ভাসানপানি

ভাসানপানি
রচনা: প্রদীপ ঘোষ
মূল ভাবনা: জাহাঙ্গীর আলম
প্রযজনা: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সুনামগঞ্জ জেলা সংসদ

প্রথমে বন্দনা করি এ দেশেরী ভাটির মানুষ যাঁরা
যাঁদের রক্তে মিশে আছে শক্ত শ্রমের ধারা
বলি মাটির কথা

বলি মাটির কথা, এ মাটিতে জন্ম নিছেন যারা
ধন্য জ্ঞানি সাধক পুরুষ ধন্য করলেন তারা
তাদের প্রনাম জানাই

তাঁদের প্রণাম জানাই প্রথমেতে হযরত শাহজালাল
আউলিয়াদের আগমনে জাগে মহাকাল
বলি চৈতন্য দেব

বলি শ্রীচৈতন্যের পিতৃভূমি এই মাটিরি কোলে
শীতালং, হাছন রাজা এ মাটিরি ছেলে
তাদের সালাম জানাই

তাদের সালাম জানাই প্রণাম জানাই মাটির বাউল যারা
ধানে গানে গল্প কথায় পূণ্য করলো যারা
বলি রাধারমন

বলি রাধারমন, দুরবিন শাহ, আব্দুল করিম নাম
গানের মাঝে বাংলা বাঁচে তাদেরকে প্রনাম
বলি গল্প শোন

বলি গল্প শোন নেইতো কোন বুলির বাহাদুরি
সবুজ শ্যামল ধানে গানে ভরপুর এক সুন্দরী
বলি ভাটির কথা

বলি ভাটির কথা, মাছের কথা, জালের কথা শোন
পানি আসে বর্ষাকালে বাধা নাইকো কোন
শোন ভাসান পানি

শোন ভাসান পানি আমরা জানি জমি ভরে জলে
এক ফসলি জমি ভরে বাদলা বর্ষাকালে
তারা মাছ ধরে

তারা মাছ ধরে, জাল ফেলে দাদার আমলে থেকে
মাছ মারতে যায় ছেলে বুড়ো গ্রামের গরীব লোকে
তারা সুখে ছিলো…

তারা সুখে ছিলো বুকে ছিলো বারোমাসি গান
মুর্শিদি মরফতি গানে জুরায় তাদেও প্রাণ
বলি ঘাটুগান

বলি ঘাটুগান, জারি-সারি ভাটিয়ালি গানে
মন জুরাতো প্রাণ জুরাতো ধামাইল আর কীর্তনে
বলি হাওর বাওর

বলি হাওর বাওর নদী নালায় ছিলো স্বাধীনতা
ইংরেজ আমল শুরু হইলো, হইলো মাথা ব্যাথা
দিলো ইজারা..

আগের কালে হাওরের মালিক আছিলো সবাই। ইংরেজরা আসার পরে চালু করলো চিরস্থায়ি বন্দবস্ত। সাধারণ মানুষের কপাল থেইকা চইলা গেলো হাওরের সামাজিক মালিকানা। জমিদারেরা বাৎসরিক চান্দার বিনিময়ে তখন মাছ মারতে দিতো। কিন্তু সর্বনাশ হইলো ১৯৫০ সালে। দেশ ভাগের পর আইলো পাকিস্তান সরকার। সেই ৫০ সালে জমিদারি প্রথাও বন্ধ কইরা দিলো। সবগুলো জলমহাল গেলো রাজস্ব বিভাগের কাছে। ১৯৫০ থেইকা ১৯৬৫ সালের মধ্যে শুরু হইয়া গেলো লিজ দেওয়া। ডিসিরা ধনী জোতদারগো লিজ দেওয়া শুরু করলো। শুরু হইলো ধনী পয়সাওয়ালা জোতদারগো নির্যাতন।

বলি হাওর বাওর চইলা গেলো জোতদারেরি কাছে
ধনী যারা নিলাম পাইলো, লিজ তাগো কাছে
কয় মাছ ধইরোনা

কয় মাছ ধইরোনা, আর আইসোনা টেটা জাল নিয়া
মাছ ধরিলে শাস্তি দিম,ু বাড়ি বাড়ি গিয়া
বলে হও হুশিয়ার

বলে হও হুশিয়ার কথা শোন কান খারা কইরা
মাছ ধইরো না, বাঁইচা থাক অন্য কিছু কইরা
কথা মনে রাইখো

কথা মনে রাইখো, সুখে থাইকো যদি আল্লা চায়
টানলে পানি পাইবা জমি এখন তোমার নয়
জমি পানির তলে।

জমি পানির তলে লোকে বলে এইডা কেমন কথা?
আমগো জমি পানির তলে আমগো মাথা ব্যাথা
শুনি তোমরা কারা?

শুনি তোমরা কারা আমরা যারা এই জমি চাষ করি
দাদার আমল থেইকা আমরা পানিতে মাছ ধরি
যখন পানি আসে

যখন পানি আসে, আশেপাশের গেরামের মানুষে
উল্লাস কইরা মাছ ধরতে যাই, গানে গলা ভাসে
গাই মাছ ধরার গান

গাই মাছ ধরার গান, জাল ফেলার গান, আল্লার পানিতে
রুই কাতলা শোয়ল বোয়াল ধরি দিনে রাইতে
আমরা লালপুরবাসি

আমরা লালপুরবাসি, মাছ মারি খরচারও হাওরে
গজারিয়া আছে মোদের নদী বলে যারে
আমরা দিনমজুর

আমরা দিনমজুর, ক্ষেতমজুর জমিতে হাওরে
নাঙ্গল চালাই, জাল ফেলাই হপ্তায় জুম্মাবারে
আমাগো ছুটি নাই

আমাগো ছুটি নাই, কাজ চাই আল্লার দুনিয়ায়
হাওর জমি লিজে গেলে হইবো কি উপায়
আমরা আইন বুঝিনা

আমরা আইন বুঝিনা, সুদ খুজিনা আল্লার এই জগতে
আল্লা তুমি রহম করো তোমার দুনিয়াতে
নইলে বাঁচবো কেমনে?

নইলে বাঁচবো কেমনে? প্রশ্ন করে গ্রামের সর্বহারা
খোদার সৃষ্টি হাওর নদী কাইরা নিলো কারা
করে নির্যাতন

করে নির্যাতন, জল গড়ায় যতদূরে যায়
হাওরের মালিকানা জোতদারেরা পায়
ক্ষেপে লালপুরবাসি

ক্ষেপে লালপুরবাসি ,প্যারিনগর ক্ষেপে মৎস্যদাস
রাগের মাথায় অস্ত্রধরে, ভারি হয় বাতাশ
আসে বরুণ রায়

আসে বরুণ রায়, আলফাত মুক্তার পাশেতে দাঁড়ায়
গ্রামে গ্রামে ঘুইরা ঘুইরা মানুষরে জাগায়
বলে জোটবাঁধো

বলে জোটবাঁধো, তৈরি হও ভাটির মানুষ যারা
বাশেঁর লাঠি তৈরি করো জেলে সর্বহারা
যারা কাইড়া নেয়

যারা কাইড়া নেয়, বরশী জাল মাছ মারার টেটা
কাছে আস দেখতে চাই কোন জোতদারেরি বেটা
বলে জাল যার

বলে জাল যার জলা তার এইটা হইলো কথা
১৯৮৩ সালের প্রতিবাদের কথা
শোনেন মন দিয়া

প্রত্যেক বছর হাওরে মাছ মারতে গিয়া নির্যাতিত হইতো গ্রামের সাধারণ খাইটে খাওয়া মানুষ। রক্তে ভেইসা যাইতো হাওয়রের পানি। শুধু নির্যাতন কইরা ক্ষেন্ত হইতো না, মারধোর করার পরে জোতদারেরা মামলা দিয়ে জেলে পাঠাইতো অসহায় জেলেদের।

শোনেন মন দিয়া, বইলা যাই জাগে বাংলা ভাটি
প্রতিবাদে রুইখা দাঁড়ায় কমুনিস্ট পার্টি
বলেন সুভান আল্লা

বলেন সুভান আল্লা দাবী ওঠে হাওরে বাওরে
ক্ষেতমজুর সমিতি ছুটে যায় ঘরেঘরে
চলে গ্রাম সভা

চলে গ্রাম সভা গৌরারঙ্গ আর ধনপুরে
ধরেরপার তাহিরপুর আর ফতেপুরে
দেখেন মানুষ জাগে

দেখেন মানুষ জাগে শুরু হয় প্রতিবাদের সুর
নির্যাতনে নাইমা পরে লেচিদের বান্দর
চালায় হত্যাকাÐ

চালায় হত্যাকাÐ , লাল হয় হাওরেরো পানি
পুলিশ দিয়া মামলা দিয়া চালায় রে হয়রানি
তারা জেল খাটে

তারা জেল খাটে হাটে মাঠে ছড়ায় রে খবর
ভাটি বাংলায় জাইগা ওঠে আন্দোলনের ঝড়
তারা তোলে আওয়াজ

তারা তোলে আওয়াজ তৈরি হয় লড়াইয়ের ময়দান
আলফাত মুক্তার কমরেড নজির আবু সুফিয়ান
গেলেন কারাগারে

গেলেন কারাগারে, প্রতিবাদে হইলো সমাবেশ
কমরেড ফরহাদ , সুরঞ্জিৎ সেন করলেন দাবী পেশ
কইলেন মুক্তি দাও

কইলেন মুক্তি দাও , মামলা দিয়া পারবা না রুখিতে
সারা বাংলা ঘেড়াও হবে মাছ ধরার দাবীতে
কইলো পঙ্কজ, মানিক

কইলো পঙ্কজ, মানিক, আব্দুর রাজ্জাক আর বরুণ রায়
প্রসাশন ভয় পাইয়া কয় করলাম কি হায়হায়
শোনেন বরুণ বাবুর কথা

বরুণ রায়ের কথা কি বলবো আর ভাটি বাংলার নেতা
ইতিহাসে বাঁইচা আছে এই গণ দেবতা
লড়াই থামে নাই

লড়াই থামে নাই, কাটে নাই আন্দোলনের রেশ
আছে দাবী সবার বুকে জাগবে ভাটিরদেশ
মানুষ স্বপ্ন দেখে

মানুষ স্বপ্ন দেখে জাল যার জলা হবে তার
হাওরের মালিকানা হবেরে সবার
গাই মানুষের গান..

গাই মানুষের গান, যতদিন বাইচা থাকে প্রাণ
থাকেন পাশে ভাই বন্ধুরা লড়াইয়ের ময়দান
চলেন তৈরি করি

চলেন তৈরি করি শুরু করি আবার আন্দোলন
দেশের মানুষ বইসা আছে আসবো শুভক্ষন
চলেন স্বপ্ন দেখি।

প্রযজনা: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, সুনামগঞ্জ জেলা সংসদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *