সংস্কৃতিই গণঐক্যের বলিষ্ঠ হাতিয়ার: কামাল লোহানী

সাংস্কতিক উত্তরাধিকারই যে আমাদের গর্ব, ইতিহাস তাই নয়, আমরাও তো চলমান ইতিহাসের নায়ক, সৃষ্টি করে চলেছি নবনব অধ্যায়, নতুন কোন শত্রু“র বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদী উপনিবেশিক শত্রু“, সমান্তবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ নানা শোষকশ্রেণী ও গণবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়েছি । এ লড়াইয়ে আমাদের সহযোদ্ধা ছিলেন প্রধানত: এ দেশীয় কৃষক তথা মেহনতি মানুষ এবং সচেতন নাগরিক সমাজ। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগ্রামে গণমানুষের অগ্রগামী অংশই ছিলেন নিপীড়িত, নির্য্যাতিত জনগোষ্ঠী। এদেশীয় সামন্তপ্রভূরা শাসকশ্রেণীর লেজুড়বৃত্তি করে নিজেদের আখের গোছাবার লক্ষ্যে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে শোষক গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টাই করে গেছে। ফলে ওদের ভূমিকা সব সময়ই গণবিরোধী ছিল এবং থেকেও গেছে। আর তেমনি ভারতের প্রথম স্বাধীনতা মযদ্ধ- সেই ১৮৫৭ সালে যেমন সাধারণ সিপাহীরা বিদ্রোহ করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী কপটতা ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি প্রয়োগের বিরুদ্ধে ঐক্যের সাহসে, তেমনি দ্বিতীয় সহাযুদ্দ শেষে যখন ঐ বৃটিশ বেনিয়া-সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বাংলায় অকল্পনীয় দূর্ভিক্ষ- ছিয়াত্তর বাংলা সনের মানুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তর সৃষ্টি করেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের গণশক্তিকে দূর্বল এবং বিভক্ত করতে, তখনই সাম্রাজ্যলোভী বিলেতী পরাশক্তিই বিদায় ঘন্টা যেন বেজে উঠেছিল। আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ্য কোরে এবং জনরোষের প্রবল উত্তাপ লক্ষ্য কোরে তাকে দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে এবার সেই ক্ষমতাসীন পরাশক্তি বাংলায় বাধিয়ে দিল ভ্রাতৃযাতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভরতের জাতীয় কংগ্রেস এবং ভিখিল কারত মুসলিম লীগ বটিশ শাসকদের টোপ গিলে ভারতকে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামে দুটি নতুন দেশে পরিনত করেছিল।
এমনই সময় চল্লিশের দশকেই ভারতবর্ষে দিশেষ করে সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ভরতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি ওরা গড়ে তুলেছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং সেই গণসংস্কৃতিই প্রবল শক্তি নিয়ে সারা উম্মাতাল করে তুলেছিল। এই মহান গণশক্তির আবির্ভাব বাংলার মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছিল প্রবলভাবে।
তেতাল্লিশের মহাদূর্ভিক্ষ এবং ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে জনশক্তিকে বিভক্ত করতে উঠে পড়ে যখন লেগে গিয়েছিল এমন সময়েই বাংলার কৃষকশ্রেণী সংঘবদ্ধ হয়ে প্রচলিত সামন্তবাদী প্রথাকে ভেঙ্গে কৃষকের পাওনা বুঝে নেয়ার জন্য অধিকার আদায়েল সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন, সে ঠিল তেভাগা আন্দোলন কিংবা তেকুটি’র লড়াই। জমিদার-জোতদার শ্রেণীর শোষনকারেিদর রিুধ্ধে এ ছিল ন্যায্য প্রাপ্যের যুদ্ধ। তাই কৃষকশ্রেনী সংঘবদ্ধ হয়েছিলেন সারা ভারত কিষাণ সবার নেতৃত্বে, যা ঠিল ভারতয়ি কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন। পার্টি’র ডাকে শুরু হলো তেভাগা আন্দোলন।

পুরনো ইতিহাস দেখলেই দেখা যাবে, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অসাধারণ গণচেতনামূলক কর্মকাণ্ডের দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি সংস্কৃতিক আন্দোলন বিছ্নিনভাবে ঘটছিল, তাকে কমিউনিস্টরা সংঘবদ্ধ করে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ফ করেছিলেন, যাকে বাংলায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বলা হয়। গণনাট্যের এই সংগঠন সারা ভারকে ছড়িয়ে পড়েছিল প্রবল বেগে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজনে কিংবা আন্দোলন- সংগ্রামে ক্রমশ: এই গণসঙ্গীত-নাটকের জোয়ার জেগেছিল, সেই সেদিন। বৃটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামেও এদের বিরাট অবদান রয়েছে। যেমন ধরুন, বৃটিশ শোষকদের অন্তিমকালে বাংলায় কৃষক সমাজ তেভাগার সংগ্রাম শরু করলেন। যা অব্যাহত ছিল ভরতবিভাগের পরও। বৃটিশ খারতবর্ষকে বিভক্ত কোরে চলে যাবার পরও ভারতে কংগ্রেস সরকার ও পাকিন্তানে মুসলিম লীগ সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের পূর্বাংশে অর্থাৎ এই পূর্ব বাংলায় সেই তেভাগা আন্দোলনই ছিল লীগশাহীর বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত। প্রচণ্ড দমন নীতি চায়িয়েছিল লীগ সরকার। বগু কৃষকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, মামলা চাপিয়ে দিয়ে তাদের বিশাল সংখ্যায় গ্রেফতার করেছিল ‘স্বাধীন’ বলে আখ্যায়িত পূর্ব পাকিস্তানে। জনগণ প্রথমেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন সেদিন যে, এই জালিম মুসলিম লীগ সরকার আমাদের জন্যে নয়। পাঠক মনে পড়ে কি চল্লিশ দশকের শেষভাগের সেই গণআন্দোলনকে? ওয আন্দোলনে কৃষক ছিলেন মূল শক্তি। একে বৃটিশ ও পাকিস্তনী শাসকগোষ্ঠী দমন করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পর্য্যন্ত নামিয়েছিল এবং অকথ্য নির্যাতন, গ্রেফতার , ধর্ষণ নানা কেীশলে অংশগ্রহণকারীদের শায়েস্তা করা হচ্ছিল। কিèতু তা সত্বেও কৃষকরা সংঘবদ্ধ হয়ে এম্ব পাশাবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন। এই প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহে কমরেয মণিসিং, রাজশাহীতে ইলামিত্র-রমেন মিত্র , সিলেটে কমরেড অজয় ভট্টাচার্য, দিনাজপুরে হাজী দানেশ, ভামারাম সিং, গুরুদাস তালুকদার, রংপুরে পাবনায় কমরেড অমূল্য লাহিড়ী, খলানায় কমরেড বিষ্ণু চ্যার্টাজি, ফরিদপুরে কমরেড শান্তি সেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। তাইতো সংগ্রামের পথরেখায় আমাদের যে যাত্রাভিযান শুরু হয়েছিল রক্তের আখরে, সেই পরিক্রমায় রেণুকনা দিয়ে লিখিত হয়েছে সংস্কৃতি-সম্ভাবনা আর সেই রক্তের কারুকাজে অনুবীক্ষণ করেছি পরিবর্তনের, সংশোধনের। এ পথেও সংস্কৃতিই ছিল চৈতন্যের হাতিয়ার।
৪. সাম্রাজ্যবাদের লোভাতুর শোষণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে, কিংবা সেবাদাস স্থানীয় সমাজপতি, জমিদার, জোতদার আর সাহেবীখানার কাছে আত্মসমর্পণকৃত নরকীটের উত্থান রুখে দিতে গড়ে উঠেছে সে সংস্কৃতি জনগণের গর্বে-গৌরবে; আমরা পেয়েছি তারই হাজার বছরের ঐতিহ্য, হতে পেরেছি সেই মহত্বের পদাঙ্ক অনুসারী। যুদ্ধের বিভীষিকা, মন্বন্তরের ভয়াবহতা, ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পৈশাচিকতা আমাদের সাময়িকভাবে কিংবা আচানক থমকে দিয়েছে। কিন্তু আমরা বাংলার তাবৎ মানুষ সদাসর্বদাই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধেই রয়ে গেছি। নিঃশঙ্কচিত্তে, সাহসে প্রত্যয়ে গেয়েছি জীবনের জয়গান। লড়াকু মানুষের অকুতোভয় অবিরাম যুদ্ধ আমাদের সঞ্চয়। তাইতো আমরা থেমে থাকিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ এই আশীর্বাদকে শিরোধার্য করে মানুষের ঐক্যে গেয়েছি সাম্যের গান, কারণ শিকল পরেই ওদের শিকল বিকল করার মন্ত্র জপেছিলাম প্রাণে। ঐ যে বললাম বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুশলী-কূটবুদ্ধির খপ্পরে পড়ে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ লোভ-লালসায় স্বাধীনতাকে ক্ষমতা পাওয়ার মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছিলেন। সে মানসিকতা তাদের আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতায় ডুবিয়ে দিয়েছিল । দেশ যখন বিভক্ত হয়েই গেল, ব্রিটিশরা চলে গেল, তখনকার আমরাই হলাম রাষ্ট্রের মালিক। বেশিদিন গেলো না, কপটতার প্রকাশ ঘটলো এ বঙ্গে। কারণ ভারতীয় কংগ্রেস ছিল অসাম্প্রদায়িক আর মুসলিম লীগ মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতাকেই প্রশ্রয় দিয়ে রাজনীতিকে একপেশে করে ফেলেছিল। এই মানসিকতা খুব বেশিদিন নয়, অল্প সময়েই প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের নামে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো বটে, পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ ক্রমশ স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী চরিত্রে প্রকাশিত হতে থাকলো এবং অঞ্চলগুলোর প্রতি ধীরে ধীরে গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করতে শুরু করে দিয়েছিল। ওদের দুঃশাসন, বঞ্চনা, অবহেলা এবং শোষণ এসব জনগণকে ক্রমশ উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। আর সে থেকেই ঘৃণার উদ্রেক করলো। অব্যাহত শোষণে নিপীড়নে ক্রোধ সঞ্চারিত হলো এবং একদিন সেই গণশক্তির ক্রুব্ধ বিস্ফোরণ ঘটলো- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। আমরা শত্র“মুক্ত হলাম।
স্বদেশ মুক্তির লড়াইয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন যেভাবে গণভিত্তি রচনা করেছিল, তারই গৌরবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও সমৃদ্ধ করেছে মাঠে এই সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সংঘবদ্ধ প্রয়াস আমাদের শক্তিকে সংহত করেছে। কিন্তু আজ এই নতুন জীবন ধারণ প্রত্যুষে আমরা নিরুপায় হয়ে যেন পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছি। যে আদর্শ শক্তিমত্তা ছিল, সংগ্রামে আন্দোলনে সাফল্য ছিল বিজয়ের; সেই মোক্ষম অস্ত্র রাজনীতি ও সংস্কৃতি যেন আজ বিসর্জিত আমাদের কর্মকাণ্ড থেকে। বুদ্ধিজীবীরা কেবলই লোভের শিকার মাত্র, মুষ্টিমেয় কজন বাদে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে যেন এক শৈথিল্য কাজ করছে। গণসংস্কৃতির অপব্যাখ্যাই যেন সংস্কৃতির প্রধান উপাচারে পরিণত হয়েছে। জনগণ যে গণসংস্কৃতি, লোকজ সংস্কৃতির প্রধান বিষয় এবং তাদের কর্মকাণ্ডই সংস্কৃতির আধার সে কথা যেন আমরা ভুলে যেতে চাইছি অর্থপিয়াসের কাছে আত্মাহুতি দিয়ে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংস্কৃতিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করার দায়িত্ব যাদের, তারা আজ অবিন্যস্ত অথচ তাদের সম্মিলিত প্রয়াস এখন সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রকে তাই এতোদিন ধরে যে ঐতিহ্যবিরোধী সংস্কৃতি প্রচার ও বিস্তার ঘটেছে তাকে প্রত্যাখ্যান করে জনগণের রাজনীতিভিত্তিক সংস্কৃতির ইতিহাসকে আঁকড়ে ধরে শুদ্ধ লোকঐতিহ্যকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণসংস্কৃতি কর্মী-সংগঠকদের এ কথা স্মরণে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে কেবল অর্থই সংস্কৃতিকে সবল-বলিষ্ট করে নির্মাণ করতে পারে না। তার জন্য চাই জনগণ আর জনগণের রাজনীতি। রাজনীতি যদি নাই থাকে তবে সে সংস্কৃতি কেবল সুড়সুড়ি দেয়, চটকের সাথে চমৎকৃতই করে মানুষকে; কিন্তু অঙ্গীকারাবদ্ধ দেশপ্রেম সৃষ্টি করে না। সুতরাং রাজনীতি হলো সংস্কৃতির উৎস এবং সংস্কৃতি রাজনীতির ঐক্যের হাতিয়ার। আর সে রাজনীতি মানুষেরই কল্যাণ চায়।
সুতরাং গড়ে তুলে ঐক্য সংস্কৃতির।