“আমরা পার্টিতে এসেছিলাম গান করার জন্য নয়, বিপ্লব করার জন্য” -হেমাঙ্গ বিশ্বাস :জাকির তালুকদার

রেললাইনের পূর্ব পাশে বিহারি-কালোনির পরের চত্বরেই শেকলঘেরা কুড়িফুট উঁচু শিবলিঙ্গের সদৃশ সাদা চুনকাম করা সিমেন্টের গায়ে আলকাতরা-কালো কালিতে ‘ঈমান-একতা-শৃঙ্খলা’ লেখা জিন্নাস্মারক থেকে শুরু হয়ে মোটামুটি সরলরেখার মতো আয়ুব খানের উন্নয়ন-দশকে বানানো ষাটফুটি সড়কটিই আমাদের লোকালয়ের রাজপথ। এলোপাথারি গড়ে ওঠা জমাটি রিক্সাস্ট্যান্ড আর একঘোড়ার প্রায় উচ্ছন্নের পথে যাওয়া টমটমস্ট্যান্ডের সামনে-পেছনে ভাতের হোটেল, হোলসেল ওষুধের দোকানগুলোর সারি, জুটমিলের পাটক্রয়কেন্দ্র, মারোয়াড়িদের ডাল-খোল-ভূষির গুদাম এবং গদি দেখতে দেখতে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলে সড়ক। তারপর জেলার সবচেয়ে বড় কলেজ, টুকটাক কিছু অফিস-দোকান, আর নোয়াখালিপাড়ার কসাইদের গোস্তের দোকান দেখা পাওয়া যায় শহরের প্রাণকেন্দ্রের সিনেমা হলের আগপর্যন্ত। তারপরেই বাসস্ট্যান্ড পেরুলেই আবার ফাঁকা ফাঁকা কয়েকটা দালানকোঠা ছাড়া মাদ্রাসা মোড়ের আগে আর জমজমাট কোনো জনসমাবেশ পাওয়া যাবে না। ঢাকার বিক্রমপুর আর কুমিল্লা থেকে আসা বাস্তুহারাদের পাড়া কাছেই বলে মাদ্রাসা মোড়কে আমাদের শহরের আদি বাসিন্দারা কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের সাথে ডাকে ঢাকাইয়া মোড় বলে। তো এই পর্যন্ত এসেই নিজের বিস্তারের দৈর্ঘ্যরে সমাপ্তি ঘোষণা করেছে আমাদের আড়াই কিলোমিটারের ছোট্ট রাজপথ। সেই রাজপথ দখলের সংগ্রামে সম্মুখ সারিতে দেখেছি আমাদের জনপদের সবচেয়ে মেধাবী তরুণদের, উজ্জ্বল যুবাদের আর জনপদে সবচেয়ে সৎ এবং প্রাজ্ঞ বলে পরিচিত বয়স্কদের। হতাশার নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত তাদের দখলেই ছিল আমাদের রাজপথ। আর সেই রাজপথ দখলের সংগ্রামে যেসব হাতিয়ার ছিল তাদের হাতে, সেগুলির মধ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানগুলি ছিল একাগ্নি বানের মতোই অন্যতম প্রধান আয়ুধ।
শহীদ হওয়াটা বাংলাদেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। বিপ্লবী প্রচেষ্টার জন্য তো বটেই, এত সব তুচ্ছ ও প্রকৃতির মতো স্বাভাবিক মানবিক-নাগরিক অধিকারের জন্য আমাদের শহীদ হতে হয় যেমনটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যবাদী এবং ফ্যাসিস্ট দেশগুলিতেও অকল্পনীয়। কোনো এক কবি বোধহয় লিখেছিলেন, ছায়াপথের নক্ষত্রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠে আমাদের শহীদের সংখ্যা। আর তাই মাঝেমাঝেই গান বাজত আমাদের জনপদের বাতাসেÑ আমরা তো ভুলি নাই শহীদ একথা ভুলব না/ তোমার কইলজার খুনে রাঙ্গাইল কে আন্ধার জেলখানা!
হেমাঙ্গ বিশ্বাস শুধু গান করার জন্য গান করেননি, গান বান্ধার জন্য গান বান্ধেননি সে কথা সবাই জানে। অন্তত শিল্পীখ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে ‘করে খাওয়া’র মধ্যবিত্তসুলভ লুম্পেন মানসিকতা তাঁকে কোনোদিনই আচ্ছন্ন করতে পারেনি। কারণ তিনি গানের জন্য গান করেননি, করেছেন বিপ্লবের জন্য। সেই নিরিখে বিচার করলে হেমাঙ্গ বিশ্বাসই আমাদের একমাত্র বড় শিল্পী যিনি তাঁর গান বা সৃজিত শিল্প বিক্রি করেননি। অথবা বলা যায়, শিল্পের নামে নিজেকে বিক্রি করেননি। এই কথাটা বলা যত সহজ, কাজে পরিণত করা যে কত কঠিন তা সবচেয়ে ভালো বলতে পারে তারাই যারা নিজেদের বিক্রি করতে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছেন।
সিলেটের হবিগঞ্জের ছোট-খাট জমিদার অথবা বড়সড় জোতদার পরিবারের সন্তান হেমাঙ্গ বিশ্বাস শিল্পীজীবনের শুরুতেই পিতৃপরিবার থেকে বহিস্কৃত হলেন। অপরাধ তাঁর শিল্প এবং রাজনীতি। এটুকু অন্তত ধারণা করা যায়, রাজনীতিটা না করলে শুধু শিল্প তথা গণসঙ্গীতের জন্য হয়তো তাঁকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না। আবার কমিউনিস্ট পার্টি যে তাঁকে খুব ভালোভাবে মূল্যায়ণ করেছে, বা তাঁর প্রতি সুবিচার করেছে- এমনটিও বলা যাবে না। কারণ ঐ একটাই। হেমাঙ্গ বিশ্বাস সবসময় পার্টিলাইনের সঙ্গে একমত হতে পারতেন না। প্রতিমুহূর্তে মিলিয়ে নিতে চাইতেন নিজের ও নিজেদের কার্যক্রম মতাদর্শ এবং মানবমুক্তির সংগ্রামের সাথে হাত ধরাধরি করে চলছে কি না। জীবনের শেষ পর্বে এসে যে কমিউনিস্ট পার্টির সকল অংশের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, তার কারণও ছিল পার্টির লাইনকে মানবমুক্তির সহায়ক মনে না করে অন্তরায় মনে করা। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম এবং বামফ্রন্ট যখন সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করল, তখন সুবিধার হালুয়া-রুটির লোভে অনেকেই নিজ নিজ ক্ষোভ চেপে রেখে ওপরে ওপরে পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছিলেন। কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস পারেন নি নপুংশকদের কৌশল গ্রহণ করতে। কারণ সেই ১৯৫৫ সাল থেকেই তিনি প্রকাশ্য মঞ্চে বলে আসছিলেন যে পার্টি তথা শিল্পীদের যে প্রধান সমস্যা তা হচ্ছে আদর্শগত দুর্বলতা। সেই আদর্শগত দুর্বলতার কারণ আবার আমাদের দেশের সংস্কৃতির ইতিহাস এবং আমাদের ঐতিহ্যের ধারা সম্পর্কে আমাদের শিল্পীদের অজ্ঞতা।

০২.
ঘোষণাপত্রে, মুখে এবং শ্লোগানে বিপ্লবের কথা বললেও, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মনে এই সন্দেহ ঢুকে পড়েছিল যে কমিউনিস্ট পাটির্ বিপ্লবের ব্যাপারে ঠিক আন্তরিক তো নয়ই, কিছুটা যেন ভীতও। ব্রিটিশ আমলের শেষদিকে বোম্বাইয়ের নাবিক-বিদ্রোহ সংঘটিত হলো। ‘খাইবার’ নামক ক্রুজারের নৌসেনারা বিপ্লবের পতাকা তুলে ধরলেন। তাঁদের সাথে যোগ দিল বোম্বাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিক। কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন নেতৃত্বের ভূমিকা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে, ছিল পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতার। বিপ্লবী নাবিকরা কমিউনিস্ট পার্টিকে আহ্বান জানালেন এই বিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু হওয়া বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণের। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সাহস পাননি। তারা নাবিক-শ্রমিকদের আহ্বান উপেক্ষা করে তাদের বললেন কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের কাছে যেতে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিচারণায় তীব্র শ্লেষের সাথে উল্লেখ করেছেন সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে মার্কস-লেনিনের ছবির পাশাপাশি গান্ধি-জিন্না-নেহরুর ছবি টাঙিয়ে রাখার কথাও। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছিলেন- ‘নীল সমুদ্র লাল করে গেল/ নাবিকের রক্তধারা/ তারাও তো শুনেছে আমাদের ডাক/ তারাও তো দিয়েছে সাড়া।’ কিন্তু বেদনাহত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো হাজার হাজার পার্টিকর্মী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখলেন বিপ্লবের আহ্বানে সাড়া দিতে তাদের পার্টিনেতৃত্বের সুস্পষ্ট অনীহা।
তেলেঙ্গানা-কাকদ্বীপের কৃষক অভ্যুত্থান এদেশের শ্রমজীবী মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল। সেই অভ্যুত্থানের পবিত্র আগুনকে নিজে নিজে নিভিয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেদের মধ্যে শুরু করেছিল কাপুরুষতা এবং সংশোধনবাদের জয়যাত্রা। কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরিণত বয়সের বিশ্লেষণ জানাচ্ছে যে পার্টির মধ্যে আপোসকামিতা ও দোদুল্যমানতা অনেক আগে থেকেই বিস্তৃত হচ্ছিল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাছে মনে হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পার্টি যে ভূমিকা পালন করেছে, তা কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পার্টির কাছ থেকে আশা করা যায় না। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধের চরিত্র বদলে গিয়েছিল, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যেহেতু সোভিয়েত ইউনয়ন মিত্রশক্তির সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করছিল, তার ফলে এই দেশে পার্টি ব্রিটিশদের বিরোধিতা বন্ধ করে তার পক্ষে প্রচারণা শুরু করে দেবে এমনটি আশা করতে পারে না কেউই। কিন্তু সেটাই ঘটেছিল। জার্মানি বা জাপানের বিরোধিতায় দেশজাগানোর মন্ত্র প্রচার করে চললেও দুইশো বছরের ঔপনিবেশিক প্রভু ব্রিটেনের বিরোধিতা বন্ধ করে দিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি। পৃথিবীর অন্য দেশের পার্টির মতো সশস্ত্র গণবাহিনী গঠন করে, নিজেদের উদ্যোগ সম্পূর্ণ বজায় রেখে ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধপ্রয়াসের সহায়তা করার বদলে পার্টি পুরো উদ্যোগ তুলে দিল ব্রিটিশের হাতে, আর নিজেরা হয়ে পড়ল ব্রিটিশের লেজুড়। সেই সময় সারাভারতব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। পার্টি নিজেকে সেই জোয়ার থেকে সরিয়ে তো রাখলই, উপরন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কর্মকা-কে ‘পঞ্চম বাহিনী’র ষড়যন্ত্র বলে প্রচারণা চালাল। সেই সময় যে গানই লেখা হোক না কেন, তাতে পার্টির নির্দেশে দখরহশ-ঁঢ়’ কিংবা দধিু-ড়ঁঃ’ দিতে হতো। তার অন্য নাম শ্রেণীদ্বন্দ্বের পরিবর্তে শ্রেণী সহযোগিতা। সেই ধারায় গান লিখতে হয়েছে খোদ হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং সত্যেন সেনদেরও। স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজেদের অবস্থান পেছনে রেখে কমিউনিস্ট পার্টি তখন বারবার রোবটের মতো আহ্বান চালিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেস-লীগ একতার। (এই প্রসঙ্গে মনে পড়বেই যে কোনো জাতীয় সমস্যায় আমাদের দেশে তথাকথিত সুশীল সমাজের মতো বামদলগুলোও জপ করতে থাকে দুই নেত্রীর একত্রিত হওয়ার আহ্বানমন্ত্র)। ১৯৪২-৪৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি সারা দেশজুড়ে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে- তোরা আয়, আয়রে ছুটে আয়-/ এ ভারতের হিন্দুমুসলিম কে আছ কোথায়/ স্বাধীন হাওয়া লাগল পালে স্বরাজের নৌকায়/ কংগ্রেস-লীগ এক হয়ে ভাই সেই তরণী বায়।
কমিউনিস্ট পার্টি বলছে শুধু কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের কথা। নিজেদের নাম নিজেরাই নিচ্ছে না। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের আত্মশাসনের নামে পাকিস্তান প্রস্তাবকেও প্রকারান্তরে সমর্থন জানাচ্ছে। আবার দেশভাগের আগে আগে সিলেট অঞ্চলকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে। কারণ, পার্টিনেতারা ধারণা করছেন যে ভারতে হিন্দু-মুসলিম জনতার, বিশেস করে হিন্দুর, গণতান্ত্রিক অধিকার পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি বিরাজমান থাকবে।
সন্দেহ নেই, কমিউনিস্ট পার্টির ডানবিচ্যূতির প্রতিবাদ করতে করতে হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজেও মাঝেমাঝে বামবিচ্যূতির শিকার হয়েছেন। এই কারণেই পার্টির ভাঙনের পরে সিপিএমকে সমর্থন করা, সিপিএম সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দিলে তা থেকে বেরিয়ে আসা, এবং পরবর্তীতে নকশালবাড়ি-অভ্যুত্থানকে সমর্থন করার মতো ঘটেছে তাঁর জীবনে। শেষ জীবনে পার্টির কোনো অংশের সাথেই থাকেননি। কারণ তিনি মনে করতেন পার্টিগুলি বিপ্লব করতে তো চায়ই না, উল্টো বিপ্লবকে ভয়ই পায়। চীনে বহুল প্রচলিত একটি গল্পকে উদ্ধৃত করতেন তিনি-
একসময় চীনের এক রাজা ড্রাগনের খুব ভক্ত ছিলেন। তিনি তার রাজ্যের সর্বত্র ড্রাগনের ছবি আঁকতে বলতেন। আর রাজবাড়িতে তো কথাই নেই। রাজবাড়ির দরজা-জানালা-দেয়ালে শুধু ড্রাগনেরই ছবি। একরাতে আকাশপথে উড়ে যেতে যেতে ড্রাগন ভাবল, রাজা যখন তার এত বড় ভক্ত, তখন তার অন্তত একবার রাজাকে দেখা দেওয়া কর্তব্য। সে নেমে এলো রাজার শোবার ঘরের কাছে। রাজা তখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। রাজার ঘর বিশাল বটে, কিন্তু ড্রাগনের শরীরের তুলনায় সেটি কিছুই নয়। ড্রাগন কোনোমতে নিজের লেজটিকে জানালা দিয়ে রাজার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে সকালের অপেক্ষা করে রইল। সকালে ঘুম ভেঙে রাজা ড্রাগনের লেজ দেখেই ভয়ে অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরলেই আবারও অজ্ঞান। মাথায় পানি-টানি ঢেলে জ্ঞান ফেরাতে না ফেরাতেই আবারও অজ্ঞান।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস খুলে বলতেন না যে ড্রাগনকে বিপ্লবের জায়গায় এবং রাজাকে কমিউনিস্ট পার্টির জায়গায় কল্পনা করে নিতে হবে।

০৩.
জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টুকু পার্টির জন্য ব্যয় করার পরে যখন সেই পার্টিনেতৃত্বের প্রতি আস্থা টলে যায়, তখন আর একজন মানুষের নিজের অবলম্বন বলতে থাকেটা কী? এমন ঘটনা ঘটেছে লক্ষ লক্ষ পার্টি-কমরেডের জীবনে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো সৃষ্টিশীল মানুষের তবুও তো একটা অবলম্বন থাকে। তাঁর ছিল গান। হাঁপানি রোগ কিংবা ফুসফুসের যক্ষা তাঁর গানকে কেড়ে নিতে পারেনি। কিন্তু রাজনীতিশূন্যতা যত তীব্রভাবে আক্রমণ করেছিল তাঁর গানকে, সেই আক্রমণ যে কোনো রোগের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকারক। তবু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গী ছিল গণসঙ্গীত। ততদিনে বাংলাদেশ তো বটেই, সারা ভারতবর্ষেই গণসঙ্গীতের সঙ্গে পরিপূরকভাবে উচ্চারিত হতে শুরু করেছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম। গণসঙ্গীতকে তিনি বিপ্লবের হাতিয়ার বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। আর সে কারণে তাঁকে গণসঙ্গীতের সঠিক চরিত্র নিয়েও বিতর্কে লিপ্ত হতে হয়েছিল সমকালীন গায়ক-সঙ্গীতকারদের সঙ্গেও। সে বিতর্ক, বলাই বাহুল্য, অমীমাংমিত আজও। শিল্পের কোনো শাখা নিয়েই যেমন কোনো শেষ কথা বলা যায় না। তেমনই গণসঙ্গীতের বিতর্কও আজও জারি রয়েছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথে আমাদের সঙ্গীতজগতের আরেক দিকপাল সলিল চৌধুরীর নান্দনিক বিতর্ক আমাদের দেশের নন্দনতত্ত্বের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রয়েছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে তেলেঙ্গানা-আন্দোলনের ব্যর্থতার পরে হতাশ সলিল চৌধুরী গানের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় ফরমালিজমের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন। পাশ্চাত্য অর্কেস্ট্রেশনের প্রতি সলিল চৌধুরীর দুর্বলতা ছিল আগে থেকেই। সে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান এবং দক্ষতাও ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত ফরমালিজম-প্রীতিকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই বলে নিন্দা জানিয়েছিলেন যে, সলিল চৌধুরী বাংলার গণসঙ্গীতকে তার জাতীয় চরিত্র থেকে দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কসমোপলিটনিজম-এর দিকে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এককথা, কমিউনিস্ট শিল্পীর গান হবে স্ট্যালিনের মতের অনুসারিÑ ‘বিষয়ের দিক থেকে আন্তর্জাতিক, আর আঙ্গিকের দিক থেকে দৈশিক।’ এই সূত্র অনুসারে হেমাঙ্গ বিশ্বাস জনগণের সামনে গণসঙ্গীত উপস্থাপনার সময় লৌকিক মাধ্যমের ওপরেই জোর দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে অবশ্য হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজের চিন্তার মধ্যে একপেশে চিন্তার ছাপ ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। এবং শুধরে নিতে পেরেছিলেন নিজের চিন্তাকে, যে শক্তি কেবলমাত্র সত্যিকারের বিপ্লবী শিল্পীর মধ্যেই বিদ্যমান থাকে।
এই রাজনৈতিক এবং শিল্পের আদর্শবাদ নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন আরও অনেকের সঙ্গেই। যেমন বিজন ভট্টাচার্য। বিজন ভট্টাচার্য তাঁর ‘নবান্ন’ নাটকের মাধ্যমে বাংলা নাটকের জগতে বিপ্লব এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাস, এই নাটককে তার প্রাপ্য সমস্ত প্রশংসা প্রদান করার পরেও সমালোচনা করেন এই বলে যে, ‘নবান্ন’ নাটকের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতিগত বন্ধ্যা লাইনের ছাপ পুরোপুরিই রয়ে গেছে। সেখানে শুধু দুঃখ, শুধু কান্না, আর জনগণের শত্রু বলতে এক ঐ মজুতদার। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দেশজুড়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির জন্য দায়ী, সেই ইংরেজ শাসকের কথা নাটকে একটি বারের জন্যও উল্লেখিত হলো না। রাজনৈতিক দিক থেকে তাই তার মূল্য মোটেই বেশি হতে পারে না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বললেন যে, দীনবন্ধু মিত্র তো তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকে অন্তত একজন তোরাপ চরিত্র সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, কিন্তু ‘নবান্ন’ নাটকে তেমন একটি চরিত্র সৃষ্টি হতে পারেনি শুধুমাত্র ভুল রাজনৈতিক দৃষ্টির কারণে।
একই কারণে তাঁর চোখে সমালোচিত জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রও। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতে, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’ সুর এবং রচনা উভয় দিক থেকে এক অসাধারণ সৃষ্টি। নাগরিক সংস্কৃতিতে রূপান্তর আনার চেষ্টাটি ছিল পুরোপুরি লক্ষণীয়। এই নৃত্যনাট্যে রাগসঙ্গীতের অপূর্ব ব্যবহারের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কিন্তু তিনি এখানেও প্রশ্ন তোলেন রাজনীতি নিয়েই। বিজন ভট্টাচার্য এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এবং তাঁর এই পর্যবেক্ষণ যে সঠিক ছিল তা বোঝা যায় পরবর্তীতে, বিশেষ করে, ১৯৪৬ সালের পরে কমিউনিস্ট পার্টি জঙ্গি আন্দোলনের লাইন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই উপরোক্ত দুজনের গণনাট্য আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাওয়ার ঘটনায়।
একইভাবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তীব্র সমালোচনা করেছেন হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানী সেন, এবং পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পূরণচাঁদ যোশীরও। তাঁদের ব্যক্তিজীবন নিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু তিনি আপোসহীন তাঁদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে।
তবে হেমাঙ্গ বিশ্বাস চিরকাল শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন তাঁর প্রিয় জর্জদা বা দেবব্রত বিশ্বাসের প্রতি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেবব্রতই একমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী যিনি নিজে অরাবীন্দ্রিক। দেবব্রত বিশ্বাসের জীবনচর্যায় যেমন রবীন্দ্রঘরানা ছিল না- সঙ্গীতেও তিনি তেমনই কোনো ঘরানায় বন্দি ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাউকে তিনি গুরু মানতেন না। মায়ের সঙ্গে ছোটবেলায় ব্রাহ্মসমাজে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন বটে, কিন্তু পরবর্তীতে ব্রাহ্মসমাজেরও ধার তিনি ধারতেন না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস একটু বিদ্রুপের সুরেই জানিয়েছেন যে, প্রেম হোক প্রকৃতি হোক আর পূজা পর্বেরই হোক- রবীন্দ্রনাথের সব গানকেই ‘পেলব ঢঙ এবং এলানো ছন্দে’ গাইতেন সবাই। তাই কলকাতায় প্রথম দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে চমকে উঠেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ‘এভাবেও রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া যায়!’ হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানাচ্ছেন যে- ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো’ কিংবা ‘বাঁধ ভেঙে দাও’ গাইতে গিয়ে বিশেষ বিশেষ শব্দ জর্জ বিশ্বাস এমন স্বরাঘাতে উচ্চারণ করতেন যে পুরো গানের আবহটিই পুরুষকারে ভরে উঠত ও অসম্ভব এক গতিময়তা লাভ করত। তথাকথিত ‘বিশুদ্ধ’ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইয়েরা তখন থেকেই দেবব্রত বিশ্বাসের পেছনে লেগেছিলেন। তারা দেবব্রত বিশ্বাসের গায়কীকে বলতেন ‘ঘুষি বাগানো রবীন্দ্রসঙ্গীত’। কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের চোখে দেবব্রত-ই ছিলেন সেই শিল্পী যিনি ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের সবল উদ্দীপক ধারার সঙ্গে গণসঙ্গীতকে মিশিয়ে দিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে আমাদের, অর্থাৎ গণসঙ্গীত গাইয়েদের মনোভাবকে সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করলেন যেমন, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মোহান্তদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও মন্দিরের বেদি থেকে গণসঙ্গীতের সঙ্গে প্রান্তরে নামিয়ে আনলেন। এই দুই ধারার সমন্বয়ে জর্জদা যেমন শ্রেষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী, তেমনি শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক। এখানেই জর্জদার যুগান্তকারী ভূমিকা। এখানেই তিনি মহান গণশিল্পী।’
শিল্পী বা সংস্কৃতিকর্মী হিসাবে নিজেকে কোন শ্রেণীতে দেখতে চেয়েছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস? এই একটি প্রশ্নের মীমাংসা করার জন্যই আসলে এই রচনা। এতক্ষণে উত্তরের একটি চিত্রও বোধকরি ফুটে উঠেছে আমাদের সামনে। উপসংহারের জন্য কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়।
১৯৩৪-৩৫ সালে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক লেখক-শিল্পী ব্রিগেডের সমস্য হিসাবে স্পেনে গিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন প্রগতিশীল লেখকরা। আমেরিকার হেমিংওয়ে, ইংল্যান্ডের ক্রিস্টোফার কডওয়েল, র‌্যালফ ফকস-এর মতো লেখকরা ছিলেন সেই ব্রিগেডে। ভারতবর্ষ থেকে সেই ব্রিগেডে যোগ দিতে গিয়েও আবার ফিরে এসেছিলেন মুলকরাজ আনন্দ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন একজন বাঙালি সন্তানÑ ডা. অটল। এই ডা. অটলকেই আমরা আবারও দেখতে পাই চীন-জাপান লড়াইয়ের সময় চীনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত লড়াইতে মেডিক্যাল টিম নিয়ে পাশে দাঁড়াতে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস সুযোগ পেলেই শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতেন ডা. অটলের নাম।
ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ দাসকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস অসাধারণ কবি ও ব্যক্তি বলে শ্রদ্ধা জানাতেন সর্বদাই। তাঁর মতে, গোবিন্দ দাস পুরোপুরি ইংরেজ ও ইংরেজির প্রভাবমুক্ত অত্যন্ত উঁচুদরের কবি। তিনি ভাওয়ালের রাজবাড়ির ছায়ায় বসে শোষকদের ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখেছেন। তখন ভাওয়াল এস্টেটের ম্যানেজার কালিপ্রসন্ন ঘোষ, যিনি নিজেও কবিতা লিখতেন, তার আদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল গোবিন্দ দাসের ঘরবাড়ি। এই গোবিন্দ দাসই চীনে সানইয়াৎ সেন-এর বিপ্লবের সময় ১৯১১ সালে প্রথম কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন চীনে, সেখানকার বিপ্লবীদের অভিনন্দন জানিয়ে। দেশের তথাকথিত সুশীল মানুষদের ব্যঙ্গ করে গোবিন্দ দাস লিখেছিলেন- ‘স্বদেশ স্বদেশ করিস কারে, এদেশ তোদের নয়/ এই যমুনা গঙ্গা নদী, তোদের ইহা হতো যদি/ পরের পণ্যে গোরা সৈন্যে জাহাজ কেন বয়’। কৃষকদের উদ্দেশ্য করে গোবিন্দ দাস লিখেছিলেনÑ ‘ওই খেতে শস্য ভরা/ তোদের নয়তো একটি ছড়া/ তোরা শুধু চাষের মালিক/ গ্রাসের মালিক নয়’।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আরেক প্রিয় ব্যক্তিত্ব ভাওয়ালেরই কবিয়াল হরি আচার্য। কারণ হরি আচার্যই প্রথম কবিয়াল যিনি খিস্তি আর রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে পাশ কাটিয়ে স্বদেশপ্রেমমূলক কবিগান লিখতে শুরু করেছিলেন।
প্রিয় ব্যক্তিত্ব গগণ হরকরা। কারণ রবীন্দ্রনাথ যে সময় স্বদেশপ্রেমের গানগুলি লিখছিলেন, তখন ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথও নিজের গুরুদেব হিসাবে পেয়েছিলেন গগণ হরকরাকে।
আরেক প্রিয় ব্যক্তি গুরুদাস পাল। জুটমিলের শ্রমিক। লেখাপড়া তেমন জানতেন না। কিন্তু এখনকার অনেক বিপ্লবী গণসঙ্গীতশিল্পীই চমকে উঠবেন যখন জানবেন যে ‘থাকিলে ডোবাখানা হবে কচুরিপানা’ গানটির রচয়িতা এই গুরুদাস পাল।

আবার সেই শুরুর কথা। তাঁর সেই জেদ- ‘পার্টিতে এসেছি বিপ্লব করতে, গণসঙ্গীত গাইতে নয়’। সেই পার্টি যখন বিপ্লব থেকে দূরে সরে যায়, তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস পার্টিকে ত্যাগ করেন, কিন্তু বিপ্লবকে ত্যাগ করেন না। আর তখন তাঁর অবস্থা সেই নাবিকের মতো যার জাহাজ তলিয়ে যাচ্ছে অতলে কিন্তু সে জীবনরক্ষার্থে জাহাজ ত্যাগ করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে নারাজ।