে কিন্তু সেগুলোতে সরকার কদাপি আমাকে স্থানান্তরিত না করায় সে দুটি সম্পর্কে আমার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় তা নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগ আমার নেই।
আমি যে ৮/১০ দফায় কারারুদ্ধ হয়েছি তারই এক পর্যায়ে পাবনা জেলা কারাগার থেকে আমাকে প্রথমে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অতঃপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। দুবার এমনটি ঘটেছিল অর্থাৎ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবার সুযোগ ঘটেছিল। এরই একদফায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলে আমার পরিচয় ঘটে কমরেড সত্যেন সেনের সঙ্গে। সেটা ষাটের দশকের কথা। সত্যেনদার কথা তার আগেও শুনেছি। তাঁর দু একখান বইও হাতে এসেছে। কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ তার আগে কদাপি পাইনি। কিন্তু সাক্ষাৎ বা পরিচয় হলে কী হবে? বেশি কথাবার্তা বলা বা আলাপ-আলোচনা করার তার সুযোগ কোথায়? ২৬ সেলের একটি সেলে সত্যেনদা থাকতেন। আমি অপর এক সেলে মতিন ভাইসহ (ভাষা মতিন) থাকতাম। সন্ধ্যায় লকআপ ভোরে খুলে দেয়া হতো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে স্নানাদি সেরে প্রাতরাশ সমাপ্তির পর নতুন সংবাদপত্রের অপেক্ষা। সংবাদপত্র বেশ অনেকগুলোই আসতোÑ তবে রীতিমতো ঈবহংড়ৎবফ হয়ে। অর্থাৎ কারা কর্তৃপক্ষ যে খবরগুলো রাজবন্দীদের জন্য আপত্তিকর মনে করতেন সেগুলো ঘন কালি দিয়ে লেপটে দিয়ে তবে পাঠাতেন এবং তখন তা আমরা পড়তে পারতাম। ঐ সেন্সর প্রক্রিয়ার জন্য জেলগেটে দেরি হতো। আমরা তাই পত্রিকা পেতে পেতে প্রায় দুপুর বা তাড়াতাড়ি হলে এগারটার দিকে পেতাম। পত্রিকাগুলো পড়ার পর যার যার নিজস্ব লেখাপড়া, বৈঠক, আলাপ-আলোচনা প্রভৃতি নানা ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া ছিল দৈনন্দিন কর্মসূচি। এভাবেই বছরের পর বছর জেলজীবন কাটাতে রাজবন্দীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। একনাগাড়ে ৭/৮ বছর জেলে কাটানোয় অনেকের সঙ্গেই পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছে। এরা সবাই ইংরেজ আমলের বিপ্লবী। সত্যেনদা তাদেরই দলে।
২৬ সেলে আর যারা আমার আগে থেকেই আটক ছিলেন তাদের মধ্যে নগেন সরকার, অজয় রায় প্রমুখের কথা মনে আছে। কমিউনিস্ট বন্দীদের কাছে ষাটের দশকের ঐ সময়টা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন চীন-রাশিয়ার মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব তুঙ্গে উঠেছে পৃথিবীব্যাপী। পূর্ববঙ্গ তা থেকে বাদ থাকতে পারেনি। এখানে তোয়াহা-শরদিন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে মাওবাদী চিন্তাভাবনা সমর্থন করে এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও তার প্রতি সমর্থন দেয়ার দাবি জানিয়ে একটা থিসিস প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পাঠান। কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনার পর অধিকাংশ ভোটে ঐ থিসিস প্রত্যাখ্যাত হয় এবং রুশ পার্টির লাইন গৃহীত হয়। তখন চীনপন্থীরা পার্টির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে বিলি করেন কিন্তু সেখানেও অধিকাংশ সমর্থন রুশপন্থায় প্রতিই ছিলÑ যদিও তরুণদের একটা বড় অংশ চীনপন্থায় আকৃষ্ট হয়ে পরে নকশালী সন্ত্রাসবাদী পথ বেছে নিয়ে অনেকেই মৃত্যুর কবলে পতিত হন। সত্যেনদা অনুরক্ত ছিলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাতমুখ ধুয়ে ছোট একটা টেবিল ও একটি চেয়ার কিছু কাগজ ও একটি কলম নিয়ে সত্যেনদা বসতেন লিখতে। অতিশয় হালকা-পাতলা গড়ন, চোখে হাইপাওয়ার ভারী কাচের চশমা, পরনে সাধারণ একটা ধুতি ও ফুলশার্ট আবার কখনো বা একটি পায়জামা ও ফুলশার্ট থাকতো তার পরনে। অক্টোবর বিপ্লব দিবস, নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভৃতি বিশেষ দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা ছাড়া তাকে বড় একটা কোনো অনুষ্ঠানে, বৈঠকে বা আড্ডায় পাওয়া যেতো না। তিনি শুধুই বসে লিখতেনÑ যেন মুখস্ত কিছু লিখে চলেছেন অবিরাম। বাকস্বল্পতা ছিল সত্যেনদার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কারাগারের বাইরের জীবনে সত্যেনদার সঙ্গে কদাপি সাক্ষাৎ হয়েছে এমন কোনো কথা স্মরণে আনতে পারছি না। বস্তুত কোথাও আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তার লেখা বেশ কয়েকটি আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করেছিল। তার লিখিত বিপুল সংখ্যক গ্রন্থে সেই জাগরণী বক্তব্যই তিনি বিপুল নৈপুণ্যের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সত্যেনদা তার লেখনীর মাধ্যমে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, সেই একাত্মতার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে তাদের জীবনের দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্নার বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। ঘরে বসে কল্পনাপ্রসূত কোনো ছবি আঁকতে দেখা যায়নি তাকে।
সত্যেনদার পৈতৃক বাড়ি ছিল সেকালের বিপুল ঐতিহ্যবাহী এবং ইতিহাসখ্যাত বিক্রমপুরÑ যা আগে ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত এবং এখন মূলত মুন্সীগঞ্জ জেলা বলে খ্যাত। তবে বিক্রমপুরের একটা বড় অংশ পদ্মার ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেখানে ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ সত্যেনদা জন্মগ্রহণ করেন একটি অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পরিবারই ছিল প্রাথমিকভাবে তাঁর সাহিত্যপ্রীতির প্রেরণা। আর রাজনীতিতে নামার প্রথম প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন ১৪ বছর বয়সে ১৯২১ সালে কংগ্রেসের একটি জনসভা থেকে। সেই থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তাঁর মধ্যে সক্রিয়ভাবে দানা বাঁধে।
পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলন এবং কৃষক সমিতিতে যোগদান করেন সত্যেন সেন। বিশের দশকে এসে তৎকালীন গোপন বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৩১ সালে ঘটে তার প্রথম কারাবরণ। তাঁরই প্রেরণায় সত্যেনদার অনুরাগী স্কুলছাত্রী লীলা রায় ও ঐ বিপ্লবী দলে যোগ দেন। এই বিপ্লবী মহিলা সত্যেনদার জীবনে বিশেষ স্থান দখল করেছিলেন। ঐ সময়ে সত্যেন সেন ছিলেন কলেজের ছাত্র। আবার গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালে। এই দফায় একটানা ছয় বছর কারাবাসের পর ১৯৩৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। এই দফায় যে দীর্ঘ সময় তিনি কারাজীবন ভোগ করলেন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন সেখানে আরো বহুসংখ্যক প্রবীণ মার্কসবাদীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং মার্কসীয় তত্ত্ব আত্মস্থ করার কাজে পড়াশুনায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে। মুক্তির পর ফিরে যান গ্রামে। সেখানে কৃষক সমিতি গড়ার কাজে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। একই সঙ্গে ঢাকার, নারায়ণগঞ্জের নানা কলকারখানার শ্রমিকদেরকেও ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত করার কাজে উদ্যোগী হন। বেছে নেন কঠোর বাস্তবতার জীবনÑ সকল আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে। ইতোমধ্যেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন এবং পার্টি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন সংগঠনে অংশ নিয়েছেন। এলো ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষÑ যা পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে ইতিহাসে পরিচিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখনো চলছিল। ইংরেজ শাসকদের কারসাজিতে ঐ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। ৩০ থেকে ৫০ লাখ বাঙালি নরনারী, শিশু অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন। এই দুর্ভিক্ষবিরোধী সংগ্রাম এবং ত্রাণকাজেও সত্যেনদা নেমে পড়েন। সম্ভবত মানুষের বেদনার এই চরম মুহূর্তে আরো বেশি বেশি করে জাগরণী গান, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার আকুতি সত্যেনদার মনে গভীরভাবে দানা বেঁধেছিল। তাই তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও নেমে পড়েনÑ গণসংস্কৃতির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে। অনেক গান এই সময়ে তিনি রচনা করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকেÑ একই সময়ে ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামও নতুন মাত্রা অর্জন করে। আর এই স্বাধীনতার লড়াইকে ছুরি মারার জন্য ঐ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক, তাদের তাঁবেদার চরম প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের একটি ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক অংশ ষড়যন্ত্র করে ভারতের বহু স্থানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে। তার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হয় সত্যেনদাকে।
দানা বাঁধলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। এ দাবি মুসলিম লীগের কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে উগ্র আবহ দাঙ্গা প্রভৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে তার পরিণতিতে বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী ১৯৪৬-এর নির্বাচনে একবাক্যে মুসলিম লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেন। ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে শুরু করেন হিন্দুরা। বিক্রমপুর হিন্দুপ্রধান বর্ধিষ্ণু এলাকা ছিল। তাই দেশত্যাগের অভিঘাত বিক্রমপুরকেও আঘাত হানে। শুরু হয় কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান। ১৯৪৯ এ পুনরায় গ্রেপ্তার হন সত্যেনদাÑ বের হন ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের যথেষ্ট পরে। ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক আঘাত হানেÑ দেশত্যাগও অতঃপর কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু সত্যেনদা বেরিয়ে দেখেন তাঁর পরিবারের কেউ কেউ, গ্রামের বহুসংখ্যক হিন্দু অধিবাসী চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। ফলে তার বহু কমরেড, বহু কর্মীকে হারিয়ে তিনি গভীর বেদনা অনুভব করেন। অনেকে তাকেও দেশত্যাগের পরামর্শ দিলে তিনি তাতে অসম্মতি জানিয়ে দেশে থেকেই শোষণ মুক্তির আন্দোলনে নানাভাবে আত্মনিয়োগের শপথ নেন নতুন করে।
সত্যেনদা এ সময়ে সাহিত্যকর্মে অনেক বেশি বেশি করে আত্মনিয়োগ করেন। কী বাইরে কী কারাগারে সর্বত্র তিনি অক্লান্ত সাহিত্যকর্মী; শুধু তাই ননÑ তিনি দৈনিক সংবাদের একজন সহকারী সম্পাদকও। সেই সুবাদেও সাহিত্য সৃজন তাঁর দৈনন্দিনই নয় শুধু প্রায় সার্বক্ষণিক কাজে পরিণত হয়। চোখের অবস্থা তাঁর ছিল অত্যন্ত করুণ। কিন্তু সত্যেনদা তাতে থেমে থাকবার লোক ছিলেন না। ফলে দৃষ্টিশক্তির হানিই ঘটেছে প্রতিদিন।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সত্যেনদা তার অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। সেখানেও কর্মব্যস্ততা ছিল প্রচ-। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরে পুনরায় দেশে ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। এর আগেই ১৯৬৮ সালে সত্যেনদা গড়ে তোলেন তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। তার সঙ্গে কৃষক-শ্রমিককে যুক্ত করে বিপ্লবী চেতনায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করে শোষণমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক ও সকল সংকীর্ণতা পশ্চাৎপদতামুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারকে ধারণ করে তাকে অগ্রসর করে নেয়ার লক্ষ্যে গড়ে তুললেন উদীচী। মার্কসীয় সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত তার সঙ্গী হন। সত্যেনদা উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিস্ময়কর ঘটনাটি হলো অচিরেই দেশের প্রতিটি জেলায় উদীচীর শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটে এবং উদীচী একটি জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে রূপ ধারণ করে।
আমার এখন মনে পড়ে পাবনায় উদীচীর জন্মের ইতিকথা। বহুদিন থেকেই সংগঠনটি পাবনাতে গড়ে তোলার কথা ভাবছিলাম কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকা-জনিত অত্যধিক ব্যস্ততা এবং বারংবার কারাবরণ করতে হওয়ায় তা যেন কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না। দেশটা স্বাধীন হওয়ার পর ভেবেছিলাম আর যাই হোক, জেলে যাওয়ার ব্যাপারটার ইতি ঘটলো অতঃপর। কিন্তু না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আবার সেই পাকিস্তানি রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনলো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পরবর্তীতে। তাই স্রেফ একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দেয়ার পরপরই ১৯৭৬ সালে আবার গ্রেপ্তার। ১৯৭৭-এর সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেলাম। মুক্তির পর দেখি সঙ্গীতশিল্পী নজরুল ইসলাম বুলবুল পাবনাতে বদলি হয়ে এসেছেন এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি অর্জন করেছেন। তার বাড়ি কোথায়, কী চাকরি করেন জানতাম না। পূর্বে পরিচয়ও ছিল না। একদিন কোনো এক অনুষ্ঠানে পরিচয় এবং জানলাম তিনি উদীচী করতেন। বললাম, সুবিধেমতো বাসায় দেখা করবেন। এলেন। কথাবার্তা হলো পাবনার উদীচীর শাখা গড়ে তোলা হবে। সমমনা শিল্পী ও সংগঠকদের ডেকে ঠিকই তা গড়ে তোলা হলো। নজরুলকেই সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই উদীচী পাবনায় রীতিমতো নাম-ডাকওয়ালা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। সালটা ১৯৭৭ বলেই মনে পড়ে। অবশ্য নজরুল থাকতেই সংগঠনটির অভ্যন্তরে একটি বিরোধী গ্রুপের নানা চক্রান্ত শুরু হয় এবং কয়েক বছরের মধ্যেই তার ফলে উদীচী পাবনাতে তার গৌরবও হারিয়ে ফেলে। সেই দুঃখজনক অধ্যায়ের আজো পরিসমাপ্তি ঘটেনি বরং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে পাবনাতে তার প্রায় অবলুপ্তিই ঘটে গেছে। পাবনার মানুষ এখন আর উদীচীর অস্তিত্বের ন্যূনতম সন্মান পায় না। সত্যেনদার কাছে, বিপ্লবী আদর্শের কাছে ক্ষমা চাইতেই হয়Ñ আমরা তাঁর গড়া সংগঠনটিকে পাবনায় সাজাতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু উদীচী অবশ্যই আবার নতুন উদ্যমে একদিন ভালো সংগঠকদের হাতে গড়ে উঠবেÑ এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবেই মনে পোষণ করি।
যাহোক, সম্ভবত উদীচীই সত্যেনদার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। প্রগতির ধারা আজ বিশ্বব্যাপীই ক্ষীণস্রোতে প্রভাবিতÑ একদিন তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবেÑ পুনরায় সমাজতন্ত্রের জয়গানে বিশ্বের তরুণ সমাজ উদ্বুদ্ধ হবেÑ সত্যেনদারা সেদিন নতুন করে আমাদের চোখে ধরা দেবেন। সেটাই প্রত্যাশা। বিপ্লবী সত্যেন সেনের জন্মশতবার্ষিকী শুরু হলো। দেশব্যাপী বছরজুড়ে তা পালিত হোকÑ বিপ্লবের সুর সর্বত্র ধ্বনিত হোকÑ এই কামনা এই আকাক্সক্ষা রেখে নিবন্ধটির ইতি টানছি। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সত্যেনদার অমর আত্মার প্রতিÑ তাঁর সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার প্রতি।
রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, কলাম লেখক।
যঃঃঢ়://িি.িনযড়ৎবৎশধমড়ল৫.হবঃ/হব/িনষড়ম/২০১৪/০৩/২২/১৬৭০৩৭.ঢ়যঢ়

সত্যেন সেন ও ‘মেহনতি মানুষ’
মাসুদুল হক
সত্যেন সেন ১৯০৭ সালে বঙ্গবঙ্গের (১৯০৫) দু’বছর পরে ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরের বছর ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে প্রখ্যাত সেন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ধরণী মোহন সেন। শান্তিনিকেতনের আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর পিতৃব্য।
সোনারং স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় গমন করেন। সেখানে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন, পরে যুগান্তর দলের ব্রিটিশবিরোধী গোপন রাজনৈতিক তৎপরতার সাথে যুক্ত হন। ১৯৩১ সালে বি.এ পরীক্ষার পর তিনি রাজনৈতিক মামলায় বন্দী হয়ে ১৯৩৩ সালে মুক্তি লাভের পর আরেকটি রাজনৈতিক মামলায় কারাবরণ করেন। এসময় বহরমপুর বন্দী শিবিরে একটানা পাঁচ বছর আটক থাকেন। জেলে বসেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। রাজবন্দী থাকাকালেই মার্কসবাদকে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন রূপে গ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে মুক্তিলাভের পর বগুড়া জেলার গ্রামাঞ্চলে অর্ন্তরীণ রাখা হয় তাকে। এসময় তিনি শান্তিনিকেতনে আতœীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করতে গেলে তাঁরা চেষ্টা করেন তাঁকে সেখানে স্থায়ীভাবে রেখে দিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করে গবেষণা বৃত্তির ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু তিনি সকলের অনুরোধ প্রত্যাখান করে পুরোপুরি মার্কসবাদী কর্মীরুপে আত্মনিয়োগের জন্য নিজ গ্রাম সোনারং এ প্রত্যাগমন করেন। সেখানে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ক্রমেক্রমে ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির নেতৃত্বে চলে আসেন।
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পর প্রগতি লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ঢাকায় এই সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তি ছিলেন কিরণশঙকর সেনগুপ্ত, ……………, সোমেন চন্দ, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। সত্যেন সেনও এই সংস্কৃতি আন্দোলনে যোগ দেন। এসময় তিনি রচনা করেন প্রচুর গণসঙ্গীত।
১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকার তাঁকে দ্বিতীয় বার গ্রেফতার করেন। প্রায় চার বছর কারা নির্যাতনের ভোগের পর ১৯৫৩-তে যুক্ত হন। ১৯৫৪-র ৩০ মে পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা জারি হলে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কিছুকাল পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সহকারী সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৮ এর ৭অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করা হলে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
দীর্ঘ পাঁচ বছর জেল বাসের পর ১৯৬৩ সালে পুনরায় ‘দৈনিক সংবাদ’-এ যোগদান করেন। সত্যেন সেনের জীবনের সঙ্গে মেহনতি মানুষ আর আর জেলের যেন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আচার্য হবার কিছুই নেই ১৯৬৫-র……. থেকে ১৯৬৮ পযর্ন্ত কারাবরণ করেন তিনি। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় যুক্ত হয় সংবাদের সঙ্গে। এর মধ্যে তিনি ১৯৬৯ সালে প্রগতিশীল সংস্কৃতি সংস্থা ‘উদীচী’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা উপন্যাসে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। তাঁর ‘আল বেরুনী উপন্যাসটি পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় গমন করলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কাজে আতœনিয়োগ করেন তিনি। ১৯৭৩-এর শেষের দিকে হাপানি রোগে আক্রান্ত হন এবং তার চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়। একই বছর ঢাকা ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে ভগ্নী প্রতিভা সেনের কাছে থাকতে শুরু করেন। চোখের চিকিৎসার জন্য তাঁকে মস্কো পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান নি। অন্ধ অবস্থায় মুখে মুখে বলে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন চিরকুমার সত্যেন সেন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাহিত্যে অগ্রগন্য এই মানুষটি সম্পর্কে তার ভগ্নী প্রতিভা সেনের মূল্যায়ন এরকম :
“সমস্ত জীবন জেলে ও বাইরে বাইরে ঘুরিয়ে কাটাইয়া, শেষ সময়টা আমার কাছে আমিরা থাকিবে, এই আশা আমি কোন দিন করি নাই। ১৯৭৩ সালে মে বাংলাদেশ হতে আমিরাছিল, ১৯৮১ তে চলিয়া গেল। বহুদিন আগে ঘরবাড়ি ছাড়িয়াছিল, পথে ঘাটে গ্রামে গঞ্জে বহু ঘরে ও জেলে কাটাইয়া পরে২৫/৩০টা বছর বাংলাদেশে ও শেষের ৫/৬টা বছর আমার কাছে থাকিয়া গেল।……. বাড়ির মোহ কাটাইয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল। শেষটা সকলের মধ্যে আমিরা থাকিয়া গেল।”(‘ভূমিকা : সত্যেন সেন রচনা সমগ্র’ পঞ্চম খন্ড, প্রতিভা সেন)
সত্যেন সেন ১৯৮১ সালের ৫ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রধানত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত সত্যেন সেন শেষ পযর্ন্ত তার সাহিত্য-কৃর্তীর জন্য অনন্য হয়ে আছেন আমাদের কাছে। মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম ও গণমানুষের মুক্তির বাণী তার সাহিত্যকর্মে উজ্জলভাবে প্রকাশিত। তিনি যখন সাহিত্য সাধনা শুরু করেন তখন তিনি বয়সে পঞ্চাশ অতিক্রান্ত। লক্ষণীয় তার প্রায় সব গ্রন্থই কারাগারে বসে লেখা। সত্যেন সেন লিখেছেন অজস্্র, প্রধানত উপন্যাস। আর উপন্যাসের সংখ্যা ১৫টি। তার উপন্যাসের বিষয় সমাজ, রাজনীতি , সমকালীন ও অতীত ইতিহাস। বিজ্ঞান সর্ম্পকিত গ্রন্থ, আন্দোলন- সংগ্রামের আলোমালা ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনায়ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
সত্যেন সেনের উপন্যাস নিয়ে বেশ কিছু গবেষনাও হয়েছে। সমালোচকেরা তার উপন্যাসগুলোকে সামাজিক আর ঐতিহাসিক উপন্যাসে শ্রেণীবিভক্তও করেছেন। সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাত নম্বর ওয়ার্ড, সোয়ানা, পদচিহ্ন, মা, উত্তরণ। ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাপের সন্তান ও আল বেরুনী। এ নিবন্ধে আমরা সত্যেন সেনের আন্দোলন-সংগ্রামের আলেখ্যমালা বিষয়ক একটি গ্রন্থ ‘মেহনতি মানুষ’ নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সত্যেন সেনের রাজনীতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্দতা অনুধাবনের জন্যেই পরিসরে তার জীবন পর্যালোচনা করা হল।
সত্যেন সেনের সমস্ত জীবনের মূল অনুধ্যান ও অনুসন্ধানের বিষয় মানুষ। বিশেষ করে শ্রমজীবি-মেহনতি মানুষ। খুব কাছ থেকে মেহনতি মানুষের জীবন দেখেছেন। অনুভব করেছেন তাদের কমিটমেন্ট, আবেগ, বিশ্রাম আর চারিত্রিক দৃঢ়তাকে। খুব প্রখ্যাত নয়, সাধারণ সব মানুষের সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রতি আস্থা; মার্কসবাদের প্রতি অবিচল থেকে এক এক জন শ্রমিক-মানুষ যেভাবে খ্যাতিমান শ্রমিক নেতায় পরিণত হয়েছেন, তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন তিনি। তার দেখা সেইসব মানুষদের সুখশ্রী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটি।
‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটিমূলত ছিল যুগ রচনার সংকলন। সত্যেন সেন ও বিষু…. চট্রোপাধ্যায় রচিত যথাক্রমে চারটি ও দুটি প্রবন্ধ একত্রিত করে গ্রন্থটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। প্রকাশিত হয়েছিল কালিকলম প্রকাশনী( ৩৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১) থেকে, ১৯৬৯ সালে প্রকাশক ছিলেন জনাব এম.এ আলিম। প্রচ্ছদ একেছিলেন নিতাই কুমার সাহা। ‘ সত্যেন সেন রচনা সমগ্র’ পঞ্চম খন্ডে ….. চট্রোপাধ্যায় রচিত দুটি প্রবন্ধ বাদ দিয়ে চারটি প্রবন্ধ রাখা হয়। প্রবন্ধ চারটি হচ্ছে ঢাকা জেলা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের রক্তবাঙ্গা অধ্যায় বেলগুয়ে শ্রমিক নূর হোসেন, পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের আদিপর্ব ও কবি গানের দল।
‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটিকে মোটাদাগে প্রবন্ধ বলা গেলেও এই গুলো সত্যেন সেনের চিন্তা প্রকাশের ধরণটিকে মুক্ত গদ্যের আদলের আলেখ্যমালা বলাই শ্রেয়।
‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থের প্রথম আখ্যানটিতে ১৯৪৬ সালে ঢাকা জেলার কটনমিলের শ্রমিকেরা তাদের ন্যায় দাবীর প্রতি, সর্ব ভারতীয় শ্রমিক নেতা পি. সি যোশীর প্রতি যে অনুরাগ প্রকাশ করেছেন তা ইতিহাসে অনন্য। পি.সি যোশীর জনসভায় যোগ দেবার জন্য ২১ জন বাছা বাছা নেতৃস্থানীয় কর্মীকে ছাটাই করেছিল মালিক পক্ষ। কিন্তু শ্রমিকেরা সেই অবৈধ ছাটাই মেনে নেয়নি। সে জন্য জীবন দিয়েছিল। সেই বাস্তবতা ইতিহাসকে সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে সত্যেন সেন নিপুনভাবে তুলে এনেছেন এই রচনায় এক নতুন আখ্যানমূলক গল্প সৃষ্টি করেছেন যা সত্যিই বিরল।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে প্রভাবশালী মহল শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে চাইলেও বাংলার সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবি-মেহনতি শ্রমিকেরা তাকে দেয়নি। বরং হিন্দু-মুসলমানের সর্ম্পকের নানা দিকে একটা ভারসাম্য রাখতে সচেষ্ট ছিল বাংলার জনগন তথা শ্রমিক শ্রেণী। এ প্রসঙ্গটিও রচনায় আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। সত্যেন সেনের ভাষায় তা লক্ষ করা যাক : …… আলীর মাথা ফেটে গিয়েছিল। তার আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য তার জীবনীশক্তি। চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বা….. মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে দিয়ে সে ক্রমে ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল।
আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ….. আলী তার দুহাত দিয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, কমরেড কই আমি মরলাম না তো। আমি বললাম, না, না, মরবেন কেন? ডাক্তার বলেছেন আপনার ভয়ের সময় কেটে গিয়েছে। ভয় নাই? সে কি, তবে আমি মরব না? …… আলী আর্ত কন্ঠে বলে উঠল। তার কন্ঠে হতাশার স্বর শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। …… আলী কি বলতে চাইছে? প্রশ্ন করলাম, কেন কমরেড, এমন কথা বলছেন কেন? আপনি কি মরতে চান? …… আলী কোন উত্তর দিল না। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি সত্য সত্যিই মরতে চান? একজন সংগ্রামী শ্রমিকের মুখে এমন কথা কি সাজে?
….. আলী একটু ইতস্তত : করে বলল, কিন্তু কমরেড, এত সমস্ত ঘটনা ঘটল, এত লোক মারা গেল, কিন্তু একটা মুসলমানতো মরল না। এ কেমন হল কমরেড, কমরেড, এ কেমন হল?
আমি (সত্যেন সেন) চমকে উঠে বললাম, বলেন কি, …… আলী এই কথা বলল? হ্যাঁ …… আলী এই কথাই বলল। এই বলেই অনিল মূখার্জী (বিখ্যাত মার্কসবাদী নেতা ও লেখক) চুপ করে গেলেন। আমিও কতক্ষন কোন কথা খুজে পেলাম না। তার পর থেকে …. আলীর কথা আমার মাসে মাসেই মনে পড়ে। তার সেই ব্যাকুল আকুতি আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। এত সমস্ত ঘটনা ঘটল, এত লোক মারা গেল, কিন্তু একটা মুসলমানও মারা গেল না। …… আলী বড় আশা করেনছিল সে নিজে মরে তার এ দুঃখটা ঘুচিয়ে দেবে। কিন্তু দেবের প্রতিকুলতায় সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল না। ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় আখ্যানমূলক রচনাটির নাম “রেলওয়ে শ্রমিক নূর হোসেন”। নির্ভেজাল মরল প্রাণ একজন শ্রমিক মুখশ্রী তিনি তুলে ধরেছেন এ রচনায় নূর হোসেন আসাম …….. রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কাজে অনশন দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তার মূল কারণ ছিল পাকিস্তানের তথা মুসলমানের সবাই মানুষের মত বেচে থাকার সুযোগ পাবে। …….. নূর হোসেন তার নেতা মহেন্দ্র দত্তের মতের সঙ্গে না থেকে চেরাগ খাঁর মুসলিম এমপ্লয়ি এসোসিশেনে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় সে নূর হোসেন চৈতন্য ফিরে আসে। এখানে এসে দেখে রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বাদ-বিবাদ বা বৈষম্যের কোন বিষয় নেই। বরং পাকিস্তান সরকার আর পাকিস্তানের মেহনতি মানুষ পরস্পরের প্রতিদ্বন্ধী দুটো পক্ষ। নূর হোসেনের উপলব্ধি হয় :“ এদেশের মেহনতি মানুষদের এত দিনের আন্দোলনের ফলে হাসিল হয়েছে। তাদেরই ভোঠের জোরে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার সেই সাধারণ মেহনতি মানুষদের অভাব-অভিযোগ মিটাতে বা সুযোগ সুবিধা দিতে চাইছে না, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখছে এবং মেহনতি মানুষদের বাঁচতে হলে মিছিল করে, সভা করে আর ধর্মঘট করে সেই সমস্ত দাবী দাওয়া আর অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে-….. কি সত্যি? নূর হোসেন পাল্টে যায় ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলনে নেমে পড়ে। শ্রমিক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে এস নূর হোসেন আরো উপলব্ধি করে এখানে সুকুমার চক্রবর্তী, ডা. মারুফ হোসেন, ব্যারিস্টার লতিফ, ধরনী রায় রফিকুল ইসলাম, সুলতান প্রমুখ নেতাদের মধ্যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান, এখানকার শ্রমিকেরা তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না। তারা শুধু দেখে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপনজন, কে কত বেশি কর্মঠ আর সংকটের মুখে কে তাদের সবচেয়ে সঠিকভাবে পথনির্দেশ দিতে পারে। নূর হোসেনের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে সত্যেন সেন মূলত বাংলার মেহনতি মানুষের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের । ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। শ্রমিক নূর হোসেনের নূর হোসেন হয়ে উঠবার কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে সত্যেন সেন তাঁর দক্ষ ভাষায় শিল্পমান সম্পন্ন সার্থক গল্পই নির্মান করে ফেলেছেন। যেখানে একজন শ্রমজীবি মানুষের ব্যক্তি অস্তিত্ব, সমস্যা-সংকট, ঘটনা প্রবাহ, আবেগ-উচ্ছাস, সবই উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের শাসনবিধি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলন-সংগ্রাম ও ঘটনা…… কুশলী বিন্যাস যৌক্তিকভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই আখ্যানে আমরা ভাষা আন্দোলন আর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও তার প্রতিক্রিয়ার স্বরুপও অনুধাবন করতে পারি। সেই অর্থে নূর হোসেনকে নিয়ে এ ্ক অসাধারণ গল্প। সত্যেন সেনের বর্ননায় এ-রচনায় শেষটুকু এ-রকম :
“সুদীর্ঘ বারো বছর বাদে আবার দেখা নূর হোসেনের সঙ্গে এর মধ্যে তার জীবনে নানা বিপর্যয় এসেছে। কিন্তু তার গতি থেমে যায়নি। যৌবনের উষালগ্নে যেই সংগ্রামী আদর্শ সে এক দিন মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছিল, তারই আলোই পথ দেখে এগিয়ে চলছে নূর হোসেন। এক গভীর রাত্রির নিস্তব্ধ পরিবেশে তার মুখে তার জীবন কাহিনী শুনেছিলাম। ছেলেটি? ছেলেটি কোথায় আছে? নূর হোসেন উত্তর দিল, ছেলেটা মামাবাড়িতে ওর নানীর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। এখন স্কুলে পড়ে। এর পর কিছুক্ষন নিঃশব্দতার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। নূর হোসেন এমন গভীরভাবে কি ভাবছে মনে মনে তা অনুমান করবার চেষ্টা করছিলাম। ছেলের প্রসঙ্গে তার কি আবার তার ছেলের মার কথা মনে পড়ে গিয়েছে? আমি কোন কথা বলার আগেই নূর হোসেন বলে উঠল, না দাদা, ও সব ভেবে আর দুঃখ করি না। আমরা যে আদর্শ নিয়ে চলেছি, তাতে এসব দুঃখ নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকলে কি চলে। কিন্তু একটা দুঃখ কিছুতে ভুলতে পারি না। কি এমন দুঃখ? সে কি আমার কাছে বলা চলে?
কেন চলবেনা ? আপনারা ছাড়া একথা কাকে বলব-কেইবা বুঝবে। দুঃখটা কি জানেন দাদা, যাদের কথা মনে করে এত দিন এতকিছু করলাম, তাদের জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না। যাই কিছু গড়ে তুলি, সবই যে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। নূর হোসেনকে নানা রকম যুক্তি আর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে উৎসাহিত করে তুলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই দুঃখটা তো একমাত্র নূর হোসেনেরই নয়। ভাঙ্গা হাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত ও অবসন্ন মুহূতে আদর্শবান কর্মীদের অনেকের মনেই সামরিকভাবে হলেও এই দুঃখটা কি জেগে ওঠে না?”
তৃতীয় রচনা ‘পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের আদিপর্ব’। এখানেও লেখক সত্যেন সেন শ্রমিক নেতা ….. হোসেনের আন্দোলন-সংগ্রামের ভুবন তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে মুসলিম লীগ সরকারের সেচ্ছাচারী শাসন-ব্যবস্থার চিত্র অংকন করেছেন। তখনকার দিনে রাজবন্দীর উপর অত্যাচার কি ভয়াবহ ছিল, তার রুপ আমরা উপলব্ধি করতে পারি এই আলেখ্য থেকে। মুসলিম লীগ সরকার তার দোর্দন্ড প্রতাপে মহিলা রাজবন্দীদের উপর নির্মম অত্যাচার করলে, সেই অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রচা অভিযানের উদ্যোগক্তাদের মধ্যে এল হোসেন অন্যতম ভূমিকা পালন করে। এজন্য তিনি জেলেও যান। জেল থেকে বেরিয়ে এলে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তাঁকে তার নিজ জেলার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে। সেই সঙ্গে হুশিয়ারি দেয়, ভাল মানুষের মত চুপচাপ শান্তিতে না থাকলে ভবিষ্যতে তাঁর অদৃষ্টে এর চেয়েও বেশি দুঃখ আছে। কিন্তু দুঃসাহসী এল হোসেন । আবার ফিরে আসে ঢাকায়। গ্রহণ করে শ্রমিকের জীবন। এবার আদমজী জুট মিলের মেকানিকের কাজ। তার পর শুরু করে জীবন যাপনে নানা অসুবিধা নিয়ে আন্দোলন। যেমন থাকা, খাওয়া, শৌচাগার আর স্লান ব্যবস্থার উন্নয়ন। শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে তিনি আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ইউনিয়ন গড়ে তুলেন এল হোসেন। এল হোসেন শ্রমিকদের মধ্যে এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে তার একক সিদ্ধান্তে হরতাল পালিত হয়। কিন্তু এল হোসেন তার চরিত্র নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মার্কসবাদী আদর্শে। সেচ্ছাচারিতাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। সে সত্যিই সত্যেন সেন তুলে ধরেছেন এই রচনায়, তার অসাধারণ গল্প বলার ভঙ্গিতে। গ্রন্থের শেষ রচনা ‘কবি গানের দল’ । এই রচনা থেকে আমরা সত্যেন সেনের প্রতিভার আরেকটি দিকের সন্ধান পাই। সুকন্ঠ গায়কের পাশাপাশি তিনি ঢাকেশ্বরী মিলের কবিদলের দলনেতা দিলেন। এই কবিদল সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়। শ্রমিকদের মধ্যে প্রচারনা চালানোর কাজে এই কবিদল বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। কবিদলের অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে সত্যেন সেন তার সহজ সরল যুবক……….. কবির সরকার হবার ঘটনা তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে পাচালী আর ধর্মীয় পুঁথিপড়া জানকী কীভাবে ইউনিয়নের একজন উৎসাহী কর্মীতে পরিণত হলেন, সেই স্মৃতি বর্ননা করেছেন তার অভিজ্ঞতা ভিত্তিক এই আখ্যানমূলক রচনায়। এই রচনার শেষ অংশ লক্ষ্য করা যাক :
“পরাজয়ের ঘাটা শুকিয়ে যাবার আবার নতুন আহবান এসেছে। বেরিয়ে পড়েছে সংগ্রামী ভাইরা। আমাদের কবি গানের দলের সিরাজ মিয়া এই সঙ্গে আসে নি। এসেছে সেই চারজন দোহার। আর কে জানেন ? আর এসেছে জানকী। এদের মুখে শুনলাম, এরই মধ্যে সে ইউনিয়নের একজন উৎসাহী কর্মী হয়ে দাড়িয়েছে। তার পুরানো দিনের পাচালী আর ধর্মীয় পুথিপত্র তাকে তুলে রেখে সে এখন রাজনৈতিক পুস্তিকা পড়ায় মন দিয়েছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। একেবারেই বদলে গেছে মানুষটা। এই কবি গানের মধ্যে দিয়ে নব জীবন লাভ করেছে জানকী”।
সত্যেন সেন তার অভিজ্ঞতা লব্ধ মেহনতি মানষের জীবন-সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আদর্শ-উদ্দেশ্য আরন বিশ্রামকে এক স্বতন্ত্র শিল্প-কৌশলে প্রকাশ করেছেন ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থে। ভারতীয় প্রাচীন শিল্প শাস্ত্রে শিল্পকে অভেদান্তক বলা হয়েছে। অর্থাৎ নাটক, কবিতা, গল্প কি প্রবন্ধ- এদের প্রকরণগত দিক থেকে আলাদা করা যায় না। তাই যেকোন শিল্পীকে মর্যাদা দিয়ে বলা হয়েছে কবি-কোবিদ। এক্ষেত্রে সত্যেন সেনও কবি-কোবিদ। ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটিকে আপাত প্রবন্ধ গ্রন্থ বলা গেলেও আমার বিবেচনায় এ এক অসাধারণ আখ্যানমূলক গ্রন্থ। যে গ্রন্থে সাধারণ মানুষের গল্প অসাধারণ ভঙ্গিমায় উঠে এসেছে।

সত্যেন সেনের বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা
আবদুল্লাহ আল-মুতী
সত্যেন সেন বিজ্ঞান-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছোটদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে দু’খানি বই লিখেছেন; দু’টিই প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। ‘আমাদের এই পৃথিবী প্রকাশিত হয় ১৩৭৫ সালে (ইংরেজী ১৯৬৮ সালে) আর ‘এটমের কথা’ ১৩৭৬ সালে (ইংরেজী ১৯৭০)। এর কিছু আগেই অবশ্য তাঁর ছোটদের জন্যে লেখা আরো একটি বই প্রকাশিত হয়েছে; সেটির নাম ‘পাতাবাহার’ সালে (১৩৭৪) এটি একটি গল্প সংকলন। সত্যেন সেনের অজস্্র রচনা সম্ভারের মধ্যে এই তিনটি বইকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলেই গণ্য করতে হয়।
বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ না হয়ে রবীন্দ্রনাথও জীবনের শেষ প্রান্তে বিজ্ঞান বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান যে সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতক জীবনের অতি আবশ্যকীয় অঙ্গ অথচ সাহিত্যে তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এ সত্যি উপলব্ধি করেই তিনি ‘বিশ্ব পরিচয়’ রচনার দুঃসাহসিক কাজ হাতে নিয়েছিলেন। তিনি এ বইয়ের ভূমিকায় বলেছিলেন: আমার দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে যদি কোন মনীষী যিনি একাধারে সাহিত্য-রসিক ও বিজ্ঞানী, এই অত্যাবশ্যক কর্তব্য কর্মে নামেন, তাহলে আমার এ চেষ্টা চরিতার্থ হবে।’
সত্যেন সেনও স্পষ্টতঃই এই একই সামাজিক দায়িত্বকোধ থেকে বই দু’খানি লেখেন। তবে সামান্য একটু তফাত এই যে তার অধিকাংশ রাচনার মত সম্ভবতঃ এ বই দু’টিও কারাবাস কালে লেখা এবং এ কারনে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী সহকর্মীর পরামর্শ গ্রহনের সুযোগ তাঁর পক্ষে সুলভ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই তুলনা অবশ্যই সত্যেন সেনের বই দু’টিকে বাগুল্য মূল্য দানের উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাঁর প্রচেষ্টার যথাযথ সূল্যায়নের জন্যেই এই পটভ’মির বিষয়টির উল্লেখ।
‘আমাদের এই প্রথিবী’ বইটিতে প্রথিবীর জন্মকথা, মাটির প্রথিবী, মধ্যাকর্ষণ, সমুদ্র প্রভৃতি পৃথিবী ও তার পরিবেশ সম্পের্কে নানা বিষয় থেকে শুরু করে আবহমন্ডল, আয়নমন্ডল, সৌরশক্তি প্রভৃতি নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। নানা প্রসঙ্গ পরস্পরের সঙ্গে সংবদ্ধ; অথচ প্রতিটি অধ্যায়ই স্বয়ংসম্পূর্ন। ভাষা অতি প্রাঞ্জর; কিন্তু ভাষার সৌকর্যের তাগিদে তথ্যের কোন কমতি ঘটানো হয়নি। প্রকৃত পক্ষে মাত্র ১১৫ পৃষ্ঠার বইতে যে পরিমাণ তথ্য যতখানি মুনশিয়ানার সাথে পরিবেশন করা হয়েছে তার তুলনা পাওয়া দুরূহ। আগামী দিনে যখন পৃথিবীর সঞ্চিত খনি সম্পদ শেষ হয়ে যাবে তখন অতি সূক্ষ শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ বা কৃত্রিম ক্লোরফিলের সাহায্যে সূর্যশক্তিকে আরো দক্খতার সাঙ্গে ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে সব গবেষণা চালাচ্ছেন তার আলোচনা দিয়ে বইটি শেষ হয়েছে।
‘এটমের কথা’ মোটামুটি একই আকারের(১১২ পৃষ্ঠা) পরমানু বিঝ্হান সম্পর্কে একটি স্বয়ংসম্পূর্ন বই। অতি অল্প পরিসরে এটমের পরিচয়, পদার্থের গঠন-বৈচিত্র্য থেকে শুরু করে তেজষ্ক্রিয়তা, আইসোটোপ, বস্তুু ও শক্তি, পরমানু বিভাজন, পারমাণবিক শক্তি, এটম বোমা, সংযোজন ক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তি প্রভৃতি প্রায় সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। সর্বশেষ অধ্যায়ে শক্তি প্রভৃতি প্রায় সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছে। সর্বশেষ অধ্যায়ে পরিশিষ্ট আকারে এটম ভাঙ্গা, পিরিয়ডিক টেবল এবং নিউট্রিনো, মেসন প্রভৃতি অতিমৌল কণার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। খুব সম্ভব লেখক এই বিষয়গুলো বইটি প্রকাশের শেষ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ অনুভব করেন কিন্তুু তখন এগুলো ভেতরে যথাস্থানে স্থাপন করা সম্ভব ছিল না; সেটা এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময়ও সম্ভব হতে পারে।
জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই-এর ভাষা সম্পর্কিত সমস্যাটি চিরকালের। তবে বলতেই হবে সত্যেন সেনের জন্য এই বইয়ে ব্যবহৃত সহজ, সরল অথচ রসাল ভাষা সম্ভবতঃ স্বভাবজ। ‘পাতাবাহার’ বইয়ের গল্পগুলোতে তাঁর শিশু কিশোরদের উপযোগী আশ্চর্য মিষ্টি ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় শিশু মনস্তত্ত¦ সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধির। রূপকথার ধাঁচে লেখা এই গল্পগুলোতে ফ্যান্টাসি আর বাস্তবর ঘটেছে আশ্চর্য মেশামেশি-ঠিক যেমন ঘটে শিশুদের মনে। এদেশের গ্রাম-বাংলার চিরকালের শিশু কিশোরদের চেনা জানা কাঠুরে, হারণ ছানা, ভালুক, শুকপাখি, শেয়াল এমনি সব চরিত্রগুলোর সাথে যোগ হয়েছে আজকের দিনের নানা সমস্যার কাথা। আর সে ভাষা আর সে রচনাভঙ্গি বাংলা শিশু সাহিত্যের সেরা দিকপাল দিপেন্দ্রকিশোর, দক্ষিণারঞ্জন, সুকুমার রায় এঁদের ভাষার সাথে অনায়াসে তুলনীয়। আমাদের দেশে আধুনিক কালে বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য তেমন সবল নয়। সাধারণ মানুষের জীবনে আধুনিক জীবন ধারার আরো সকল উপকরণের মতই বিজ্ঞানের অধিষ্ঠানও নিতান্ত ক্ষীণ। সৌভাগ্যের কথা বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আর সংস্কৃতিসেবীরা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে বার বার এই সমস্যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। বস্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের মত দিকপাল সাহিত্যিকরা যেমন করেছেন, তেমনি করেছেন উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায় প্রমুখ শিশু কিশোরদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা লিখে।
সত্যেন সেন যে সময়ে আমাদের এই পৃথিবী’ বা ‘এটমের কথা’ লেখেন সে সময়ে এ দেশে এ জাতীয় বিষয় নিয়ে বই আর বেরোয় নি বললেই চলে। এদিক থেকে তাকে তাঁর অন্যান্য বহুমুখী কর্মধারার সাথে এদিকেও একজন পথিকৃৎ বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বপরিচয়’ বই এর ভূমিকায় অনিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ে জনপ্রিয় রচনার সেই কর্মোদ্যোগ আজ অর্ধ শতাব্দী পরেও যে অতি ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত সেটা আমাদের জন্য মোটেই তেমন সুখ বা গৌরবের বিষয় নয়।

সত্যেন সেন
কল্যান চন্দ্র
সত্যেন সেন একজন নির্যাতিত রাজনৈতিক কর্মী। তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক। শুধুমাত্র এই পরিচয়ে সমাজে, দেশে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃত লাভে সক্ষম। তাঁর বিচিত্র জীবন, জীবনবোধ এবং সাহিত্যে বহুমাত্রিক অনায়াসে বিচরন। তাঁর একটা পূণাঙ্গ জীবনী রচিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা ও অনপ্রেরণা লাভ করতে পারে।
সাম্যবাদের কবল থেকে স্বদেশ মুক্তির স্বপ্নের জন্য, মানুষকে ভালেঅবেসে তাঁদের সংগ্রামের যুক্ত হয়ে একজন সৈনিকের ভূমিকায়, তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
বিপ্লবী যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ১৯৩১ সালে তিনি তিনমাস জেল খাটেন। ১৯৩৩ সালের শেষ বা’ ৩৪ এর প্রথম ভাগে তিনি গ্রেফতার হন। পাঁচ বছর কারাবাস হয়।
এইবার জেলে যাওয়ার আগে তিনি বি.এ পরীক্ষা দিয়ে যান। জেলে এম-এ পাশ করেন। সামার অল্পকাল পূর্বে তিনি ছাড়া পান এই শর্তে যে, তিনি তাঁর কাকা ক্ষিতিমোহন সেনের সহায়তায় ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষনা করবে। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কিন্তু তা না করে সোজা বিক্রমপুরে চলে যান। উদ্দেশ্য কৃষকদের সংগঠন গড়ে তুলবেন। জেলে তিনি গভীর অধ্যায়ন করেন। কমিউনিজম এর পপ্রতি তাঁর বিশ্বাস জন্মে। তাই তিনি মুক্ত হয়ে কৃষক ফ্রন্টে কাজ আরম্ভ করেন। ঐসময়ের কথা আলোচনা করতে গিয়ে জ্ঞানচক্রবর্তী লিখেছেন(ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ) “১৯৩৭-১৯৩৭ আন্দামান ও বিভিন্ন জেল থেকে বহু সংখ্যক অভিজ্ঞ নেতৃস্থানীয় বন্দী মুক্তি লাভ করিয়া ঢাকায় আসেন এবং পার্টিতে যোগ দেন। জেল খানা হইতে ইহারা কমিউনিজমের আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে ……জীবন চ্যাটার্জী ্রপের সত্যেন সেন প্রবোধ, সুশীল ঘোষ… পৃষ্ঠা-১৯। অন্যাত্র ঐ (পৃষ্ঠা-৬২ খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়) তিন টাকার চাল চৌদ্দ হয়ে যায়, পরে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এসময় কমরেড সত্যেন সেন এ সমস্যার উপর একটা গান রচনা শুরু করেন। যাহা জিলার সর্বত্র যাওয়া হয় এবং অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। গানটির দুই পঙক্তি নি¤œরুপ :
“চাউলের মণ চৌদ্দ টাকা কেরোসিন তেল নাইরে
কেরোসিন তেল নাই, হায় কি করি উপায় রে,কি করি উপায়”।
বেঝা যায় এ গানটি ১৯৫৩ এর দুর্ভিক্ষের আগের।
এপ্রিল ৪১’ এ ঢাকায় ডাঙ্গা হয়। আমরা দক্ষিন মৈশন্ডীর ৪৭ নং লাল মোহন সাহা স্ট্রীট বাসা পরিবর্তনে বাধ্য হই। চলে আসি ঠাটারী বাজারের বামাচরণ চক্রবর্তী রোডে (মনে হয় ১৩ নম্বর হবে)। ২০০৩ সালে আমি ড. আমিনুর রহমান সুলতানের সঙ্গে গিয়ে ঐ দোতলা বাড়িটি ( সামনে সামান্য সংযোজন ভিন্ন) একই রকম দেখেছি।
ঐ বাসায় ৪১ এর শেষের দিকে সত্যেন সেনকে দাদার কাছে আসতে দেখেছি। ৪২ এ ও দাদার মৃত্যুর আগে হয়ত এসে থাকবেন। কিন্তু তখন আমরা ছোটরা, মা-বাবার সাথে দেশের বাড়ি বাড়িয়ায় ছিলাম। ঢাকায় দাদা, বীনা মাসী মা ও বড়বোন রুবি ছিলেন। দাদা তখন প্রগতি লেখক সংঘের প্রধান সংগঠক, উদীয়মান লেখক এবং গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।
মনে আছে সত্যেন সেনকে। অতি সাধারণ পোশাক, ধূতি হাটুর সামান্য নীচে (যতদূর মনে পড়ে খালি পা)। পরে বড়দের মধ্যে আলোচনায় তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধষেু ভাব লক্ষ করেছি। দাদা ও মংক্ষের সঙ্গে সত্যেন সেনের এই যোগাযোগ ওনাকে লেখক হতে অনেকখানি প্রভাবিত করেছে, এটা বলা যেতে পারে।
৮ই মার্চ ১৯৪২ সালে দাদার হত্যার পর, সত্যেন সেন লেখক সংগে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সন্ত্রাসবাদী লেখক সাম্যবাদী সত্যেন নে কৃষক সংগঠনের পাশাপাশি লেখক সংগের অন্যতম সংগঠক। এই ভূমিকা সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ আবির্ভাবের অনুঘটকের কাজ করেছি। লেখক সংঘ সংগঠনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে কয়েকটা তথ্যের উল্লেখ করেছি।
সংঘের অন্যতম প্রধান, কবি কিরণ শংকর সেনগুপ্ত পরিচয় পনে সংঘের মুখপত্র “প্রতিরোধ” সম্পর্কে লিখেছেন…….“এই সময় সত্যেন সেন, অজিত কুমার গুহ, সরলান্দ সেন, অসিত সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সানাউল হক, সৈয়দ নূরউদ্দিন, রণেশ মজুমদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশনার ব্যাপারে নানা দায়িত্ব এই পত্রিকার অন্তত কয়েকটি বছর অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছিলেন।
কবি কিরণ শংকর “প্রতিরোধ” প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম নামটি লিখেছেন সত্যেন সেনের। তথ্যের দিক থেকে এটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
রণেশ দাশগুপ্ত (উদীচী প্রকাশিত গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ভূমিকায়) লিখেছেন। ৩৮ সালেই ঢাকা শহরে যে প্রগতি সাহিত্যের আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে ওঠে এবং চল্লিশের দশকে সোমেন চন্দের রেখে যাওয়া সাধনাকে ভিত্তি করে এবং যে প্রসার ঘটে, সত্যেন সেন তার সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্ট ভাবে যুক্ত করেন।
এই সময়ে প্রগতি সাহিত্যের বৈঠকে দু,একটি ছোট গল্প পড়েছিলেন। কিন্তু লেখক সংঘ, প্রগতি লেখক ও শিল্পী-সংঘ নাম নিয়ে সাহিত্য ও সঙ্গীতকে একত্র করার পর্যায়ে তিনি এতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
সেদিন প্রায় প্রত্যেক লেখা পাঠ করা হত সংঘের সভায় আলোচিত হত। প্রধান আলোচক-সমালোচক ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত ও অচুৎও গোস্মামী। এই প্রক্রিয়ার ফলে অনেকে সাহিত্যের অঙ্গণে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন সঙ্গীতে তখন অনেক প্রতিষ্ঠা করতে পেলেও সত্যেন সেনের দু’একটি গল্প পড়াকে কথাসাহিত্যে তার প্রবশকাল বলে গণ্য করা যায়।
এই সময় সংঘে যুক্ত হয়েছিলেন আর একজন প্রতিভাবান শিল্পী সাধন দাশগুপ্ত। তিনি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তিনি নাট্য দল গঠন করে নাটক পরিচালনা করতেন। বলার অপেক্ষ রাখে না সুঅভিনেতা ও ছিলেন। সত্যেন সেন ও সাধন দাশগুপ্তের কর্মকা-ের সাথে ঢাকা জেলার সাম্যবাদী সংস্কৃতির অনেক প্রসার ঘটেছিল। পার্টির প্রভাব বৃদ্ধিতে সাধু ভূমিকা ছিল।
সরদার ফজলুল করিম ঐ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, “……..১৯৪০ এর দশকে তখন তিনি একজন কমিউনিস্ট কর্মী এবং সাহিত্য সংগঠক ছিলেন। ঢাকা জিলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এ সংগঠনের নিয়মিত সভা আহবান, এর মুখপত্র প্রকাশ কিংবা প্রগতি লেখকদের সম্মেলনের আয়োজন এবং এর কোন সংকলন প্রকাশ প্রচেষ্টার একজন কর্মী ছিলেন সত্যেন সেন”।
উপরের তিনজন শ্রদ্ধাভাজনদের বক্তব্য এটাি পরিস্কার, কৃষক সংগঠনে নিবেদিত সত্যেন সেন, সোমেন চন্দের হত্যার পর (৮ই মার্চ ১৯৪২) সংঘে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কমিউনিজমে বিশ্বাসী সত্যেন সেন কৃষকদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেন, সঙ্গীত এক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। শান্তিনিকেতনের সাথে তাঁর গভীর যোগাযোগের ফলে, সঙ্গীতের নানান শাখা নিয়ে তাঁর সাম্যক ওদাত্ব ছিল।
পূর্ব বাংলার লোকসঙ্গীত যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী ছিল। কবি গানও। নজরুল ইসলামের দেশাত্ববোধক গান চারণ কবি মুকুন্দ দাশ যাত্রা এ গান গেয়ে স্বদেশ মুক্তির সংগ্রাম যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন।
সত্যেন সেন গানের স্কোয়াড পরিচালনা ছাড়াও নির্বাচনের সময় কবি গানের দলও গড়েছিলেন। এই সব প্রচেষ্টার শেষে স্থায়ীভাবে একটি গণসংগঠনের প্রয়োজন বোধ করেন। অই কয়েকজন মাত্র সহশিল্পীদের নিয়ে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর “উদীচী” প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সংগঠন আজ বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হিং¯্র আক্রমন সত্ত্বেও দৃঢ়তার সঙ্গে এই সঙ্গের শিল্পীরা সক্রিয় রয়েছেন। এই সংগঠনের অন্যতম প্রধান গোলাম মোহাম্মদ ইদু তথ্য অনুযায়ী, আজ “উদীচীর” সভা সংখ্যা ৮ হাজার। শাখা ২১০টি। তাঁর মধ্যে বিদেশেও ৫টি শাখা রয়েছে।
উদীচীকে আমার অনুরোধ, সত্যেন সেন রচিত সূরারেপ্তিত গানগুলি সংগ্রহ করে পুস্তক প্রকাশনার ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করা হোক। তাঁর সময়কার শিল্পীদের অনেকে এখনও নিশ্চয় রয়েছেন। পরে হয়ত অনেক গান হারিয়ে যাবে। সাহিত্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোয্য। আমার দাদার ক্ষেত্রে দেখেছি মৃত্যুর সত্তর বছর পরেও তাঁর অগ্রন্থিত গল্প পাওয়া গেছে।
গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ভূমিকায় রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন……..সব মিলিয়ে ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে তিনি তের বছর জেল কেটেছেন। ব্রিটিশ আমলে তিনি ৫ বছরের মত জেল কারাবাস কাটিয়েছেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সত্যেন সেন ১৮ বছরের উপর জেল খেটেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন অন্তরীণ ও আত্বগোপনের সময়ও।
যদিও কারাবাসকালে বন্দীদের অনশন ধর্মঘটে তাঁর অংশগ্রহনের কোন তথ্য জানা যায় না। তবু তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যদের মত তিনিও নিশ্চয় তাঁর অংশীদার ছিলেন।
এ ক্ষেত্রে রণেশ দাশগুপ্তের কথাই ধরা যাক।
১৯৪৯ সালে ১১ই মার্চ থেকে ৫ দিন
ঐ সালে দ্বিতীয়বার ৪০ দিন
তৃতীয়বারে-কদিন জানা নেই।
চতুর্থবারে অনশন ছিল অনির্দিষ্ট কালের।
এই সময় আমাদের উপমহাদেশে কোন লেখক, অনুরুপ নির্যাতন ভোগ করেছেন বলে আমার জানা নেই। হয়তবা সারা বিশ্বেও দূর্লভ।
১৯৬৭ সালের আগেই তিনি হাঁপানিতে আক্রান্ত হন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে আরম্ভ করে। ১৯৭১ সালে তিনি রাশিয়ায় যান। তারা সত্যেন সেনকে কোন আশার কথা শোনাতে পারেনি। ক্রমে তিনি অন্ধ হয়ে যান।
পাকিস্তানী আক্রমন কালে, ‘৭১ সালের ২ শে মার্চের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের চলে আসতে বাধ্য হন। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে দুরে তাদের উৎসাহিত করেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বইও লেখেন।
বাংলাদেশ মুক্ত হলে তিনি ঢাকায় যান। রণেশদাও। ‘৭৩ এ তাঁর শরীর আরো খারাপ হয়। তিনি শান্তিনিকেতনের দিদি প্রতিভা সেনের কাছে চলে আসেন। রণেশদাও‘৭৫অক্টোবরে বিমানের রির্টান টিকিট কেটে কলকাতা চলে আসেন। আর ফিরে যাননি। কেবলমাত্র মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আমি যতদুর বুঝেছি, বাংলাদেশের সকলের বরেণ্যএই দুইজন, যারা আমৃত্যু নিজেদের বাংলাদেশী বলে গর্ববোধ করতেন তাঁরা যে আর দেশে ফিরে যেতে চাননি, তাঁর নিশ্চয় কোন না কোন কারণ রয়েছে।
সত্যেন সেনের সত্যেন নেসের জন্ম ২৮শে মার্চ ১৯০৭ সাল। মৃত্যু ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সাল : অর্থাৎ জীবনকাল ৭৩ বছর ৯ মাস ৭ দিন।
তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতায়, তথ্যকেন্দ্রের দোতলায় এক সমরণ মজা হয়েছিল। রণেশদার সাথে গিয়েছিলাম। অল্প সংখ্যক উপস্থিতি, খুব খারাপ লেগেছিল। তাঁরমত একজন সর্বত্যাগী সুপ্রতিষ্ঠিত লেখকের প্রতি এবঙ্গের অবজ্ঞায় বেদনাহত হয়েছিলাম।
দাদার ক্ষেত্রেই দেখেছি, ঢাকার লেখক হওয়ায়, কিরণশংকর সেনগুপ্ত ও রণেশ দাশগুপ্ত প্রভৃতির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি পশ্চিমবঙ্গেই যোগ্য স্বীকৃতি পাননি।
এই উপেক্ষা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে এদের সাহিত্যও বেঁেচ থাকবে। আত্বত্যাগ ও অনুপ্রেরনা জোগাবে।

কল্যাণচন্দ
কোলকাতা
১৯/০৩/২০১৪

মানবমুক্তির এক নিবেদিত প্রাণপুরুষ সত্যেন সেন
প্রফেসর মাহফুজা খানম
প্রথমেই সত্যেন সেনের উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমার বাল্য স্মৃতিতে ১৯৫৩-১৯৫৪ সালের কথা বলতে গেলে মনে পড়ে আমাদের ৩৬নং স্বামীবাগে একজন আমার আব্বার মতোই দেখতে গড়নে হালকা-পাতলা একহারা গড়ন, পায়জামা, শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল, মোটা চশমা পরে আসতেন আমাদের বাড়িতে, যাঁকে আমরা সত্য কাকা বলে ডাকতাম।
সত্য কাকা আমাদের বাড়িতে এলেই আব্বা বলতেন ‘কি সত্য বাণী শুনাইতে আসিলা’? উত্তরে সত্য কাকা বলতেন ‘চিরকাল মহাসত্য প্রকাশিয়া যাইব’। এমন পরিবেশে আব্বা-সত্য কাকার গল্প আলোচনা চলত। আমরা ভাইবোনেরা মুড়ি-মাখাসহ অন্যান্য নাস্তা নিয়ে যেতাম। সত্য কাকার সঙ্গে আমরাও খেতাম। নানা গল্প বলতেন- এখনও মনে আছে সত্যকাকা নানা ইতিহাস, রাজনৈতিক গল্প, মজার মজার গল্প, বিপ্লবীদের গল্প, দেশে দেশে বিপ্লবের ইতিহাসের গল্প বলতেন। পৃথিবীকে আরেক আঙ্গিক থেকে দেখবার শুরু আমার সেই থেকেই। আব্বার সঙ্গে কাকুর বয়সের পার্থক্য কমই ছিল। আব্বার জন্ম ১৯১০ এর ১০ জুলাই সত্যকাকু ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ। তাদের দু’জনের বন্ধুত্ব কবে কখন কোথা থেকে জানি না। সম্ভবত কলকাতা থেকে। আব্বা ও সত্যকাকু দু’জনেই যুগান্তরের (বিপ্লবী দল) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এটি আমি জানি।
উনিশ শতক! সারা বিশ্বে ভাঙ্গাগড়ার নতুন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন, বিশ্বে মার্কস এঙ্গেলসের নতুন রাজনৈতিক দর্শনের উন্মেষ ও চর্চা, ইউরোপের রেনেসাঁ। এর প্রভাবে সত্যকাকা তাঁর জীবন চেতনাকে প্রভাবিত করেছিল। সমগ্র বিশ্বের মানবমুক্তি, ধনতান্ত্রিক বিশ্বের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে দেখবার স্বপ্ন তাঁকে এক নতুন পথের যাত্রী হিসেবে জীবন পরিচালনায় ব্রতী করেছিল।
সত্যকাকা জন্মেছিলেন বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ি থানার সোনারঙ গ্রামে, শান্তি কুটীর নামের বাড়িতে। তিনি ছিলেন মা-বাবার চতুর্থ সন্তান। তাঁর পুরো নাম সত্যেন্দ্রমোহন সেন, ডাকনাম লস্কর। তাঁর বাবা ধরণীমোহন সেন। পরিবারের ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য। স্বনামধন্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন সত্যকাকুর কাকা। শিশু সাহিত্যিক মনোমোহন সেন, মুরারীমোহন সেন সত্যকাকুর বড় ঠাকুরদা; প্যারিমোহন সেনের প্রথম ও পঞ্চম পুত্র। সত্যকাকুর বাবা ধরণীমোহন সেনের নামেই সোনারঙ গ্রামের স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধরণীমোহন সেন। সত্য কাকার বাবার নিজের ছিল প্রতœতত্ত্ব চর্চার অভ্যাস আর এ বিষয়ে তাঁর লেখা তৎকালীন উল্লেখযোগ্য পত্রিকা প্রবাসীতে ছাপা হয়েছিল। এ কথাগুলো থেকে বোঝা যায় কাকুর পরিবার যথার্থই শিক্ষা সংস্কৃতিতে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবার। নিজ গ্রামে অর্থাৎ সোনারঙ স্কুলেই, কাকুর লেখাপড়ার হাতেখড়ি।
তাঁর বাল্যকালের বন্ধু ছিল কাকুর বড় ভাই জিতেন সেন (শঙ্কর)। আরও একজন, বাউ ওরফে মাহাঙ্গু বানিয়া কাকুর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। বাউ সত্যকাকুর ঠাকুর মার পালিত পুত্র। কে এই মাহাঙ্গু? দুর্ভিক্ষের সময় ১০/১১ বছরের এক বালক এলাহাবাদ থেকে হেঁটে কাশিতে আসেন। তাঁর বাবা-মা নেই, কেবল তার বাবার নাম রামতুন বানিয়া বলতে পেরেছিল। সত্যকাকুর জ্যাঠামশাই মাহাঙ্গু বানিয়াকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। সেই থেকে মাহাঙ্গু এই পরিবারের একজন হয়ে গেল। সত্যকাকুর সব ভাই-বোন মাহাঙ্গুর কোলেপিঠে চড়েই বড় হয়েছে। মাহাঙ্গুর প্রভাব তাঁর জীবনে অনেক অবদান রেখেছে।
কাকুর প্রথম রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় ১৯২১ সালের টঙ্গিবাড়ির এক জনসভায় গিয়ে, তখন কাকু অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, সঙ্গে ছিল মাহাঙ্গু। এই জনসভা শেষে কাকু মাহাঙ্গুকে কথা দিয়েছিল বড় হয়ে কাকু দেশের জন্য কাজ করবেন। কাকু এর পরদিনই যে নেতার বক্তৃতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করেন কংগ্রেস পার্টির অফিস টঙ্গিবাড়িতে। কাকুর বয়স বিবেচনা করে সেই নেতা তাঁকে পার্টি কর্মীদের খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে মুষ্টি ভিক্ষা করে চাল সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন, এটিই ছিল কাকুর জীবনের প্রথম রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন।
এই সময় চৌরিচরার ঘটনার পর গণআন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হল। যারা স্কুল/কলেজকে ‘গোলামখানা’ বলে শিক্ষায়তন ত্যাগ করেছিলেন তাঁরা এক গভীর সঙ্কটে পড়লেন। এমন রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় ঘটে যাচ্ছিল অনেক অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক ঘটনা- এর মধ্যে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের যুদ্ধ, মেদিনীপুরের তিন ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা ইত্যাদি। ব্রিটিশ রাজ খতম করার আকাক্সক্ষার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে যুবসমাজে। কাকুও এর বাইরে থাকতে পারলেন না। স্কুল শেষে কলেজে পড়ার জন্য কাকু কলকাতায়, বিপ্লবী দল যুগান্তরে নাম লিখালেন আশ্বিন ১৩২৫ এ। একদিকে স্বদেশী সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, সঙ্গে শুরু করলেন সাহিত্য চর্চা। ১৯৩১ সালে সত্যকাকু প্রথম কারাবন্দী হন। কোন একটি বাড়িতে কিছু অস্ত্রের সঙ্গে সত্যকাকুর লেখা এক চিঠি পাওয়া যায়। যার ফলশ্রুতিতে কলকাতার মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, সে সময় তিন মাস তিনি কারাবন্দী ছিলেন। জীবনের এক নতুন দিগন্তে তাঁর পদচারণার শুরু।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নতুন পদযাত্রা শুরু। এ সময় খুলনার নারায়ণ চন্দ্র ব্যানার্জী তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৩৩ এ কাকু দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন। তাঁর মা তখন বেরিবেরি জ্বরে গুরুতর অসুস্থ। মায়ের অসুখের টেলিগ্রাম পুলিশের হাতে পড়ায়, পুলিশ কলকাতায় কাকুকে গ্রেফতার করে। আলীপুর জেলে রেখে পরে বহরমপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়। একটানা ৫ বছর বহরমপুর জেলে থাকাকালীন কাকু সেখানকার কমিউনিস্ট পাঠচক্রের সংস্পর্শে আসেন। জেলে বসেই জীবনের দর্শনের এক বিরাট পরিবর্তন হলো। লেখাপড়া-তর্কবিতর্ক ইত্যাদির মধ্যে কমিউনিজমের পাঠ গ্রহণ করে অবশ্যি জেলে যাওয়ার আগেই তিনি বিএ পাস করেন। পরে জেলে থেকেই বাংলায় এমএ পরীক্ষা দেন। এই সময় মা মারা যান, কিন্তু তাঁর দাদা শঙ্কর ও তাঁর স্ত্রী-প্রতিমাও তাঁর পাশে ছিলেন সবসময়।
এর মাঝে ১৯৩৮ সালে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মুক্তি পান এ শর্তে- কাকা ক্ষিতিমোহন সেনের সাহায্যে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রিসার্চ করবেন। কিন্তু সত্যকাকু তখন আরেক মানুষ, মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে সকল অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে চলে এলেন আপন গ্রামে। গ্রামে আত্মীয়স্বজন সব কলকাতাবাসী হয়েছে, কেবল রয়ে গেছে শৈশবের সঙ্গী বাউ- মাহাঙ্গু বানিয়া।
বিক্রমপুরের কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন, সঙ্গে ছিলেন কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ। জিতেন ঘোষ সত্যেন সেনের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সত্যেন সেন সারা বিক্রমপুর চষে বেড়াতেন। বিশ-পঁচিশ মাইল রাস্তা তিনি অনায়াসে হেঁটে যেতেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও নিরহঙ্কার চরিত্র, নির্মল বন্ধুপ্রেমই তাঁকে বিক্রমপুরের কর্মীদের কাছে প্রিয় করে রেখেছে। তাঁর ত্যাগোদীপ্ত চরিত্র একমাত্র তাঁরই বৈশিষ্ট্য। মানবপ্রেম এবং গণশক্তিতে বিশ্বাসই তাঁর সমস্ত শক্তির উৎস।’
কাকু সেই সময় সাধন দাশগুপ্তসহ একত্রে অনেক গান লিখেন ও সুর করেন যা গাওয়া হতো সেই সময় জেলায় জেলায়। সত্যকাকা নিজেই একজন ভাল গায়ক ছিলেন। তখন একটা কবিয়াল দল গঠন করেন। ১৯৪৬ সালে কবিয়াল দল নারায়ণগঞ্জে বিশিষ্ট জননেতা কমরেড ব্রজেন দাসের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা করে গান গেয়ে। এই কবিয়াল দল নারায়ণপুর, রহিমাবাদ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়াও তখন তিনি প্রগতিশীল লেখকদের একত্রিত করে নিয়মিত সভা, এর মুখপত্র প্রকাশ, প্রগতিশীল লেখকদের সম্মেলন করেছেন, বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন।
চলে এলো ১৯৪৭ সাল। ভারত পাকিস্তানের জন্ম হলো। ’৪৭ এরপর পাকিস্তানী জান্তা কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও কমিউনিস্টদের ওপর দারুণ অত্যাচার শুরু হয়। সত্যকাকু আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু তিনি ধরা পরে যান ১৯৪৯ সালে বনগ্রাম লেনের এক বাড়ি থেকে। প্রথমে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত হন। পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল শাসন আমলে সত্যকাকু ১৩-১৪ বছর জেলে বন্দী ছিলেন। ১৯৪৯ এ গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ তে আবার জেলে। ১৯৫৫ এ মুক্তি, ১৯৫৫-৫৭ এ যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ সরকার থাকায় মুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল’ল এলো। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে জেল জীবনে ছিলেন। ১৯৬৫ সালে দেশ রক্ষা আইনে আবার গ্রেফতার হন। সম্ভবত ১৯৬৭ বা ১৯৬৮ এর প্রথম দিকে মুক্তি পান।
এরপর কাকুর আরেক নতুন সংগ্রাম। জেলে থেকে তাঁর পড়াশুনা ও লেখালেখি, সাহিত্য চর্চার এক অপার জগতে তিনি প্রবেশ করেন। তাঁর সাহিত্য চর্চা পুরোদমে গতি পায়। তাঁর লেখা চলে অবিরাম। তিনি ৪০টি’র বেশি বই লিখেন। এর মধ্যে রয়েছে: আলবেরুনী, ভোরের বিহঙ্গী, জীববিজ্ঞানের নানা কথা, সেয়ানা, গ্রামবাংলার পথে পথে, ইতিহাস ও বিজ্ঞান (১ম খ-), ইতিহাস ও বিজ্ঞান (২য় খ-), বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম, সীমান্ত সূর্য গাফফার খান, অপরাজেয়, কুমারজীব, মানবসভ্যতার উষালগ্নে, বিদ্রোহী কৈবর্ত, মনোরমা মাসীমা, পাপের সন্তান, বিপ্লবী রহমান মাষ্টার, শহরের ইতিকথা, উত্তরণ, পাতাবাহার, মসলার যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহের কাহিনী, অভিশপ্ত নগরী, প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ, পুরুষমেধ, সাত নম্বর ওয়ার্ড, রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ, মা, একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে, পদচিহ্ন, অভিযাত্রী, এটমের কথা, আমাদের এই পৃথিবী, মেহনতি মানুষ, আইসোটোপ, বিকিরণ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা, প্রাচীন চীন, প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগ, ইতিহাস ও বিজ্ঞান (৩য় খ-), বিশ্বমানবের মহাতীর্থে, কমরেড মণি সিং ইত্যাদি।
প্রতিটি লেখায় নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কথা, ইতিহাস নির্ভর, বিজ্ঞানভিত্তিক। তাঁর লেখা ৪০টি বই মানবমুক্তি, মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়ার মতো বিষয়বস্তুই প্রাধান্য পায়। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েননি। তাই ১৯৬৮ সালে প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিকাশের জন্য ‘উদীচী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন যার প্রথম প্রতিষ্ঠিত সভাপতি সত্যেন কাকু। উদীচী এখনও তার স্বমহিমায় কাজ করে চলেছে।
তাঁর কর্মবহুল জীবনে তাঁর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৭০ সালে, একুশে পদক পান ১৯৬৮ সালে, তাঁর মৃত্যুর পর। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কর্মযজ্ঞে ব্যাপৃত হন। শরীর ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ে, চোখে কম দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের পর কিছুদিন বাংলাদেশে থেকে পরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ওখানে চোখে কম দেখার জন্য লিপিকার দিয়ে লেখাতেন। এক অদম্য প্রাণ স্পৃহা সম্পন্ন মানুষ মানবমুক্তির অমৃত জীবনধারায় যিনি সিক্ত, সত্যেন কাকু ৭৩ বছর ৯ মাস ৮ দিন এই ধরাধামে থেকে ১৯৮১’র ৫ জানুয়ারি মানবমুক্তির এক সংগ্রামী অবিসংবাদিত নেতা আমার সত্যেন কাকু আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেন।
আমরা যারা তাঁর উত্তরসূরি তারা লজ্জিত, তাঁর মতো এক মানবমুক্তির যোদ্ধাকে জাতির কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আজ ক’জন জানে সত্যেন সেনকে। তাঁর প্রচুর লেখা এখনও নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে, তাঁর সব লেখা নিয়ে সত্যেন সেন গ্রন্থাবলি রচনা সমগ্র প্রকাশ করে আমরা আমাদের দায়মুক্ত করতে পারি। তাঁর জীবনদর্শন থেকে শিক্ষা নিলে জাতি সচল হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি নতুন পথের দিশা পাবে। সত্যেন সেন চিরজীবী হোক।

লেখক : সভাপতি, বিশ্বশিক্ষক ফেডারেশন,
সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

দুই নয়নে দেখা হয় নাই, তৃতীয় নয়নে দেখেছি
ইকবালুল হক খান
সত্যেনদাকে সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। উদীচীর সাথে যুক্ত হওয়ার আগে সত্যেনদাকে জানতাম একজন সাহিত্যিক হিসেবে এবং উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। উদীচী’র সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সত্যেনদা সর্ম্পকে জানতে শুরু করলাম, প্রতিদিনই যেন একটু একটু করে জানতে চেষ্টা করছি । বিপ্লবী সত্যেন সেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার সোনরং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ধরণী মোহন সেন , মা মৃণালিনী সেন বাবা মার দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে সত্যেনদা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। সত্যেনদার দুই বোন ইন্দুবালা সেন ও প্রতিভা সেন, ভাই জিতেন্দ্র মোহন সেন। সত্যেন সেনের দাদা ক্ষিতি মোহন সেন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠীত শান্তি নিকেতনের অধ্যক্ষ। সোনারং গ্রামের স্কুলে সত্যেন সেন লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯২১ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় কংগ্রেসের হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯২৪ সালে সত্যেন দা সোনা রং স্কুল থেকে ম্যাট্্িরক পাশ করেন । ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য কলকাতায় চলে যান। কলেজে অধ্যয়ন রত অবস্থায় যোগ দেন বিপ্লবী দল যুগান্তরের সাথে। স্বদেশী বিপ্লবী কাজে তাকে উৎসাহ যোগাতেন তার মেজ দি প্রতিভাসেন । তার সাহিত্য চর্চ্ওা শুরু হয় সেই সময় থেকেই।
১৯৩১ সাথে সত্যেন দা প্রথম কারা ভোগ করেন। তিন মাস জেল হয় তার । জেলখানায় বসে সত্যেন দা রাজনৈতিক ভাবনার জন্ম হয়, সমাজতন্ত্রের পরিচয় ঘটল এবং সমাজতন্ত্র কে আদর্শ বলে গন্য করলেন তিনি ।
১৯৩২ সালে সত্যেন দা দ্বিতীয় বারের মতো গ্রেপ্তার হন। প্রথমে আলীপুর জেলে এবং পরবর্তীতে বহরমপুর জেলে, এবার তাকে টানা পাঁচ বছর জেলে থাকতে হয়। এই জেল জীবনই ছিল সত্যেন দার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জেলে থাকা অবস্থায় এম এ পাশ করেন। জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। সত্যেন দা চলে এলেন নিজ গ্রাম সোনারংএ । এর পর প্রখ্যাত কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ এর সাথে কৃষক আন্দোলন গড়ার কাজ শুরু করেন। কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি ঢাকা, রায়পুরা, নরসিংদী,মুন্সীগঞ্জ,বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে কাজ করেন। সত্যেন দা এসময় শুধু কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না। তিনি একই সাথে ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্, লক্ষèীনারায়ণ কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ্ও ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাট কলের ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক শ্রেনীকে তাদের ন্যায্য মজুরী, দাবী দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করার কাজে আতœনিয়োগ করেন। এছাড়্ওা এসময়ে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে।
চল্লিশের দশকে ঢাকায় প্রগতী লেখক সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪২ সাথে ঘাতকদের হাতে সোমেন চন্দ নিহত হবার পর সত্যেন সেন এই সংগঠনের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪২ সাথে তিনি প্রথম গান রচনা করেন ”লীগ কংগ্রেস এক হও” এই গান বাংলায় সর্বত্র গাওয়া হতো এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জণ করে। ১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময় সত্যেন দা শ্রমিক- কৃষক দের সাথে নিয়ে নিরন্ন মানুষের জন্য লঙ্গর খানা খুলে খাদ্যের ব্যবস্থা করেন । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমিউনিস্টদের উপর জুলুম অত্যাচার শুরু হয়, সত্যেন দা তখন আতœগোপনে চলে যান। বাঙ্গালীর জাতীয় ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেবার গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়, প্রথম আঘাতটা আগে ভাষার উপর , শুরু হয় ভাষা আন্দোলন । এই অবস্থায় ১৯৩৯ সাথে সত্যেন দা কে ঢাকার বনগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং চার বছর কারাগারে কাটান। প্রথমে রাজশাহী জেলে এবং পরবর্তী ঢাকা জেলে বন্দী রাখা হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি মুক্তি পান, মুক্তি পাবার পর চলে যান নিজ গ্রাম সোনারং এ আবার শুরু করলেন কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই কাজ করতে লাগলেন । আর এই কারনেই পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছরের মধ্যে আঠারো বছরই সত্যেন দা কে কাটাতে হয় জেলে আর বাকী সময় টা আতœগোপনে। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে পরবর্তীতে ১৯৫৮-১৯৬৩ সালে কারাগারে কাটান। ১৯৬৫ সালে আবার গ্রেপ্তার করে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সত্যেন দাকে কারাগারে আটক রাখা হয়।
সত্যেন দার কাছে সাহিত্যই ছিল সংস্কৃতির প্রাণ। সেই সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌছে দেবার জন্যই তিনি আশ্রয় নেন সাহিত্যের দ¦ারে। সেই দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের জীবন মুখি, সমাজ তান্ত্রীক বাস্তবতার সাহিত্য নির্মাণের অগ্রপথিক ছিলেন সত্যেন দা।
১৯৬৮ সাল সত্যেন দা জীবনের এক বিশেষ তাৎপর্যময় সময়। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্বপ্নের সংগঠন “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” যদিও উদীচী’র কার্যক্রম তিরি তাঁরও অনেক আগে শুরু করেছিলেন। সামগ্রীক পরিস্থিতির কারণে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর “উদীচী” নামে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে তিনি মগ্ন থাকেন সাহিত্য রচনায়। ১৯৬৯ সালে তিনি রচনা করেন ৬টি গ্রন্থ এবং ১৯৭০ সালে সত্যেনদার ১১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
সত্যেনদার জীবনের একটি অংশ কেটেছে সাংবাদিকতায়, তিনি দৈনিক সংবাদের সংবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে মহা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় সত্যেনদা মুন্সিগঞ্জে ছিলেন। সে সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও মনের দিক দিয়ে সতেজ ছিলেন। সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তিরি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরীর কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। বিভিন্ন শিবির ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেন গণহত্যা ও “প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” নামক গ্রন্থ। সত্যেনদা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই দেশে ফিরে আসেন ¦ং দেশ পূর্ণগঠনে যথাসাধ্য কাজ করেন। এক পর্যায়ে শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে তিনি তাঁর মেজদি প্রতিভা সেনের কাছে শান্তি নিকেতনে চলে যান। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি প্রতিভা সেনের সত্যেন দা মৃত্যুবরণ করেন।

সত্যেনদার বিখ্যাত বাণী-
“ মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান,
মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ”।
সত্যিই সত্যেনদা নিজের জীবনের সকল অর্জন মানুষের মাঝে ঢেলে দিয়ে গেছেন। হালকা, পাতলা গড়নের ছোট-খাট আকৃতির মানুষটি যে এত বড় মাপের মানুষ এবং বহুবিদ গুণের অধিকারী তা আগে জানা ছিল না; তার জীবনের সকল কিছু জানা মনে হয় এক জনমে সম্ভব নয়। তিনি সাহিত্যক, রাজনীতিবিদ, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী-সংগ্রামী, সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশকে এবং এদেশের মানুষকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন কিন্তু বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। সত্যেনদাকে ভালোভাবে চিনতেন ব্রিটিশ-পাকিস্তানী সরকার, এ কারণে হয়তো তাকে দীর্ঘ দিন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। পুরো মানুষটি ছিল একটা বারুদ, যার বিস্ফোরনের ভয়েই ব্রিটিশ-পাকিস্তানী সরকার তাকে দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন। কারাগারে বসেই তিনি সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন রচনা করেছেন। সত্যেন দা বাংলার শ্রমিক ,কৃষক মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গ্রাম বাংলার পথে পথে ঘুরে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে মুক্তির বাণী শিখিয়েছেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কৃষক সমিতি গঠন করে কৃষক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন এবং কৃষক তাঁর ন্যায্য পাওনা পাবে সে ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করেছেন, কৃষকদের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছেন। তিনি মনে করতেন বক্তৃতা, বিবৃতির চেয়ে গানের মাধ্যমে হয়তো মানুষকে কাছে টানা সহজ হবে এবং মানুষের মাঝে মুক্তির বার্তা সহজে পৌছে দেওয়া যাবে, মানুষ তার অধিকার সর্ম্পকে বুঝতে পারবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী হবে, গঠন করলেন গানের দল, ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর নাম দিলেন “উদীচী”। এদেশে পাকিস্তানী শাসকদের অত্যাচারে যখন দেশের টালমাটাল অবস্থা ঠিক সেই সময়েই তিনি উদীচীর যাত্রা শুরু করলেন, শুরু করলেন সুসংগঠিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক আন্দোলন পথ তৈরী হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র পাই।
কোন দেশের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানলে সে দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায় না। এ কারনেই পাকিস্তানী সরকার আমাদের সংস্কৃতির উপর বারবার আঘাত হেনেছে। সত্যেনদা সংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সে আঘাত মোকাবেলা করে জয়ী হয়েছেন এবং আমাদেরকে লড়াই-সংগ্রাম করে জয়ী হবার পথ দেখিয়েছেন, বহু গুনের অধিকারী সত্যেনদার অন্যতম সৃষ্টি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। উদীচী’র সকল প্রত্যেক কর্মী-তাঁর আদর্শকে ধারণ করে, তিনি যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের কর্মজীবন উৎসর্গ করা এবং একটি শোষণ মুক্ত হাসি-গানে মুখরিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সংবিধানের ৪ মূলনীতির ৩ মূলনীতি হচ্ছে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা এক বাক্যে উদীচী বলতে বুঝি, একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিকামী, সেচ্ছাসেবী গণসাংস্কৃতিক সংগঠন। অর্থাৎ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উদীচী’র লক্ষ্যে আদর্শ একই সূত্রে গাঁথা । সত্যেনদার স্বপ্নের বাংলাদেশ ও উদীচী’র লক্ষ্য আদর্শ অভিন্ন। সত্যেনদা যেভাবে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন সেভাবেই উদীচী প্রতিষ্ঠা করেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও আমরা সে জায়গায় অবস্থান করতে পারিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি, যেমনটি সত্যেনদা চেয়েছিলেন। এর অন্যতম আমাদের দেশের সংস্কৃতিবিহীন রাজনীতির প্রচলন হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিছুটা সঠিক পথে চললেও ১৯৭৫ এর পর আবার পাকিস্তান ধারায় চলে এসেছে এবং সে ধারা এখনো পর্যন্ত বলবৎ আছে। এ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সত্যেনদার আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। সত্যেনদার জীবনে আরেকটি দিক খুজে পেয়েছি তিনি অভিমানী ছিলেন, কি কারণে অভিমান করেছিলেন তা অজানাই রয়ে গেল।
রাষ্ট্র সত্যেনদাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। রাষ্ট্রের কাছে তিনি এই সম্মান পেয়েছেন। সত্যেনদা জীবনে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, শুধুমাত্র একুশে পদকে ভূষিত করে সে ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র এবং উদীচীকে অনেক কাজ করতে হবে, হতে পারে এরকম সত্যেনদার সমগ্র সাহিত্যকর্ম প্রকাশের ব্যবস্থা করা এবং সারাদেশে পাঠাগারের মাধ্যমে মানুষ যেন সেই বই পড়তে পারে সে ব্যবস্থা করা। উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে সত্যেনদার সাহিত্যকে অন্তভূর্ক্ত করা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী সহ, লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য এবং কিছু সাহিত্য কর্ম অন্তর্ভূক্ত করা , সত্যেনদার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। সত্যেনদা বাংলাদেশে মেষ সময়ে তোপখানা রোডে উদীচী অফিসে সময় কাটিয়েছেন। , তোপখানা রোডে নাম পরিবর্তন করে “সত্যেন সেন সড়ক” রাখতে হবে। প্রথম কাজটি হয়তো উদীচী উদ্যোগ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে পারবে কিন্তু অন্যান্য বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্র এই কাজগুলো করার জন্য উদীচীকেই বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উদীচী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং রাষ্ট্রকে তা বাস্তবায়নে বাধ্য করা হবে। এত করে আমাদের সামগ্রীক লাভ হবে রাষ্ট্রের এবং এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের। প্রায় তিনশত বছর যাবৎ আমাদের ভূ-খন্ডের মানুষ মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সত্যেনদার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত হাসি-গানে মুখরিত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। আমি মনে করি উদীচী’র প্রতিষ্ঠা কর্মী সত্যেনদার আদর্শকে ধারণ করে তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং সত্যেন দার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে।
সত্যেন’দা কে দুই নয়নে দেখিনি, শুধু তৃতীয় নয়নে দেখেছি এ মহানায়ককে। চেষ্টা করবো তাঁর আদর্শ ধারন করে সত্যেন দার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, শোষনমুক্ত হাসি-গানে মুখরিত সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবো এবং সত্যেন দার সপ্ন বাস্তবায়নে চেষ্টা করবো।
রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশ্যা, রাষ্ট্র সত্যেন’দাকে অনুসরন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সত্যেনদার সপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

সত্যেন সেন : শ্রদ্ধার্ঘ্য
মোরশেদ শফিউল হাসান
বিপ্লবী ও মানবতাবাদী লেখক সত্যেন সেন ৭৩ বছর বয়সে গত সোমবার শান্তিনিকেতনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর আগে মুহূর্ত পযর্ন্ত তাঁর জীবন ছিল কর্মময়। বর্ধক্য, দৃষ্টিহীনতা ও ব্যাধি কিছুই তাঁর সাধনায় ছেদ টানতে পারেনি। অবশেষে মৃত্য এসে এই অক্লান্ত জ্ঞানসাধক ও কর্মবীরের জীবন-দীপ নিভিয়ে দিল। যে দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসায় তার জীবন ছিল উৎসর্গীকৃত শেষজীবনের শারীরিক অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব তাঁকে সেই মাটি ও মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল সত্যি, কিন্তু বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে তাঁর অনিঃশেষ ভালোবাসা ও অক্ষয়-অটল অঙ্গীকার চিরকাল আমাদের স্পর্শ করবে।
সত্যেন সেনের পরিচয় সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্ম-সাধনার বৈশিষ্ট্য অনুধাবনে এ পরিচয়টুকু বলতে গেলে কিছুই নয়। নিতান্ত কিশোর বয়সে দেশকে বিদেশী অধীনতা মুক্ত করার আকাঙক্ষা নিয়ে সেই যে তিনি সন্ত্রাসবাদী-বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সভ্য হয়েছিলেন, তার পর থেকে এক মহৎ লক্ষ্যের অভিমুখে ছিল তার অক্লান্ত পথচলা। সে লক্ষ্য মানবতার মুক্তি সাধনের, সে স্বপ্ন শোষণমুক্ত এক নয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার। সবকিছুর উর্দ্ধে তিনি ছিলেন বিপ্লবী। তাঁর সাহিত্যচর্চাকেও সে রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না। শোষিত শ্রমজীবি মানুষের জন্য সত্যিকারের দরদ ও তাদের স্বার্থের সাথে সমতাবোধ তাকে আপন পারিবারিক ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের গন্ডি থেকে টেনে ওই সব সাধারন মানুষের সংগ্রামের কাতারে দাঁড় করিয়েছিল। সে ভালোবাসা ও অঙ্গীকারের স্বীকৃতি তাঁর সাহিত্য-সাধনার মধ্য দিয়েও উচ্চারিত। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করলে তাতে অস্বাভাবিকতার কিছু থাকে না। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, সত্যেন সেনের কর্ম-সাধনার শুরু একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। যে রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা থেকে তিনি চল্লিশের দশকে আরো অনেকের সঙ্গে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ সংগঠনে ও প্রতিরোধ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেই দায়িত্বশীলতাই বৃদ্ধ বয়সে ও বন্দি-জীবনে একজন কৃষক-কর্মীর হাতে কলম তুলে দিয়েছিল। এরপর থেকে একের পর এক তিনি লিখে চলেছেন- উপন্যাস, ঐতিহাসিক আখ্যান, জীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। দেশবাসীর মনে বিজ্ঞানবোধ ও ইতিহাস সচেতনতার উদ্বোধন ঘটাবার আকাঙ্খা জীবনের উপান্তেও, সম্পূর্ণ লুপ্ত দৃষ্টিশক্তি নিয়ে, তাঁকে শ্রুতলিপির সহায়তায় খন্ডে খন্ডে ইতিহাস ও বিজ্ঞান গ্রন্থের অনুবাদকর্মে ব্রতী করেছিল। আমাদের আবহমান ইতিহাসের সংগ্রামী তাৎপর্যবহ ও ছড়ানো-ছিটানো লুপ্তপ্রায় ঘটনা-উপাদানসমূহকে সংগ্রথিত করে তিনি ভাবীকালের প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করে গেছেন। আর এই বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান, আমাদের সমাজ ও সমকালের প্রেক্ষাপটে, যাকে বলে তুলনাহীন। তাঁর রচনা-কর্মের বিশালতা ও বৈচিত্রের সাথে তুলনায় অধিকাংশ রচনার উৎকর্ষ বা শৈল্পিক সফলতার মাত্রা নিয়ে বিচার-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, দৃষ্টির প্রসারতা ও সমুন্নতি এবং অঙ্গীকারের একাগ্রতায় সীমিত অর্থে তিনিই ছিলেন আমাদের সাহিত্যের একমাত্র রেনেসাঁস-ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তি হিসেবেও সত্যেন সেন ছিলেন, দলমত নির্বিশেষে, সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর সৎ, ত্যাগী, নির্লোভ ও আপোসহীন চরিত্র এবং নিরহঙ্কার ও দরদি ব্যক্তিত্ব তাঁকে পরিচিত মহলে এক বিরল সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী করেছিল। তিনি ছিলেন সবার প্রিয় ‘সত্যেন-দা’। ‘অজাতশত্রু’ কথাটাকে তার সঠিক অর্থে বোধকরি এই চিরকুমার লোকটি সর্ম্পকেই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেত।
জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁর কারাগারেই কেটেছে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত, মাঝে কয়েক মাস বা দু’এক বছরের বিরতির কথা বাদ দিলে, জেলই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। বন্দি-জীবনের একঘেঁয়েমি কাটাতেই তিনি হয়তো কোনো একদিন হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে সেটি ছিল আমাদের সাহিত্যের পক্ষে এক শুভলগ্ন। তাঁর লেখা গানে তিনি মানুষের তিনি মানুষের জন্য ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করেছিলেন:

মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী
তাই দিয়ে রচি গান
মানুষের কাজে ঢেলে দিয়ে যাব
মানুষের দেয়া প্রাণ।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভালোবাসার দায় শোধ করে গেছেন।
১৯৮১

সেলিনা হোসেন
শুধু কিছু কথা
১৯৭০ সালে সত্যেনদার সঙ্গে যখন আমার পরিচয় তখন তিনি ভাল দেখতে পান না। চলতে ফিরতে লোকের দরকার হয়। কাউকে ছাড়া হাঁটতে পারে না। থাকতেন নারিন্দার ৬৪, মুনির হোসেন লেনে। সত্যেনদার সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৯৭৪ সালে কোলকাতায়। থাকতেন আলীপুরে তাঁর বোনের বাসায়। তখন তিনি একদম অন্ধ। আমি যাওয়াতে তিনি কতটা খুশি হয়েছিলেন তা আমি দেখলাম তার অভিব্যক্তিতে। কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেন না। শুধু আমার কণ্ঠ শুনলেন। আমার সঙ্গে তার পরিচয়টা হয়েছিল এমন একটা সময়ে যখন তিনি অনেক কিছু হারিয়েছেন। খুব খারাপ লেগেছিল আমার। মনে হয়েছিলো আরো আগে কেনো দেখা হোল না। কিন্তু পরিচয়ের আন্তরিকতায় আমার সে মনোবেদনা অল্পদিনেই উবে গিয়েছিল। তখন আমি জেনেছিলাম সত্যেনদা মানুষকে শুধু চোখ দিয়েই দেখেন না, …….. দিয়ে দেখেন। এবং । এভাবে দেখেন বলেই মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি কাছে টানেন। সত্যেনদার সঙ্গে পরিচয়ের সময়টা খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু বড় বেশি উজ্জল। সময়ের হীরক-দ্যুতি। আলো ঠিকরে পড়ে আমার স্মৃতির একটুখানি জায়গা দারুণ ঔজ্জল্যে ঝকমকিয়ে রাখে। করো কারো সঙ্গে দিন রাতের অনেক দীর্ঘ সময় কেটে যায়। কিন্তু মনে দাগ কাটে না। অবলীলায় হারিয়ে যায় স্মৃতির কীর্তিনাশা ¯্রােতে। কিন্তু সত্যেনদার সঙ্গে চাপর বছরের পরিচয় সমস্ত প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে আশ্চর্য জীবন্ত।
সত্যেনদা নামে চিনতেন আমাকে। লেখা পড়েছিলেন। প্রথম সাক্ষাৎ বাংলা একাডেমিতে। সরদার ফজলুল করিম সাহেবের টেবিলে। তিনিই আমার সঙ্গে সত্যেনদার পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিন সত্যেনদা হেসে বলেছিলেন, তুমি সেলিনা হোসেন? লেখা পড়ে ভেবেছিলাম দেখতে আরো বড়সড়।
তাঁর কথার উত্তর আমি দেইনি। দিয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম, সত্যেনদা শুধু ফিগার দেখে কি লেখার বিচার চলে?
Ñঅবশ্যই তা চলে না। তবে কারো লেখা পড়লে তার সম্পর্কে একটা ধারণা মনে আসে কিন্তু।
Ñতা ঠিক
সকলে হেসেছিলেন। সেদিন আমার সঙ্গে বেশি কথা হয়নি। চুপচাপ কথা শুনেছিলাম কেবল। তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছিল আরো পরে। তখন জেনেছিলাম তরুণ লেখক সম্পর্কে তাঁর কি ভীষণ উৎসাহ। আবিস্কারের আনন্দ ছিল তার মনে। সত্যেনদার জন্যই আমার ‘জ্যো¯œায় সূর্যজ্বালা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল কালি কলম প্রকাশনী থেকে। কালিকলমের আলী ভাই তাঁর কথাতে বইটি চেপেছিলাম। কেননা তখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম সত্যেনদার আন্তরিকতায়। নিজে যতœ সহকারে পা-লিপি শুনেছিলেন। নিজে পড়তে পারতেন না বলে সমরদা তাকে পা-লিপি পড়ে শুনিয়েছিলেন। জায়গায় জায়গায় পরামর্শ দিয়েছিলেন। আরো আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন সত্যেনদা আলীম ভাই-র কাছ থেকে পাঁচ শতটাকা অগ্রিম নিয়ে ছিলেন রয়্যালচি বাবদ। পাদটীকা হিসাবে বলে রাখি ঐটাই ছিল রয়্যালটি বাবদ আমার পাওনা। পরবর্তীকালে আলীম ভাই আমাকে আর কোন টাকা দেননি। এখন আমাদের প্রকাশনা শিল্পে বড়ই দুর্দিন। সকলেই হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। লেখকদের কোথাও ঠাঁই নেই। প্রতিষ্টিতরাই থৈ পাচ্ছেন না। তরুণদের অবস্থাতো আরো শোচনীয়। মাথার ওপর একজন সত্যেনদা নেই যাকে ভরসা করা যায়। যার হাত ধরে পায়ের নিচে মাটি খুজে পাওয়া যাবে। যিনি বলবেন, কি হে কি লিখছো? এসব কথা এখন কেমন বেমানান শোনায়। মনে হয় বানোয়াট, মিথ্যা। যেন রূপকথার আমলের কথা। সত্যেনদা সামনে নেই বলে দুঃখ। নইলে সামনাসামনি যাচাই করিয়ে বলতাম, কথাগুলো খাঁটি, নির্ভেজাল সত্য কথা।
সত্যেনদার বিপুল রচনা সম্ভার আমার এক বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। কেননা ষাট দশক পর্যন্ত কম লেখাই ছিল ফ্যাশন। বেশি লেখার কথা তখন কেউ একটা ভাবতেন না। অথচ সত্যেনদা অবিশ্রাম লিখছেন। আশ্চর্য মুখর ছিল তাঁর লেখনী। আমি প্রায়ই তাঁকে বলতাম, সত্যেনদা আপনি এত লেখেন কি করে? এটা কোন কথা হল? সত্যেনদার কাছে আমি কােন সদুত্তর পাইনি ঠিকই তবু আমার বিস্ময় কমেনি। আমি কিছুতেই ভাবতে পারতাম না যে একজন মানুষ কিভাবে এতো লিখতে পারেন। ছিপছিপে হালকা পাতলা গড়নের লম্বা মানুষটার ভেতরে যে এত শক্তি আছে তা বোঝা যেতো না। নত্যেনদার বলতেন, সকলে যখন শেষ করে, তখন আমি শুরু করেছি। পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি লিখতে আরম্ভ করি। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সৃষ্টির এমন ফলবান বৃক্ষ তৈরী করা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব। সত্যেনদা শেষ জীবনে শেষ জীবনে যা করেছেন একজন লেখক সারা জীবনেও অনেক সময় তা করতে পারেন না। শুধু তা^র অভাব ছিল এক জায়গায়। শিল্পকে তিনি করায়ত্ত করতে পারেননি। আর পারেননি বলেই তাঁর উপন্যাসে বক্তব্য এবং শিল্পের সম্মিলন ঘটেনি। দু’য়ের মধ্যে যোজন মাইলের তফাৎ অনুভূত হয়। সত্যেনদার মানসিক শক্তি নিয়ে কোনো প্রতিভাবান তরুণের আবির্ভাব ঘটলে আমাদের উপন্যাসে জোয়ার আসতো। তিনি আমাদের সামনে এমন এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।
সত্তর সালে আগস্ট মাসের তিন তারিখে তিনি আমাকে ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’ বইটি দিলেন। সেদিন বইয়ের ওপর আমার নাম লিখতে তাঁর হাত কাঁপছিলো। ভালো দেখতে পান না বলে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল লেখা। ভীষণ খারাপ লেগেছিল। যখন তাঁর মন সৃজনশীলতার বেদনায় পূর্ণ, সৃষ্টির সম্ভারে টইটুম্বুর, তখঝন তার দৃষ্টি শক্তি নেই। অত্যাচারে, অবহেলায়, নির্যাতনে, তিনি তা হারিয়েছেন। তবু কোথাও নতি স্বীকার করেননি বা হেরে যাবার কথাও ভাবেননি। নিজেদের এমন শক্তি কৈ? ঝড়তো দুরের কথা, সামান্য বাতাসেই নুয়ে যেতে চায় মাথা। ঘাড়ের ওপর মাথাটা সোজা রাখতে বড় কষ্ট।
সত্যেনদা আপনার যৌবন দেখিনি, বৃদ্ধ বয়সে যে তেজ দেখেছি সেজন্যেই যৌবনের সেই দুর্বিনীত ভঙ্গী দেখার ইচ্ছা হয়। আপনারা কেমন করে এমন লৌহ-কঠিন মানব হন? বিবেক, চরিত্র, মন, সাহস ইত্যাদি শব্দগুলো যখন আমাদের জীবনে কিংবদন্তীতে পরিণত হতে যাচ্ছে তখন বলতে ইচ্ছে করে যে একজন সত্যেনদা আসুক আমাদের জীবনে। আমরা সমুদ্রে ভেসে যাওয়া প্রাণী হয়ে তাকে অবলম্বন করে কূলে উঠি।
সত্যেনদার সঙ্গে অনেকদিন দেখা নেই। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। তিনি শুধু আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করুক তা আমি চাই না। আমি চাই তিনি যেমন আমার জীবনে উদাহরণ হবেন, তেমনি আমার উপন্যাসেরও চরিত্র হবেন। এমন একটা চরিত্র যা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট চরিত্র হিসেবে অমরত্ব পাবে। তবেই হয়তো তাঁকে আতœস্থ করার সাধনা আমার সফল হবে। নইলে সত্যেনদার সঙ্গে আমার পরিচয়ের আন্তুরিকতা শুধু স্মৃতি, কোন সফল অনুভব নয়। সত্যেনদার গুণাবলীর সামান্যতম বিন্দুও যদি নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারি তাহলে তার সঙ্গে আর কোনদিন দেখা না হলেও আমার কো দুঃখ থাকবে না। আমার জীবন এবং আমার সাহিত্য তাঁর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তের দ্রীপ্র চেতনার আলোকে।
সত্যেনদার সীমানা অনেক ব্যাপক। সে জন্যেই একটি ঘটনা বলব। ঘটনাটি আমার শোনা। আমি শুধু যোগফল মেলাবো। এক ভদ্রলোক ট্রেনে করে রংপুর যাচ্ছিলেন। পথে এক ব্রিজের কাছে ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে। সামনের কতগুলো বগি লাইন-চ্যূত হয়ে পাশে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় লোকজন সামান্য আহত হলেও কেউ মারা যায়নি। কারো কোন বড় ধরনের ক্ষতিও হয়নি। যাহোক কিছুক্ষণের মধ্যেই আশপাশের লোকজন এসে জড়ো হয়। তাঁরা অনেকে বলে, সাব ওখানে একজন ভালো মানুষের কবর আছে সেজন্যে আপনারা জানে বেচে গেলেন। নইলে অনেককে মরতে হোত।
ঘটনাটি বলে ভদ্রলোক বলেছিলেন, এখন তেমন একজন ভাল মানুষ নেই যার জন্যে আমরা অনেকে বেঁেচ যেতে পারি।
আমি জানি না কেন সত্যেনদার সর্ম্পকে লিখতে বসে বারবার আমার এ কথাটাই মনে হচ্ছে। একজন দু’জন ভালমানুষ চাই যার জন্যে আমরা হাজার জনে বেঁেচ যেতে পারি। তাই কামনা করি সত্যেনদার অনুপস্থিতি আমাদের জীবনে কাঙ্খিত অনুপস্থিতি হোক। শুধু শারীরিক উপস্থিতিটাই যেন বড় না হয়।

হাজেরা বেগম
সত্যেন সেন
আমার জন্মভূমি রামপুর। রামপুর উত্তর ভারতের ছোট্ট একটি মুসলমান করদরাজ্য। আমাদের মুসলমান সমাজের মেয়েদের অবস্থা তো জানাই আছে তোমার। কিন্তুু রামপুরের যা অবস্থা তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না। পর্দা, পর্দা চারদিকে শুধু পর্দা। এই পর্দার মধ্যে মেয়েদের জীবন কাটাতে হয়। …………ঘরের মেয়ে আমি। যত বেশি …….., ততবেশি কড়াকড়ি। গরীবন ঘরের মেয়ে হলে এর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা পেতাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকে এসব দেখেশুনে এতই অভ্যস্থ হয়ে এঠছিলাম যে, এজন্য কোনোদিন সামান্য আফশোসটুকুও হয়নি। এ কথাটা জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলাম, এইটাই মেয়েদের জীবন। তাই এর জন্য মনে কোনোরূপ অস্থিরতা বা ছট-ফটানি ছিল না। আজ কিন্তুু ভাবতে ভারি আশ্চর্য লাগে, এই আমি যে সেই আমি এ-কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আমাদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া করার কিছুটা সুযোগ দেওয়া হত। লাহোরের এক জেনানা স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। স্কুলের সঙ্গেই হস্টেল-এর বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, কোনো উপলক্ষও ছিল না। বাড়িতে আদরের মেয়ে ছিলাম, সবার ভালোবাসা পেতাম, কিন্তু অবস্থা বিশেষে সেই আদর ও ভালোবাসার কি প্রচ- রুপান্তর ঘটতে পারে তা দেখেছি।
হস্টেলে থাকতে অথবা বাড়িতে,আমাদের কোনোরকম খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হত না। আমাদের রামপুর এস্টেটের লোকেরা, বিশেষ করে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা অত্যন্ত রাজভক্ত। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ কোনোদিন সেখানে প্রবেশ করতে পারে নি। খবরের কাগজগুলি সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম কথালেখে। তাই সংবাদপত্র পাঠ আমাদের পক্ষে একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। ‘স্টেট্ম্যান’ বা ‘ইংলিশ ম্যান’ সরকারের অতি বশস্বদ পত্রিকাগুলিও আমাদের পড়তে দেয়া হত না। মেয়েদের খবরের কাগজ পড়ার কি দরকার। তাই আমরাও এ নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামাইনি । আমি এই সংসারের সার তত্ত্বটিকে জেনে নিয়েছিলাম, মেয়ে হয়ে জন্মালে এইভাবেই জীবন কাটাতে হয়। মানুষের জন্মগত অধিকার বলে কোনো কথা আছে, এ সমস্ত কথা কোনোদিন কানেও আসে নি।
ম্যাট্টিক পাশ করার পর আমার বিয়ে হয়ে গেল। রামপুর এস্টেটের ছেলে, দেখতে সুন্দর, ঘরে টাকা পয়সাও যথেষ্ট আছে, পেশায় পুলিশ অফিসার , ভবিষ্যত উন্নতির উজ্জল সম্ভাবনা। এর চেয়ে ভালো বর আমি আর কি আশা করতে পারি! তাছাড়া পছন্দ আর অপছন্দ সে তো বাপ-মারাই করবে। এ বিষয়ে আমি কথা বলার কে ?
বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়িতে ঘুরে-ফিরে কয়েকটা বছর কেটে গেল। আমার স্বামী যখন মিরাটে পোস্টেড সে সময় আমি স্থায়ী ভাবেই তার সঙ্গে । বাড়িতে যেতাম। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা স্বামীদের সম্পদ, বিশেষ করে সেই……… যদি সুন্দরী হয়। এখন আমাকে দেখে আমার যাই মনে হোক না কেন, একসময় আমি কিন্তু সুন্দরী বলে পরিচিত ছিলাম। আরো এক অবিশ্বাস্য …………, রামপুর এস্টেটের সেই পর্দানশিন মেয়ে তখন নিজেই মোটর ড্রাইভ করতে পারে। আমার স্বামীই আমাকে শখ করে শিখিয়েছে।
এ পরিবর্তন গুলি বড় কম নয়। কিন্তু এর চেয়েও বড় পরিবর্তন আমার জীবনে নেমে এল। এটাকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলতে পার। একদিন আমার স্বামীর সঙ্গে তার ‘বস’-এর বাড়িতে গিয়েছিলাম। মাঝে-মাঝেই সেখানে যাওয়া-আসা করতাম। কিন্তু একদিন সেখানে গিয়ে যে ঘটনাটা ঘটল তা আমার জীবনে অবিস্মরণীয়। আমার স্বামীর ‘বস’-এর বাড়িতে আমরা কজন বসে চা খাচ্ছিলাম।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেই বৎসরটি থাকতে তোমার জানা

বর্ষা উৎসব-১৪২১
অনুষ্ঠান সূচি :
৭.০০-৭.১০ যন্ত্রসঙ্গীত
৭.১০-৭.১৫ দলীয় নৃত্য
৭.১৫-২৫ অগ্নিবীণা শিল্পকলা বিদ্যালয় (দলীয় সঙ্গীত)
৭.২৫-৭.৩০ দলীয় নৃত্য (হ্যাপি হোমস্)
৭.৩০-৭.৪০ ……..
৭.৪০-৭.৫০ ক্ল্যাসিক্যাল
৭.৫০-৭.৫৫ মেঘদূত (ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়)
৭.৫৫-৮.০০ উদীচী মিরপুর শাখা (দলীয় সঙ্গীত)
৮.০০-৮.০৫ উদীচী গেন্ডারিয়া শাখা (দলীয় সঙ্গীত)
৮.০৫-৮.১০ উদীচী পল্লবী শাখা (দলীয় সঙ্গীত)
৮.১০-৮.১৫ দলীয় নৃত্য (বহ্নিশিখা)
৮.১৫-৯.০০ আড্ডা (সঙ্গীত ও আবৃত্তি)
৯.০০-৯.১৫ বর্ষা কথন
৯.১৫-৯.২০ স্পন্দন (দলীয় নৃত্য)
৯.২০-৯.৪৫ উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ
৯.৪৫-৯.৫০ নটরাজ (দলীয় নৃত্য)

হাসেম খান

বর্ষা Ñ ষড় ঋতুর ২য় ঋতু।
গ্রীষ্মের খরতাপে ধরিত্রি যখন দগ্ধ হচ্ছে মাটি ফেঠে চৌচির, গাছপালা শুকিয়ে বিবর্ণ চেহারা, নদীর পানি, বিলের পানি, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। চাষবাসে দেখা দেয় নানাবিধ জটিলতা। মানুষ, পশুপাখি গাছ-পালা, নদী-নালা আকাশ বাতাস সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন ‘বর্ষা’ আসবে-ঝির-ঝির, ঝর-ঝর ধারায় নামবে বৃষ্টি-শান্ত হবে প্রকৃতি।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীস্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। প্রত্যেক ঋতুরই আছে ভিন্ন ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট গুলোই নানাভাবে প্রভাবিত করে বাংলার মানুষকে, তাদের চালচলন, আচার আচরনে, শিক্ষা- সংস্কৃতি চর্চা ও জীবন যাপনে কখনো প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। গ্রীস্মের প্রচন্ড গরমের শেষে এসে ‘বর্ষা’ মানুষের কাছে, প্রকৃতির কাছে আকাঙ্খিত ঋতু। ঝির ঝির ঝড়ে ভালোবাসার বৃষ্টি। বৃষ্টি পেয়ে গাছপালা সবুজ সতেজ রঙের অবগোহনে মেতে ওঠে, খাল-বিল, নদীও মাঠে থৈ থৈ পানির প্রয়োজনীয় প্রান চাঞ্চল্যে সর্বত্রই আনন্দের নাবন। যদিও কখনো কখনো অতি বৃষ্টিতে ও বন্যায়, জীবন যাপনে মানুষের বিড়ম্বনা ও কষ্টের কারন হয়ে দাড়ায়- তারপরেও বর্ষাকে মানুষ ভালোবাসে।
সেই কবে- বহুকাল আগে লিখিত মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত কে নিয়ে এ কালের মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেনÑ
কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন পূণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘচন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিযাছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘন সংগীতমাঝে পুঞ্জিভূত করে

সেদিনের পরে গেছে কত শতবার
প্রথম দিবস ¯িœগ্ধ নব বরষার।
প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের পরে করি বরিষন
নববৃষ্টি বারিধারা, করিয়া বিস্তার
নবঘন ¯িœগ্ধচ্ছায়া, করিয়া সঞ্চার
নব নব প্রতিধ্বনি জলদমন্দ্রের.
স্ফীত করি ¯্রােতোবেগ তোমার ছন্দের
বর্ষাতরঙ্গিনীসম

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বর্ষার আগমনীকে সাদরে ও আনন্দে আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলার মানুষের হৃদয়ের সজীবতা হেলে দুলে নড়ে উঠুক। আষাঢ়ের বৃষ্টি শীতল পানিতে ধয়ে যাক, মুছে যাক যতো গ্লানি, দু:খ ও কষ্ট। বৃষ্টির ঝির ঝির আর ঝর ঝর ছন্দে ও সুরে কেন গেয়ে উঠছিনা ভালবাসার গান, আনন্দের গান।
“হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল-
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল
কোন ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে+Ñ
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

উৎসবে মাতোয়ারা আজ বর্ষাবরনে
কামাল লোহানী

এলো বরষা, সহসা মনে তাই বুঝি দোদুলছন্দে
নেচে উঠলো মনটা মহানন্দে
জগতের প্রচন্ড গ্রীষ্মহরণ করে এই বুঝি স্বস্তি নিয়ে এলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। আজ কেমন যেন এই পৃথিবীটা তারই সৃষ্ট নিয়ম কানুন মানছেনা। ষড়ঋতুর দেশতো বাংলাদেশ। তাই আজ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস সূর্যকে আবাসন করে গানে নাচে কবিতায় ওকে মুগ্ধ করতে চাই যে চিরন্তর রীতি তার কি হলো, প্রকৃতি বিরূপ কেন? আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসতো বর্ষার জন্য, যেন সেই সময় মানুষ স্বস্তির জীবন যাপন করতে পারেন। বরষায় ঐ ভৈরব গর্জনে নিপাতির বারিধারায় যেন শিক্ত না হয় গ্রামাঞ্চল। আবার গাইতে যেন না হয়
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে
আয় রিমঝিম বরষারা গগনে রে…..
প্রকৃতির ¯িœগ্ধ বারিধারায় সিঞ্চিত নগর কিংবা গ্রাম জীবন স্বস্তি ও আনন্দে, ফলে ও ফসলে ভরে উঠে, তাইতো মানুষের প্রানে আসে প্রবল আনন্দ, আয়োজন হয় উৎসবের। ——-। নতুন ধানের ঘাসে বাসে, সবার ঘরে নেমন্তন্ন পৌছে যায়। সে নেমন্তন্নে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির অপূর্ব সম্মিলন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় কী অসাধারন আয়োজন, স্বত:স্ফূর্ত আয়োজন চলে দিকে দিকে। হিন্দু না ওরা মুসলিম কেউ জিজ্ঞেস করে না। পরবের গরবে মানুষ ধন্যবাদ। তাই বৈসম্য কোন স্থান পায় না এখানে। সবাই ভাই- বোন মিলে জেগে উঠে জননী জন্মভূমি সন্তানের গৌরবে। জ্যৈষ্ঠের পর যখন আষাঢ় আসে তখন ভরা নদী ক্ষুরধারা, যা টেনে নিয়ে যায় হিংসা বিদ্বেষ। মানুষের বুক মেলে মানুষেরই সাথে। জীবন গর্বিত হয় সখ্যতার এই অপূর্ব সৌরভে। উৎসবে মেতে উঠে মানুষ নতুন ফল ফলাদিকে উপলক্ষ্য করে। অথচ এই সম্মিলিত মানবশক্তি চান এমন শান্তির পৃথিবী গড়তে, কিন্তু একে রুখে দেবার উন্মাদ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের স্বজ্জনেরা সংগ্রামে লিপ্ত লড়াকু চরিত্রগুলো একত্রিত হয় সব মানুষের উৎসবে। তারা জানেন এ বিশ্বটা আমাদের সকলের, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলমান সকলের। সুতরাং ভ্রাতত্বপ্রেমের বন্ধন যাবে কোথায় ? এমনি শান্তিপ্রিয় পৃথিবীর বিরুদ্ধে মানুষ নামেরই এক পশুশক্তি দেশটাকে হিংস্্র পাশবিকার গহবনে টেনে নিয়ে ফেলে। আমরা মানুষ অনেক কিন্তু হিং¯্র পিশাচ যখন মুখবাদান করে ছুটে আসে ভীতির সহ্যতার হয়। আমরা ভয় পাই। ভয় না পেয়ে যদি রুখে দাড়াতে পারি তবেই মানুষের জন্য হয়।
প্রকৃতি আমাদের বন্ধু। সেই প্রকৃতি এত চমৎকার পরিবেশটাকে নস্যাৎ করে দিতে প্রবল বর্ষায় নেমে আসে প্লাবনের সৃষ্টি করে যেন মৈত্রীর বন্ধন ছুটে যায়, প্লাবনের তোড়ে যেন এক অপরের হাত ছেড়ে চলে যেতে বাদ্য হই। সেই জলোচ্ছাস ঘরবাড়ি, বাড়ি, পশুপাখি, গাছপালাকে ও মানুষের মত ছাড় দেয় না। মানুষের বাড়িঘর ডুবে, ¯্রােতের টানে ভেঙ্গে যায় দুর কোন গায়ে অথবা প্রান্তরে। আর গাছপালাও তেমনি ভেসে চলে জলধারায় প্রবল টানে। আসাম এলাকা থেকে আসা ঐ জলরাশিতে গরু, মহিষ যেমন ভেসে চলে তেমনি বিশালকায় বিষধর সাপও মৃতদেহ নিয়ে অসহায় জলে বাসা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। নদী পথে চলা এই জলরাশির উপচে পড়া প্রবল চলতি জন্তু-জানোয়ার, গাছপালা আবার নদীর দুপাশের মানুষ গুলো গাছপালা তুলে নিজেদের সম্পদ বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে যান। যে যেন আরেক ধূম। এ বর্ষার ঢল।

কিন্তু বর্ষার আগমন যখন ঘটে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে কবি জিজ্ঞেস করেন কালিদাসকে। কবিবর কোন বিস্তৃত বষষে লিখেছিলে ‘মেঘদূত’। সেখানে কবি গুরু লেখেন :
ঐ আসে ঐ তাতি ভৈরব বভসে
জল সিক্তিত ক্ষিতি সৌরভ বভসে
…… গৌবতে নবযৌবন বরষা
স্যাম গম্ভীর সরসা।

বর্ষা মৌসুমে এক নব উস্মিমম কবির কল্পনায় যেমন তেমনি বাস্তবেও যেন। কিন্তু প্রবল বৃষ্টি আর কড়কড়ে বজ্রপাত যখন কানে তালা ধরায়, তখনতো গৃহবাসী ঘরের কোণেও জড়োসড়ো হয়ে জবুথব হয়ে বসে থাকে। বর্ষা নানারুপে আসে জীবনে। কখনও আনন্দে, কখনও বেদনার্ত চরিত্র নিয়ে। তবে বর্ষা যে চাই সময় মতন ফসলের ক্ষেতে, না হলে কত যে ফসল অঙ্কুরেই সহস হয়ে যায়। অনাবৃষ্টি যখন চাষীর কলাপ চোকে, তেমনি অতিবৃষ্টি বুকের হলে সেচ দেয়া যে ফসলের কাজ গোনে কৃষককে হতাশায় ডুবিয়ে ছাড়ে। নিক বছরই তো এমন পোহাতে হয় যারা উৎপাদক তাদের।
তাইতো বর্ষার উচার আবার নিষ্ঠর। মানবকে মানবেতর করতে খুব একটু ভাবেও না। বর্ষনার করুণা বলে বোধ হয় কিছু নেই। তবু বর্ষা এলে স্বাভাবিক জীবন বনার্ঢ্য বর্ষাবরণ উৎসব ভোলেন বটে গ্রামবাংলা ……… পারে না খুব সহজে। অবশ্য নগরও প্লবনের দাপটে বন্যায় করলে পরে অনেক সময় বন্যা হয়ে যায়। এখনতো বাংলায় নদী গুলো শুকিয়ে …………. জলধারা বাহিত পলিমাটিতে একবারে ভরাট হয়ে যায় এমনই আকার ধারণ করে যে, বর্ষার আগমনে যে আনন্দবাগ বইবার কথা তা আজ আর বাংলার মানুষের …….. বয় না। বর্ষা এখন দুঃখ দেয় কেবল। ছোটবেলায় স্মৃতির বষর্ষায় আমবাগানে ছোটাছুটি, ঝড়ে পড়ে যাওয়া আম কুড়িয়ে খাবার সে আনন্দ এখন আর নেই।

এবারের খরতাপদগ্ধ ………………………. বাস করতে পারে সবাই গ্রামে কি শহরে স্বস্তি খুজতে গিয়ে বর্ষা কেন আসে না, তার পাতা লাগিয়েছে। জলবায়ু দুষনের এমন অভিশাপ বহর করছি আমরা যে বৃষ্টির কৃপন আমাদের একেবারে শাস্তি দেবার পর্যায়ে নিয়ে ফেলেছে। আজ বাংলার মাটিতে নদীর যে ধারা নিয়ে ফেলেছে।

পাহাড় থেকে ঢল আসছে না। নদীতে জল নেই বলে মাঝির গলায় সেই প্রিয় গান শুনতে পাই না।

“পানবিনে ঠোঁট কালো তোমরা
রুপশালী ধানভানা রুপ দেখ তোমরা”
কী অপূর্ব বাংলা আজ শুকনো মরুভুমি না হলেও কাঠখোটকা জীবনের কন্কাল হয়ে গেছে। কেউ জল দিছে না অভিযোগ শুনি। কিন্তু নিজেরা নদীগুলো দখল না করেপুণখনননের ব্যবস্থা যে করছি না তা কোথায় দেখি না।

“আয় বৃষ্টি ঝেপে আয়রে ধান দেবো মেপে
আয় রিমঝিম বরষার গগনে আয়রে।
কাঠফাটা রোদ্দুরের আগুনে
আয় বৃষ্টি ঝেপে আয়রে ধান দেবো মেপে
আসুক বৃষ্টি ঝেপে ভিজবো সবাই মিলে। কী আনন্দ!

মুঠোবন্দি মন
পাবলো নরেুদা

আরো একটি গোধূলি এলো গলে।
চরাচরজুড়ে নীল রাত নামছ,ে
অথচ সন্ধ্যায় আমাদরে হাত-ধরাধরি হাঁটাই হলো না।

আমি জানালা দযি়ে দখেলাম
অনকে দূররে পাহাড়চূড়ায়
র্সূযাস্তরে উৎসব বসছে।ে

কখনো কখনো আমার হাতরে তালুতে
মুদ্রার মতো
একটুকরো র্সূয পুড়তে থাক।ে

মনটা বষিণ্ণ –
তোমার কথা খুব মনে পড়ছলি
যে মনরে কথা তুমি ছাড়া বশেি কে জান!ে

তুমি কোথায় ছলিে তখন?
সাথে আর কে ছলি?
কী কথা তাহার সাথ?ে
যখন মনটা খুব খুব খারাপ থাকে
টরে পাই, তুমি অ-ন-েক-দূ-র,ে
বলো তো তখন হঠাৎ সব ভালোবাসা আমাকে পযে়ে বসে কনে?

গোধূলি এলে আমার পড়ার বন্ধ বইটা হাত থকেে পছিলে পড়,ে
চোট পাওয়া কুকুররে মতো আমার নীল সোয়টোরটি
আমারই পায়রে কাছে গড়াগড়ি যায়।

প্রতটিি দনি সন্ধ্যা এলে
তুমি সন্ধ্যাকে পছেনে ফলেে
স্মৃতরি র্মূতি মুছে ক্রমশ এগোতে থাকো গোধূল-িদকি।ে

ভাষান্তর: সুরশে রঞ্জন বসাক

আমার নেতা সত্যেন সেন
জসিম উদ্দিন মন্ডল
অবিভক্ত বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে এবং এদশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা হিসাবে পরিচিত নাম সত্যেন সেন। সবচেয়ে বেশি পরিচিত তাঁর এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দীর্ঘ কালের সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। এবছর সত্যেন সেনের জন্ম শতবার্ষিকী। সত্যেন সেনের সাথে আমার প্রথম দেখা কমিউনিস্ট পার্টি আন্ডার গ্রাউন্ডের থাকার সময় এক গোপন মিটিংয়ে, মিটিংয়ে আসল নামে চিনতে পারিনি পরে জেনেছি ইনিই সত্যেন সেন। কারণ পার্টি আন্ডার গ্রাউন্ডে থাকার সময় প্রায় সকল পার্টি সদস্য …… ব্যবহার করতেন। এটাই নিয়ম ছিল। এর বেশি কিছু পরে রাজশাহী জেল থেকে আমাকে যখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে আসা হল তখন ঢাকা জেলে আমাকে থাকতে দিল ২৬ সেলে। ২৬জন কয়েদি এখানে থা তো বলে নাম ২৬ সেল। যুক্তফ্রন্ট সরকারের পর তখন মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায় সম্ভবত ১৯৫৬ সাল। আমি এখানে এসে পেলাম সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ ব্যানার্জী, অজয় রায়, শহীদুল্লাহ কায়সার, ধীরেন ভট্রাচার্য্য, ময়মনসিংহের আলতাব আলী, আওয়ামী লীগের মনিসহ আরো অনেককে, আজ আর সবার কথা মনে নেই। আমি অনেকের থেকে অনেক ছোট এবং নতুন হওয়ায় সত্যেনদা আমাকে তার পাশে নিয়েছিলেন। তাঁর নং ছিল ৬ আর আমার নং ছিল ৫। পাকিস্তান সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের কারণে অনেক নেতাকর্মী বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতাকর্মী তখন জেলে, তাদের মধ্যে সরকারের তরফ থেকে কারো কারো বন্ড সই নিয়ে জেল খানা থেকে ছেড়ে দিতো। সত্যেনদার বা রণেশ দাশসহ আরো অনেকের মধ্যে এরকম কোনো লক্ষন দেখিনি। তারা বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছেন কিন্তু বন্ড সই দিয়ে জেল থেকে বেরুনোকে তাঁরা সবাই ঘৃণার চোখে দেখতেন।
সত্যেনদার সাথে জেলখানায় এক বছর ছিলাম। এই এক বছরে অনেক স্তৃতি। সত্যেনদা নিজে গান করতেন। খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন তার গাওয়া অনেক গানের মধ্যে ‘যাও যাও রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও’ গানটি আমার খুব ভালো লাগতো। আমার সেলে কেউ ছাড়া পেলে বা অন্য জেলে চলে যাওয়া সময় সত্যেনদা বিদায়ের আয়োজন করতেন। সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে সত্যেনদা গান ধরতেন আমরা গলা মেলাতাম। নিরান্দ জেলবন্দী জীবনে শত আনন্দ ও কাজের মাঝে দিয়ে সবাইকে ভুলিয়ে রাখতেন। যারা ভালো করে পড়তে জানতো না তাদের খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন। পড়ার পর ঘটনার ব্যাখ্যা দিতেন। এই সময়ে জেলখানায় বসে সত্যেনদা ‘গ্রামবাংলার পথেপথে’ বইটি লেখেন। এই বইটি প্রখ্যাত কৃষক নেতা হাতেম আলীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি গল্প লেখার পর আমাদের পড়ে শোনাতেন। মতামত নিতেন সবার। আমাকেও অনেকবার জিজ্ঞাসা করতেন। আমি আমার বোধ ও বুদ্ধি থেকে মতামত দিতাম। তিনি প্রত্যেকের মতামতের গুরুত্ব দিতেন। এক্ষেত্রে রণেশদার কথাও বলতে হয়, রণেশদাও লিখতেন। তিনিও প্রত্যেকের মতামত জানতে চাইতেন। মতামতের ভিত্তিতে লেখা পরিবর্তন করতেন। শহীদুল্লাহ কায়সারও লিখতেন।
সত্যেনদার কথায় আসি। আমাদের সেলের কারো কোন চিঠি এলে এবং সে চিঠিতে বাড়ির কোন খারাপ খবর থাকলে আগেই তাঁর হাতে চিঠি দেয়া হতনা। ধীরে সুস্থে তাঁর মনমেজাজ বুঝে খবর জানানো হত। মন খারাপ হলে তাকে বুঝানো হত। এক্ষেত্রে সত্যেনদার ভূমিকা ছিল প্রধান। একবার আমার স্ত্রীর চিঠি এলো চিঠিতে বাড়ির মানুষের অনেক দুর্দশার কথা লেখা ছিল। সন্তানের অসুখ-বিসুখ, খাবারের সমস্যা। এসব নিয়ে আমার মনটা খুব খারাপ ছিল। সত্যেনদা এসে গান ধরলেন ‘যাও যাও রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাও’। আমাকে গাইতে বললেন, তখন কি আর মন ভার করে বসে থাকা যায়?
এই সময় জেলখানায় বসে সত্যেনদা পৃথক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার কথা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং সে লক্ষ্যে সংগঠন গড়ে তোলা জন্য সবার সাথে পরামর্শ শুরু করেন। ফলশ্রুতিতে পরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জন্ম। যদিও উদীচীর জন্ম অনেক পরে ১৯৬৮ তো কিন্তু এর প্রাথমিক কাজ শুরু করেছিলেন আরো অনেক আগে থেকে। সত্যেনদাকে যারা কাছে থেকে দেখেছেন তারা জানেন তিনি কি রকম দরদী মনের মানুষ ছিলেন। তাঁর বিশাল …….. দরদের বিষয়ে বলি, ঢাকা জেলখানার কয়েদীদের ভেতর থেকেই বাচাই করে জেলখানার বিভিন্ন কাজ করানো হত। সে রকম একজন ছিল রহমত, সে মেথরের কাজ করত। এরা জেলখানার সব জায়গায় যেতে পারতো। তার কাজে আমাদের ওয়ার্ডেও আসতো। মাঝে মাঝে বকশিশ চাইতো। একদিন এসে বকশিশ চাচ্ছে, সত্যেনদাকে ডেকে বললাম দাদা মেথর এসে বসে আছে আমার মুখে মেথর শুনে সত্যেনদা প্রচন্ড রেগে গেলেন আমাকে বললেন আপনি কেন ‘মেথর’ বললেন ও তো মানুষ। আপনি কমিউনিস্ট হয়ে কেন মেথর বললেন এভাবে বার বার মাথা কুটতে লাগলেন। এবারে জেলখানার বাইরের ঘটনা, আমার স্ত্রী অসুস্থ হাসপাতালে। আমার স্ত্রীর অপারেশন হয়েছিল এসময় তিনি খুব সাহায্য করেছিলেন। আমার মেয়ে ১০ বছরের আলোর মামা ছিলোনা বলে মামার জন্য তার খুব দুঃখ ছিলো। সে সময় একদিন সত্যেনদা ও রণেশদা ফলমূল নিয়ে বিকালে আমার স্ত্রীকে দেখত এলেন। এরা দুইজন সবসময় জুড়িদার ছিলেন। এরা এল আমার মেয়ে দুঃখ করে বলেছিল আমার কোনো মামা নেই সাথে সাথে সত্যেনদারা বললেন কে বলে তোমার মামা নেই। আমরা দুইজন তোমার আপন মামা। আমার স্ত্রীকে সাক্ষী মেনে বললেন, আমরা তোমার মায়ের আপন ভাই সে সাথে বানিয়ে দুজনের মুসলমান নামও বলেছিলেন আজ আর সে নাম মনে নেই। তার পর থেকে আমার স্ত্রী ও মেয়েকে আপন জানতেন। একবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, আমার স্ত্রী পরিবার কোলকাতায়। একদিন বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপার নিয়ে জয়বাংলার অনুষ্ঠান হচ্ছে। আমি ও আমার স্ত্রী মেয়ে নিয়ে জয় বাংলার অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছি। মঞ্চে সত্যেনদা সভাপতি। হঠাৎ সত্যেনদার নজরে পড়লো আমার স্তী সামনে বসে আছে। তখনি তিনি মঞ্চ থেকে নেমে এসে আমার স্ত্রীকে হাত ধরে মঞ্চে নিয়ে সবার মাঝে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন এই আমার বোন, আপন বোন। এই ছিলেন সত্যেনদা পরেও আমার ছেলে মেয়েকে প্রয়ই টাকা দিতেন, খোজ খবর করতেন।
জেলের আরেক দিনের ঘটনা। জেলের ভিতরে ধীরেন ভট্টাচার্য্য ফুলগাছ লাগিয়ে ছিলেন। সত্যেনদা ফুল খুব পছন্দ করতেন। একাদ আমার মন খুব খারাপ হঠাৎ কি মনে করে একটা গোলাপ তুলেছিলাম, তুলে গেলাসের পানিতে রেখেছিলাম। সত্যেনদা জানতে পেরে আমাকে বঝিয়ে ফুল ছেঁড়ার ব্যাপারে অনেক নিষেধ করেছিলেন। কিছুটা রাগও করেছিলেন। ফুল ছেঁড়া তিনি একদম পছন্দ করতেন না।
আমাদের ২৬ সেলে পর্যায়ক্রমে প্রতিমাসে একজন করে ম্যানেজার হতো। প্রত্যেককে এই ম্যানেজারের দায়িত্ব নিতে হতো। সত্যেনদাও জেলখানায় আমাদের ম্যানেজার হলেন। তার ম্যানেজারের সময়টা আমাদের জন্য খুব আনন্দের সময় ছিল। তার সময়ে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব হতো না। খাবারে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতেন। আমাদের জিজ্ঞেস করতেন আমরা কে কি খাবো। সাধ্যমত চেষ্টা করতেন সে রকম খাবার দিতে। জেলখানার বাইরে সত্যেনদার সাথে আমি দুই জায়গায় পার্টির মিটিং করেছি। প্রথমবার নওগাঁয় দ্বিতীয়বার দিনাজপুরের কাহারোলে। এইসব জনসভায় তিনি গান করতেন, বক্তৃতাও করতেন তখন কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় একবার খড়গপুরে রেলের মিটিংএ গেলে সেখানে সত্যেনদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।
সত্যেনদার কর্মজীবন নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে অনেকে আমার চাইতে ভালো বলতে বা লিখতে পারবেন। যারা আমার খুব কাছে থেকে বেশি দিন দেখেছেন তারা। তবে তার কাছ থেকে আমি যে শিক্ষা পেয়েছি তা হল কমিউনিস্ট হতে হলে পড়ালেখা করতে হয়। সাংস্কৃতিক চর্চাও করতে হয়। কমিউনিস্ট আন্দোলনে জীবন জীবিকা আর অধিকারের লড়াই করতে হয়। এর জন্য বক্তৃতার যেমন দরকার তেমনি মেহনতি মানুষের জাগরণের জন্য চাই উদ্দীপনামূলক গান, নাটক, কবিতা। যা হবে মেহনতি মানুষের মনের কথা, মনের খোরাক। এই জন্য ময়মনসিংহের মতো সত্যেন সেনও আমার নেতা। জীবন ও সংস্কৃতিক আন্দোলনের জানা-বোঝার নেতা।
সত্যেন সেনকে যেভাবে দেখেছি
ডা. সারওয়ার আলী
সত্যেন সেন একাধারে একজন কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা এবং সুসাহিত্যক। যুবক বয়সে সমাজতন্ত্রের তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে তিনি এ অঞ্চলের প্রথম প্রজন্মের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসাবে নিজেকে কৃষক আন্দোলনে যুক্ত করে। এই প্রজন্মের হিন্দু ধর্মাবলম্বী কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের অনেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করণ ও দমন-পীড়নে অতিষ্ট হয়ে দেশ ত্যাগ করেন কিন্তুু সত্যেন সেন মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি। পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ সময় তাকে কারাগারে কালাতিপাত করতে হয়েছে। কারাবাসকালে কিছুটা পরিণত বয়সে সত্যেন সেন নিজেকে সাহিত্য কর্মে নিয়োজিত করেন এবং অনবধ্য উপন্যাস ও গীতিকবিতা রচনা করেছেন। শেষ বয়সে তিনি অসুস্থতার কারণে তিনি প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন, এতদসত্ত্বেও সাহিত্য রচনা পরিত্যাগ করেননি, বিকল্প পথের সন্ধান করেছেন। শান্তি নিকেতনে দিদির বাসায় থাকা অবস্থায় সন্জীদা খাতুনকে যে চিঠিপত্র লিখেছেন, তাতে লক্ষ করা যায় যে, বাংলাদেশে তার মন পড়ে ছিল এবং পত্রাদির উচ্চ সাহিত্যমূল্য রয়েছে। উপরোক্ত তিনটি পরিচয়ের মধ্যে কোনটি প্রধান তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে আমার বিবেচনায় তিনি সাহিত্যিক হিসেবেই পাঠককুলের কাছে সুপরিচিত হয়েছেন এবং বিশেষ অর্জন করেছেন। বিশেষ করে ‘অভিশপ্ত নগরী’ গ্রন্থে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া, সেয়ানা উপন্যাস সমাজের বঞ্চিত মানুষের জীবন আশা-আকাক্সক্ষার মূর্তরুপ প্রকাশ প্রায়।
আমার সাথে সত্যেনদার স্বল্প সময়ের পরিচয় ছিল, সেখানে মানুষ সত্যেন সে পরিচিতিটি প্রধান হয়ে উঠেছে। তার সমবয়সী যে সব আতœগোপনকারী কিংবা প্রকাশ্যে রাজনীতি করেন এমন কমিউনিস্ট নেতাদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে, তাদের সাথে সত্যেন সেনের জীবনধারন, কথাবার্তা কিংবা ব্যবহারের পার্থক্যটি বেশ স্পষ্ট। অন্যরা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সম্ভবত: সমাজ বিপ্লবে নিবেদিত প্রাণ এবং বিপ্লবের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার প্রেরণার কারণে মূলত নীতি ও কৌশলের নিয়ে সাধারণভাবে আলোচনা করেন, অন্যান্য ক্ষেত্রে আবেগ শূন্য। অন্যদিকে সত্যেন সেন কোমল …….. আবেগপ্রবণ ভাবুক প্রকৃতির মানুষ, যা একজন কবি গীতিকারকে মানায়। আমার জানা মতে তিনি দলের উচ্চ পর্যায়ের কোন পদ গ্রহণ করেন নি, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী পর্যায়ে সদস্য ছিলেন না। চীন-রুশ দ্বন্দের ফলে কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি হওয়ার পর এই ভাবুক মানুষটি চরম অবসাদ গ্রস্থ হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী হন।
ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির মেডিকেল কলেজের কর্মীদের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, রাজবন্দীদের হাসপাতালের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কারাগার থেকে কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ, শ্রমিক নেতা সুনীল রায়ের সাথে সত্যেন সেনও দীর্ঘ সময় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কারা মুক্তির পরও তাদের চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করতে হয়েছে। তখন অসুস্থ শরীরেও তারা সূত্রাপুরের কমিউন থেকে সারা পথ হেটে হাসপাতালে আসতেন। প্রায় প্রতিদিন তাদের শয্যাপাশে নার্স ও ওয়ার্ড বয়দের ভীড়, তাদের দুজনের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তারা তারা তাদের দাদু ডাকে এবং কবে আবার ভর্তি হবেন সেজন্য অপেক্ষা করে। বস্তুত:পক্ষে আমাদের চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন পড়ে না।
কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে চীন-রুশ দ্বন্দ্বের জেরে ছাত্র ইউনিয়নে মতপার্থক্য চরমে উঠলে, সম্মেলনের আগে সুনীল রায় ও সাংবাদিক সিরাজুল হোসেন খানের সাথে সত্যেন সেন ছাত্র সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ রাখার বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। প্রথমে সূত্রাপুরের কমিউনে ও পরে সিরাজুল হোসেন খানের বাসায়। এ আলোচনায় সুনীল রায় যতটা সক্রিয়, সত্যেন সেন তেমনি নিরব। তিনি এখন এই দ্বন্দ্বের কারণে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন।
এর পর সত্যেন সেন প্রধানত: সাহিত্যকর্মে মনোনিবেশ করেছেন। অধিকাংশ সাক্ষাৎ হয়েছে ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুনের আজিমপুর কোয়ার্টারে, আলোচ্য বিষয় শিল্প ও সাহিত্য। রণেশ দাশগুপ্তর সাথে গড়ে তুলেছেন উদীচী; নিজে সঙ্গীত রচনায় ব্যস্ত। তখন দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে আসছে, স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে, শেষাবধি পাড়ি জমালেন শান্তিনিকেতনে দিদির বাসায়। সেখানেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।

আমাদের সত্যেন দা
সাংবাদিক জি. এম ইয়াকুব
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক, অনুজ মাহমুদ সেলিম দিন কয়েক আগে আমাকে ফোন করে জানালো উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেনদার জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হবে। আমাকে কিছু লিখতে অনুরোধ জানালে স্মারক গ্রন্থে জন্য। আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম সেলিমের প্রস্তাবে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবনায় পরে গেলাম। কারণ সাহিত্যিক সাংবাদিক, দার্শনিক সত্যেনদার মত একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব আজীবন বিপ্লবী সম্পর্কে আমি কতটুকুই বা জানি। যা হোক সেলিমের অনুরোধ আমাকে রাখতেই হবে।
বিশাল পান্ডিত্যের অধিকারী সত্যেনদা আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। বৃটিশ এবং পাকিস্তান আমলে বহু বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী সাহিত্যিক, সাংবাদিক আজীন বিপ্লবী সত্যেনদা মহা বিদ্রোহের কাহিনী, মানব সভ্যতার উষালগ্নে সরলাদি, বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমাদের ভূমিকা, মনোরমা মাসিমা, বিপ্লবী রহমান মাস্টার, আল বেরুনী, মা, সীমান্ত সূর্য-আবদুল গফফার খান, শেয়ানা কুমারজিত, বিদ্রোহী কৈবর্ত সহ অসংখ্য বই লিখে গেছেন সত্যেনদাকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবেন না যে এই লোকটি এত বিপ্লবী ও দার্শনিক। আজীবন বিপ্লবী সত্যেনদার অন্তর ছিল শিশুর মত অত্যন্ত কোমল।
আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনীতিকরা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। আমার মনে হয় সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমাদের দেশের সদ্য নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যে ঢালাওভাবে রাজনীতিকদের একহাত নিলেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থী ও অন্যান্য রাজনৈতিকদের অংশগ্রহণ তথা তাদের অবদানের কথা নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুস সাহেবের জানার কথা নয়। কারণ তিনি একজন লগ্নী ব্যবসায়ী। যাক ড. সাহেবের কপাল ভালো তিনি এখন একাই খোলামাঠে রাজনীতি করে বেড়াচ্ছেন নির্বিঘেœ। রাজনৈতিক দল করবার সুযোগ পেলেন।
যাক ফিরে আসা যাক আমার পরম শ্রদ্ধেয় সত্যেন দা সর্ম্পকে। সত্যেন দা রাজনৈতিক, সাংবাদিক এবং উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিবারের ছোট বড় প্রত্যেক সদস্যের কাছে ছিলেন একজন আপনজন হিসেবে।
আমি ও আমার ছোট বোন অধ্যাপিকা রাজিয়া বেগম সত্যেন দার প্রতিষ্ঠিত উদীচীর সঙ্গে শুরু থেকেই সম্পৃক্ত ছিলাম। সে সুবাদে আমাদের বেচারাম দেউরীর বাসায় প্রায়ই যেতেন। বাবা সত্যেনদাকে ¯েœহ করে সত্যেন বলে ডাকতেন। বাবা ছোট বোন রাজিয়াকে পড়ানোর কথা বললেন তাকে। সত্যেনদা বিনে পারিশ্রমিকে পড়ানোর জন্য সহাস্য রাজি হলেন। সত্যেনদা কোনদিন কখন পড়াবেন তা আগে থেকেই বলে যেতেন। সময় নিয়মানুবর্তীতা ছিল তার আর একটি বৈশিষ্ট্য। যদি বলতেন অমোকদিন রাত ৭.০০ টায় আসব ঠিক ঘড়ির কাটায় যখন রাত ৭.০০ তখনই দরজায় কড়া নড়ে উঠত, বুঝা যায় সত্যেনদার আগমন। ঝড় বৃষ্টি কোনটাই তার সময়ানুবর্তীতায় ব্যাঘাত ঘটতে পারেনি। সত্যেনদা মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় রাতের খাবার খেতেন। তার খাবারের মেনু ছিল নগন্য, তিনি একটু দুধ,একটা কলা আর একটা ডিম ছাড়া আর কিছুই খেতেন না। রাজিয়া পড়ার সময় সত্যেনদাকে অনেক ফাঁকি দিত। যেমন ইংরেজী বানান লিখতে ‘ই’ না ‘আই’ লিখেছে রাজিয়া জিজ্ঞস করলে বলত আই লিখেছি, সত্যেনদা বলতেন াখোনেতো ‘ই’ হবে, রাজিয়া কলম দিয়ে ঘষে বলতো আমিতো ‘ই’ ই লিখেছি। সত্যেনদা হাসি দিতেন এবং বলতেন ঠিক আছে। সত্যেনদা রাজিয়াকে খুব ¯েœহ করতেন, কোন দিন রাগ করতে দেখিনি তাকে। মাঝে মধ্যে সত্যেনদার চশমায় ধুলো ময়লা জমে কিছুই দেখতেন না তিনি, তখন রাজিয়া পরিস্কার করে দিত। তিনি বলতেন রাজিয়া তুমি ঐ গানটি কর, রাজিয়া খুব দরদ দিয়ে গাইত, “আমি মানুষেরে ভালবাসি…………….এই মোর অপরাধ” আরেকটা গান সত্যেনদার পছন্দ “আমার সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে দ্বীবস……………..জ্বেলে দিবস”। সত্যেনদার এক দুর্ঘটনার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সেবা করার। সত্যেনদার সঙ্গে আমি অনেকদিন অনেক বাসায় গিয়েছি, এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে মহান ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী সত্যেনদা সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। আজ সত্যেন দা ও নেই আমার ছোট বোন রাজিয়া ও আর ইহ জগতে নেই।
উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন দা
মোনায়েম সরকার
মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী দুটি বছর ইতিহাসের আলোকে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই আমরা বাঙালিরা অনুভব করতে শুরু করতে শুরু করেছিলাম, পাকিস্তান কাঠামোয় থাকা আমাদের অসম্ভব। হাজার বছরের লালিত সংস্কৃতির গৌরব, স্বাতন্ত্রবোধকে স্বকীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত করার প্রয়োজনে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম ছিল অপরিহার্য। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-র ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৬৯ গণঅভ্যূথান সংগঠিত হয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জন্মের মূলমন্ত্র ছিলো বাঙালিত্বের অহংকার। ভাষা আন্দোলন থেকে ‘৬৯-এর গণঅভ্যত্থান, এরপর ‘ ৭০-এর নির্বাচন এবং মুক্তিযুদ্ধ- এ সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা অবিস্মরনীয়। বিশেষ করে ষাট এবং সত্তরের দশকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের পরিচয়ে আমরা রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে গেছি। আইয়ূব সরকার যখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করে তখন আমরা বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠক গড়ে তুলি, এ সংগঠনগুলোকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়েছি কাঙ্খিত গন্তব্যে। বঙ্গবন্ধু ৬-দফা পেশের পর আমরা ‘নির্ঝর’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি যার সভাপতি ছিলেন কবি জসিম উদ্দীন। বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কয়েকজন নেতা নির্ঝরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা আমেনা বেগম, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান, ন্যাপের পীর হাবিবুর রহমান এবং আমিসহ আরো অনেকে। ঐ সংগঠনের আড়ালে আমরা রাজনৈতিক বৈঠক ও করতাম। নির্ঝর নামে একটি একুশে সংকলনও বের করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। গান, নাটক, গীতি-নকশার মাধ্যমে গণমানুষের চেতনা শাণিত হয়েছে, মানুষ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছে স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। সত্যেন সেন এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বহু গনসঙ্গীত রচনা করেন। যা সেই সময় বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হতো।
সত্যেন দা প্রথমে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং কিছু সংখ্যক সংস্কৃতিমনা লোকের সঙ্গে আলোচনা করেন, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। বাঙালীর আবহমান সংস্কৃতির ধারক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। আমি এখন ২৩, চামেলী বাগের যে বাড়িতে থাকি, সে সময় এ বাড়ির আঙ্গিনায় একটি টিনের ঘর ছিলো আমাদের আস্তানা। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে এ বাড়ির ভূমিকা কি পরিমান গুরুত্বপূর্ন ছিলো, তা দেশের সব রাজনৈতিক নেতাই কম বেশী জানেন। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই বাড়ি। উনিশ’শ আটষট্রি সালের ২৯ সে অক্টোবর সেই টিন সেডের বাড়িতে সৃষ্টি হয় উদীচী’র। এই সংগঠনটি শুধু সেই সময়েই নয়, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পূনরুত্থান-মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লালন ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে উদীচী। আজো তা অব্যাহত রয়েছে।
উদীচীর জন্মলগ্নে আমাদের জন্য এ ধরনের একটি সংগঠন খুব জরুরি হয়ে পড়ে। ছোট-খাটো সংগঠনের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আমাদের কাজ চলছিলো ঠিকই, তা সত্ত্বেও আমরা উপলব্ধি করছিলাম আরো বড় একটি গণসংগঠন প্রয়োজন। সে সময় আমাদের ডেরায় নিয়মিত আসতেন সত্যেন সেন, রণেশ দাস গুপ্ত, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, মনজুরুল আহসান খান, কামরুল আহসান খান, মোস্তফা ওয়াহিদ, একরাম আহমদ, হেলেন করিম, রিজিয়া, তাজিম প্রমুখ। ‘৬৯-এর অক্টোবরে ন্যাপের সহযোগী সংগঠন কৃষক সমিতির একটা অনুষ্ঠান হয় মুন্সিগঞ্জে। সেখানে গনসঙ্গীত পরিবেশনের পরিবেশনের জন্য শিল্পী দরকার। এমনিতে শিল্পীর অভাব ছিলো না। সে সময়কার শিল্পীরা আমাদের আমন্ত্রনে অংশ নিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, কোনো সন্মানি ছাড়াই। কিন্তু সংগঠিত কোন দল ছিলো না। মুন্সিগঞ্জের সে অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে সত্যেন দা প্রস্তাব দিলেন শিল্পীদের একটা দল গড়ে তোলার। আর সে দলের নাম হলো উদীচী। এর নামকরন নিয়ে মজার এক ঘটনা ঘটে।
আমাদের আস্তানাকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছিলো, সে আন্দোলনের কর্মীদের বেশির ভাগই ছিলেন ঢাকার উত্তর অংশের। ভোরে উত্তরের আকাশে এক তারা উঠে, যার নাম উদীচী। সত্যেন দা এ আলোকেই সংগঠনের নাম রাখলেন উদীচী। কামরুল আহসান খানকে আহ্বায়ক করে সত্যেন দা সহ কয়েকজনকে সদস্য করে উদীচীর প্রথম আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। পরবর্তীতে সত্যেন সেনকে সভাপতি এবং মোস্তফা ওয়াহিদকে সাধারন সম্পাদক করে উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটি করা হয়। তারপর পর সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন একরাম আহমেদ, যিনি বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান। এই উদীচীর কার্যক্রম চালাতে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। আমাদের টিনের ঘরে শিল্পীরা মহড়া দিতেন, তাতে বাধ সাধলো আমাদের পাড়ার মসজিদের মোল্লারা। আশেপাশের বাড়ির লোকদের দিয়ে তারা বলাতে লাগলো, আমরা নাকি ইসলাম বিরোধী কাজ করছি। তারা বহু চেষ্টা করেছে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার, কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তাদের অপচেষ্টা নশ্যাৎ করেছি আমরা। আর তা করার মতো মনোবল এবং দৃঢ়তা আমাদের ছিলো। গোটা দেশ তখন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তপ্ত উনুনের মতো হয়ে আছে। অনিয়ন্ত্রনাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে চলছে রাজধানী সহ সারাদেশের মানুষ। মোল্লাদের ভন্ডামি আর ধর্ম ব্যবসার কাছে পরাজিত হবার কোনো সুযোগ আমাদের ছিলো না। অত্যাধুনিক অস্ত্র তাক করে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা ভয় পাইনি, লাঠি-গুলি-টিয়ার গ্যাস সহ্য করে অটল ছিলাম পাকিস্তানি দু:শাসনের বিরুদ্ধে। স্লোগানে প্রকম্পিত করেছি রাজপথ। সেই নিবেদিত প্রান কর্মীদের মোল্লারা কি ঠেকিয়ে রাখতে পারে? হাজারো তরুন-যুবকের বুকে আগুন, হৃদয়ের আশা- আকাঙ্খা জ্বালাময়ী স্লোগান হয়ে ঝড়ে পড়ার দিন ছিলো তখন। একপর্যায়ে বাড়ির মালিক রহিমা চৌধুরানী অনুরোধ করলেন, বাবারা আমারতো পাড়ার লোকদের সঙ্গে থাকতে হবে, তোমরা রিহার্সেল অন্য জায়গায় করার ব্যবস্থা করো। আমরা বাধ্য হয়ে তৎকালীন ন্যাপের কেন্দ্রীয় অফিস ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে নিতে বাধ্য হলাম। সেখানেই রিহার্সেলের কাজ চলতো পাকিস্তান আমলে। স্বাধীনতার পর ন্যাপের কেন্দ্রীয় অফিস উশ্রী বিল্ডিং ( প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকে)-এ উদীচীর অফিস ও রিহার্সেলের কাজ চলতে থাকে। পরবর্তীতে উশ্রীর পূর্বপাশের বিল্ডিংয়ে সরকারের অনুমোদন নিয়ে বর্তমান ঠিকানায় অফিস স্থানান্তরিত হয়।
এই দীর্ঘ কাল পর্বে উদীচীর সভাপতির পদ অলন্কিত করেছেন বহু গুণীজন। তাদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত, কলীম শরাফী, পান্না কায়সার, হায়াৎ মাহমুদ, হাসান ইমাম, যতীন সরকার, গোলাম মোহাম্মদ ইদু এবং কামাল লোহানী। সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাহমুদ সেলিম তার লেখা ‘ইতিহাস কথা কও’ গীতি আলেখ্য বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে। এমনকি সিডিতেও ধারণ করা হয়েছে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠন গড়ে তুলেছে এবং বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলেছে। বর্তমানে সংগঠনের শাখার সংখ্যা প্রায় চারশত…..। আজ সত্যেন দা বেচে নেই কিন্তু তার অমর সৃষ্টি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সগৌরবে পৃথিবীর দেশে দেশে সংস্কৃতিতে অনন্য ভুমিকা রেখে চলেছেন। এই সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকে যুক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। উদীচীর কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিভাগ সত্যেন দার জীবন ও কর্ম সম্বলিত স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে জেনে অসুস্থ শরীরে আমার সামান্য কিছু বক্তব্য তুলে ধরলাম। সত্যেন দার অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার লেখা শেষ করছি।

আমাদের সত্যেন দা
কাজী মোহাম্মদ শীশ
সত্যেন দা আমার। সত্যেন দা আপনার। সত্যেন দা সবার। সবার মাঝে কথাটা সত্য বটে। তবে বেশি ভাবে কথাটা বিরাজ করছে তাদের মাঝে, য়ারা উদীচী করেছেন, উদীচী করছেন, উদীচী করবেন। সময়ের আবর্তনে এঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন সত্যেন দার সহকর্মী ও সাথী। তাদের সুযোগ ঘটেছে তার সান্নিধ্য লাভ করায়। ঘনিষ্টভাবে তার সাথে পরিচিত হওয়ার। আবার কারও কারও সৌভাগ্য হয়েছে তাকে দেখার; সল্পভাবে ব্যক্তিগত পরিচয় লাভের। আর যারা নতুন প্রজন্ম তারা যেমন নিজের প্রচেষ্টায় তেমনি উদীচীর মাধ্যমে এই মহান ব্যক্তিকে জানার কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে উদীচী সাথে জড়িত নন তেমন সুধীজনেরাও এই সংগ্রামী মানুষটির নিরলস কর্মকে, দর্শন ও আদর্শকে জানার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তাই অবশ্যই উদীচী এবং উদীচীর বাইরে বাংলাদেশের সকল প্রগতি ও চিন্তাশীল মানুষের কাছে একটি প্রিয় নাম সত্যেন সেন। মানুষের হৃদয়ের মাঝে সত্যেনদার পৌঁছে যাওয়ার ইতিহাস দীর্ঘ। মানুষের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া জীবনের সে কথা জানার সামান্য প্রয়াস আমরা নিতে পারি।
বিভাগপূর্ব এই উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, মানব মুক্তির এক্গ্র সন্ধানী, প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, সুরকার, বাংলাদেশ বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা সোনা রং নামে বাংলাদেশের এক গ্রামে। বাংলাদেশে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যের অধিকারী বিক্রমপুর জনপদ। এটি ছিল প্রাচীন বঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এক সময় দক্ষিন-পূব বঙ্গের প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। পশ্চিমে প….., উওর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিনে আড়িয়াল ও মেঘনার সংযোগ স্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে নিয়ে বিক্রমপুর গঠিত ছিল। তবে প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুর প্রায় ধ্বংশ হয়ে গেছে। বর্তমানে যা আছে তা হল ঢাকা বিভাগের মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রাচীন বিক্রমপুর জেলা অংশ। এই মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি থানার সোনারং গ্রামে শান্তিকুটির নামে এক বাড়িতে বিখ্যাত সেন পরিবারে সত্যেন সেনের জন্ম। তার বাবা ধরিত্রী মোহন সেন, মা মৃণালিনী সেন চার ভাই-বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সত্যেন সেন। অন্যরা হলেন ইন্দুবালা সেন, প্রতিভা সেন ও জিতেন্দ্র মোহন সেন। সোনারং গ্রামটি যেমন ঐতিহ্যবাহী, তেমনি সেন পরিবারও এক বিখ্যাত পরিবার। উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত ব্যক্তি এই পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন। প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক খোকার দপ্তর এবং মোহন ভোগের লেখক মনেমহন সেন হচ্ছেন সত্যেন সেনের বড় ঠাকুরদার ছেলে। বিশ্বভারতীর একসময়ের আচায্য ক্ষিতি মোহন ছিলেন তার কাকা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ভাগ্নে। এছাড়া শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে এই পরিবার অনেক কৃতি সন্তান বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। সোনারং গ্রামের স্কুলটি সেন পরিবারের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এমন একটি জন্ম নেয়া সত্যেন সেনের জীবন কালে স্বদেশে ও বিশ্বে ঘটে গেছে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উথান পতনের ঘটনা। সেই সব ঘটনার সাযুজ্য যেমন সত্যেন সেনের জীবন গড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলে, তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায় মানব মুক্তির আন্দোলনে শরীক হওয়ার। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী মুক্তি সংগ্রামের দিকটার প্রতি লক্ষ্য করলে আমরা দেখব, ১৯০৭-১৯৩৫ সময়ে অর্থাৎ ক্ষুদিরাম থেকে মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি পর্যন্ত বাংলার তরুণ সমাজ সশস্ত্র সংগ্রামের (তখন এই আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী অভ্যুদয় নামে আখ্যা দেয়া হয়েছে) মাধ্যমে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রায় সমসাময়িককালে (১৯১৬, ১৯২০ এবং ১৯২২ সালে) এই পৃথিবীর আর এক প্রান্তে আয়ারল্যান্ডে একই ইংরেজ শাসক শক্তির বিরুদ্ধে আয়রিশ অভ্যুদয়ের রক্তক্ষয়ী ঘটনা ঘটে। আবারও প্রমাণিত হয়, অত্যাচারীর খড়গ সাদা, কালো, বাদামিÑ সব রঙের মানুষের লাল রক্তে কলুষিত হয়েছে বার বার। এমনকি কারাগারে আবদ্ধ বন্দীদের ওপর অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এই ভারতবর্ষে ও আয়ারল্যান্ডে একই রকম ছিল। এ প্রসঙ্গে মুক্তি সন্ধানী চিন্তাবিদ রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর ‘আইরিশ, বাংলা, সিয়ান ও ক্যাসি’ নিবন্ধে লিখেছেনÑ ‘(আইরিশ) স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক টেরেন্স ম্যাকসুইনি কারাগারে রাজনৈতিক মর্যাদা আর দেশের মুক্তির দাবীতে পঁচাত্তর দিন অনশন করে প্রাণ দিয়েছিলেন। ইংরেজ রাজত্ব উচ্ছেদের প্রচেষ্টায় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত বাংলার যতীন দাস একই ধরনের দাবিতে কারাগারে চৌষট্টি দিন অনশন করে যখন প্রাণ দিলেন, তখন বাংলার যৌবনের মর্মভূমিতে যতীন দাস-ম্যাকসুইনি যমজ ভাইয়ের মত আসীন হয়েছিলেন।’ এমনই এক পরিস্থিতিতে-পরিবেশে গত শতাব্দীর বিশ দশকের শেষের দিকে সত্যেন সেন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী যুগান্তর দলের প্রতি আকৃষ্ট হন। আরও সব বড় ঘটনা যা তাঁর উপলব্ধিতে নাড়া দিয়েছে, বিবেককে তীক্ষè করেছে, মর্মে পীড়া দিয়েছে, কর্মে উৎসাহিত করেছে, সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেছে, প্রতিবাদ করার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলেছে তারও ব্যাপ্তি বিশাল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, রুশ বিপ্লব, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বিশ্বজুড়ে প্রগতিশীর শিল্পী-সাহিত্যিক ও সচেতন মানুষের ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশে ইংরেজি ১৯৪৩ বাংলা ১৩৫০ সালে বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৭ সালে দেশভাগ, পাকিস্তানী শাসকদের ২৩ বছরের অত্যাচার ও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাÑ এসবের মধ্য দিয়ে খাঁটি সোনার মানুষ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছেন সত্যেন দা। রাশিয়ার স্বেচ্ছাচারী জারতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার প্রস্তুতি পর্বে ছিল রুশ তরুণ-তরুণীর বোমা ও ডিনামাইট আক্রমণের একটি অধ্যায়। আয়ারল্যান্ডের মতো এই আন্দোলনও বাংলার যুব সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করেছিল। তবে ১৯১৭ সালের অক্টোবরের রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। একইভাবে বিশ দশকের সশস্ত্র অভ্যুদয়ে অনুপ্রাণিত যুগান্তর দলের সত্যেন সেন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রাম ও প্রগতিশীল আন্দোলন করার জন্য তাঁকে নানা নিগ্রহ সহ্য করতে হয় এবং বার বার তিনি কারাবরণ করেন। প্রথমবার কারারুদ্ধ হন তিন মাসের জন্য, ১৯৩১ সালে। দ্বিতীয়বার টানা পাঁচ বছর ১৯৩৩-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত। এই কারাবাসের সময় তিনি কমিউনিজমে দীক্ষিত হন। কারামুক্তির পর তাঁর কাকা ক্ষিতিমোহন সেন শান্তি নিকেতনে, বিশ্বভারতীতে ভাষাতত্ত্বের ওপর গবেষণার জন্য একটি স্কলারশীপ গ্রহণের প্রস্তাব দেন। সত্যেন সেন তখন কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ নিয়ে সংগঠনের স্বপ্নে বিভোর। তিনি এই স্কলারশীপ গ্রহণ না করে নিজ গ্রামে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বিশ্বপটে তখন ফ্যাসিস্ট শক্তি উত্থান ঘটেছে। সেটা ১৯৩৫ সাল। বিশ্বমানবকে ধাওয়া করেছে এক মহা দুর্যোগ। হিটলার জার্মানিতে হত্যা-বই পোড়ানোর মতো প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছে। ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি ইতালিতে প্রগতিকামী গণতান্ত্রিক শক্তির কণ্ঠরোধ করে আবিসিনিয়া আক্রমণ করতে উদ্যোগী হয়েছে। জাপানও ভয়াবহ আক্রমণাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৩৬ সালেন মাঝামাঝি সময় স্পেন প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেনারেল ফ্রাংকো বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিশ্ববাসী আরও এক ফ্যাসিস্ট আক্রমণের নগ্নরূপ দেখতে পাই। মানবজাতিকে হিটলার মুসোলিনির ঘৃণ্য থাবা থেকে রক্ষা করার জন্য পৃথিবীর অগ্রগণ্য শিল্পী-সাহিত্যিকরা ১৯৩৫ সালে প্যারিস শহরে অনুষ্ঠিত এক মহাসম্মেলনে ‘ইন্টারন্যাশানাল অ্যাসোসিয়েশন অব রাইটার্স ফর দ্য ডিফেন্স অব কালচার এগেইনস্ট ফ্যাসিজম’ গঠন করেন। অন্যদিকে স্পেনে গড়ে ওঠে ফ্যাসিস্ট বিরোধী পপুলার ফ্রন্ট। বিশ্বজুড়ে এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ভারতবর্ষেও লাগে। গঠিত হয় সর্ব ভারতীয় এবং বিভিন্ন অঞ্চল পর্যায় ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’। ঢাকাতেও ‘ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ গঠিত হয়। এই সংগঠনের অন্যতম সংগঠন ও সম্পাদক সোমেন চন্দ ঢাকার সূত্রাপুরে আয়োজিত ফ্যাসি-বিরোধী সম্মেলনে যোগ দানের উদ্দেশ্যে একটি মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষীবাজারের কাছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে নিহত হন ১৯৪২ সালে। সোমেন চন্দের মৃত্যুর পর ঢাকা জেলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সংগঠক হিসেবে যাদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়, তাদের পুরোধাদের অন্যতম ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন প্রমুখ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে ইংরেজ রাজত্বে বাংলাদেশে মনুষ্যসৃষ্ট এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। পঞ্চাশের সেই (বাংলা ১৩৫০ সাল) মন্বন্তর খাদ্যাভাব ও অসুখ-বিসুখে বহু লোক মারা যান। দুর্গত মানুষের সেবায় সত্যেন দা ত্রাণকাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। গান লিখে, গান গেয়ে স্বচ্ছল পরিবারের মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করেন। তাঁর লেখা গান জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাঁর কর্মজীবনের এক পর্যায়ে সত্যেন দা গড়ে তুলেছিলেন একটি গানের দল। ১৯৫৮ সাল থেকে দীর্ঘ দশ বছর বিভিন্ন কৃষক সমাবেশে, শ্রমিক জমায়েতে এই দলটি দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করত। আরও পরে ১৯৬৮ সালে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সত্যেন সেন প্রতিষ্ঠা করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। দেশে-বিদেশে নানা শাখা বিস্তৃত সত্যেন দা’র চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল চিন্তাধারায় সম্পৃক্ত সংগঠনটি বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক চর্চা ও প্রসারের কেন্দ্র। চল্লিশ দশকে সত্যেন দা প্রচুর গান রচনা করেন। সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে সত্যেন সেন অনেক জনপ্রিয় গণসংগীত রচনা করেন। সত্যেন সেনের গানগুলো সঠিকভাবে আজও সংগৃহীত হয়নি। তাঁর লেখা স্বল্প সংখ্যক গান কেবল আমরা শুনতে পাইÑ এটা বড়ই দুঃখের বিষয়।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক কর্মী বিশেষ করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মীদের ওপর শাসক গোষ্ঠীর অত্যাচার-নিপীড়ন বেড়ে যায়। সত্যেন সেনকে বার বার কারারুদ্ধ করা হয়। কখনো বা তাঁকে আত্মগোপনে থাকতে হয়। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান পর্যায়ে সত্যেন সেনের কারাবন্দী জীবন শুরু হয়। এভাবে পাকিস্তানের ২৩ বছর শাসনামলে তিনি ১৩ বছরেরও বেশি সময় কারাভোগ করেন।
ছেলেবেলা থেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় সত্যেন সেন নিয়োজিত ছিলেন। তবে তাঁর সাহিত্য সম্ভারের এক বিপুল অংশই তিনি কারাগারে অবস্থানকালে সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে কারাবাসকালে প্রথম উপন্যাস ‘ভোরের বিহঙ্গী’ রচনা করেন। তবে তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই ‘মহাবিদ্রোহের কাহিনী’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। ‘ভোরের বিহঙ্গী’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। সত্যেন সেনের এই পর্যন্ত প্রকাশিত ৪১টি গ্রন্থের মধ্যে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালের দিকে। গভীর মননশীল মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়ে জীবনমুখী সাহিত্য রচনা করে গেছেন তিনি। সাহিত্য কর্মে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৬৯ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৬ সালে একুশে পদক (মরণোত্তর) পান।
সত্যেন সেনের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন দীর্ঘ ও কর্মবহুল। স্বল্প পরিসরে তার খুব সামান্য অংশ উল্লেখ করা সম্ভব। তাঁর জীবন চর্চাকে উপলব্ধির মধ্যে ধারণ করাই মানুষটাকে জানা-চেনার অন্যতম উপায়। সদাব্যস্ত, মুক্তিসন্ধানে অবিরাম পথচলা সত্যেন দা কোন নির্দিষ্ট পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেননি। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা করেছেন, তবে তা বিরতিহীন নয়Ñকয়েক পর্যায়ে। অকৃতদার সত্যেন দা অবশ্য নিজের পেশা সম্বন্ধে লিখেছেন, “লেখা আমার পেশা, আমার জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায়।” তিনি তাঁর এন পেশায় আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন।
কারাবাসকালে সত্যেন সেনের চোখের পীড়া দেখা দেয়। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি সময় জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার চোখের জ্যোতি ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে আসতে থাকে। সেই অবস্থায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে নিয়োজিত হন। চোখের পীড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৭২ সালে চিকিৎসার জন্য মস্কো গমন করেন। সেখানে সত্যেন সেনের সাথে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাদের সাথে দেশ-সমাজ-বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন। দেশে ফেরার পর তার সে অভিজ্ঞতা কলাম আকারে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি উদীচী পুনর্গঠনের কাজ ও সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত হন। কিন্তু ক্রমশ তাঁর দৃষ্টিশক্তি কমে আসতে থাকে এবং ধীরে ধীরে তিনি অন্ধত্বের দিকে যেতে থাকেন। এই অবস্থায়, সবার অনুরোধে এবং তাঁর মেজদিদি প্রতিভা সেনের আমন্ত্রণে ১৯৭৩ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান। তবে দৃষ্টিহীন অবস্থায় শ্রুতিলিখনের মাধ্যমে তিনি লেখার কাজ চালিয়ে যান। দীর্ঘদিন পরবাসে থাকাকালে প্রতিভা সেনের আশ্রয়ে শান্তিনিকেতনের গুরুপল্লীতে ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি ৭৪ বছর বয়সে অকৃতদার সত্যেন সেন আমাদের ছেড়ে চলে যান। শিল্পী, সংগ্রামী, ত্যাগী এই মানুষটির কথা বাংলার মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে।

তথ্যসূত্র:
১. বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ। খ- ৯, প্রকাশক: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ৫, ওল্ড সেক্রেটারিয়েট রোড নিমতলী, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ২০১১ পৃষ্ঠা: ২৯৬-২৯৮
২. প্রাগুক্ত: খ- ১৪, পৃষ্ঠা ৬১-৬২
৩. সত্যেন সেন মহাজীবনের রূপকার, সত্যেন সেন জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি: প্রকাশকাল ২০০৬, রচনা: মাহাবুবুর রহমান, প্রকাশনায়: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, চট্টগ্রাম জেলা সংসদ

সত্যেনদার কিছু স্মৃতি
আমেনা আক্তার
বিশিষ্ট সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আজীবন বিপ্লবী, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পীসংগ্রামী সত্যেন সেনের জীবন ও কর্ম সমন্দে আগে কিছুই জানা ছিলনা আমার। তবে অল্পকিছুদিন সত্যেনদা যেভাবে দেখার বা জানার সৌভাগ্য হয়েছিল তারই দু, একটি স্মৃতি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
১৯৫৬ সালের সুখ-দুঃখের স্মৃতি লক্ষ্রীবাজারের গোপন আস্তানায় কমিউনিস্ট পরিবারের ভাই-বোনেরা ঐ আস্তানা বদল করে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ে চলেগেলেন। এর পর ঘরে টুকটাক জিনিসপত্র যা ছিল তা নিয়ে পাতলা খান লেনে দেড় রুমের একটি বাসা ভাড়া করে আমরা সেখানে চলে গেলাম। সেখানে কিছু দিন থাকার পার্টি থেকে নির্দেশ আসলো পার্টি থেকে এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় সেল্টার নিতে হবে। এখন বাড়ির মালিক খালাম্মাকে বলা হল জানুয়ারির এক তারিখে বাসা ছেড়ে দিন বাসা ছাড়ার কথা শনে তিনি বললেন তোমরা কোথায় বাসা বাড়া নিয়েছগো, “বললাম মালিবাগের দিকে হবে হয় তো? তিনি তখন বললেন “ওমা অত দুর; সে তো গ্রাম ওখানে শুধু ধানক্ষেত আর জঙ্গলে ভর্তি রাত হলেই শিয়াল ডাকে। তুমি ঐ বন জঙ্গলের মধ্যে থাকতে পারবে তো? বললাম থাকতে পারবো আপনি দোয়া করবেন”। কমরেড আফজাল হোসেন প্রামনিক (চাচা) তিনি তার পুরানো খবরের কাগজের বস্তা ও খুটিনাটি জিনিসপত্র ঠেলা গাড়িতে তুলে দিলেন, এর পর আমরা রিকসা করে চলে এলাম মালিবাগের রাস্তা থেকে ভিতরে এক নির্জন গ্রামে। রাত্রি হলেই জঙ্গলে শিয়ালের ডাকাডাকি শোনা যেত, এই বাড়ির চার কোণায় চাটি টিনের চৌরি চার ছিল মধ্যেখানে উঠোন ছিল আর ছিল বিশাল এলাকা জুড়ে আম-কাঠালের বাগান ছিল। ঘরগুলোর মাটির মেঝে……………. অপরিস্কার মাটির চুলা তা ভেঙ্গে রেখে গেছে কেউ। এসব ঘর-দোর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে নেয়াহল। গোসলখানা ছিল একবারে খোলা জায়গায় এক চিলতা খলপার ভেড়া দেয়া ছিল। কাপড় দিয়ে আড়াল না করলে সেখানে গোসল করা সুবিধা হত। ল্যাটিন ছিল ঘর ছেড়ে অনেক দুরে জঙ্গলের ভিতর সেখানে যেতেও ভয় লাগত ঐ পরিবেশের মধ্যে অন্যকমরেডদের সঙ্গে আরও যে দু,জন নতুন কমরেড আসলেন তখন দেখলাম একজনের মাথায় ধবধবে সাদা চুল পরিচ্ছন্ন লুঙ্গি গেঞ্জী পরা, অন্য জন খুবই সাধারণ লুঙ্গি পরা, খালি গা, খালি পা কতদিন মাথায় চিরুনী পড়েনি, তিনি গুন গুন করে গান করতে করতে রান্না ঘরে নাস্তা খেতে বসে কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বললেন না চুপচাপ নাস্তা খেয়ে রুমে চলে গেলেন।
এর পর কমরেড নেপাল নাগ ‘রহমান ভাই’ তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন একজন আমিন ভাই অন্যজন শাহাজান ভাই। নেপালদা আরও বললেন ওনারা এখন থেকে তোমাদের সঙ্গেই থাকবেন, তিনি ………… …….. বললেন অনারা খুবই ভালো মানুষ, আমার থেকেও ভালো। এ কিছু দিন পর জানতে পারলাম একজন কমরেড অনিল মুখার্জী, অন্যজন কমরেড সত্যেন সেন। তখন থেকে জেনেছিলাম সত্যেন দা সারা জীবন গ্রাম থেকে গ্রামের মেঠো পথের দুরন্ত ছিলেন, তিনি শুধু দেশ আর দেশের দিনহীন মানুষের জন্য ছিলেন নিবেতি প্রাণ। নিজের আরাম আয়েসের কোনো রকম ভাবনা করেননি এর পরও তাকে জেলজুলুম পোহাতে হয়েছে এবং আন্দামনে নির্যাসিত হয়েছিলেন তিনি। সত্যেনদার খাবারের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। ইচ্ছা থাকলেও ব্যবস্থা করার মত উপায় ছিল না। তিনি প্রায় সময় আমলকির আচার দিয়ে ডাল ভাত খেতেই পছন্দ করতেন, দেখতাম সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়ার সময় ঢিলাঢালা শার্ট পায়জামা এবং কতদিনের সেন্ডেল পড়ে কাপড়ের থলে কাধে ঝুলিয়ে তিনি তার কর্মস্থলে বের হয়ে যেতেন। দেখতাম ডেরার ভিতরে সরু গলি পথ ছিল ঐ পথেই সকাল বিকাল তিনি আমার বাচ্চার হাত ধরে পায়চারী করতেন আর গুন গুন করে গান করতেন দাদার চলা-ফেরা, পোশাক আশাক দেখে কখনই বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি জনমানুষের এত বড় নেতা। এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করলাম তা হল এশিয়া সর্বপ্রথম অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী হন তিনি হলেন কমরেড সত্যেন সেনের জীবিত মামা ড.অমত্য সেন। সত্যেন দা একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন তুমি কোথা থেকে পড়ালেখা করেছ? তখন আমি কি বলব কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না, দাদা তখন বললেন, কোন অসুবিধা নেই তুমি বল। আমি তখন বললাম, চুপিচুপি গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যেতাম, ও পাঠশালার সবদের পন্ডিত আমাকে পড়াতেন। আর ঘরে বাবা পড়াতেন তখন দাদা প্রশ্ন করলে চুপিচুপি পড়তে যেতে? তখন আমি তো রক্ষনশীল পরিবারের মেয়ে সে কারণে স্কুলে যাওয়া কারণ ছিল। তখনই সত্যেন দা আমাকে বললেন, তোমাকে এখন থেকে আরও ভালো করে পড়ালেখা শিখতে হবে। তা না হলে পৃথিবী সমন্ধে জানতে ও বুঝতে পারবে না। এখন থেকে লেখা পড়া শুরূ করবে, তুমি আর গফুর সময় করে আমার কাছে বসবে। তারপর থেকে দাদার কাছে মাঝে মাঝে বসতাম। তিনি তখন বুঝাতেন ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য কি এবং সমাজতন্ত্রে কীভাবে অগ্রসর হব তিনি সে কথা আমাকে বুঝাতেন, দেশের সব মানুষ যখন সুযোগ-সুবিধা, অধিকার সমানভাবে ভোগ করে কেউ কারো চেয়ে ছোট বড়, উচু নিচু থাকে না তখনই দেশে সমাজতন্ত্র আসে। এখন গণতন্ত্রের সিড়ি বেয়ে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি লক্ষ্যে আমরা পৌছাবোই। দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম সমাজতন্ত্র আমরা কি দেখে যেতে পারবো ? তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন, তোমরা দেখতে না পারলেও তোমাদের নাতির ঘরের পুতিরা তো আশা করি অবশ্যই দেখতে পারবে। তিনি আরও বুঝালে, জানো আমার এক বোন ছিল সে কিন্তু অনেক বয়সেও উননের (ফুলার) পাশে বই রেখে পড়ালেখা করে এম. এ পাশ করেছিলে, ইচ্ছা থাকলে সব বয়সেই লেখাপড়া করা যায়। তুমি কেন পড়বেনা। এর পর তিনি বললেন, এখন থেকে তোমার কোন স্মরণীয় ঘটনা যা তোমার মনে আসে তাই লিখে আমাকে দেখাবে। চেষ্টা করলে মানুষ অনেক কিছু শিখতে ও জানতে পারে। তুমি কেন পারবেনা। লেখা দেখানোর সৌভাগ্য আমার আর হয়নি, দুরভাগ্য আমার।
১৯৫৭ সালের আইয়ুব খানের শাসন আমলে দেশে তখন খাদ্য সংকট। পার্টির পরিবার গুলো মধ্যেও অর্থনৈতিক সংকট বেড়ে গেল ফলে শুরু হলো সকালে এবং রাতে আটার রুটি খাওয়া। সন্ধ্যা বেলা রুটি গুলো ভাজা হতো বলে অধিক রাতে রুটি গুলো শক্ত হয়ে যেত। ফলে কমরেডদের এগুলো খেতে খুব কষ্ট হতো। একদিন সত্যেনদা কমরেড সত্যেন সেন, রুটি সেকার নতুন নিয়মটি সেখালেন। যেমন গরম তাওয়াতে রুটি এপিঠ ওপিঠ অল্প সেকে খুন্তির মাথায় গেথে চুলার আগুনের উপর ধরলে রুটি ফুলে উঠবে এবং রুটিও নরম থাকবে। এ নিয়মে পাতা পোড়ানো আগুনে সেকতে গেলেই রুটি কালো হয়ে যেত। তথাপি ঐ কালো রুটি দাদারা খেতেন। দু, বেলা রুটি কি দিয়ে খাবেন সেটাও একটা ব্যাপার ছিলো অবএব ঐ বাড়ির ভিতরে অনেক ঝংলী কচু ছিল। ঐ কচু শাক কেটে এনে রান্না করা হত তাই দিয়ে রুটি খেতে সবাই। এখানে একটি মজার ব্যাপার উল্লেখ না করে পারছিনা। আমাদের পাশেই থাকতেন ক্যালকেশিয়ান পরিবার। ভদ্রমহিলা কচু কাটতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন এ শাক দিয়ে কি করব। তাকে জানালাম এগুলো রান্নআ করে খাব। শুনে তিনি অবাক হলেন। এর পর একদিন শাক রান্না করেও পাঠালাম। তারপর তিনি জেনে নিলেন রান্নার পদ্ধতি। এরপর তিনিসহ আরও কয়েকজন মিলে কচুশাক কেটে নিয়ে গেলেন। এরপর আমিন ভাই সত্যেনদার শূন্য কচু ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন তোমার বন্ধুদের কি রান্না শেখালে যে তোমার শাকের ক্ষেতে একেবারে বিরানভূমিতে পরিণতি করে দিয়ে গেলেন ঐ সময় আমাদের খাদ্য তালিকায় ছিল কচুশাক লাউ ঘন পাতলা মশুরে ডাল। তবে বিভিন্ন জেলার নেতারা এলে মাছ বা মাংসের ব্যবস্থা থাকত। সত্যেনদা আমাকে একটি গান লিখে দিয়ে তোমরা মেয়েরা যখন আন্দোলন করতে রাস্তায় নামবে তখন হারমোনিয়াটা গলায় ঝুলিয়ে রাজপথে ঐ গানটি গাইবে, দেখবে তোমাদের মিছিলে অনেক লোক জড়ো হবে। অবশ্য পুরোটা গান আমার মনে নেই ভুলভ্রান্তি আছে। তার পরেও লিখে দিলাম।
মেয়েরা জাগো জাগে
মেয়েরা জাগো জাগে,
পুরুষের হাতে গড়া …… বিধানে
কাড়া গৃহে নন্দিনী নারী,
মেয়েরা জাগো জাগো,
তোমাদের পাদ ভারে কেঁপে যাক ধরণী
ভেঙ্গে জাক জীর্ণ একাড়া
ভেঙ্গে জাক জীর্ণ একাড়া
মেয়েরা জাগো জাগে
মেয়েরা জাগো জাগে,
এভাবেই কমরেড সত্যেনদাকে দেখার ও জানার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।

আমাকে তুমি অশেষ করেছ
মালেকা বেগম
প্রিয় সত্যেন দা, আজ আপনি নেই বলে আমার মতো অনেকেরই শান্তির আশ্রয় নেই। আপনি কেন জানি ‘তুমি’ বলেননি প্রথমে। একচোট চেচাঁমেচি করে সেই যে ‘তুমি’ আর ‘বোনটি’ আদায় করলাম সে আর ঘোচেনি জীবনভর। দাদা বলে ছুটে গিয়েছি আপনার কাছে নানা পরামর্শের জন্য। নারী আন্দোলনের কর্মকা-ে আপনার অনেক সহায়তা পেয়েছি। হেলেন আপনার কথা বলেছে নানা সময়ে। আপনার কথা জেনেছি হেনা আলম-এর কাছে। মনোরমা মাসিমা বলেছেন। সুফিয়া কামাল খালাম্মা বলেছেন। সবই আপনাকে ঘিরে, আপনার জীবিত সময়ের স্মৃতি চারণের কথা। আপনার বইগুলো সংগ্রহ করে পড়েছি। সেতো কোন আলের হরফ পড়া নয়। সে পড়া পড়েছি আপনার হৃদয়ের হীরা-দ্যুতির ছটায় দীপ্ত জীবন সংগ্রামের কথা। সজীব হয়ে আছে আজও। কারাগারে বসে লেখাগুলোর মধ্যে যে জীবন দীপ্তির ছটা আপনি ছড়িয়েছেন, যে বিদ্রোহ-বিপ্লবের কাহিনী আপনি শুনিয়েছেন, যে শোনিতধারা আপনি নাটকের হৃদস্পদনের মধ্যে বইয়ে দিয়েছেন আপনি; তা বয়ে চলেছে আজও প্রজন্ম-উত্তর প্রজন্মের হৃদয়ে। যেদিন জানলাম আপনি জন্মেছেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ বিক্রমপুরের সোনারঙ গ্রামে ‘শান্তিকুটির’ নামে একান্নবর্তী পরিবারের বাড়িতে। আপনার বাবা ধরণীমোহন সেন প্রত্মতত্ত্ব চর্চা করতেন। আপনি পড়তেন ‘সোনারঙ’ স্কুলে। আপনাদের বাড়িটি ছিল গ্রামের বাইরে। ভাই-বোনরাই পরস্পরের খেলার সঙ্গী ছিলেন। কি চমৎকার শৈশব ছিল, কৈশোর ছিল আপনার। চালতা গাছের ওপরে মাচা বেঁধে পড়াশুনা করতেন, গানের চর্চা করতেন- সেসব স্মৃতিকাতর আপনাকে দেখেছি নারিন্দার এক শহুরে আলিন্দে, এক চিলতে ঘরে নিমগ্ন হয়ে লিখতেন, কথা বলতেন, হেলেনকে সাহায্য করতেন, পরামর্শ দিতেন, কোন না কোন ছোট খাটো গৃহস্থালী কাজে। যেমন বাড়িই হোক না কেন; থাকার জন্য; বাস করার জন্য যত ছোট হোক না কেন, -ছিল বইয়ে ভরা বিছানা, আলমারিতে ছিল ঠাসাঠাসা বই, পা-ুলিপি। স্মৃতি হাতড়ে বলেছিলেন; সেই শৈশবেই গ্রামের বাড়িতে ঠাকুরদা, কাকা, বাবাদের সংগ্রহকৃত ‘অনেক কাব্য-কবিতা-উপন্যাস ও জীবনী’ ভরা আলমারির প্রভাবের কথা।
কত সুন্দর উন্মুক্ত শৈশব, কৈশোর ছিল আপনার। কাকা-ভাই-বোন, বই-গান তো ছিলই আর ছিলেন ‘মাহাঙ্গু বানিয়া’ নামের সঙ্গী। আপনার বিপ্লবী দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠার জন্য মাহাঙ্গু বানিয়ার প্রতি ছিলেন ঋণী। আমরা যেমন আপনার এবং আরও অনেকের কাছে ঋণী- নতুন এক সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাওয়ার পথপ্রদর্শক রূপে।
অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছিলেন ১৯২১ সালে। সেই সময় আপনি এক রাজনৈতিক সভায় যোগ দিয়েছিলেন ‘মাহাঙ্গু বানিয়া’র সাহচর্যে। তাঁকে কথাও দিয়েছিলেন দেশের জন্য কাজ করবেন। কীভাবে যে কখন কার মনে কে সোনার জীয়নকাঠির ছোঁয়া দেয়! আপনিও তো হাজার-লক্ষ তরুণের প্রাণে ‘উদীচী’র ছোঁয়া দিলেন। সেই সময়কাল ছিল ১৯৬৮। ‘উত্তর আকাশের নক্ষত্র’ উদীচী- নামকরণ আপনিই করেছিলেন।
কি বিস্ময় জেগেছিল আমাদের তারুণ্যের মনে। ছেলে-মেয়েদের চিত্ত উন্মোচন ঘটেছিল। মাত্র যখন বয়স আপনার ২৪ ছিল, ১৯৩১ সালে, আপনাকে ‘যুগান্তর’ দলের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে জেলে বন্দী হতে হয়। তিন মাস পরে মুক্ত হন। রাজনৈতিক সাম্যবাদী মতাদর্শে তখন আপনি বিশ্বাসী হতে থাকেন। কিন্তু আবারও ধরা পড়েন পুলিশের হাতে। জেলে আবদ্ধ থাকেন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত।
বড় কষ্ট, বড় দুঃখ বহন করেছেন আপনার মা এবং আপনিও। মা-ছেলের চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেলে ১৯৩৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পর। আপনি ছাড়া পেলেন ১৯৩৮ সালে। কি অসহনীয় কারা-অন্তরীণ যন্ত্রণা সহ্য করেছেন আপনি ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত। অবাক হতে হয়। এর মধ্যেই কারান্তরালেই এম.এ পাশ করেছেন, কত বইয়ের পা-ুলিপি লিখেছেন- এসব জেনেছি আপনার সহযোগী বিপ্লবী-দেশপ্রেমিক বন্ধুদের কাছ থেকে। আপনি কখনো বলতে চাননি। মৃদু হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বলতেন, সেসব কোন কাজের কথা হলো?
বইয়ের নাম ‘রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ’- হাতে নিয়েই চমকে গিয়েছিলাম। রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে বসে লেখা ১৯৫৯ সালে। এর আগে, তৈরি করা পা-ুলিপি ছিল ‘মহাবিদ্রোহের কাহিনী’। সিপাহী বিপ্লবের একশত বছর (১৮৫৭-১৯৫৭)-এর পূর্তিতে লেখা বইটি বেরিয়েছিল ১৯৫৮ সালে। আমার-আমাদের মনে আছে সেই বছরটা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল সেনাশাসন শুরুর বছর। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ হলেও পাঠকের হৃদয়ে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহবান আপনি পরোক্ষে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
‘রুদ্ধদ্বার মুক্ত প্রাণ’ বইটির বিষয়ে বলেছেন, এটি কল্পকাহিনী নয়। নারীর মুক্তির কাহিনী কি? নারীর জীবনের রুদ্ধদ্বার কি? প্রেম-চাঞ্চল্য-প্রতীক্ষার অনবদ্য কাহিনী। আপনি নায়কের জবানীতে প্রেমিকাকে বললেন, ‘তুমি মুক্ত হও’। নায়িকা বললেন, ‘তোমাকে বাদ দিয়ে আমার স্বতন্ত্র কোন অস্তিত্ব নেই’। এই তো চির পুরাতন, চির নতুন, নারীর প্রেম বেষ্টনির বাঁধন। শুনে নায়কের জবানীতে আপনি ধিক্কার জানালেন, ‘মানুষ নয়, এ যেন ষোল আনা মেয়ে’। সমাজ কাঠামোতে, সংসার-পরিবারের বেষ্টনিতে মেয়েরা তো মানুষ নয়। সে নিজেও বুঝতে চায় না ষোল আনা ‘মেয়ে’ হওয়ার দোষ কি? ‘মানুষ’ হলেই বা কি লাভ? পুরুষ তো মানুষ বলেই সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্রে স্বীকৃত। তা সে কি ‘ষোল আনাই পুরুষ নয়?’ পুরুষ অহমিকা, আধিপত্য, কি ‘মানুষ’ হওয়ার লক্ষণ? এসব কথা নিয়ে কত না বিরক্ত করেছি আপনাকে। বুঝেছি আপনার আদর্শগত অবস্থান। নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে বৈশ্বিক-দেশীয় প্রেক্ষাপটে আপনি আধুনিক মুক্ত মনের দার্শনিক ছিলেন।
প্রতিটি বই আমাকে আমাদের আলোড়িত করেছে। পদচিহ্ন, মসলার যুদ্ধ, সেয়ানা, মাসিমা, গ্রামবাংলার পথে পথে- সব বইই মানুষের কথায় পূর্ণ। গ্রামের নারী-পুরুষ, ইতিহাসের উত্তাল সময়, সমকালীন কৃষক-সমাজের কথা, গণসঙ্গীতের কথা, সবই লিখেছেন। আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন, এখনও অনুপ্রাণিত করছেন।
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ মাত্র শেষ হলো। একুশে পদক-এর খবর পড়তে পড়তে মনে পড়লো আপনি ১৯৭০ সালে একুশে পদক অর্জন করেছেন। এ আমাদের দেশের গৌরব, আপনার এ অর্জনে দেশবাসী গর্বিত হয়েছে।
সত্যেন দা, আপনার সঙ্গে সাংগঠনিক যোগাযোগের বাইরেও ছিল ব্যক্তিগত পারিবারিক যোগাযোগ। আমার মা ফাহিমা বেগম-এর বিশেষ অনুরোধে আপনি নারিন্দা থেকে বাইরের কাজে যাওয়ার পথে প্রায় প্রতিদিন ওয়ারির ১৫ লারমিনিস্ট্রিটে আমাদের বাসায় এসে পদধূলি দিতেন। মায়ের তৈরি ‘চা আর একটি ডিম পোচ’ আপনাকে প্রতিদিন-অনেক দিন খেতে হয়েছে। আমরা ধন্য, আমার মা ধন্য হয়েছেন।
‘আজ ‘মা’ নেই, আপনি নেই’ কিন্তু সেই সব স্মৃতি সৌরভ আমাদের ভরিয়ে রেখেছে।
আপনি এরকম অন্দর মহলের বহু মা-মাসীমার শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন। আপনার স্মরণে আমি আজ সেই সব কথার ঝাঁপি খুলতে পেরে কৃতার্থ হোলাম।

০৩.০৩.২০১৪

সত্যেন সেন স্মরণে : তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে
ভোরের কাগজ : ২২/০৩/২০১৪

সেকালে কারাগার ছিল বামপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রায় স্থায়ী আবাসস্থল। সেই সূত্রে কারাগারগুলো বিশেষ করে তৎকালীন ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার দুটি পরিণত হয়েছিল মার্কসবাদীদের ব্যাপক মিলনকেন্দ্রে আর সেই সুবাদে ঐ দুটি কেন্দ্রীয় কারাগারে সমৃদ্ধ পাঠাগারও। দেশে আরো গোটা দুয়েক কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল বটে কিন্তু সেগুলোতে সরকার কদাপি আমাকে স্থানান্তরিত না করায় সে দুটি সম্পর্কে আমার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকায় তা নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগ আমার নেই।
আমি যে ৮/১০ দফায় কারারুদ্ধ হয়েছি তারই এক পর্যায়ে পাবনা জেলা কারাগার থেকে আমাকে প্রথমে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অতঃপর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। দুবার এমনটি ঘটেছিল অর্থাৎ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবার সুযোগ ঘটেছিল। এরই একদফায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলে আমার পরিচয় ঘটে কমরেড সত্যেন সেনের সঙ্গে। সেটা ষাটের দশকের কথা। সত্যেনদার কথা তার আগেও শুনেছি। তাঁর দু একখান বইও হাতে এসেছে। কিন্তু সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ তার আগে কদাপি পাইনি। কিন্তু সাক্ষাৎ বা পরিচয় হলে কী হবে? বেশি কথাবার্তা বলা বা আলাপ-আলোচনা করার তার সুযোগ কোথায়? ২৬ সেলের একটি সেলে সত্যেনদা থাকতেন। আমি অপর এক সেলে মতিন ভাইসহ (ভাষা মতিন) থাকতাম। সন্ধ্যায় লকআপ ভোরে খুলে দেয়া হতো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে কিছুটা হাঁটাহাঁটি করে স্নানাদি সেরে প্রাতরাশ সমাপ্তির পর নতুন সংবাদপত্রের অপেক্ষা। সংবাদপত্র বেশ অনেকগুলোই আসতোÑ তবে রীতিমতো ঈবহংড়ৎবফ হয়ে। অর্থাৎ কারা কর্তৃপক্ষ যে খবরগুলো রাজবন্দীদের জন্য আপত্তিকর মনে করতেন সেগুলো ঘন কালি দিয়ে লেপটে দিয়ে তবে পাঠাতেন এবং তখন তা আমরা পড়তে পারতাম। ঐ সেন্সর প্রক্রিয়ার জন্য জেলগেটে দেরি হতো। আমরা তাই পত্রিকা পেতে পেতে প্রায় দুপুর বা তাড়াতাড়ি হলে এগারটার দিকে পেতাম। পত্রিকাগুলো পড়ার পর যার যার নিজস্ব লেখাপড়া, বৈঠক, আলাপ-আলোচনা প্রভৃতি নানা ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়া ছিল দৈনন্দিন কর্মসূচি। এভাবেই বছরের পর বছর জেলজীবন কাটাতে রাজবন্দীরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। একনাগাড়ে ৭/৮ বছর জেলে কাটানোয় অনেকের সঙ্গেই পরিচয়ের সুযোগ ঘটেছে। এরা সবাই ইংরেজ আমলের বিপ্লবী। সত্যেনদা তাদেরই দলে।
২৬ সেলে আর যারা আমার আগে থেকেই আটক ছিলেন তাদের মধ্যে নগেন সরকার, অজয় রায় প্রমুখের কথা মনে আছে। কমিউনিস্ট বন্দীদের কাছে ষাটের দশকের ঐ সময়টা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন চীন-রাশিয়ার মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব তুঙ্গে উঠেছে পৃথিবীব্যাপী। পূর্ববঙ্গ তা থেকে বাদ থাকতে পারেনি। এখানে তোয়াহা-শরদিন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে মাওবাদী চিন্তাভাবনা সমর্থন করে এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও তার প্রতি সমর্থন দেয়ার দাবি জানিয়ে একটা থিসিস প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পাঠান। কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনার পর অধিকাংশ ভোটে ঐ থিসিস প্রত্যাখ্যাত হয় এবং রুশ পার্টির লাইন গৃহীত হয়। তখন চীনপন্থীরা পার্টির সাধারণ সদস্যদের মধ্যে বিলি করেন কিন্তু সেখানেও অধিকাংশ সমর্থন রুশপন্থায় প্রতিই ছিলÑ যদিও তরুণদের একটা বড় অংশ চীনপন্থায় আকৃষ্ট হয়ে পরে নকশালী সন্ত্রাসবাদী পথ বেছে নিয়ে অনেকেই মৃত্যুর কবলে পতিত হন। সত্যেনদা অনুরক্ত ছিলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাতমুখ ধুয়ে ছোট একটা টেবিল ও একটি চেয়ার কিছু কাগজ ও একটি কলম নিয়ে সত্যেনদা বসতেন লিখতে। অতিশয় হালকা-পাতলা গড়ন, চোখে হাইপাওয়ার ভারী কাচের চশমা, পরনে সাধারণ একটা ধুতি ও ফুলশার্ট আবার কখনো বা একটি পায়জামা ও ফুলশার্ট থাকতো তার পরনে। অক্টোবর বিপ্লব দিবস, নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভৃতি বিশেষ দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা ছাড়া তাকে বড় একটা কোনো অনুষ্ঠানে, বৈঠকে বা আড্ডায় পাওয়া যেতো না। তিনি শুধুই বসে লিখতেনÑ যেন মুখস্ত কিছু লিখে চলেছেন অবিরাম। বাকস্বল্পতা ছিল সত্যেনদার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কারাগারের বাইরের জীবনে সত্যেনদার সঙ্গে কদাপি সাক্ষাৎ হয়েছে এমন কোনো কথা স্মরণে আনতে পারছি না। বস্তুত কোথাও আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তার লেখা বেশ কয়েকটি আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারকে সমৃদ্ধ করেছিল। তার লিখিত বিপুল সংখ্যক গ্রন্থে সেই জাগরণী বক্তব্যই তিনি বিপুল নৈপুণ্যের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সত্যেনদা তার লেখনীর মাধ্যমে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, সেই একাত্মতার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে তাদের জীবনের দুঃখ-বেদনা, হাসি-কান্নার বাস্তব ছবি তুলে ধরেছেন। ঘরে বসে কল্পনাপ্রসূত কোনো ছবি আঁকতে দেখা যায়নি তাকে।
সত্যেনদার পৈতৃক বাড়ি ছিল সেকালের বিপুল ঐতিহ্যবাহী এবং ইতিহাসখ্যাত বিক্রমপুরÑ যা আগে ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত এবং এখন মূলত মুন্সীগঞ্জ জেলা বলে খ্যাত। তবে বিক্রমপুরের একটা বড় অংশ পদ্মার ভাঙনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেখানে ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ সত্যেনদা জন্মগ্রহণ করেন একটি অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তাঁর পরিবারই ছিল প্রাথমিকভাবে তাঁর সাহিত্যপ্রীতির প্রেরণা। আর রাজনীতিতে নামার প্রথম প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন ১৪ বছর বয়সে ১৯২১ সালে কংগ্রেসের একটি জনসভা থেকে। সেই থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মনোভাব তাঁর মধ্যে সক্রিয়ভাবে দানা বাঁধে।
পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলন এবং কৃষক সমিতিতে যোগদান করেন সত্যেন সেন। বিশের দশকে এসে তৎকালীন গোপন বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৩১ সালে ঘটে তার প্রথম কারাবরণ। তাঁরই প্রেরণায় সত্যেনদার অনুরাগী স্কুলছাত্রী লীলা রায় ও ঐ বিপ্লবী দলে যোগ দেন। এই বিপ্লবী মহিলা সত্যেনদার জীবনে বিশেষ স্থান দখল করেছিলেন। ঐ সময়ে সত্যেন সেন ছিলেন কলেজের ছাত্র। আবার গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালে। এই দফায় একটানা ছয় বছর কারাবাসের পর ১৯৩৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। এই দফায় যে দীর্ঘ সময় তিনি কারাজীবন ভোগ করলেন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন সেখানে আরো বহুসংখ্যক প্রবীণ মার্কসবাদীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং মার্কসীয় তত্ত্ব আত্মস্থ করার কাজে পড়াশুনায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে। মুক্তির পর ফিরে যান গ্রামে। সেখানে কৃষক সমিতি গড়ার কাজে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হন। একই সঙ্গে ঢাকার, নারায়ণগঞ্জের নানা কলকারখানার শ্রমিকদেরকেও ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত করার কাজে উদ্যোগী হন। বেছে নেন কঠোর বাস্তবতার জীবনÑ সকল আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে। ইতোমধ্যেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন এবং পার্টি গঠনের লক্ষ্য নিয়ে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন সংগঠনে অংশ নিয়েছেন। এলো ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষÑ যা পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে ইতিহাসে পরিচিত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখনো চলছিল। ইংরেজ শাসকদের কারসাজিতে ঐ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। ৩০ থেকে ৫০ লাখ বাঙালি নরনারী, শিশু অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন। এই দুর্ভিক্ষবিরোধী সংগ্রাম এবং ত্রাণকাজেও সত্যেনদা নেমে পড়েন। সম্ভবত মানুষের বেদনার এই চরম মুহূর্তে আরো বেশি বেশি করে জাগরণী গান, সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার আকুতি সত্যেনদার মনে গভীরভাবে দানা বেঁধেছিল। তাই তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও নেমে পড়েনÑ গণসংস্কৃতির চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে। অনেক গান এই সময়ে তিনি রচনা করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে থাকেÑ একই সময়ে ভারতবর্ষ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামও নতুন মাত্রা অর্জন করে। আর এই স্বাধীনতার লড়াইকে ছুরি মারার জন্য ঐ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসক, তাদের তাঁবেদার চরম প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের একটি ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক অংশ ষড়যন্ত্র করে ভারতের বহু স্থানে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে। তার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হয় সত্যেনদাকে।
দানা বাঁধলো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। এ দাবি মুসলিম লীগের কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে উগ্র আবহ দাঙ্গা প্রভৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে তার পরিণতিতে বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠী ১৯৪৬-এর নির্বাচনে একবাক্যে মুসলিম লীগকে বিপুলভাবে বিজয়ী করে পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেন। ব্যাপকভাবে দেশত্যাগ করতে শুরু করেন হিন্দুরা। বিক্রমপুর হিন্দুপ্রধান বর্ধিষ্ণু এলাকা ছিল। তাই দেশত্যাগের অভিঘাত বিক্রমপুরকেও আঘাত হানে। শুরু হয় কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযান। ১৯৪৯ এ পুনরায় গ্রেপ্তার হন সত্যেনদাÑ বের হন ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের যথেষ্ট পরে। ভাষা আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ব্যাপক আঘাত হানেÑ দেশত্যাগও অতঃপর কিছুটা কমতে থাকে। কিন্তু সত্যেনদা বেরিয়ে দেখেন তাঁর পরিবারের কেউ কেউ, গ্রামের বহুসংখ্যক হিন্দু অধিবাসী চলে গেছেন দেশ ছেড়ে। ফলে তার বহু কমরেড, বহু কর্মীকে হারিয়ে তিনি গভীর বেদনা অনুভব করেন। অনেকে তাকেও দেশত্যাগের পরামর্শ দিলে তিনি তাতে অসম্মতি জানিয়ে দেশে থেকেই শোষণ মুক্তির আন্দোলনে নানাভাবে আত্মনিয়োগের শপথ নেন নতুন করে।
সত্যেনদা এ সময়ে সাহিত্যকর্মে অনেক বেশি বেশি করে আত্মনিয়োগ করেন। কী বাইরে কী কারাগারে সর্বত্র তিনি অক্লান্ত সাহিত্যকর্মী; শুধু তাই ননÑ তিনি দৈনিক সংবাদের একজন সহকারী সম্পাদকও। সেই সুবাদেও সাহিত্য সৃজন তাঁর দৈনন্দিনই নয় শুধু প্রায় সার্বক্ষণিক কাজে পরিণত হয়। চোখের অবস্থা তাঁর ছিল অত্যন্ত করুণ। কিন্তু সত্যেনদা তাতে থেমে থাকবার লোক ছিলেন না। ফলে দৃষ্টিশক্তির হানিই ঘটেছে প্রতিদিন।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সত্যেনদা তার অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন। সেখানেও কর্মব্যস্ততা ছিল প্রচ-। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরে পুনরায় দেশে ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। এর আগেই ১৯৬৮ সালে সত্যেনদা গড়ে তোলেন তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্নের বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। তার সঙ্গে কৃষক-শ্রমিককে যুক্ত করে বিপ্লবী চেতনায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করে শোষণমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক ও সকল সংকীর্ণতা পশ্চাৎপদতামুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গীকারকে ধারণ করে তাকে অগ্রসর করে নেয়ার লক্ষ্যে গড়ে তুললেন উদীচী। মার্কসীয় সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত তার সঙ্গী হন। সত্যেনদা উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বিস্ময়কর ঘটনাটি হলো অচিরেই দেশের প্রতিটি জেলায় উদীচীর শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটে এবং উদীচী একটি জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনে রূপ ধারণ করে।
আমার এখন মনে পড়ে পাবনায় উদীচীর জন্মের ইতিকথা। বহুদিন থেকেই সংগঠনটি পাবনাতে গড়ে তোলার কথা ভাবছিলাম কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকা-জনিত অত্যধিক ব্যস্ততা এবং বারংবার কারাবরণ করতে হওয়ায় তা যেন কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছিল না। দেশটা স্বাধীন হওয়ার পর ভেবেছিলাম আর যাই হোক, জেলে যাওয়ার ব্যাপারটার ইতি ঘটলো অতঃপর। কিন্তু না। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট আবার সেই পাকিস্তানি রাজনীতির ধারা ফিরিয়ে আনলো সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পরবর্তীতে। তাই স্রেফ একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দেয়ার পরপরই ১৯৭৬ সালে আবার গ্রেপ্তার। ১৯৭৭-এর সেপ্টেম্বরে মুক্তি পেলাম। মুক্তির পর দেখি সঙ্গীতশিল্পী নজরুল ইসলাম বুলবুল পাবনাতে বদলি হয়ে এসেছেন এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিতি অর্জন করেছেন। তার বাড়ি কোথায়, কী চাকরি করেন জানতাম না। পূর্বে পরিচয়ও ছিল না। একদিন কোনো এক অনুষ্ঠানে পরিচয় এবং জানলাম তিনি উদীচী করতেন। বললাম, সুবিধেমতো বাসায় দেখা করবেন। এলেন। কথাবার্তা হলো পাবনার উদীচীর শাখা গড়ে তোলা হবে। সমমনা শিল্পী ও সংগঠকদের ডেকে ঠিকই তা গড়ে তোলা হলো। নজরুলকেই সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। অল্প দিনের মধ্যেই উদীচী পাবনায় রীতিমতো নাম-ডাকওয়ালা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। সালটা ১৯৭৭ বলেই মনে পড়ে। অবশ্য নজরুল থাকতেই সংগঠনটির অভ্যন্তরে একটি বিরোধী গ্রুপের নানা চক্রান্ত শুরু হয় এবং কয়েক বছরের মধ্যেই তার ফলে উদীচী পাবনাতে তার গৌরবও হারিয়ে ফেলে। সেই দুঃখজনক অধ্যায়ের আজো পরিসমাপ্তি ঘটেনি বরং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে পাবনাতে তার প্রায় অবলুপ্তিই ঘটে গেছে। পাবনার মানুষ এখন আর উদীচীর অস্তিত্বের ন্যূনতম সন্মান পায় না। সত্যেনদার কাছে, বিপ্লবী আদর্শের কাছে ক্ষমা চাইতেই হয়Ñ আমরা তাঁর গড়া সংগঠনটিকে পাবনায় সাজাতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু উদীচী অবশ্যই আবার নতুন উদ্যমে একদিন ভালো সংগঠকদের হাতে গড়ে উঠবেÑ এ বিশ্বাস দৃঢ়ভাবেই মনে পোষণ করি।
যাহোক, সম্ভবত উদীচীই সত্যেনদার শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। প্রগতির ধারা আজ বিশ্বব্যাপীই ক্ষীণস্রোতে প্রভাবিতÑ একদিন তাতে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবেÑ পুনরায় সমাজতন্ত্রের জয়গানে বিশ্বের তরুণ সমাজ উদ্বুদ্ধ হবেÑ সত্যেনদারা সেদিন নতুন করে আমাদের চোখে ধরা দেবেন। সেটাই প্রত্যাশা। বিপ্লবী সত্যেন সেনের জন্মশতবার্ষিকী শুরু হলো। দেশব্যাপী বছরজুড়ে তা পালিত হোকÑ বিপ্লবের সুর সর্বত্র ধ্বনিত হোকÑ এই কামনা এই আকাক্সক্ষা রেখে নিবন্ধটির ইতি টানছি। গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি সত্যেনদার অমর আত্মার প্রতিÑ তাঁর সৃষ্টি ও সৃজনশীলতার প্রতি।
রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক, কলাম লেখক।
যঃঃঢ়://িি.িনযড়ৎবৎশধমড়ল৫.হবঃ/হব/িনষড়ম/২০১৪/০৩/২২/১৬৭০৩৭.ঢ়যঢ়

সত্যেন সেন ও ‘মেহনতি মানুষ’
মাসুদুল হক
সত্যেন সেন ১৯০৭ সালে বঙ্গবঙ্গের (১৯০৫) দু’বছর পরে ও মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পরের বছর ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে প্রখ্যাত সেন পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ধরণী মোহন সেন। শান্তিনিকেতনের আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর পিতৃব্য।
সোনারং স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতায় গমন করেন। সেখানে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন, পরে যুগান্তর দলের ব্রিটিশবিরোধী গোপন রাজনৈতিক তৎপরতার সাথে যুক্ত হন। ১৯৩১ সালে বি.এ পরীক্ষার পর তিনি রাজনৈতিক মামলায় বন্দী হয়ে ১৯৩৩ সালে মুক্তি লাভের পর আরেকটি রাজনৈতিক মামলায় কারাবরণ করেন। এসময় বহরমপুর বন্দী শিবিরে একটানা পাঁচ বছর আটক থাকেন। জেলে বসেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। রাজবন্দী থাকাকালেই মার্কসবাদকে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন রূপে গ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে মুক্তিলাভের পর বগুড়া জেলার গ্রামাঞ্চলে অর্ন্তরীণ রাখা হয় তাকে। এসময় তিনি শান্তিনিকেতনে আতœীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করতে গেলে তাঁরা চেষ্টা করেন তাঁকে সেখানে স্থায়ীভাবে রেখে দিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অনুরোধ করে গবেষণা বৃত্তির ব্যবস্থাও হয়েছিল। কিন্তু তিনি সকলের অনুরোধ প্রত্যাখান করে পুরোপুরি মার্কসবাদী কর্মীরুপে আত্মনিয়োগের জন্য নিজ গ্রাম সোনারং এ প্রত্যাগমন করেন। সেখানে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। ক্রমেক্রমে ঢাকা জেলা কৃষক সমিতির নেতৃত্বে চলে আসেন।
১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পর প্রগতি লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। ঢাকায় এই সাহিত্য-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তি ছিলেন কিরণশঙকর সেনগুপ্ত, ……………, সোমেন চন্দ, রণেশ দাশগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ। সত্যেন সেনও এই সংস্কৃতি আন্দোলনে যোগ দেন। এসময় তিনি রচনা করেন প্রচুর গণসঙ্গীত।
১৯৪৯ সালে পূর্ববঙ্গ সরকার তাঁকে দ্বিতীয় বার গ্রেফতার করেন। প্রায় চার বছর কারা নির্যাতনের ভোগের পর ১৯৫৩-তে যুক্ত হন। ১৯৫৪-র ৩০ মে পূর্ব বাংলায় ৯২-ক ধারা জারি হলে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। কিছুকাল পর জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সহকারী সাংবাদিক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫৮ এর ৭অক্টোবর দেশে সামরিক আইন জারি করা হলে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
দীর্ঘ পাঁচ বছর জেল বাসের পর ১৯৬৩ সালে পুনরায় ‘দৈনিক সংবাদ’-এ যোগদান করেন। সত্যেন সেনের জীবনের সঙ্গে মেহনতি মানুষ আর আর জেলের যেন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আচার্য হবার কিছুই নেই ১৯৬৫-র……. থেকে ১৯৬৮ পযর্ন্ত কারাবরণ করেন তিনি। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় যুক্ত হয় সংবাদের সঙ্গে। এর মধ্যে তিনি ১৯৬৯ সালে প্রগতিশীল সংস্কৃতি সংস্থা ‘উদীচী’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা উপন্যাসে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭০ সালে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। তাঁর ‘আল বেরুনী উপন্যাসটি পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় গমন করলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক কাজে আতœনিয়োগ করেন তিনি। ১৯৭৩-এর শেষের দিকে হাপানি রোগে আক্রান্ত হন এবং তার চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যায়। একই বছর ঢাকা ত্যাগ করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে ভগ্নী প্রতিভা সেনের কাছে থাকতে শুরু করেন। চোখের চিকিৎসার জন্য তাঁকে মস্কো পাঠানো হয়েছিল কিন্তু তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান নি। অন্ধ অবস্থায় মুখে মুখে বলে তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন চিরকুমার সত্যেন সেন। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাহিত্যে অগ্রগন্য এই মানুষটি সম্পর্কে তার ভগ্নী প্রতিভা সেনের মূল্যায়ন এরকম :
“সমস্ত জীবন জেলে ও বাইরে বাইরে ঘুরিয়ে কাটাইয়া, শেষ সময়টা আমার কাছে আমিরা থাকিবে, এই আশা আমি কোন দিন করি নাই। ১৯৭৩ সালে মে বাংলাদেশ হতে আমিরাছিল, ১৯৮১ তে চলিয়া গেল। বহুদিন আগে ঘরবাড়ি ছাড়িয়াছিল, পথে ঘাটে গ্রামে গঞ্জে বহু ঘরে ও জেলে কাটাইয়া পরে২৫/৩০টা বছর বাংলাদেশে ও শেষের ৫/৬টা বছর আমার কাছে থাকিয়া গেল।……. বাড়ির মোহ কাটাইয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল। শেষটা সকলের মধ্যে আমিরা থাকিয়া গেল।”(‘ভূমিকা : সত্যেন সেন রচনা সমগ্র’ পঞ্চম খন্ড, প্রতিভা সেন)
সত্যেন সেন ১৯৮১ সালের ৫ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।
প্রধানত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত সত্যেন সেন শেষ পযর্ন্ত তার সাহিত্য-কৃর্তীর জন্য অনন্য হয়ে আছেন আমাদের কাছে। মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম ও গণমানুষের মুক্তির বাণী তার সাহিত্যকর্মে উজ্জলভাবে প্রকাশিত। তিনি যখন সাহিত্য সাধনা শুরু করেন তখন তিনি বয়সে পঞ্চাশ অতিক্রান্ত। লক্ষণীয় তার প্রায় সব গ্রন্থই কারাগারে বসে লেখা। সত্যেন সেন লিখেছেন অজস্্র, প্রধানত উপন্যাস। আর উপন্যাসের সংখ্যা ১৫টি। তার উপন্যাসের বিষয় সমাজ, রাজনীতি , সমকালীন ও অতীত ইতিহাস। বিজ্ঞান সর্ম্পকিত গ্রন্থ, আন্দোলন- সংগ্রামের আলোমালা ও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনায়ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
সত্যেন সেনের উপন্যাস নিয়ে বেশ কিছু গবেষনাও হয়েছে। সমালোচকেরা তার উপন্যাসগুলোকে সামাজিক আর ঐতিহাসিক উপন্যাসে শ্রেণীবিভক্তও করেছেন। সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাত নম্বর ওয়ার্ড, সোয়ানা, পদচিহ্ন, মা, উত্তরণ। ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাপের সন্তান ও আল বেরুনী। এ নিবন্ধে আমরা সত্যেন সেনের আন্দোলন-সংগ্রামের আলেখ্যমালা বিষয়ক একটি গ্রন্থ ‘মেহনতি মানুষ’ নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। সত্যেন সেনের রাজনীতি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্দতা অনুধাবনের জন্যেই পরিসরে তার জীবন পর্যালোচনা করা হল।
সত্যেন সেনের সমস্ত জীবনের মূল অনুধ্যান ও অনুসন্ধানের বিষয় মানুষ। বিশেষ করে শ্রমজীবি-মেহনতি মানুষ। খুব কাছ থেকে মেহনতি মানুষের জীবন দেখেছেন। অনুভব করেছেন তাদের কমিটমেন্ট, আবেগ, বিশ্রাম আর চারিত্রিক দৃঢ়তাকে। খুব প্রখ্যাত নয়, সাধারণ সব মানুষের সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রতি আস্থা; মার্কসবাদের প্রতি অবিচল থেকে এক এক জন শ্রমিক-মানুষ যেভাবে খ্যাতিমান শ্রমিক নেতায় পরিণত হয়েছেন, তা খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন তিনি। তার দেখা সেইসব মানুষদের সুখশ্রী নিয়ে রচিত হয়েছে ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটি।
‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটিমূলত ছিল যুগ রচনার সংকলন। সত্যেন সেন ও বিষু…. চট্রোপাধ্যায় রচিত যথাক্রমে চারটি ও দুটি প্রবন্ধ একত্রিত করে গ্রন্থটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। প্রকাশিত হয়েছিল কালিকলম প্রকাশনী( ৩৪ বাংলাবাজার, ঢাকা-১) থেকে, ১৯৬৯ সালে প্রকাশক ছিলেন জনাব এম.এ আলিম। প্রচ্ছদ একেছিলেন নিতাই কুমার সাহা। ‘ সত্যেন সেন রচনা সমগ্র’ পঞ্চম খন্ডে ….. চট্রোপাধ্যায় রচিত দুটি প্রবন্ধ বাদ দিয়ে চারটি প্রবন্ধ রাখা হয়। প্রবন্ধ চারটি হচ্ছে ঢাকা জেলা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের রক্তবাঙ্গা অধ্যায় বেলগুয়ে শ্রমিক নূর হোসেন, পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের আদিপর্ব ও কবি গানের দল।
‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটিকে মোটাদাগে প্রবন্ধ বলা গেলেও এই গুলো সত্যেন সেনের চিন্তা প্রকাশের ধরণটিকে মুক্ত গদ্যের আদলের আলেখ্যমালা বলাই শ্রেয়।
‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থের প্রথম আখ্যানটিতে ১৯৪৬ সালে ঢাকা জেলার কটনমিলের শ্রমিকেরা তাদের ন্যায় দাবীর প্রতি, সর্ব ভারতীয় শ্রমিক নেতা পি. সি যোশীর প্রতি যে অনুরাগ প্রকাশ করেছেন তা ইতিহাসে অনন্য। পি.সি যোশীর জনসভায় যোগ দেবার জন্য ২১ জন বাছা বাছা নেতৃস্থানীয় কর্মীকে ছাটাই করেছিল মালিক পক্ষ। কিন্তু শ্রমিকেরা সেই অবৈধ ছাটাই মেনে নেয়নি। সে জন্য জীবন দিয়েছিল। সেই বাস্তবতা ইতিহাসকে সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে সত্যেন সেন নিপুনভাবে তুলে এনেছেন এই রচনায় এক নতুন আখ্যানমূলক গল্প সৃষ্টি করেছেন যা সত্যিই বিরল।
হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে প্রভাবশালী মহল শ্রমিকদের মধ্যে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে চাইলেও বাংলার সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবি-মেহনতি শ্রমিকেরা তাকে দেয়নি। বরং হিন্দু-মুসলমানের সর্ম্পকের নানা দিকে একটা ভারসাম্য রাখতে সচেষ্ট ছিল বাংলার জনগন তথা শ্রমিক শ্রেণী। এ প্রসঙ্গটিও রচনায় আখ্যানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। সত্যেন সেনের ভাষায় তা লক্ষ করা যাক : …… আলীর মাথা ফেটে গিয়েছিল। তার আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য তার জীবনীশক্তি। চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বা….. মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করে দিয়ে সে ক্রমে ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল।
আমি তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ….. আলী তার দুহাত দিয়ে আমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, কমরেড কই আমি মরলাম না তো। আমি বললাম, না, না, মরবেন কেন? ডাক্তার বলেছেন আপনার ভয়ের সময় কেটে গিয়েছে। ভয় নাই? সে কি, তবে আমি মরব না? …… আলী আর্ত কন্ঠে বলে উঠল। তার কন্ঠে হতাশার স্বর শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। …… আলী কি বলতে চাইছে? প্রশ্ন করলাম, কেন কমরেড, এমন কথা বলছেন কেন? আপনি কি মরতে চান? …… আলী কোন উত্তর দিল না। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি সত্য সত্যিই মরতে চান? একজন সংগ্রামী শ্রমিকের মুখে এমন কথা কি সাজে?
….. আলী একটু ইতস্তত : করে বলল, কিন্তু কমরেড, এত সমস্ত ঘটনা ঘটল, এত লোক মারা গেল, কিন্তু একটা মুসলমানতো মরল না। এ কেমন হল কমরেড, কমরেড, এ কেমন হল?
আমি (সত্যেন সেন) চমকে উঠে বললাম, বলেন কি, …… আলী এই কথা বলল? হ্যাঁ …… আলী এই কথাই বলল। এই বলেই অনিল মূখার্জী (বিখ্যাত মার্কসবাদী নেতা ও লেখক) চুপ করে গেলেন। আমিও কতক্ষন কোন কথা খুজে পেলাম না। তার পর থেকে …. আলীর কথা আমার মাসে মাসেই মনে পড়ে। তার সেই ব্যাকুল আকুতি আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। এত সমস্ত ঘটনা ঘটল, এত লোক মারা গেল, কিন্তু একটা মুসলমানও মারা গেল না। …… আলী বড় আশা করেনছিল সে নিজে মরে তার এ দুঃখটা ঘুচিয়ে দেবে। কিন্তু দেবের প্রতিকুলতায় সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল না। ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থের দ্বিতীয় আখ্যানমূলক রচনাটির নাম “রেলওয়ে শ্রমিক নূর হোসেন”। নির্ভেজাল মরল প্রাণ একজন শ্রমিক মুখশ্রী তিনি তুলে ধরেছেন এ রচনায় নূর হোসেন আসাম …….. রেলওয়ে ওয়ার্কশপের কাজে অনশন দিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তার মূল কারণ ছিল পাকিস্তানের তথা মুসলমানের সবাই মানুষের মত বেচে থাকার সুযোগ পাবে। …….. নূর হোসেন তার নেতা মহেন্দ্র দত্তের মতের সঙ্গে না থেকে চেরাগ খাঁর মুসলিম এমপ্লয়ি এসোসিশেনে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু ঢাকায় সে নূর হোসেন চৈতন্য ফিরে আসে। এখানে এসে দেখে রেলওয়ে শ্রমিকদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের বাদ-বিবাদ বা বৈষম্যের কোন বিষয় নেই। বরং পাকিস্তান সরকার আর পাকিস্তানের মেহনতি মানুষ পরস্পরের প্রতিদ্বন্ধী দুটো পক্ষ। নূর হোসেনের উপলব্ধি হয় :“ এদেশের মেহনতি মানুষদের এত দিনের আন্দোলনের ফলে হাসিল হয়েছে। তাদেরই ভোঠের জোরে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার সেই সাধারণ মেহনতি মানুষদের অভাব-অভিযোগ মিটাতে বা সুযোগ সুবিধা দিতে চাইছে না, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখছে এবং মেহনতি মানুষদের বাঁচতে হলে মিছিল করে, সভা করে আর ধর্মঘট করে সেই সমস্ত দাবী দাওয়া আর অধিকার ছিনিয়ে আনতে হবে-….. কি সত্যি? নূর হোসেন পাল্টে যায় ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলনে নেমে পড়ে। শ্রমিক লাঞ্ছনার প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে এস নূর হোসেন আরো উপলব্ধি করে এখানে সুকুমার চক্রবর্তী, ডা. মারুফ হোসেন, ব্যারিস্টার লতিফ, ধরনী রায় রফিকুল ইসলাম, সুলতান প্রমুখ নেতাদের মধ্যে কে হিন্দু আর কে মুসলমান, এখানকার শ্রমিকেরা তা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না। তারা শুধু দেখে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আপনজন, কে কত বেশি কর্মঠ আর সংকটের মুখে কে তাদের সবচেয়ে সঠিকভাবে পথনির্দেশ দিতে পারে। নূর হোসেনের উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে সত্যেন সেন মূলত বাংলার মেহনতি মানুষের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের । ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন। শ্রমিক নূর হোসেনের নূর হোসেন হয়ে উঠবার কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে সত্যেন সেন তাঁর দক্ষ ভাষায় শিল্পমান সম্পন্ন সার্থক গল্পই নির্মান করে ফেলেছেন। যেখানে একজন শ্রমজীবি মানুষের ব্যক্তি অস্তিত্ব, সমস্যা-সংকট, ঘটনা প্রবাহ, আবেগ-উচ্ছাস, সবই উঠে এসেছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের শাসনবিধি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলন-সংগ্রাম ও ঘটনা…… কুশলী বিন্যাস যৌক্তিকভাবে চিত্রিত হয়েছে। এই আখ্যানে আমরা ভাষা আন্দোলন আর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও তার প্রতিক্রিয়ার স্বরুপও অনুধাবন করতে পারি। সেই অর্থে নূর হোসেনকে নিয়ে এ ্ক অসাধারণ গল্প। সত্যেন সেনের বর্ননায় এ-রচনায় শেষটুকু এ-রকম :
“সুদীর্ঘ বারো বছর বাদে আবার দেখা নূর হোসেনের সঙ্গে এর মধ্যে তার জীবনে নানা বিপর্যয় এসেছে। কিন্তু তার গতি থেমে যায়নি। যৌবনের উষালগ্নে যেই সংগ্রামী আদর্শ সে এক দিন মন-প্রাণ দিয়ে গ্রহণ করেছিল, তারই আলোই পথ দেখে এগিয়ে চলছে নূর হোসেন। এক গভীর রাত্রির নিস্তব্ধ পরিবেশে তার মুখে তার জীবন কাহিনী শুনেছিলাম। ছেলেটি? ছেলেটি কোথায় আছে? নূর হোসেন উত্তর দিল, ছেলেটা মামাবাড়িতে ওর নানীর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। এখন স্কুলে পড়ে। এর পর কিছুক্ষন নিঃশব্দতার মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। নূর হোসেন এমন গভীরভাবে কি ভাবছে মনে মনে তা অনুমান করবার চেষ্টা করছিলাম। ছেলের প্রসঙ্গে তার কি আবার তার ছেলের মার কথা মনে পড়ে গিয়েছে? আমি কোন কথা বলার আগেই নূর হোসেন বলে উঠল, না দাদা, ও সব ভেবে আর দুঃখ করি না। আমরা যে আদর্শ নিয়ে চলেছি, তাতে এসব দুঃখ নিয়ে মন খারাপ করে বসে থাকলে কি চলে। কিন্তু একটা দুঃখ কিছুতে ভুলতে পারি না। কি এমন দুঃখ? সে কি আমার কাছে বলা চলে?
কেন চলবেনা ? আপনারা ছাড়া একথা কাকে বলব-কেইবা বুঝবে। দুঃখটা কি জানেন দাদা, যাদের কথা মনে করে এত দিন এতকিছু করলাম, তাদের জন্য তো কিছুই করতে পারলাম না। যাই কিছু গড়ে তুলি, সবই যে ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায়। নূর হোসেনকে নানা রকম যুক্তি আর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে উৎসাহিত করে তুলতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু এই দুঃখটা তো একমাত্র নূর হোসেনেরই নয়। ভাঙ্গা হাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত ও অবসন্ন মুহূতে আদর্শবান কর্মীদের অনেকের মনেই সামরিকভাবে হলেও এই দুঃখটা কি জেগে ওঠে না?”
তৃতীয় রচনা ‘পাটকল শ্রমিক আন্দোলনের আদিপর্ব’। এখানেও লেখক সত্যেন সেন শ্রমিক নেতা ….. হোসেনের আন্দোলন-সংগ্রামের ভুবন তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে মুসলিম লীগ সরকারের সেচ্ছাচারী শাসন-ব্যবস্থার চিত্র অংকন করেছেন। তখনকার দিনে রাজবন্দীর উপর অত্যাচার কি ভয়াবহ ছিল, তার রুপ আমরা উপলব্ধি করতে পারি এই আলেখ্য থেকে। মুসলিম লীগ সরকার তার দোর্দন্ড প্রতাপে মহিলা রাজবন্দীদের উপর নির্মম অত্যাচার করলে, সেই অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রচা অভিযানের উদ্যোগক্তাদের মধ্যে এল হোসেন অন্যতম ভূমিকা পালন করে। এজন্য তিনি জেলেও যান। জেল থেকে বেরিয়ে এলে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তাঁকে তার নিজ জেলার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে। সেই সঙ্গে হুশিয়ারি দেয়, ভাল মানুষের মত চুপচাপ শান্তিতে না থাকলে ভবিষ্যতে তাঁর অদৃষ্টে এর চেয়েও বেশি দুঃখ আছে। কিন্তু দুঃসাহসী এল হোসেন । আবার ফিরে আসে ঢাকায়। গ্রহণ করে শ্রমিকের জীবন। এবার আদমজী জুট মিলের মেকানিকের কাজ। তার পর শুরু করে জীবন যাপনে নানা অসুবিধা নিয়ে আন্দোলন। যেমন থাকা, খাওয়া, শৌচাগার আর স্লান ব্যবস্থার উন্নয়ন। শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে তিনি আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ইউনিয়ন গড়ে তুলেন এল হোসেন। এল হোসেন শ্রমিকদের মধ্যে এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন যে তার একক সিদ্ধান্তে হরতাল পালিত হয়। কিন্তু এল হোসেন তার চরিত্র নিয়ন্ত্রিত হয়েছে মার্কসবাদী আদর্শে। সেচ্ছাচারিতাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। সে সত্যিই সত্যেন সেন তুলে ধরেছেন এই রচনায়, তার অসাধারণ গল্প বলার ভঙ্গিতে। গ্রন্থের শেষ রচনা ‘কবি গানের দল’ । এই রচনা থেকে আমরা সত্যেন সেনের প্রতিভার আরেকটি দিকের সন্ধান পাই। সুকন্ঠ গায়কের পাশাপাশি তিনি ঢাকেশ্বরী মিলের কবিদলের দলনেতা দিলেন। এই কবিদল সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়। শ্রমিকদের মধ্যে প্রচারনা চালানোর কাজে এই কবিদল বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। কবিদলের অভিজ্ঞতা বর্ননা করতে গিয়ে সত্যেন সেন তার সহজ সরল যুবক……….. কবির সরকার হবার ঘটনা তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে পাচালী আর ধর্মীয় পুঁথিপড়া জানকী কীভাবে ইউনিয়নের একজন উৎসাহী কর্মীতে পরিণত হলেন, সেই স্মৃতি বর্ননা করেছেন তার অভিজ্ঞতা ভিত্তিক এই আখ্যানমূলক রচনায়। এই রচনার শেষ অংশ লক্ষ্য করা যাক :
“পরাজয়ের ঘাটা শুকিয়ে যাবার আবার নতুন আহবান এসেছে। বেরিয়ে পড়েছে সংগ্রামী ভাইরা। আমাদের কবি গানের দলের সিরাজ মিয়া এই সঙ্গে আসে নি। এসেছে সেই চারজন দোহার। আর কে জানেন ? আর এসেছে জানকী। এদের মুখে শুনলাম, এরই মধ্যে সে ইউনিয়নের একজন উৎসাহী কর্মী হয়ে দাড়িয়েছে। তার পুরানো দিনের পাচালী আর ধর্মীয় পুথিপত্র তাকে তুলে রেখে সে এখন রাজনৈতিক পুস্তিকা পড়ায় মন দিয়েছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। একেবারেই বদলে গেছে মানুষটা। এই কবি গানের মধ্যে দিয়ে নব জীবন লাভ করেছে জানকী”।
সত্যেন সেন তার অভিজ্ঞতা লব্ধ মেহনতি মানষের জীবন-সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আদর্শ-উদ্দেশ্য আরন বিশ্রামকে এক স্বতন্ত্র শিল্প-কৌশলে প্রকাশ করেছেন ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থে। ভারতীয় প্রাচীন শিল্প শাস্ত্রে শিল্পকে অভেদান্তক বলা হয়েছে। অর্থাৎ নাটক, কবিতা, গল্প কি প্রবন্ধ- এদের প্রকরণগত দিক থেকে আলাদা করা যায় না। তাই যেকোন শিল্পীকে মর্যাদা দিয়ে বলা হয়েছে কবি-কোবিদ। এক্ষেত্রে সত্যেন সেনও কবি-কোবিদ। ‘মেহনতি মানুষ’ গ্রন্থটিকে আপাত প্রবন্ধ গ্রন্থ বলা গেলেও আমার বিবেচনায় এ এক অসাধারণ আখ্যানমূলক গ্রন্থ। যে গ্রন্থে সাধারণ মানুষের গল্প অসাধারণ ভঙ্গিমায় উঠে এসেছে।

সত্যেন সেনের বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা
আবদুল্লাহ আল-মুতী
সত্যেন সেন বিজ্ঞান-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছোটদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে দু’খানি বই লিখেছেন; দু’টিই প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। ‘আমাদের এই পৃথিবী প্রকাশিত হয় ১৩৭৫ সালে (ইংরেজী ১৯৬৮ সালে) আর ‘এটমের কথা’ ১৩৭৬ সালে (ইংরেজী ১৯৭০)। এর কিছু আগেই অবশ্য তাঁর ছোটদের জন্যে লেখা আরো একটি বই প্রকাশিত হয়েছে; সেটির নাম ‘পাতাবাহার’ সালে (১৩৭৪) এটি একটি গল্প সংকলন। সত্যেন সেনের অজস্্র রচনা সম্ভারের মধ্যে এই তিনটি বইকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলেই গণ্য করতে হয়।
বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ না হয়ে রবীন্দ্রনাথও জীবনের শেষ প্রান্তে বিজ্ঞান বিষয়ে গ্রন্থ রচনায় হাত দিয়েছিলেন। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান যে সমাজ ও মানুষের সাংস্কৃতক জীবনের অতি আবশ্যকীয় অঙ্গ অথচ সাহিত্যে তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এ সত্যি উপলব্ধি করেই তিনি ‘বিশ্ব পরিচয়’ রচনার দুঃসাহসিক কাজ হাতে নিয়েছিলেন। তিনি এ বইয়ের ভূমিকায় বলেছিলেন: আমার দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে যদি কোন মনীষী যিনি একাধারে সাহিত্য-রসিক ও বিজ্ঞানী, এই অত্যাবশ্যক কর্তব্য কর্মে নামেন, তাহলে আমার এ চেষ্টা চরিতার্থ হবে।’
সত্যেন সেনও স্পষ্টতঃই এই একই সামাজিক দায়িত্বকোধ থেকে বই দু’খানি লেখেন। তবে সামান্য একটু তফাত এই যে তার অধিকাংশ রাচনার মত সম্ভবতঃ এ বই দু’টিও কারাবাস কালে লেখা এবং এ কারনে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী সহকর্মীর পরামর্শ গ্রহনের সুযোগ তাঁর পক্ষে সুলভ হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই তুলনা অবশ্যই সত্যেন সেনের বই দু’টিকে বাগুল্য মূল্য দানের উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাঁর প্রচেষ্টার যথাযথ সূল্যায়নের জন্যেই এই পটভ’মির বিষয়টির উল্লেখ।
‘আমাদের এই প্রথিবী’ বইটিতে প্রথিবীর জন্মকথা, মাটির প্রথিবী, মধ্যাকর্ষণ, সমুদ্র প্রভৃতি পৃথিবী ও তার পরিবেশ সম্পের্কে নানা বিষয় থেকে শুরু করে আবহমন্ডল, আয়নমন্ডল, সৌরশক্তি প্রভৃতি নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। নানা প্রসঙ্গ পরস্পরের সঙ্গে সংবদ্ধ; অথচ প্রতিটি অধ্যায়ই স্বয়ংসম্পূর্ন। ভাষা অতি প্রাঞ্জর; কিন্তু ভাষার সৌকর্যের তাগিদে তথ্যের কোন কমতি ঘটানো হয়নি। প্রকৃত পক্ষে মাত্র ১১৫ পৃষ্ঠার বইতে যে পরিমাণ তথ্য যতখানি মুনশিয়ানার সাথে পরিবেশন করা হয়েছে তার তুলনা পাওয়া দুরূহ। আগামী দিনে যখন পৃথিবীর সঞ্চিত খনি সম্পদ শেষ হয়ে যাবে তখন অতি সূক্ষ শ্যাওলা জাতীয় উদ্ভিদ বা কৃত্রিম ক্লোরফিলের সাহায্যে সূর্যশক্তিকে আরো দক্খতার সাঙ্গে ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে সব গবেষণা চালাচ্ছেন তার আলোচনা দিয়ে বইটি শেষ হয়েছে।
‘এটমের কথা’ মোটামুটি একই আকারের(১১২ পৃষ্ঠা) পরমানু বিঝ্হান সম্পর্কে একটি স্বয়ংসম্পূর্ন বই। অতি অল্প পরিসরে এটমের পরিচয়, পদার্থের গঠন-বৈচিত্র্য থেকে শুরু করে তেজষ্ক্রিয়তা, আইসোটোপ, বস্তুু ও শক্তি, পরমানু বিভাজন, পারমাণবিক শক্তি, এটম বোমা, সংযোজন ক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তি প্রভৃতি প্রায় সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। সর্বশেষ অধ্যায়ে শক্তি প্রভৃতি প্রায় সকল প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছে। সর্বশেষ অধ্যায়ে পরিশিষ্ট আকারে এটম ভাঙ্গা, পিরিয়ডিক টেবল এবং নিউট্রিনো, মেসন প্রভৃতি অতিমৌল কণার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। খুব সম্ভব লেখক এই বিষয়গুলো বইটি প্রকাশের শেষ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ অনুভব করেন কিন্তুু তখন এগুলো ভেতরে যথাস্থানে স্থাপন করা সম্ভব ছিল না; সেটা এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময়ও সম্ভব হতে পারে।
জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই-এর ভাষা সম্পর্কিত সমস্যাটি চিরকালের। তবে বলতেই হবে সত্যেন সেনের জন্য এই বইয়ে ব্যবহৃত সহজ, সরল অথচ রসাল ভাষা সম্ভবতঃ স্বভাবজ। ‘পাতাবাহার’ বইয়ের গল্পগুলোতে তাঁর শিশু কিশোরদের উপযোগী আশ্চর্য মিষ্টি ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় শিশু মনস্তত্ত¦ সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধির। রূপকথার ধাঁচে লেখা এই গল্পগুলোতে ফ্যান্টাসি আর বাস্তবর ঘটেছে আশ্চর্য মেশামেশি-ঠিক যেমন ঘটে শিশুদের মনে। এদেশের গ্রাম-বাংলার চিরকালের শিশু কিশোরদের চেনা জানা কাঠুরে, হারণ ছানা, ভালুক, শুকপাখি, শেয়াল এমনি সব চরিত্রগুলোর সাথে যোগ হয়েছে আজকের দিনের নানা সমস্যার কাথা। আর সে ভাষা আর সে রচনাভঙ্গি বাংলা শিশু সাহিত্যের সেরা দিকপাল দিপেন্দ্রকিশোর, দক্ষিণারঞ্জন, সুকুমার রায় এঁদের ভাষার সাথে অনায়াসে তুলনীয়। আমাদের দেশে আধুনিক কালে বিজ্ঞান চর্চার ঐতিহ্য তেমন সবল নয়। সাধারণ মানুষের জীবনে আধুনিক জীবন ধারার আরো সকল উপকরণের মতই বিজ্ঞানের অধিষ্ঠানও নিতান্ত ক্ষীণ। সৌভাগ্যের কথা বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক আর সংস্কৃতিসেবীরা এ বিষয়ে সচেতন হয়ে বার বার এই সমস্যার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। বস্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথের মত দিকপাল সাহিত্যিকরা যেমন করেছেন, তেমনি করেছেন উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার রায় প্রমুখ শিশু কিশোরদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা লিখে।
সত্যেন সেন যে সময়ে আমাদের এই পৃথিবী’ বা ‘এটমের কথা’ লেখেন সে সময়ে এ দেশে এ জাতীয় বিষয় নিয়ে বই আর বেরোয় নি বললেই চলে। এদিক থেকে তাকে তাঁর অন্যান্য বহুমুখী কর্মধারার সাথে এদিকেও একজন পথিকৃৎ বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথের ‘বিশ্বপরিচয়’ বই এর ভূমিকায় অনিষ্ট বিজ্ঞান বিষয়ে জনপ্রিয় রচনার সেই কর্মোদ্যোগ আজ অর্ধ শতাব্দী পরেও যে অতি ক্ষীণ ধারায় প্রবাহিত সেটা আমাদের জন্য মোটেই তেমন সুখ বা গৌরবের বিষয় নয়।

সত্যেন সেন
কল্যান চন্দ্র
সত্যেন সেন একজন নির্যাতিত রাজনৈতিক কর্মী। তিনি বাংলা সাহিত্যে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক। শুধুমাত্র এই পরিচয়ে সমাজে, দেশে একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃত লাভে সক্ষম। তাঁর বিচিত্র জীবন, জীবনবোধ এবং সাহিত্যে বহুমাত্রিক অনায়াসে বিচরন। তাঁর একটা পূণাঙ্গ জীবনী রচিত হওয়া একান্ত আবশ্যক। বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম তা থেকে শিক্ষা ও অনপ্রেরণা লাভ করতে পারে।
সাম্যবাদের কবল থেকে স্বদেশ মুক্তির স্বপ্নের জন্য, মানুষকে ভালেঅবেসে তাঁদের সংগ্রামের যুক্ত হয়ে একজন সৈনিকের ভূমিকায়, তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে।
বিপ্লবী যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ১৯৩১ সালে তিনি তিনমাস জেল খাটেন। ১৯৩৩ সালের শেষ বা’ ৩৪ এর প্রথম ভাগে তিনি গ্রেফতার হন। পাঁচ বছর কারাবাস হয়।
এইবার জেলে যাওয়ার আগে তিনি বি.এ পরীক্ষা দিয়ে যান। জেলে এম-এ পাশ করেন। সামার অল্পকাল পূর্বে তিনি ছাড়া পান এই শর্তে যে, তিনি তাঁর কাকা ক্ষিতিমোহন সেনের সহায়তায় ভাষাতত্ত্ব নিয়ে গবেষনা করবে। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কিন্তু তা না করে সোজা বিক্রমপুরে চলে যান। উদ্দেশ্য কৃষকদের সংগঠন গড়ে তুলবেন। জেলে তিনি গভীর অধ্যায়ন করেন। কমিউনিজম এর পপ্রতি তাঁর বিশ্বাস জন্মে। তাই তিনি মুক্ত হয়ে কৃষক ফ্রন্টে কাজ আরম্ভ করেন। ঐসময়ের কথা আলোচনা করতে গিয়ে জ্ঞানচক্রবর্তী লিখেছেন(ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট আন্দোলনের অতীত যুগ) “১৯৩৭-১৯৩৭ আন্দামান ও বিভিন্ন জেল থেকে বহু সংখ্যক অভিজ্ঞ নেতৃস্থানীয় বন্দী মুক্তি লাভ করিয়া ঢাকায় আসেন এবং পার্টিতে যোগ দেন। জেল খানা হইতে ইহারা কমিউনিজমের আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে ……জীবন চ্যাটার্জী ্রপের সত্যেন সেন প্রবোধ, সুশীল ঘোষ… পৃষ্ঠা-১৯। অন্যাত্র ঐ (পৃষ্ঠা-৬২ খাদ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়) তিন টাকার চাল চৌদ্দ হয়ে যায়, পরে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হয়। এসময় কমরেড সত্যেন সেন এ সমস্যার উপর একটা গান রচনা শুরু করেন। যাহা জিলার সর্বত্র যাওয়া হয় এবং অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। গানটির দুই পঙক্তি নি¤œরুপ :
“চাউলের মণ চৌদ্দ টাকা কেরোসিন তেল নাইরে
কেরোসিন তেল নাই, হায় কি করি উপায় রে,কি করি উপায়”।
বেঝা যায় এ গানটি ১৯৫৩ এর দুর্ভিক্ষের আগের।
এপ্রিল ৪১’ এ ঢাকায় ডাঙ্গা হয়। আমরা দক্ষিন মৈশন্ডীর ৪৭ নং লাল মোহন সাহা স্ট্রীট বাসা পরিবর্তনে বাধ্য হই। চলে আসি ঠাটারী বাজারের বামাচরণ চক্রবর্তী রোডে (মনে হয় ১৩ নম্বর হবে)। ২০০৩ সালে আমি ড. আমিনুর রহমান সুলতানের সঙ্গে গিয়ে ঐ দোতলা বাড়িটি ( সামনে সামান্য সংযোজন ভিন্ন) একই রকম দেখেছি।
ঐ বাসায় ৪১ এর শেষের দিকে সত্যেন সেনকে দাদার কাছে আসতে দেখেছি। ৪২ এ ও দাদার মৃত্যুর আগে হয়ত এসে থাকবেন। কিন্তু তখন আমরা ছোটরা, মা-বাবার সাথে দেশের বাড়ি বাড়িয়ায় ছিলাম। ঢাকায় দাদা, বীনা মাসী মা ও বড়বোন রুবি ছিলেন। দাদা তখন প্রগতি লেখক সংঘের প্রধান সংগঠক, উদীয়মান লেখক এবং গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক।
মনে আছে সত্যেন সেনকে। অতি সাধারণ পোশাক, ধূতি হাটুর সামান্য নীচে (যতদূর মনে পড়ে খালি পা)। পরে বড়দের মধ্যে আলোচনায় তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধষেু ভাব লক্ষ করেছি। দাদা ও মংক্ষের সঙ্গে সত্যেন সেনের এই যোগাযোগ ওনাকে লেখক হতে অনেকখানি প্রভাবিত করেছে, এটা বলা যেতে পারে।
৮ই মার্চ ১৯৪২ সালে দাদার হত্যার পর, সত্যেন সেন লেখক সংগে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সন্ত্রাসবাদী লেখক সাম্যবাদী সত্যেন নে কৃষক সংগঠনের পাশাপাশি লেখক সংগের অন্যতম সংগঠক। এই ভূমিকা সাহিত্য ক্ষেত্রে তাঁর বলিষ্ঠ আবির্ভাবের অনুঘটকের কাজ করেছি। লেখক সংঘ সংগঠনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে কয়েকটা তথ্যের উল্লেখ করেছি।
সংঘের অন্যতম প্রধান, কবি কিরণ শংকর সেনগুপ্ত পরিচয় পনে সংঘের মুখপত্র “প্রতিরোধ” সম্পর্কে লিখেছেন…….“এই সময় সত্যেন সেন, অজিত কুমার গুহ, সরলান্দ সেন, অসিত সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সানাউল হক, সৈয়দ নূরউদ্দিন, রণেশ মজুমদার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ‘প্রতিরোধ’ প্রকাশনার ব্যাপারে নানা দায়িত্ব এই পত্রিকার অন্তত কয়েকটি বছর অব্যাহত রাখতে সাহায্য করেছিলেন।
কবি কিরণ শংকর “প্রতিরোধ” প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম নামটি লিখেছেন সত্যেন সেনের। তথ্যের দিক থেকে এটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
রণেশ দাশগুপ্ত (উদীচী প্রকাশিত গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ভূমিকায়) লিখেছেন। ৩৮ সালেই ঢাকা শহরে যে প্রগতি সাহিত্যের আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে ওঠে এবং চল্লিশের দশকে সোমেন চন্দের রেখে যাওয়া সাধনাকে ভিত্তি করে এবং যে প্রসার ঘটে, সত্যেন সেন তার সঙ্গে নিজেকে ঘনিষ্ট ভাবে যুক্ত করেন।
এই সময়ে প্রগতি সাহিত্যের বৈঠকে দু,একটি ছোট গল্প পড়েছিলেন। কিন্তু লেখক সংঘ, প্রগতি লেখক ও শিল্পী-সংঘ নাম নিয়ে সাহিত্য ও সঙ্গীতকে একত্র করার পর্যায়ে তিনি এতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।
সেদিন প্রায় প্রত্যেক লেখা পাঠ করা হত সংঘের সভায় আলোচিত হত। প্রধান আলোচক-সমালোচক ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত ও অচুৎও গোস্মামী। এই প্রক্রিয়ার ফলে অনেকে সাহিত্যের অঙ্গণে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন সঙ্গীতে তখন অনেক প্রতিষ্ঠা করতে পেলেও সত্যেন সেনের দু’একটি গল্প পড়াকে কথাসাহিত্যে তার প্রবশকাল বলে গণ্য করা যায়।
এই সময় সংঘে যুক্ত হয়েছিলেন আর একজন প্রতিভাবান শিল্পী সাধন দাশগুপ্ত। তিনি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তিনি নাট্য দল গঠন করে নাটক পরিচালনা করতেন। বলার অপেক্ষ রাখে না সুঅভিনেতা ও ছিলেন। সত্যেন সেন ও সাধন দাশগুপ্তের কর্মকা-ের সাথে ঢাকা জেলার সাম্যবাদী সংস্কৃতির অনেক প্রসার ঘটেছিল। পার্টির প্রভাব বৃদ্ধিতে সাধু ভূমিকা ছিল।
সরদার ফজলুল করিম ঐ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, “……..১৯৪০ এর দশকে তখন তিনি একজন কমিউনিস্ট কর্মী এবং সাহিত্য সংগঠক ছিলেন। ঢাকা জিলা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের তিনি অন্যতম সংগঠক ছিলেন। এ সংগঠনের নিয়মিত সভা আহবান, এর মুখপত্র প্রকাশ কিংবা প্রগতি লেখকদের সম্মেলনের আয়োজন এবং এর কোন সংকলন প্রকাশ প্রচেষ্টার একজন কর্মী ছিলেন সত্যেন সেন”।
উপরের তিনজন শ্রদ্ধাভাজনদের বক্তব্য এটাি পরিস্কার, কৃষক সংগঠনে নিবেদিত সত্যেন সেন, সোমেন চন্দের হত্যার পর (৮ই মার্চ ১৯৪২) সংঘে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কমিউনিজমে বিশ্বাসী সত্যেন সেন কৃষকদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেন, সঙ্গীত এক্ষেত্রে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। শান্তিনিকেতনের সাথে তাঁর গভীর যোগাযোগের ফলে, সঙ্গীতের নানান শাখা নিয়ে তাঁর সাম্যক ওদাত্ব ছিল।
পূর্ব বাংলার লোকসঙ্গীত যথেষ্ট সমৃদ্ধশালী ছিল। কবি গানও। নজরুল ইসলামের দেশাত্ববোধক গান চারণ কবি মুকুন্দ দাশ যাত্রা এ গান গেয়ে স্বদেশ মুক্তির সংগ্রাম যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন।
সত্যেন সেন গানের স্কোয়াড পরিচালনা ছাড়াও নির্বাচনের সময় কবি গানের দলও গড়েছিলেন। এই সব প্রচেষ্টার শেষে স্থায়ীভাবে একটি গণসংগঠনের প্রয়োজন বোধ করেন। অই কয়েকজন মাত্র সহশিল্পীদের নিয়ে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর “উদীচী” প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সংগঠন আজ বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হিং¯্র আক্রমন সত্ত্বেও দৃঢ়তার সঙ্গে এই সঙ্গের শিল্পীরা সক্রিয় রয়েছেন। এই সংগঠনের অন্যতম প্রধান গোলাম মোহাম্মদ ইদু তথ্য অনুযায়ী, আজ “উদীচীর” সভা সংখ্যা ৮ হাজার। শাখা ২১০টি। তাঁর মধ্যে বিদেশেও ৫টি শাখা রয়েছে।
উদীচীকে আমার অনুরোধ, সত্যেন সেন রচিত সূরারেপ্তিত গানগুলি সংগ্রহ করে পুস্তক প্রকাশনার ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করা হোক। তাঁর সময়কার শিল্পীদের অনেকে এখনও নিশ্চয় রয়েছেন। পরে হয়ত অনেক গান হারিয়ে যাবে। সাহিত্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোয্য। আমার দাদার ক্ষেত্রে দেখেছি মৃত্যুর সত্তর বছর পরেও তাঁর অগ্রন্থিত গল্প পাওয়া গেছে।
গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ভূমিকায় রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন……..সব মিলিয়ে ১৯৪৯ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে তিনি তের বছর জেল কেটেছেন। ব্রিটিশ আমলে তিনি ৫ বছরের মত জেল কারাবাস কাটিয়েছেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সত্যেন সেন ১৮ বছরের উপর জেল খেটেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন অন্তরীণ ও আত্বগোপনের সময়ও।
যদিও কারাবাসকালে বন্দীদের অনশন ধর্মঘটে তাঁর অংশগ্রহনের কোন তথ্য জানা যায় না। তবু তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যদের মত তিনিও নিশ্চয় তাঁর অংশীদার ছিলেন।
এ ক্ষেত্রে রণেশ দাশগুপ্তের কথাই ধরা যাক।
১৯৪৯ সালে ১১ই মার্চ থেকে ৫ দিন
ঐ সালে দ্বিতীয়বার ৪০ দিন
তৃতীয়বারে-কদিন জানা নেই।
চতুর্থবারে অনশন ছিল অনির্দিষ্ট কালের।
এই সময় আমাদের উপমহাদেশে কোন লেখক, অনুরুপ নির্যাতন ভোগ করেছেন বলে আমার জানা নেই। হয়তবা সারা বিশ্বেও দূর্লভ।
১৯৬৭ সালের আগেই তিনি হাঁপানিতে আক্রান্ত হন। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হতে আরম্ভ করে। ১৯৭১ সালে তিনি রাশিয়ায় যান। তারা সত্যেন সেনকে কোন আশার কথা শোনাতে পারেনি। ক্রমে তিনি অন্ধ হয়ে যান।
পাকিস্তানী আক্রমন কালে, ‘৭১ সালের ২ শে মার্চের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের চলে আসতে বাধ্য হন। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে দুরে তাদের উৎসাহিত করেন। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বইও লেখেন।
বাংলাদেশ মুক্ত হলে তিনি ঢাকায় যান। রণেশদাও। ‘৭৩ এ তাঁর শরীর আরো খারাপ হয়। তিনি শান্তিনিকেতনের দিদি প্রতিভা সেনের কাছে চলে আসেন। রণেশদাও‘৭৫অক্টোবরে বিমানের রির্টান টিকিট কেটে কলকাতা চলে আসেন। আর ফিরে যাননি। কেবলমাত্র মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আমি যতদুর বুঝেছি, বাংলাদেশের সকলের বরেণ্যএই দুইজন, যারা আমৃত্যু নিজেদের বাংলাদেশী বলে গর্ববোধ করতেন তাঁরা যে আর দেশে ফিরে যেতে চাননি, তাঁর নিশ্চয় কোন না কোন কারণ রয়েছে।
সত্যেন সেনের সত্যেন নেসের জন্ম ২৮শে মার্চ ১৯০৭ সাল। মৃত্যু ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৮১ সাল : অর্থাৎ জীবনকাল ৭৩ বছর ৯ মাস ৭ দিন।
তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতায়, তথ্যকেন্দ্রের দোতলায় এক সমরণ মজা হয়েছিল। রণেশদার সাথে গিয়েছিলাম। অল্প সংখ্যক উপস্থিতি, খুব খারাপ লেগেছিল। তাঁরমত একজন সর্বত্যাগী সুপ্রতিষ্ঠিত লেখকের প্রতি এবঙ্গের অবজ্ঞায় বেদনাহত হয়েছিলাম।
দাদার ক্ষেত্রেই দেখেছি, ঢাকার লেখক হওয়ায়, কিরণশংকর সেনগুপ্ত ও রণেশ দাশগুপ্ত প্রভৃতির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিনি পশ্চিমবঙ্গেই যোগ্য স্বীকৃতি পাননি।
এই উপেক্ষা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে এদের সাহিত্যও বেঁেচ থাকবে। আত্বত্যাগ ও অনুপ্রেরনা জোগাবে।

কল্যাণচন্দ
কোলকাতা
১৯/০৩/২০১৪

মানবমুক্তির এক নিবেদিত প্রাণপুরুষ সত্যেন সেন
প্রফেসর মাহফুজা খানম
প্রথমেই সত্যেন সেনের উদ্দেশ্যে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমার বাল্য স্মৃতিতে ১৯৫৩-১৯৫৪ সালের কথা বলতে গেলে মনে পড়ে আমাদের ৩৬নং স্বামীবাগে একজন আমার আব্বার মতোই দেখতে গড়নে হালকা-পাতলা একহারা গড়ন, পায়জামা, শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল, মোটা চশমা পরে আসতেন আমাদের বাড়িতে, যাঁকে আমরা সত্য কাকা বলে ডাকতাম।
সত্য কাকা আমাদের বাড়িতে এলেই আব্বা বলতেন ‘কি সত্য বাণী শুনাইতে আসিলা’? উত্তরে সত্য কাকা বলতেন ‘চিরকাল মহাসত্য প্রকাশিয়া যাইব’। এমন পরিবেশে আব্বা-সত্য কাকার গল্প আলোচনা চলত। আমরা ভাইবোনেরা মুড়ি-মাখাসহ অন্যান্য নাস্তা নিয়ে যেতাম। সত্য কাকার সঙ্গে আমরাও খেতাম। নানা গল্প বলতেন- এখনও মনে আছে সত্যকাকা নানা ইতিহাস, রাজনৈতিক গল্প, মজার মজার গল্প, বিপ্লবীদের গল্প, দেশে দেশে বিপ্লবের ইতিহাসের গল্প বলতেন। পৃথিবীকে আরেক আঙ্গিক থেকে দেখবার শুরু আমার সেই থেকেই। আব্বার সঙ্গে কাকুর বয়সের পার্থক্য কমই ছিল। আব্বার জন্ম ১৯১০ এর ১০ জুলাই সত্যকাকু ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ। তাদের দু’জনের বন্ধুত্ব কবে কখন কোথা থেকে জানি না। সম্ভবত কলকাতা থেকে। আব্বা ও সত্যকাকু দু’জনেই যুগান্তরের (বিপ্লবী দল) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এটি আমি জানি।
উনিশ শতক! সারা বিশ্বে ভাঙ্গাগড়ার নতুন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন, বিশ্বে মার্কস এঙ্গেলসের নতুন রাজনৈতিক দর্শনের উন্মেষ ও চর্চা, ইউরোপের রেনেসাঁ। এর প্রভাবে সত্যকাকা তাঁর জীবন চেতনাকে প্রভাবিত করেছিল। সমগ্র বিশ্বের মানবমুক্তি, ধনতান্ত্রিক বিশ্বের বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে দেখবার স্বপ্ন তাঁকে এক নতুন পথের যাত্রী হিসেবে জীবন পরিচালনায় ব্রতী করেছিল।
সত্যকাকা জন্মেছিলেন বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ি থানার সোনারঙ গ্রামে, শান্তি কুটীর নামের বাড়িতে। তিনি ছিলেন মা-বাবার চতুর্থ সন্তান। তাঁর পুরো নাম সত্যেন্দ্রমোহন সেন, ডাকনাম লস্কর। তাঁর বাবা ধরণীমোহন সেন। পরিবারের ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্য। স্বনামধন্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন সত্যকাকুর কাকা। শিশু সাহিত্যিক মনোমোহন সেন, মুরারীমোহন সেন সত্যকাকুর বড় ঠাকুরদা; প্যারিমোহন সেনের প্রথম ও পঞ্চম পুত্র। সত্যকাকুর বাবা ধরণীমোহন সেনের নামেই সোনারঙ গ্রামের স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধরণীমোহন সেন। সত্য কাকার বাবার নিজের ছিল প্রতœতত্ত্ব চর্চার অভ্যাস আর এ বিষয়ে তাঁর লেখা তৎকালীন উল্লেখযোগ্য পত্রিকা প্রবাসীতে ছাপা হয়েছিল। এ কথাগুলো থেকে বোঝা যায় কাকুর পরিবার যথার্থই শিক্ষা সংস্কৃতিতে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবার। নিজ গ্রামে অর্থাৎ সোনারঙ স্কুলেই, কাকুর লেখাপড়ার হাতেখড়ি।
তাঁর বাল্যকালের বন্ধু ছিল কাকুর বড় ভাই জিতেন সেন (শঙ্কর)। আরও একজন, বাউ ওরফে মাহাঙ্গু বানিয়া কাকুর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। বাউ সত্যকাকুর ঠাকুর মার পালিত পুত্র। কে এই মাহাঙ্গু? দুর্ভিক্ষের সময় ১০/১১ বছরের এক বালক এলাহাবাদ থেকে হেঁটে কাশিতে আসেন। তাঁর বাবা-মা নেই, কেবল তার বাবার নাম রামতুন বানিয়া বলতে পেরেছিল। সত্যকাকুর জ্যাঠামশাই মাহাঙ্গু বানিয়াকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। সেই থেকে মাহাঙ্গু এই পরিবারের একজন হয়ে গেল। সত্যকাকুর সব ভাই-বোন মাহাঙ্গুর কোলেপিঠে চড়েই বড় হয়েছে। মাহাঙ্গুর প্রভাব তাঁর জীবনে অনেক অবদান রেখেছে।
কাকুর প্রথম রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় ১৯২১ সালের টঙ্গিবাড়ির এক জনসভায় গিয়ে, তখন কাকু অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, সঙ্গে ছিল মাহাঙ্গু। এই জনসভা শেষে কাকু মাহাঙ্গুকে কথা দিয়েছিল বড় হয়ে কাকু দেশের জন্য কাজ করবেন। কাকু এর পরদিনই যে নেতার বক্তৃতা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁর সঙ্গে দেখা করেন কংগ্রেস পার্টির অফিস টঙ্গিবাড়িতে। কাকুর বয়স বিবেচনা করে সেই নেতা তাঁকে পার্টি কর্মীদের খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে মুষ্টি ভিক্ষা করে চাল সংগ্রহের দায়িত্ব দিলেন, এটিই ছিল কাকুর জীবনের প্রথম রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন।
এই সময় চৌরিচরার ঘটনার পর গণআন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হল। যারা স্কুল/কলেজকে ‘গোলামখানা’ বলে শিক্ষায়তন ত্যাগ করেছিলেন তাঁরা এক গভীর সঙ্কটে পড়লেন। এমন রাজনৈতিক দুর্যোগের সময় ঘটে যাচ্ছিল অনেক অবিশ্বাস্য রাজনৈতিক ঘটনা- এর মধ্যে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের যুদ্ধ, মেদিনীপুরের তিন ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা ইত্যাদি। ব্রিটিশ রাজ খতম করার আকাক্সক্ষার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে যুবসমাজে। কাকুও এর বাইরে থাকতে পারলেন না। স্কুল শেষে কলেজে পড়ার জন্য কাকু কলকাতায়, বিপ্লবী দল যুগান্তরে নাম লিখালেন আশ্বিন ১৩২৫ এ। একদিকে স্বদেশী সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, সঙ্গে শুরু করলেন সাহিত্য চর্চা। ১৯৩১ সালে সত্যকাকু প্রথম কারাবন্দী হন। কোন একটি বাড়িতে কিছু অস্ত্রের সঙ্গে সত্যকাকুর লেখা এক চিঠি পাওয়া যায়। যার ফলশ্রুতিতে কলকাতার মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে, সে সময় তিন মাস তিনি কারাবন্দী ছিলেন। জীবনের এক নতুন দিগন্তে তাঁর পদচারণার শুরু।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নতুন পদযাত্রা শুরু। এ সময় খুলনার নারায়ণ চন্দ্র ব্যানার্জী তাঁর জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৩৩ এ কাকু দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন। তাঁর মা তখন বেরিবেরি জ্বরে গুরুতর অসুস্থ। মায়ের অসুখের টেলিগ্রাম পুলিশের হাতে পড়ায়, পুলিশ কলকাতায় কাকুকে গ্রেফতার করে। আলীপুর জেলে রেখে পরে বহরমপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়। একটানা ৫ বছর বহরমপুর জেলে থাকাকালীন কাকু সেখানকার কমিউনিস্ট পাঠচক্রের সংস্পর্শে আসেন। জেলে বসেই জীবনের দর্শনের এক বিরাট পরিবর্তন হলো। লেখাপড়া-তর্কবিতর্ক ইত্যাদির মধ্যে কমিউনিজমের পাঠ গ্রহণ করে অবশ্যি জেলে যাওয়ার আগেই তিনি বিএ পাস করেন। পরে জেলে থেকেই বাংলায় এমএ পরীক্ষা দেন। এই সময় মা মারা যান, কিন্তু তাঁর দাদা শঙ্কর ও তাঁর স্ত্রী-প্রতিমাও তাঁর পাশে ছিলেন সবসময়।
এর মাঝে ১৯৩৮ সালে সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই মুক্তি পান এ শর্তে- কাকা ক্ষিতিমোহন সেনের সাহায্যে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে রিসার্চ করবেন। কিন্তু সত্যকাকু তখন আরেক মানুষ, মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে সকল অনুরোধ ফিরিয়ে দেন। কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে চলে এলেন আপন গ্রামে। গ্রামে আত্মীয়স্বজন সব কলকাতাবাসী হয়েছে, কেবল রয়ে গেছে শৈশবের সঙ্গী বাউ- মাহাঙ্গু বানিয়া।
বিক্রমপুরের কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন, সঙ্গে ছিলেন কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ। জিতেন ঘোষ সত্যেন সেনের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সত্যেন সেন সারা বিক্রমপুর চষে বেড়াতেন। বিশ-পঁচিশ মাইল রাস্তা তিনি অনায়াসে হেঁটে যেতেন। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও নিরহঙ্কার চরিত্র, নির্মল বন্ধুপ্রেমই তাঁকে বিক্রমপুরের কর্মীদের কাছে প্রিয় করে রেখেছে। তাঁর ত্যাগোদীপ্ত চরিত্র একমাত্র তাঁরই বৈশিষ্ট্য। মানবপ্রেম এবং গণশক্তিতে বিশ্বাসই তাঁর সমস্ত শক্তির উৎস।’
কাকু সেই সময় সাধন দাশগুপ্তসহ একত্রে অনেক গান লিখেন ও সুর করেন যা গাওয়া হতো সেই সময় জেলায় জেলায়। সত্যকাকা নিজেই একজন ভাল গায়ক ছিলেন। তখন একটা কবিয়াল দল গঠন করেন। ১৯৪৬ সালে কবিয়াল দল নারায়ণগঞ্জে বিশিষ্ট জননেতা কমরেড ব্রজেন দাসের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা করে গান গেয়ে। এই কবিয়াল দল নারায়ণপুর, রহিমাবাদ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়াও তখন তিনি প্রগতিশীল লেখকদের একত্রিত করে নিয়মিত সভা, এর মুখপত্র প্রকাশ, প্রগতিশীল লেখকদের সম্মেলন করেছেন, বিভিন্ন সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন।
চলে এলো ১৯৪৭ সাল। ভারত পাকিস্তানের জন্ম হলো। ’৪৭ এরপর পাকিস্তানী জান্তা কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ও কমিউনিস্টদের ওপর দারুণ অত্যাচার শুরু হয়। সত্যকাকু আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু তিনি ধরা পরে যান ১৯৪৯ সালে বনগ্রাম লেনের এক বাড়ি থেকে। প্রথমে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত হন। পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল শাসন আমলে সত্যকাকু ১৩-১৪ বছর জেলে বন্দী ছিলেন। ১৯৪৯ এ গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ১৯৫৩ সালে। ১৯৫৪ তে আবার জেলে। ১৯৫৫ এ মুক্তি, ১৯৫৫-৫৭ এ যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ সরকার থাকায় মুক্ত ছিলেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের মার্শাল’ল এলো। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে জেল জীবনে ছিলেন। ১৯৬৫ সালে দেশ রক্ষা আইনে আবার গ্রেফতার হন। সম্ভবত ১৯৬৭ বা ১৯৬৮ এর প্রথম দিকে মুক্তি পান।
এরপর কাকুর আরেক নতুন সংগ্রাম। জেলে থেকে তাঁর পড়াশুনা ও লেখালেখি, সাহিত্য চর্চার এক অপার জগতে তিনি প্রবেশ করেন। তাঁর সাহিত্য চর্চা পুরোদমে গতি পায়। তাঁর লেখা চলে অবিরাম। তিনি ৪০টি’র বেশি বই লিখেন। এর মধ্যে রয়েছে: আলবেরুনী, ভোরের বিহঙ্গী, জীববিজ্ঞানের নানা কথা, সেয়ানা, গ্রামবাংলার পথে পথে, ইতিহাস ও বিজ্ঞান (১ম খ-), ইতিহাস ও বিজ্ঞান (২য় খ-), বাংলাদেশের কৃষকের সংগ্রাম, সীমান্ত সূর্য গাফফার খান, অপরাজেয়, কুমারজীব, মানবসভ্যতার উষালগ্নে, বিদ্রোহী কৈবর্ত, মনোরমা মাসীমা, পাপের সন্তান, বিপ্লবী রহমান মাষ্টার, শহরের ইতিকথা, উত্তরণ, পাতাবাহার, মসলার যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহের কাহিনী, অভিশপ্ত নগরী, প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ, পুরুষমেধ, সাত নম্বর ওয়ার্ড, রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ, মা, একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে, পদচিহ্ন, অভিযাত্রী, এটমের কথা, আমাদের এই পৃথিবী, মেহনতি মানুষ, আইসোটোপ, বিকিরণ, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা, প্রাচীন চীন, প্রাচীন ভারতের স্বর্ণযুগ, ইতিহাস ও বিজ্ঞান (৩য় খ-), বিশ্বমানবের মহাতীর্থে, কমরেড মণি সিং ইত্যাদি।
প্রতিটি লেখায় নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কথা, ইতিহাস নির্ভর, বিজ্ঞানভিত্তিক। তাঁর লেখা ৪০টি বই মানবমুক্তি, মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়ার মতো বিষয়বস্তুই প্রাধান্য পায়। দীর্ঘ কারাবাসের ফলে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েননি। তাই ১৯৬৮ সালে প্রগতিশীল সংস্কৃতি বিকাশের জন্য ‘উদীচী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন যার প্রথম প্রতিষ্ঠিত সভাপতি সত্যেন কাকু। উদীচী এখনও তার স্বমহিমায় কাজ করে চলেছে।
তাঁর কর্মবহুল জীবনে তাঁর স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৭০ সালে, একুশে পদক পান ১৯৬৮ সালে, তাঁর মৃত্যুর পর। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে কর্মযজ্ঞে ব্যাপৃত হন। শরীর ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ে, চোখে কম দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের পর কিছুদিন বাংলাদেশে থেকে পরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ওখানে চোখে কম দেখার জন্য লিপিকার দিয়ে লেখাতেন। এক অদম্য প্রাণ স্পৃহা সম্পন্ন মানুষ মানবমুক্তির অমৃত জীবনধারায় যিনি সিক্ত, সত্যেন কাকু ৭৩ বছর ৯ মাস ৮ দিন এই ধরাধামে থেকে ১৯৮১’র ৫ জানুয়ারি মানবমুক্তির এক সংগ্রামী অবিসংবাদিত নেতা আমার সত্যেন কাকু আমাদের ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করেন।
আমরা যারা তাঁর উত্তরসূরি তারা লজ্জিত, তাঁর মতো এক মানবমুক্তির যোদ্ধাকে জাতির কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আজ ক’জন জানে সত্যেন সেনকে। তাঁর প্রচুর লেখা এখনও নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে, তাঁর সব লেখা নিয়ে সত্যেন সেন গ্রন্থাবলি রচনা সমগ্র প্রকাশ করে আমরা আমাদের দায়মুক্ত করতে পারি। তাঁর জীবনদর্শন থেকে শিক্ষা নিলে জাতি সচল হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতি নতুন পথের দিশা পাবে। সত্যেন সেন চিরজীবী হোক।

লেখক : সভাপতি, বিশ্বশিক্ষক ফেডারেশন,
সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

দুই নয়নে দেখা হয় নাই, তৃতীয় নয়নে দেখেছি
ইকবালুল হক খান
সত্যেনদাকে সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। উদীচীর সাথে যুক্ত হওয়ার আগে সত্যেনদাকে জানতাম একজন সাহিত্যিক হিসেবে এবং উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। উদীচী’র সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সত্যেনদা সর্ম্পকে জানতে শুরু করলাম, প্রতিদিনই যেন একটু একটু করে জানতে চেষ্টা করছি । বিপ্লবী সত্যেন সেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানার সোনরং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ধরণী মোহন সেন , মা মৃণালিনী সেন বাবা মার দুই পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের মধ্যে সত্যেনদা ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। সত্যেনদার দুই বোন ইন্দুবালা সেন ও প্রতিভা সেন, ভাই জিতেন্দ্র মোহন সেন। সত্যেন সেনের দাদা ক্ষিতি মোহন সেন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠীত শান্তি নিকেতনের অধ্যক্ষ। সোনারং গ্রামের স্কুলে সত্যেন সেন লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯২১ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় কংগ্রেসের হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯২৪ সালে সত্যেন দা সোনা রং স্কুল থেকে ম্যাট্্িরক পাশ করেন । ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য কলকাতায় চলে যান। কলেজে অধ্যয়ন রত অবস্থায় যোগ দেন বিপ্লবী দল যুগান্তরের সাথে। স্বদেশী বিপ্লবী কাজে তাকে উৎসাহ যোগাতেন তার মেজ দি প্রতিভাসেন । তার সাহিত্য চর্চ্ওা শুরু হয় সেই সময় থেকেই।
১৯৩১ সাথে সত্যেন দা প্রথম কারা ভোগ করেন। তিন মাস জেল হয় তার । জেলখানায় বসে সত্যেন দা রাজনৈতিক ভাবনার জন্ম হয়, সমাজতন্ত্রের পরিচয় ঘটল এবং সমাজতন্ত্র কে আদর্শ বলে গন্য করলেন তিনি ।
১৯৩২ সালে সত্যেন দা দ্বিতীয় বারের মতো গ্রেপ্তার হন। প্রথমে আলীপুর জেলে এবং পরবর্তীতে বহরমপুর জেলে, এবার তাকে টানা পাঁচ বছর জেলে থাকতে হয়। এই জেল জীবনই ছিল সত্যেন দার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জেলে থাকা অবস্থায় এম এ পাশ করেন। জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। সত্যেন দা চলে এলেন নিজ গ্রাম সোনারংএ । এর পর প্রখ্যাত কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ এর সাথে কৃষক আন্দোলন গড়ার কাজ শুরু করেন। কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি ঢাকা, রায়পুরা, নরসিংদী,মুন্সীগঞ্জ,বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর প্রভৃতি স্থানে কাজ করেন। সত্যেন দা এসময় শুধু কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন না। তিনি একই সাথে ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্, লক্ষèীনারায়ণ কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ্ও ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাট কলের ট্রেড ইউনিয়নের আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক শ্রেনীকে তাদের ন্যায্য মজুরী, দাবী দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করার কাজে আতœনিয়োগ করেন। এছাড়্ওা এসময়ে তিনি জড়িত হয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে।
চল্লিশের দশকে ঢাকায় প্রগতী লেখক সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪২ সাথে ঘাতকদের হাতে সোমেন চন্দ নিহত হবার পর সত্যেন সেন এই সংগঠনের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪২ সাথে তিনি প্রথম গান রচনা করেন ”লীগ কংগ্রেস এক হও” এই গান বাংলায় সর্বত্র গাওয়া হতো এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জণ করে। ১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে সময় সত্যেন দা শ্রমিক- কৃষক দের সাথে নিয়ে নিরন্ন মানুষের জন্য লঙ্গর খানা খুলে খাদ্যের ব্যবস্থা করেন । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমিউনিস্টদের উপর জুলুম অত্যাচার শুরু হয়, সত্যেন দা তখন আতœগোপনে চলে যান। বাঙ্গালীর জাতীয় ও সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেবার গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়, প্রথম আঘাতটা আগে ভাষার উপর , শুরু হয় ভাষা আন্দোলন । এই অবস্থায় ১৯৩৯ সাথে সত্যেন দা কে ঢাকার বনগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং চার বছর কারাগারে কাটান। প্রথমে রাজশাহী জেলে এবং পরবর্তী ঢাকা জেলে বন্দী রাখা হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি মুক্তি পান, মুক্তি পাবার পর চলে যান নিজ গ্রাম সোনারং এ আবার শুরু করলেন কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই কাজ করতে লাগলেন । আর এই কারনেই পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছরের মধ্যে আঠারো বছরই সত্যেন দা কে কাটাতে হয় জেলে আর বাকী সময় টা আতœগোপনে। ১৯৫৪-১৯৫৫ সালে পরবর্তীতে ১৯৫৮-১৯৬৩ সালে কারাগারে কাটান। ১৯৬৫ সালে আবার গ্রেপ্তার করে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সত্যেন দাকে কারাগারে আটক রাখা হয়।
সত্যেন দার কাছে সাহিত্যই ছিল সংস্কৃতির প্রাণ। সেই সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌছে দেবার জন্যই তিনি আশ্রয় নেন সাহিত্যের দ¦ারে। সেই দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের জীবন মুখি, সমাজ তান্ত্রীক বাস্তবতার সাহিত্য নির্মাণের অগ্রপথিক ছিলেন সত্যেন দা।
১৯৬৮ সাল সত্যেন দা জীবনের এক বিশেষ তাৎপর্যময় সময়। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্বপ্নের সংগঠন “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” যদিও উদীচী’র কার্যক্রম তিরি তাঁরও অনেক আগে শুরু করেছিলেন। সামগ্রীক পরিস্থিতির কারণে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর “উদীচী” নামে যাত্রা শুরু করেন। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে তিনি মগ্ন থাকেন সাহিত্য রচনায়। ১৯৬৯ সালে তিনি রচনা করেন ৬টি গ্রন্থ এবং ১৯৭০ সালে সত্যেনদার ১১টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
সত্যেনদার জীবনের একটি অংশ কেটেছে সাংবাদিকতায়, তিনি দৈনিক সংবাদের সংবাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
১৯৭১ সালে মহা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় সত্যেনদা মুন্সিগঞ্জে ছিলেন। সে সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকলেও মনের দিক দিয়ে সতেজ ছিলেন। সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তিরি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরীর কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। বিভিন্ন শিবির ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেন গণহত্যা ও “প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ” নামক গ্রন্থ। সত্যেনদা স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই দেশে ফিরে আসেন ¦ং দেশ পূর্ণগঠনে যথাসাধ্য কাজ করেন। এক পর্যায়ে শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে তিনি তাঁর মেজদি প্রতিভা সেনের কাছে শান্তি নিকেতনে চলে যান। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি প্রতিভা সেনের সত্যেন দা মৃত্যুবরণ করেন।

সত্যেনদার বিখ্যাত বাণী-
“ মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী তাই দিয়ে রচি গান,
মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেয়া প্রাণ”।
সত্যিই সত্যেনদা নিজের জীবনের সকল অর্জন মানুষের মাঝে ঢেলে দিয়ে গেছেন। হালকা, পাতলা গড়নের ছোট-খাট আকৃতির মানুষটি যে এত বড় মাপের মানুষ এবং বহুবিদ গুণের অধিকারী তা আগে জানা ছিল না; তার জীবনের সকল কিছু জানা মনে হয় এক জনমে সম্ভব নয়। তিনি সাহিত্যক, রাজনীতিবিদ, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী-সংগ্রামী, সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশকে এবং এদেশের মানুষকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন কিন্তু বাংলাদেশ ও দেশের মানুষ তাকে সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। সত্যেনদাকে ভালোভাবে চিনতেন ব্রিটিশ-পাকিস্তানী সরকার, এ কারণে হয়তো তাকে দীর্ঘ দিন কারাগারে বন্দী রাখা হয়। পুরো মানুষটি ছিল একটা বারুদ, যার বিস্ফোরনের ভয়েই ব্রিটিশ-পাকিস্তানী সরকার তাকে দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন। কারাগারে বসেই তিনি সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন রচনা করেছেন। সত্যেন দা বাংলার শ্রমিক ,কৃষক মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গ্রাম বাংলার পথে পথে ঘুরে শ্রমিক, কৃষক মেহনতি মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে মুক্তির বাণী শিখিয়েছেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অনুশীলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কৃষক সমিতি গঠন করে কৃষক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন এবং কৃষক তাঁর ন্যায্য পাওনা পাবে সে ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করেছেন, কৃষকদের পাশে গিয়ে দাড়িয়েছেন। তিনি মনে করতেন বক্তৃতা, বিবৃতির চেয়ে গানের মাধ্যমে হয়তো মানুষকে কাছে টানা সহজ হবে এবং মানুষের মাঝে মুক্তির বার্তা সহজে পৌছে দেওয়া যাবে, মানুষ তার অধিকার সর্ম্পকে বুঝতে পারবে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী হবে, গঠন করলেন গানের দল, ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর নাম দিলেন “উদীচী”। এদেশে পাকিস্তানী শাসকদের অত্যাচারে যখন দেশের টালমাটাল অবস্থা ঠিক সেই সময়েই তিনি উদীচীর যাত্রা শুরু করলেন, শুরু করলেন সুসংগঠিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমেই রাজনৈতিক আন্দোলন পথ তৈরী হয়। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র পাই।
কোন দেশের সংস্কৃতির উপর আঘাত হানলে সে দেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা যায় না। এ কারনেই পাকিস্তানী সরকার আমাদের সংস্কৃতির উপর বারবার আঘাত হেনেছে। সত্যেনদা সংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে সে আঘাত মোকাবেলা করে জয়ী হয়েছেন এবং আমাদেরকে লড়াই-সংগ্রাম করে জয়ী হবার পথ দেখিয়েছেন, বহু গুনের অধিকারী সত্যেনদার অন্যতম সৃষ্টি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। উদীচী’র সকল প্রত্যেক কর্মী-তাঁর আদর্শকে ধারণ করে, তিনি যে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিজের কর্মজীবন উৎসর্গ করা এবং একটি শোষণ মুক্ত হাসি-গানে মুখরিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করা, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের সংবিধানের ৪ মূলনীতির ৩ মূলনীতি হচ্ছে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা এক বাক্যে উদীচী বলতে বুঝি, একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিকামী, সেচ্ছাসেবী গণসাংস্কৃতিক সংগঠন। অর্থাৎ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উদীচী’র লক্ষ্যে আদর্শ একই সূত্রে গাঁথা । সত্যেনদার স্বপ্নের বাংলাদেশ ও উদীচী’র লক্ষ্য আদর্শ অভিন্ন। সত্যেনদা যেভাবে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন সেভাবেই উদীচী প্রতিষ্ঠা করেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও আমরা সে জায়গায় অবস্থান করতে পারিনি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি, যেমনটি সত্যেনদা চেয়েছিলেন। এর অন্যতম আমাদের দেশের সংস্কৃতিবিহীন রাজনীতির প্রচলন হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিছুটা সঠিক পথে চললেও ১৯৭৫ এর পর আবার পাকিস্তান ধারায় চলে এসেছে এবং সে ধারা এখনো পর্যন্ত বলবৎ আছে। এ ব্যবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে অবশ্যই সত্যেনদার আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। সত্যেনদার জীবনে আরেকটি দিক খুজে পেয়েছি তিনি অভিমানী ছিলেন, কি কারণে অভিমান করেছিলেন তা অজানাই রয়ে গেল।
রাষ্ট্র সত্যেনদাকে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। রাষ্ট্রের কাছে তিনি এই সম্মান পেয়েছেন। সত্যেনদা জীবনে যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, শুধুমাত্র একুশে পদকে ভূষিত করে সে ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র এবং উদীচীকে অনেক কাজ করতে হবে, হতে পারে এরকম সত্যেনদার সমগ্র সাহিত্যকর্ম প্রকাশের ব্যবস্থা করা এবং সারাদেশে পাঠাগারের মাধ্যমে মানুষ যেন সেই বই পড়তে পারে সে ব্যবস্থা করা। উচ্চতর শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে সত্যেনদার সাহিত্যকে অন্তভূর্ক্ত করা, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী সহ, লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য এবং কিছু সাহিত্য কর্ম অন্তর্ভূক্ত করা , সত্যেনদার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। সত্যেনদা বাংলাদেশে মেষ সময়ে তোপখানা রোডে উদীচী অফিসে সময় কাটিয়েছেন। , তোপখানা রোডে নাম পরিবর্তন করে “সত্যেন সেন সড়ক” রাখতে হবে। প্রথম কাজটি হয়তো উদীচী উদ্যোগ গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে পারবে কিন্তু অন্যান্য বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করতে হলে রাষ্ট্রকেই করতে হবে। রাষ্ট্র এই কাজগুলো করার জন্য উদীচীকেই বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উদীচী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং রাষ্ট্রকে তা বাস্তবায়নে বাধ্য করা হবে। এত করে আমাদের সামগ্রীক লাভ হবে রাষ্ট্রের এবং এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের। প্রায় তিনশত বছর যাবৎ আমাদের ভূ-খন্ডের মানুষ মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, সত্যেনদার স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত হাসি-গানে মুখরিত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। আমি মনে করি উদীচী’র প্রতিষ্ঠা কর্মী সত্যেনদার আদর্শকে ধারণ করে তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলবে এবং সত্যেন দার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে।
সত্যেন’দা কে দুই নয়নে দেখিনি, শুধু তৃতীয় নয়নে দেখেছি এ মহানায়ককে। চেষ্টা করবো তাঁর আদর্শ ধারন করে সত্যেন দার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, শোষনমুক্ত হাসি-গানে মুখরিত সোনার বাংলাদেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবো এবং সত্যেন দার সপ্ন বাস্তবায়নে চেষ্টা করবো।
রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশ্যা, রাষ্ট্র সত্যেন’দাকে অনুসরন রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সত্যেনদার সপ্ন বাস্তবায়ন হবে।

সত্যেন সেন : শ্রদ্ধার্ঘ্য
মোরশেদ শফিউল হাসান
বিপ্লবী ও মানবতাবাদী লেখক সত্যেন সেন ৭৩ বছর বয়সে গত সোমবার শান্তিনিকেতনে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর আগে মুহূর্ত পযর্ন্ত তাঁর জীবন ছিল কর্মময়। বর্ধক্য, দৃষ্টিহীনতা ও ব্যাধি কিছুই তাঁর সাধনায় ছেদ টানতে পারেনি। অবশেষে মৃত্য এসে এই অক্লান্ত জ্ঞানসাধক ও কর্মবীরের জীবন-দীপ নিভিয়ে দিল। যে দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি ভালবাসায় তার জীবন ছিল উৎসর্গীকৃত শেষজীবনের শারীরিক অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব তাঁকে সেই মাটি ও মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল সত্যি, কিন্তু বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে তাঁর অনিঃশেষ ভালোবাসা ও অক্ষয়-অটল অঙ্গীকার চিরকাল আমাদের স্পর্শ করবে।
সত্যেন সেনের পরিচয় সাহিত্যিক-সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু তাঁর জীবন ও কর্ম-সাধনার বৈশিষ্ট্য অনুধাবনে এ পরিচয়টুকু বলতে গেলে কিছুই নয়। নিতান্ত কিশোর বয়সে দেশকে বিদেশী অধীনতা মুক্ত করার আকাঙক্ষা নিয়ে সেই যে তিনি সন্ত্রাসবাদী-বিপ্লবী দল ‘যুগান্তর’-এর সভ্য হয়েছিলেন, তার পর থেকে এক মহৎ লক্ষ্যের অভিমুখে ছিল তার অক্লান্ত পথচলা। সে লক্ষ্য মানবতার মুক্তি সাধনের, সে স্বপ্ন শোষণমুক্ত এক নয়া সমাজ প্রতিষ্ঠার। সবকিছুর উর্দ্ধে তিনি ছিলেন বিপ্লবী। তাঁর সাহিত্যচর্চাকেও সে রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা চলে না। শোষিত শ্রমজীবি মানুষের জন্য সত্যিকারের দরদ ও তাদের স্বার্থের সাথে সমতাবোধ তাকে আপন পারিবারিক ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের গন্ডি থেকে টেনে ওই সব সাধারন মানুষের সংগ্রামের কাতারে দাঁড় করিয়েছিল। সে ভালোবাসা ও অঙ্গীকারের স্বীকৃতি তাঁর সাহিত্য-সাধনার মধ্য দিয়েও উচ্চারিত। আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর ভ্রাতুষ্পুত্র সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করলে তাতে অস্বাভাবিকতার কিছু থাকে না। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, সত্যেন সেনের কর্ম-সাধনার শুরু একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। যে রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা থেকে তিনি চল্লিশের দশকে আরো অনেকের সঙ্গে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’ সংগঠনে ও প্রতিরোধ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সেই দায়িত্বশীলতাই বৃদ্ধ বয়সে ও বন্দি-জীবনে একজন কৃষক-কর্মীর হাতে কলম তুলে দিয়েছিল। এরপর থেকে একের পর এক তিনি লিখে চলেছেন- উপন্যাস, ঐতিহাসিক আখ্যান, জীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। দেশবাসীর মনে বিজ্ঞানবোধ ও ইতিহাস সচেতনতার উদ্বোধন ঘটাবার আকাঙ্খা জীবনের উপান্তেও, সম্পূর্ণ লুপ্ত দৃষ্টিশক্তি নিয়ে, তাঁকে শ্রুতলিপির সহায়তায় খন্ডে খন্ডে ইতিহাস ও বিজ্ঞান গ্রন্থের অনুবাদকর্মে ব্রতী করেছিল। আমাদের আবহমান ইতিহাসের সংগ্রামী তাৎপর্যবহ ও ছড়ানো-ছিটানো লুপ্তপ্রায় ঘটনা-উপাদানসমূহকে সংগ্রথিত করে তিনি ভাবীকালের প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করে গেছেন। আর এই বিশেষ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান, আমাদের সমাজ ও সমকালের প্রেক্ষাপটে, যাকে বলে তুলনাহীন। তাঁর রচনা-কর্মের বিশালতা ও বৈচিত্রের সাথে তুলনায় অধিকাংশ রচনার উৎকর্ষ বা শৈল্পিক সফলতার মাত্রা নিয়ে বিচার-বিতর্কের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, দৃষ্টির প্রসারতা ও সমুন্নতি এবং অঙ্গীকারের একাগ্রতায় সীমিত অর্থে তিনিই ছিলেন আমাদের সাহিত্যের একমাত্র রেনেসাঁস-ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তি হিসেবেও সত্যেন সেন ছিলেন, দলমত নির্বিশেষে, সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর সৎ, ত্যাগী, নির্লোভ ও আপোসহীন চরিত্র এবং নিরহঙ্কার ও দরদি ব্যক্তিত্ব তাঁকে পরিচিত মহলে এক বিরল সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী করেছিল। তিনি ছিলেন সবার প্রিয় ‘সত্যেন-দা’। ‘অজাতশত্রু’ কথাটাকে তার সঠিক অর্থে বোধকরি এই চিরকুমার লোকটি সর্ম্পকেই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেত।
জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁর কারাগারেই কেটেছে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত, মাঝে কয়েক মাস বা দু’এক বছরের বিরতির কথা বাদ দিলে, জেলই ছিল তাঁর ঘরবাড়ি। বন্দি-জীবনের একঘেঁয়েমি কাটাতেই তিনি হয়তো কোনো একদিন হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে সেটি ছিল আমাদের সাহিত্যের পক্ষে এক শুভলগ্ন। তাঁর লেখা গানে তিনি মানুষের তিনি মানুষের জন্য ভালোবাসার কথা উচ্চারণ করেছিলেন:

মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী
তাই দিয়ে রচি গান
মানুষের কাজে ঢেলে দিয়ে যাব
মানুষের দেয়া প্রাণ।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভালোবাসার দায় শোধ করে গেছেন।
১৯৮১

সেলিনা হোসেন
শুধু কিছু কথা
১৯৭০ সালে সত্যেনদার সঙ্গে যখন আমার পরিচয় তখন তিনি ভাল দেখতে পান না। চলতে ফিরতে লোকের দরকার হয়। কাউকে ছাড়া হাঁটতে পারে না। থাকতেন নারিন্দার ৬৪, মুনির হোসেন লেনে। সত্যেনদার সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৯৭৪ সালে কোলকাতায়। থাকতেন আলীপুরে তাঁর বোনের বাসায়। তখন তিনি একদম অন্ধ। আমি যাওয়াতে তিনি কতটা খুশি হয়েছিলেন তা আমি দেখলাম তার অভিব্যক্তিতে। কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেন না। শুধু আমার কণ্ঠ শুনলেন। আমার সঙ্গে তার পরিচয়টা হয়েছিল এমন একটা সময়ে যখন তিনি অনেক কিছু হারিয়েছেন। খুব খারাপ লেগেছিল আমার। মনে হয়েছিলো আরো আগে কেনো দেখা হোল না। কিন্তু পরিচয়ের আন্তরিকতায় আমার সে মনোবেদনা অল্পদিনেই উবে গিয়েছিল। তখন আমি জেনেছিলাম সত্যেনদা মানুষকে শুধু চোখ দিয়েই দেখেন না, …….. দিয়ে দেখেন। এবং । এভাবে দেখেন বলেই মানুষকে খুব তাড়াতাড়ি কাছে টানেন। সত্যেনদার সঙ্গে পরিচয়ের সময়টা খুব দীর্ঘ নয়। কিন্তু বড় বেশি উজ্জল। সময়ের হীরক-দ্যুতি। আলো ঠিকরে পড়ে আমার স্মৃতির একটুখানি জায়গা দারুণ ঔজ্জল্যে ঝকমকিয়ে রাখে। করো কারো সঙ্গে দিন রাতের অনেক দীর্ঘ সময় কেটে যায়। কিন্তু মনে দাগ কাটে না। অবলীলায় হারিয়ে যায় স্মৃতির কীর্তিনাশা ¯্রােতে। কিন্তু সত্যেনদার সঙ্গে চাপর বছরের পরিচয় সমস্ত প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে আশ্চর্য জীবন্ত।
সত্যেনদা নামে চিনতেন আমাকে। লেখা পড়েছিলেন। প্রথম সাক্ষাৎ বাংলা একাডেমিতে। সরদার ফজলুল করিম সাহেবের টেবিলে। তিনিই আমার সঙ্গে সত্যেনদার পরিচয় করিয়ে দেন। সেদিন সত্যেনদা হেসে বলেছিলেন, তুমি সেলিনা হোসেন? লেখা পড়ে ভেবেছিলাম দেখতে আরো বড়সড়।
তাঁর কথার উত্তর আমি দেইনি। দিয়েছিলেন সরদার ফজলুল করিম, সত্যেনদা শুধু ফিগার দেখে কি লেখার বিচার চলে?
Ñঅবশ্যই তা চলে না। তবে কারো লেখা পড়লে তার সম্পর্কে একটা ধারণা মনে আসে কিন্তু।
Ñতা ঠিক
সকলে হেসেছিলেন। সেদিন আমার সঙ্গে বেশি কথা হয়নি। চুপচাপ কথা শুনেছিলাম কেবল। তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছিল আরো পরে। তখন জেনেছিলাম তরুণ লেখক সম্পর্কে তাঁর কি ভীষণ উৎসাহ। আবিস্কারের আনন্দ ছিল তার মনে। সত্যেনদার জন্যই আমার ‘জ্যো¯œায় সূর্যজ্বালা’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল কালি কলম প্রকাশনী থেকে। কালিকলমের আলী ভাই তাঁর কথাতে বইটি চেপেছিলাম। কেননা তখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ ছিল না। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম সত্যেনদার আন্তরিকতায়। নিজে যতœ সহকারে পা-লিপি শুনেছিলেন। নিজে পড়তে পারতেন না বলে সমরদা তাকে পা-লিপি পড়ে শুনিয়েছিলেন। জায়গায় জায়গায় পরামর্শ দিয়েছিলেন। আরো আশ্চর্য হয়েছিলাম যখন সত্যেনদা আলীম ভাই-র কাছ থেকে পাঁচ শতটাকা অগ্রিম নিয়ে ছিলেন রয়্যালচি বাবদ। পাদটীকা হিসাবে বলে রাখি ঐটাই ছিল রয়্যালটি বাবদ আমার পাওনা। পরবর্তীকালে আলীম ভাই আমাকে আর কোন টাকা দেননি। এখন আমাদের প্রকাশনা শিল্পে বড়ই দুর্দিন। সকলেই হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। লেখকদের কোথাও ঠাঁই নেই। প্রতিষ্টিতরাই থৈ পাচ্ছেন না। তরুণদের অবস্থাতো আরো শোচনীয়। মাথার ওপর একজন সত্যেনদা নেই যাকে ভরসা করা যায়। যার হাত ধরে পায়ের নিচে মাটি খুজে পাওয়া যাবে। যিনি বলবেন, কি হে কি লিখছো? এসব কথা এখন কেমন বেমানান শোনায়। মনে হয় বানোয়াট, মিথ্যা। যেন রূপকথার আমলের কথা। সত্যেনদা সামনে নেই বলে দুঃখ। নইলে সামনাসামনি যাচাই করিয়ে বলতাম, কথাগুলো খাঁটি, নির্ভেজাল সত্য কথা।
সত্যেনদার বিপুল রচনা সম্ভার আমার এক বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। কেননা ষাট দশক পর্যন্ত কম লেখাই ছিল ফ্যাশন। বেশি লেখার কথা তখন কেউ একটা ভাবতেন না। অথচ সত্যেনদা অবিশ্রাম লিখছেন। আশ্চর্য মুখর ছিল তাঁর লেখনী। আমি প্রায়ই তাঁকে বলতাম, সত্যেনদা আপনি এত লেখেন কি করে? এটা কোন কথা হল? সত্যেনদার কাছে আমি কােন সদুত্তর পাইনি ঠিকই তবু আমার বিস্ময় কমেনি। আমি কিছুতেই ভাবতে পারতাম না যে একজন মানুষ কিভাবে এতো লিখতে পারেন। ছিপছিপে হালকা পাতলা গড়নের লম্বা মানুষটার ভেতরে যে এত শক্তি আছে তা বোঝা যেতো না। নত্যেনদার বলতেন, সকলে যখন শেষ করে, তখন আমি শুরু করেছি। পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি লিখতে আরম্ভ করি। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে সৃষ্টির এমন ফলবান বৃক্ষ তৈরী করা খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব। সত্যেনদা শেষ জীবনে শেষ জীবনে যা করেছেন একজন লেখক সারা জীবনেও অনেক সময় তা করতে পারেন না। শুধু তা^র অভাব ছিল এক জায়গায়। শিল্পকে তিনি করায়ত্ত করতে পারেননি। আর পারেননি বলেই তাঁর উপন্যাসে বক্তব্য এবং শিল্পের সম্মিলন ঘটেনি। দু’য়ের মধ্যে যোজন মাইলের তফাৎ অনুভূত হয়। সত্যেনদার মানসিক শক্তি নিয়ে কোনো প্রতিভাবান তরুণের আবির্ভাব ঘটলে আমাদের উপন্যাসে জোয়ার আসতো। তিনি আমাদের সামনে এমন এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।
সত্তর সালে আগস্ট মাসের তিন তারিখে তিনি আমাকে ‘গ্রাম বাংলার পথে পথে’ বইটি দিলেন। সেদিন বইয়ের ওপর আমার নাম লিখতে তাঁর হাত কাঁপছিলো। ভালো দেখতে পান না বলে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল লেখা। ভীষণ খারাপ লেগেছিল। যখন তাঁর মন সৃজনশীলতার বেদনায় পূর্ণ, সৃষ্টির সম্ভারে টইটুম্বুর, তখঝন তার দৃষ্টি শক্তি নেই। অত্যাচারে, অবহেলায়, নির্যাতনে, তিনি তা হারিয়েছেন। তবু কোথাও নতি স্বীকার করেননি বা হেরে যাবার কথাও ভাবেননি। নিজেদের এমন শক্তি কৈ? ঝড়তো দুরের কথা, সামান্য বাতাসেই নুয়ে যেতে চায় মাথা। ঘাড়ের ওপর মাথাটা সোজা রাখতে বড় কষ্ট।
সত্যেনদা আপনার যৌবন দেখিনি, বৃদ্ধ বয়সে যে তেজ দেখেছি সেজন্যেই যৌবনের সেই দুর্বিনীত ভঙ্গী দেখার ইচ্ছা হয়। আপনারা কেমন করে এমন লৌহ-কঠিন মানব হন? বিবেক, চরিত্র, মন, সাহস ইত্যাদি শব্দগুলো যখন আমাদের জীবনে কিংবদন্তীতে পরিণত হতে যাচ্ছে তখন বলতে ইচ্ছে করে যে একজন সত্যেনদা আসুক আমাদের জীবনে। আমরা সমুদ্রে ভেসে যাওয়া প্রাণী হয়ে তাকে অবলম্বন করে কূলে উঠি।
সত্যেনদার সঙ্গে অনেকদিন দেখা নেই। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানি না। তিনি শুধু আমার স্মৃতির মণিকোঠায় জ্বলজ্বল করুক তা আমি চাই না। আমি চাই তিনি যেমন আমার জীবনে উদাহরণ হবেন, তেমনি আমার উপন্যাসেরও চরিত্র হবেন। এমন একটা চরিত্র যা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট চরিত্র হিসেবে অমরত্ব পাবে। তবেই হয়তো তাঁকে আতœস্থ করার সাধনা আমার সফল হবে। নইলে সত্যেনদার সঙ্গে আমার পরিচয়ের আন্তুরিকতা শুধু স্মৃতি, কোন সফল অনুভব নয়। সত্যেনদার গুণাবলীর সামান্যতম বিন্দুও যদি নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারি তাহলে তার সঙ্গে আর কোনদিন দেখা না হলেও আমার কো দুঃখ থাকবে না। আমার জীবন এবং আমার সাহিত্য তাঁর উপস্থিতি প্রতি মুহূর্তের দ্রীপ্র চেতনার আলোকে।
সত্যেনদার সীমানা অনেক ব্যাপক। সে জন্যেই একটি ঘটনা বলব। ঘটনাটি আমার শোনা। আমি শুধু যোগফল মেলাবো। এক ভদ্রলোক ট্রেনে করে রংপুর যাচ্ছিলেন। পথে এক ব্রিজের কাছে ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ে। সামনের কতগুলো বগি লাইন-চ্যূত হয়ে পাশে পড়ে যায়। দুর্ঘটনায় লোকজন সামান্য আহত হলেও কেউ মারা যায়নি। কারো কোন বড় ধরনের ক্ষতিও হয়নি। যাহোক কিছুক্ষণের মধ্যেই আশপাশের লোকজন এসে জড়ো হয়। তাঁরা অনেকে বলে, সাব ওখানে একজন ভালো মানুষের কবর আছে সেজন্যে আপনারা জানে বেচে গেলেন। নইলে অনেককে মরতে হোত।
ঘটনাটি বলে ভদ্রলোক বলেছিলেন, এখন তেমন একজন ভাল মানুষ নেই যার জন্যে আমরা অনেকে বেঁেচ যেতে পারি।
আমি জানি না কেন সত্যেনদার সর্ম্পকে লিখতে বসে বারবার আমার এ কথাটাই মনে হচ্ছে। একজন দু’জন ভালমানুষ চাই যার জন্যে আমরা হাজার জনে বেঁেচ যেতে পারি। তাই কামনা করি সত্যেনদার অনুপস্থিতি আমাদের জীবনে কাঙ্খিত অনুপস্থিতি হোক। শুধু শারীরিক উপস্থিতিটাই যেন বড় না হয়।

হাজেরা বেগম
সত্যেন সেন
আমার জন্মভূমি রামপুর। রামপুর উত্তর ভারতের ছোট্ট একটি মুসলমান করদরাজ্য। আমাদের মুসলমান সমাজের মেয়েদের অবস্থা তো জানাই আছে তোমার। কিন্তুু রামপুরের যা অবস্থা তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না। পর্দা, পর্দা চারদিকে শুধু পর্দা। এই পর্দার মধ্যে মেয়েদের জীবন কাটাতে হয়। …………ঘরের মেয়ে আমি। যত বেশি …….., ততবেশি কড়াকড়ি। গরীবন ঘরের মেয়ে হলে এর চেয়ে বেশি স্বাধীনতা পেতাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকে এসব দেখেশুনে এতই অভ্যস্থ হয়ে এঠছিলাম যে, এজন্য কোনোদিন সামান্য আফশোসটুকুও হয়নি। এ কথাটা জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলাম, এইটাই মেয়েদের জীবন। তাই এর জন্য মনে কোনোরূপ অস্থিরতা বা ছট-ফটানি ছিল না। আজ কিন্তুু ভাবতে ভারি আশ্চর্য লাগে, এই আমি যে সেই আমি এ-কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আমাদের পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া করার কিছুটা সুযোগ দেওয়া হত। লাহোরের এক জেনানা স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হল। স্কুলের সঙ্গেই হস্টেল-এর বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, কোনো উপলক্ষও ছিল না। বাড়িতে আদরের মেয়ে ছিলাম, সবার ভালোবাসা পেতাম, কিন্তু অবস্থা বিশেষে সেই আদর ও ভালোবাসার কি প্রচ- রুপান্তর ঘটতে পারে তা দেখেছি।
হস্টেলে থাকতে অথবা বাড়িতে,আমাদের কোনোরকম খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হত না। আমাদের রামপুর এস্টেটের লোকেরা, বিশেষ করে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা অত্যন্ত রাজভক্ত। স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ কোনোদিন সেখানে প্রবেশ করতে পারে নি। খবরের কাগজগুলি সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম কথালেখে। তাই সংবাদপত্র পাঠ আমাদের পক্ষে একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল। ‘স্টেট্ম্যান’ বা ‘ইংলিশ ম্যান’ সরকারের অতি বশস্বদ পত্রিকাগুলিও আমাদের পড়তে দেয়া হত না। মেয়েদের খবরের কাগজ পড়ার কি দরকার। তাই আমরাও এ নিয়ে কোনোদিন মাথা ঘামাইনি । আমি এই সংসারের সার তত্ত্বটিকে জেনে নিয়েছিলাম, মেয়ে হয়ে জন্মালে এইভাবেই জীবন কাটাতে হয়। মানুষের জন্মগত অধিকার বলে কোনো কথা আছে, এ সমস্ত কথা কোনোদিন কানেও আসে নি।
ম্যাট্টিক পাশ করার পর আমার বিয়ে হয়ে গেল। রামপুর এস্টেটের ছেলে, দেখতে সুন্দর, ঘরে টাকা পয়সাও যথেষ্ট আছে, পেশায় পুলিশ অফিসার , ভবিষ্যত উন্নতির উজ্জল সম্ভাবনা। এর চেয়ে ভালো বর আমি আর কি আশা করতে পারি! তাছাড়া পছন্দ আর অপছন্দ সে তো বাপ-মারাই করবে। এ বিষয়ে আমি কথা বলার কে ?
বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়িতে ঘুরে-ফিরে কয়েকটা বছর কেটে গেল। আমার স্বামী যখন মিরাটে পোস্টেড সে সময় আমি স্থায়ী ভাবেই তার সঙ্গে । বাড়িতে যেতাম। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীরা স্বামীদের সম্পদ, বিশেষ করে সেই……… যদি সুন্দরী হয়। এখন আমাকে দেখে আমার যাই মনে হোক না কেন, একসময় আমি কিন্তু সুন্দরী বলে পরিচিত ছিলাম। আরো এক অবিশ্বাস্য …………, রামপুর এস্টেটের সেই পর্দানশিন মেয়ে তখন নিজেই মোটর ড্রাইভ করতে পারে। আমার স্বামীই আমাকে শখ করে শিখিয়েছে।
এ পরিবর্তন গুলি বড় কম নয়। কিন্তু এর চেয়েও বড় পরিবর্তন আমার জীবনে নেমে এল। এটাকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বলতে পার। একদিন আমার স্বামীর সঙ্গে তার ‘বস’-এর বাড়িতে গিয়েছিলাম। মাঝে-মাঝেই সেখানে যাওয়া-আসা করতাম। কিন্তু একদিন সেখানে গিয়ে যে ঘটনাটা ঘটল তা আমার জীবনে অবিস্মরণীয়। আমার স্বামীর ‘বস’-এর বাড়িতে আমরা কজন বসে চা খাচ্ছিলাম।
ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেই বৎসরটি থাকতে তোমার জানা

বর্ষা উৎসব-১৪২১
অনুষ্ঠান সূচি :
৭.০০-৭.১০ যন্ত্রসঙ্গীত
৭.১০-৭.১৫ দলীয় নৃত্য
৭.১৫-২৫ অগ্নিবীণা শিল্পকলা বিদ্যালয় (দলীয় সঙ্গীত)
৭.২৫-৭.৩০ দলীয় নৃত্য (হ্যাপি হোমস্)
৭.৩০-৭.৪০ ……..
৭.৪০-৭.৫০ ক্ল্যাসিক্যাল
৭.৫০-৭.৫৫ মেঘদূত (ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়)
৭.৫৫-৮.০০ উদীচী মিরপুর শাখা (দলীয় সঙ্গীত)
৮.০০-৮.০৫ উদীচী গেন্ডারিয়া শাখা (দলীয় সঙ্গীত)
৮.০৫-৮.১০ উদীচী পল্লবী শাখা (দলীয় সঙ্গীত)
৮.১০-৮.১৫ দলীয় নৃত্য (বহ্নিশিখা)
৮.১৫-৯.০০ আড্ডা (সঙ্গীত ও আবৃত্তি)
৯.০০-৯.১৫ বর্ষা কথন
৯.১৫-৯.২০ স্পন্দন (দলীয় নৃত্য)
৯.২০-৯.৪৫ উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদ
৯.৪৫-৯.৫০ নটরাজ (দলীয় নৃত্য)

হাসেম খান

বর্ষা Ñ ষড় ঋতুর ২য় ঋতু।
গ্রীষ্মের খরতাপে ধরিত্রি যখন দগ্ধ হচ্ছে মাটি ফেঠে চৌচির, গাছপালা শুকিয়ে বিবর্ণ চেহারা, নদীর পানি, বিলের পানি, পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। চাষবাসে দেখা দেয় নানাবিধ জটিলতা। মানুষ, পশুপাখি গাছ-পালা, নদী-নালা আকাশ বাতাস সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন ‘বর্ষা’ আসবে-ঝির-ঝির, ঝর-ঝর ধারায় নামবে বৃষ্টি-শান্ত হবে প্রকৃতি।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। গ্রীস্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। প্রত্যেক ঋতুরই আছে ভিন্ন ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট গুলোই নানাভাবে প্রভাবিত করে বাংলার মানুষকে, তাদের চালচলন, আচার আচরনে, শিক্ষা- সংস্কৃতি চর্চা ও জীবন যাপনে কখনো প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। গ্রীস্মের প্রচন্ড গরমের শেষে এসে ‘বর্ষা’ মানুষের কাছে, প্রকৃতির কাছে আকাঙ্খিত ঋতু। ঝির ঝির ঝড়ে ভালোবাসার বৃষ্টি। বৃষ্টি পেয়ে গাছপালা সবুজ সতেজ রঙের অবগোহনে মেতে ওঠে, খাল-বিল, নদীও মাঠে থৈ থৈ পানির প্রয়োজনীয় প্রান চাঞ্চল্যে সর্বত্রই আনন্দের নাবন। যদিও কখনো কখনো অতি বৃষ্টিতে ও বন্যায়, জীবন যাপনে মানুষের বিড়ম্বনা ও কষ্টের কারন হয়ে দাড়ায়- তারপরেও বর্ষাকে মানুষ ভালোবাসে।
সেই কবে- বহুকাল আগে লিখিত মহাকবি কালিদাসের মেঘদূত কে নিয়ে এ কালের মহাকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেনÑ
কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন পূণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘচন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিযাছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘন সংগীতমাঝে পুঞ্জিভূত করে

সেদিনের পরে গেছে কত শতবার
প্রথম দিবস ¯িœগ্ধ নব বরষার।
প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের পরে করি বরিষন
নববৃষ্টি বারিধারা, করিয়া বিস্তার
নবঘন ¯িœগ্ধচ্ছায়া, করিয়া সঞ্চার
নব নব প্রতিধ্বনি জলদমন্দ্রের.
স্ফীত করি ¯্রােতোবেগ তোমার ছন্দের
বর্ষাতরঙ্গিনীসম

উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী বর্ষার আগমনীকে সাদরে ও আনন্দে আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলার মানুষের হৃদয়ের সজীবতা হেলে দুলে নড়ে উঠুক। আষাঢ়ের বৃষ্টি শীতল পানিতে ধয়ে যাক, মুছে যাক যতো গ্লানি, দু:খ ও কষ্ট। বৃষ্টির ঝির ঝির আর ঝর ঝর ছন্দে ও সুরে কেন গেয়ে উঠছিনা ভালবাসার গান, আনন্দের গান।
“হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল-
সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল
কোন ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে+Ñ
বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

উৎসবে মাতোয়ারা আজ বর্ষাবরনে
কামাল লোহানী

এলো বরষা, সহসা মনে তাই বুঝি দোদুলছন্দে
নেচে উঠলো মনটা মহানন্দে
জগতের প্রচন্ড গ্রীষ্মহরণ করে এই বুঝি স্বস্তি নিয়ে এলো সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। আজ কেমন যেন এই পৃথিবীটা তারই সৃষ্ট নিয়ম কানুন মানছেনা। ষড়ঋতুর দেশতো বাংলাদেশ। তাই আজ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস সূর্যকে আবাসন করে গানে নাচে কবিতায় ওকে মুগ্ধ করতে চাই যে চিরন্তর রীতি তার কি হলো, প্রকৃতি বিরূপ কেন? আষাঢ়-শ্রাবণ এই দুই মাসতো বর্ষার জন্য, যেন সেই সময় মানুষ স্বস্তির জীবন যাপন করতে পারেন। বরষায় ঐ ভৈরব গর্জনে নিপাতির বারিধারায় যেন শিক্ত না হয় গ্রামাঞ্চল। আবার গাইতে যেন না হয়
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে ধান দেব মেপে
আয় রিমঝিম বরষারা গগনে রে…..
প্রকৃতির ¯িœগ্ধ বারিধারায় সিঞ্চিত নগর কিংবা গ্রাম জীবন স্বস্তি ও আনন্দে, ফলে ও ফসলে ভরে উঠে, তাইতো মানুষের প্রানে আসে প্রবল আনন্দ, আয়োজন হয় উৎসবের। ——-। নতুন ধানের ঘাসে বাসে, সবার ঘরে নেমন্তন্ন পৌছে যায়। সে নেমন্তন্নে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির অপূর্ব সম্মিলন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় কী অসাধারন আয়োজন, স্বত:স্ফূর্ত আয়োজন চলে দিকে দিকে। হিন্দু না ওরা মুসলিম কেউ জিজ্ঞেস করে না। পরবের গরবে মানুষ ধন্যবাদ। তাই বৈসম্য কোন স্থান পায় না এখানে। সবাই ভাই- বোন মিলে জেগে উঠে জননী জন্মভূমি সন্তানের গৌরবে। জ্যৈষ্ঠের পর যখন আষাঢ় আসে তখন ভরা নদী ক্ষুরধারা, যা টেনে নিয়ে যায় হিংসা বিদ্বেষ। মানুষের বুক মেলে মানুষেরই সাথে। জীবন গর্বিত হয় সখ্যতার এই অপূর্ব সৌরভে। উৎসবে মেতে উঠে মানুষ নতুন ফল ফলাদিকে উপলক্ষ্য করে। অথচ এই সম্মিলিত মানবশক্তি চান এমন শান্তির পৃথিবী গড়তে, কিন্তু একে রুখে দেবার উন্মাদ উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের স্বজ্জনেরা সংগ্রামে লিপ্ত লড়াকু চরিত্রগুলো একত্রিত হয় সব মানুষের উৎসবে। তারা জানেন এ বিশ্বটা আমাদের সকলের, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, মুসলমান সকলের। সুতরাং ভ্রাতত্বপ্রেমের বন্ধন যাবে কোথায় ? এমনি শান্তিপ্রিয় পৃথিবীর বিরুদ্ধে মানুষ নামেরই এক পশুশক্তি দেশটাকে হিংস্্র পাশবিকার গহবনে টেনে নিয়ে ফেলে। আমরা মানুষ অনেক কিন্তু হিং¯্র পিশাচ যখন মুখবাদান করে ছুটে আসে ভীতির সহ্যতার হয়। আমরা ভয় পাই। ভয় না পেয়ে যদি রুখে দাড়াতে পারি তবেই মানুষের জন্য হয়।
প্রকৃতি আমাদের বন্ধু। সেই প্রকৃতি এত চমৎকার পরিবেশটাকে নস্যাৎ করে দিতে প্রবল বর্ষায় নেমে আসে প্লাবনের সৃষ্টি করে যেন মৈত্রীর বন্ধন ছুটে যায়, প্লাবনের তোড়ে যেন এক অপরের হাত ছেড়ে চলে যেতে বাদ্য হই। সেই জলোচ্ছাস ঘরবাড়ি, বাড়ি, পশুপাখি, গাছপালাকে ও মানুষের মত ছাড় দেয় না। মানুষের বাড়িঘর ডুবে, ¯্রােতের টানে ভেঙ্গে যায় দুর কোন গায়ে অথবা প্রান্তরে। আর গাছপালাও তেমনি ভেসে চলে জলধারায় প্রবল টানে। আসাম এলাকা থেকে আসা ঐ জলরাশিতে গরু, মহিষ যেমন ভেসে চলে তেমনি বিশালকায় বিষধর সাপও মৃতদেহ নিয়ে অসহায় জলে বাসা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। নদী পথে চলা এই জলরাশির উপচে পড়া প্রবল চলতি জন্তু-জানোয়ার, গাছপালা আবার নদীর দুপাশের মানুষ গুলো গাছপালা তুলে নিজেদের সম্পদ বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে যান। যে যেন আরেক ধূম। এ বর্ষার ঢল।

কিন্তু বর্ষার আগমন যখন ঘটে আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে কবি জিজ্ঞেস করেন কালিদাসকে। কবিবর কোন বিস্তৃত বষষে লিখেছিলে ‘মেঘদূত’। সেখানে কবি গুরু লেখেন :
ঐ আসে ঐ তাতি ভৈরব বভসে
জল সিক্তিত ক্ষিতি সৌরভ বভসে
…… গৌবতে নবযৌবন বরষা
স্যাম গম্ভীর সরসা।

বর্ষা মৌসুমে এক নব উস্মিমম কবির কল্পনায় যেমন তেমনি বাস্তবেও যেন। কিন্তু প্রবল বৃষ্টি আর কড়কড়ে বজ্রপাত যখন কানে তালা ধরায়, তখনতো গৃহবাসী ঘরের কোণেও জড়োসড়ো হয়ে জবুথব হয়ে বসে থাকে। বর্ষা নানারুপে আসে জীবনে। কখনও আনন্দে, কখনও বেদনার্ত চরিত্র নিয়ে। তবে বর্ষা যে চাই সময় মতন ফসলের ক্ষেতে, না হলে কত যে ফসল অঙ্কুরেই সহস হয়ে যায়। অনাবৃষ্টি যখন চাষীর কলাপ চোকে, তেমনি অতিবৃষ্টি বুকের হলে সেচ দেয়া যে ফসলের কাজ গোনে কৃষককে হতাশায় ডুবিয়ে ছাড়ে। নিক বছরই তো এমন পোহাতে হয় যারা উৎপাদক তাদের।
তাইতো বর্ষার উচার আবার নিষ্ঠর। মানবকে মানবেতর করতে খুব একটু ভাবেও না। বর্ষনার করুণা বলে বোধ হয় কিছু নেই। তবু বর্ষা এলে স্বাভাবিক জীবন বনার্ঢ্য বর্ষাবরণ উৎসব ভোলেন বটে গ্রামবাংলা ……… পারে না খুব সহজে। অবশ্য নগরও প্লবনের দাপটে বন্যায় করলে পরে অনেক সময় বন্যা হয়ে যায়। এখনতো বাংলায় নদী গুলো শুকিয়ে …………. জলধারা বাহিত পলিমাটিতে একবারে ভরাট হয়ে যায় এমনই আকার ধারণ করে যে, বর্ষার আগমনে যে আনন্দবাগ বইবার কথা তা আজ আর বাংলার মানুষের …….. বয় না। বর্ষা এখন দুঃখ দেয় কেবল। ছোটবেলায় স্মৃতির বষর্ষায় আমবাগানে ছোটাছুটি, ঝড়ে পড়ে যাওয়া আম কুড়িয়ে খাবার সে আনন্দ এখন আর নেই।

এবারের খরতাপদগ্ধ ………………………. বাস করতে পারে সবাই গ্রামে কি শহরে স্বস্তি খুজতে গিয়ে বর্ষা কেন আসে না, তার পাতা লাগিয়েছে। জলবায়ু দুষনের এমন অভিশাপ বহর করছি আমরা যে বৃষ্টির কৃপন আমাদের একেবারে শাস্তি দেবার পর্যায়ে নিয়ে ফেলেছে। আজ বাংলার মাটিতে নদীর যে ধারা নিয়ে ফেলেছে।

পাহাড় থেকে ঢল আসছে না। নদীতে জল নেই বলে মাঝির গলায় সেই প্রিয় গান শুনতে পাই না।

“পানবিনে ঠোঁট কালো তোমরা
রুপশালী ধানভানা রুপ দেখ তোমরা”
কী অপূর্ব বাংলা আজ শুকনো মরুভুমি না হলেও কাঠখোটকা জীবনের কন্কাল হয়ে গেছে। কেউ জল দিছে না অভিযোগ শুনি। কিন্তু নিজেরা নদীগুলো দখল না করেপুণখনননের ব্যবস্থা যে করছি না তা কোথায় দেখি না।

“আয় বৃষ্টি ঝেপে আয়রে ধান দেবো মেপে
আয় রিমঝিম বরষার গগনে আয়রে।
কাঠফাটা রোদ্দুরের আগুনে
আয় বৃষ্টি ঝেপে আয়রে ধান দেবো মেপে
আসুক বৃষ্টি ঝেপে ভিজবো সবাই মিলে। কী আনন্দ!

মুঠোবন্দি মন
পাবলো নরেুদা

আরো একটি গোধূলি এলো গলে।
চরাচরজুড়ে নীল রাত নামছ,ে
অথচ সন্ধ্যায় আমাদরে হাত-ধরাধরি হাঁটাই হলো না।

আমি জানালা দযি়ে দখেলাম
অনকে দূররে পাহাড়চূড়ায়
র্সূযাস্তরে উৎসব বসছে।ে

কখনো কখনো আমার হাতরে তালুতে
মুদ্রার মতো
একটুকরো র্সূয পুড়তে থাক।ে

মনটা বষিণ্ণ –
তোমার কথা খুব মনে পড়ছলি
যে মনরে কথা তুমি ছাড়া বশেি কে জান!ে

তুমি কোথায় ছলিে তখন?
সাথে আর কে ছলি?
কী কথা তাহার সাথ?ে
যখন মনটা খুব খুব খারাপ থাকে
টরে পাই, তুমি অ-ন-েক-দূ-র,ে
বলো তো তখন হঠাৎ সব ভালোবাসা আমাকে পযে়ে বসে কনে?

গোধূলি এলে আমার পড়ার বন্ধ বইটা হাত থকেে পছিলে পড়,ে
চোট পাওয়া কুকুররে মতো আমার নীল সোয়টোরটি
আমারই পায়রে কাছে গড়াগড়ি যায়।

প্রতটিি দনি সন্ধ্যা এলে
তুমি সন্ধ্যাকে পছেনে ফলেে
স্মৃতরি র্মূতি মুছে ক্রমশ এগোতে থাকো গোধূল-িদকি।ে

ভাষান্তর: সুরশে রঞ্জন বসাক