সংবিধান সংশোধন হলো : পাকিস্তানী চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।

সংবিধান সংশোধন হলো : পাকিস্তানী চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।
এ. এন. রাশেদা

১৯৭১ সালে ইসলামী রিপাবলিক অব পাকিস্তান থেকে আমরা তো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলাম- যার মূল কথা জনগণই সর্বময় ক্ষমতার মালিক। কিন্তু ১৯৭১ সালে জামাতে ইসলামী এবং সগোত্রীয়রা তা মেনে নিতে পারেনি। তারা দেশব্যাপী হত্যা, খুন, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, আগুনে পুড়িয়ে মারা, মানুষকে গাছের সাথে পেরেক মেরে হত্যা, গায়ের চামড়া তুলে লবণ দিয়ে হত্যা, জবাই করে হত্যা, দিনের পর দিন ধরে চরম নির্যাতন করে হত্যা, গুলি করে হত্যা, বেয়োনেট খুঁচিয়ে হত্যা, ব্রাশ ফায়ারে হত্যা ইত্যাদি কাজগুলো অত্যন্ত আনন্দের সাথে করেছিল। সেই সময়কার বিভৎসতা স্মরণ করে আজও শিহরিত হতে হয়। জামাতে ইসলামী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তাই অধিকাংশের মতামতকে মেনে না নিয়ে তাণ্ডব চালায়। কিন্তু গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করতে চায়।
১৯৭১ সালে ‘ইসলাম ইসলাম’ করেই আমাদের দেশের মেয়েদের গণিমতের মাল বলা হয়েছিল এবং বর্বরোচিতভাবে নির্যাতন করা হয়েছিল, ঐ ইসলাম ধর্মের নামেই- এই ধর্মব্যবসায়ীরা কী তা ভুলে গেছে? বহু জীবনের বিনিময়ে ইসলামকে ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করেই তো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করা হয়েছিল। আর ব্যক্তিকে যে-কোনো ধর্ম পালনের অধিকার দেয়া হয়েছিল। অথচ বঙ্গবন্ধুকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যার পর প্রথম অবৈধ সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বিসর্জন দিয়েছিল, সমাজতন্ত্রের নীতি পরিত্যাগ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর পরিবর্তে বাংলাদেশী করেছিল। পরবর্তীতে আর এক অবৈধ সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদ রাষ্ট্রের মাথায় টুপী পরাল। অর্থাৎ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করল। তার তাবৎ চাটুকারেরা বাহাবা দিল। বিখ্যাত গল্পকার অ্যান্ডারসন এর ‘ন্যাংটা রাজার’ গল্পের বালকের মত কেউ প্রশ্ন করলনা- ‘আরে রাজাতো ন্যাংটা’ অর্থাৎ রাজার পরনে কোনো কাপড়ই ছিল না। কিন্তু রাজাকে বলা হয়েছিল বিখ্যাত দর্জির সেলাই করা কাপড়টাই এত সুন্দর যে তা চোখে দেখা যায় না। তেমনি আমাদের দেশের সাংসদরা সেদিনও বলতে পারেননি যে রাষ্ট্রের ধর্মপালনের কোনো সুযোগ নেই। রাষ্ট্র কীভাবে ইসলাম ধর্মের যে চারটি ফরযের কথা বলা হয়- রোজা, নামাজ, হজ, যাকাত- তা পালন করবে? ধর্ম পালন করে ব্যক্তি; আল্লাহতায়ালা ব্যক্তির সৎপথে চলার জন্য যা-কিছু নিয়ম কানুন বেধে দিয়েছেন- তাই ধর্ম। সব ধর্মেই দেখা যায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদর্শবান হওয়ার তাগিদ। আর ব্যক্তি সমষ্টিগতভাবে সমাজে ভালভাবে বসবাসের জন্য তৈরি করে নানা নিয়ম কানুন বা ব্যবস্থা- কখনো দাসব্যবস্থা, কখনো সামন্তব্যবস্থা, কখনও গণতন্ত্র, কখনও সমাজতন্ত্র। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয়েই সব মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়; আর সমাজতন্ত্র তা নিশ্চিত করে- যেমন অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা ও বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলো। গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রেও তা করা হয়। কাজ না দিতে পারলে বেকার ভাতা দেওয়া হয়। তবুও সেখানে বিক্ষোভ হয় যেমন বর্তমানে হচ্ছে গ্রীস থেকে গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ড পর্যন্ত। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কারও পুঁজিপতি হওয়ার সুযোগ নেই। বড় বড় কল-কারখানা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে।
যখন আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলবৎ রাখা হচ্ছে- তখন ইসলামধর্ম পুঁজিসম্পর্কে কি বলছে একটু দেখা যাক; “ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিধান হচ্ছে এই যে, যে-সব ব্যবস্থায় সমগ্র জাতির সম্পদ মুষ্টিমেয় কয়েক ব্যক্তির হাতে জমা হওয়ার পথ খোলে, সে সবগুলো পন্থাই হারাম”। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাও সে কথাই বলে। এ প্রসঙ্গে কোরান ঘোষণা করছে : “সম্পদ বণ্টন করার যে নিয়ম কোরআন নির্ধারণ করেছে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, ধন দৌলত যেন কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে পুঞ্জিভুত হয়ে না পড়ে।” রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের দেশে আমরা কি তা পালন করছি? আমাদের দেশের নেতারা বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করছে, স্যুটকেস ভর্তি করে বিদেশে অর্থ নেয়ার অভিযোগের কাহিনী দলের প্রধান নেত্রীর বিরুদ্ধেও আছে- সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা নাই বলে যারা বলছেন।
আজ পুঁজিপতি এবং বিপুল বিত্তের মালিকদের জন্যই এ-দেশের মানুষ খাদ্য-বস্ত্র-অন্নের সংকটে ভুগছে। তারা বাজার থেকে যে পরিমাণ মাছ মাংস এবং নিত্যসামগ্রী কিনছে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে সাদীতে যে পরিমাণ খাবার খাওয়াচ্ছে, অপচয় করছে, লাখ লাখ টাকা দামের শাড়ী ও শত শত ভরি সোনার গহনাসহ বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে- অথচ আর একদিকে দেশের ৪০% মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে- তা কি ইসলামধর্ম সম্মত? ১৯৮৮ থেকে তো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম- তাহলে এগুলো পালন করা হলো না কেন? যেমন কেউ অভুক্ত আছে কিনা, রোগে শোকে চিকিৎসা পাচ্ছে কিনা, তার বাসস্থান আছে কিনা ইত্যাদি?
এবার দেখা যাক ইসলাম ধর্ম জুয়া সম্পর্কে কী বলছে : এক তফসীরে বর্ণনা করা হয়েছে- “জুয়া খেলা একজনের লাভ অপরজনের ক্ষতি। জয়লাভকারীর শুধুই লাভ আর পরাজিত ব্যক্তির ক্ষতিই ক্ষতি। এ খেলায় একজনের মাল অন্যজনের হাতে চলে যায়। এজন্য জুয়া সামগ্রিকভাবে জাতির ধ্বংস এবং মানব চরিত্রের অধঃপতন ঘটায়। যে ব্যক্তি লাভবান হয়, সে পরোপকারের ব্রত থেকে দূরে সরে রক্ত পিপাসুতে পরিণত হয়ে পড়ে। …. ক্রয় বিক্রয় এবং ব্যবসা বাণিজ্য এর বিপরীত।” এই তফসীরে জুয়ার নতুন পদ্ধতি সম্পর্কেও বলা হয়েছে- জুয়ার এই নতুন পদ্ধতি প্রাচীন পদ্ধতির জুয়া অপেক্ষা অধিক ক্ষতিকর এবং এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী ও সমগ্র জাতির পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এর ফলে জাতির সাধারণ মানুষের সম্পদ দিন দিন কমতে থাকে; আর কয়েকজন পুঁজিপতির মাল বাড়তে থাকে। এতে সমগ্র জাতির সম্পদ কয়েক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রিভুত হওয়ার পথ খুলে যায়।” তাই প্রশ্ন করতেই হয়- দেশে রাষ্ট্রধর্ম যখন ইসলাম তাহলে শেয়ার বাজারের ব্যবসা এখানে চলছে কি করে? আর এতদিন পর্যন্ত এইসব ধর্মব্যবসায়ীরা কোরানের এই বিধান সমুন্নত রাখতে লাঠি নিয়ে নামে নাই কেন? কোরানের এই ব্যাখ্যায় লটারীকেও জুয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে, আর হাউজীর বিরুদ্ধেই বা ইসলামী দলের এবং সাথীদের কর্মসূচি কি?
এখন কথা হলো সুপ্রীম কোর্ট দুই সামরিক শাসকের শাসনকাল এবং তাদের দ্বারা সব ফরমান অবৈধ করার ফলে ১৯৭২ এর সংবিধানের ৪ মূলনীতি অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সংসদ ৫১টি সংশোধনীসহ পঞ্চদশ সংশোধনী হ্যাঁ-ভোটে জয়যুক্ত করার ফলে চার মূলনীতির মূল স্পিরিট কী অক্ষত থাকল? ‘ইসলাম’ রাষ্ট্র ধর্ম রাখা হল। ‘ভাল’ কথা- তাহলে ইসলামের মতে দেশ চলুক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদেশের আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করেই নারী নীতি দিয়েছেন- ’৯৬-সালের নারীদের যেটুকু অর্জন ছিল তা বাদ দিয়ে একেবারে ইসলাম ধর্মমতে। তাহলে আলেমদের কথা অনুযায়ী তো নারী নেতৃত্ব ইসলাম ধর্মমতে হারাম- তার কি হবে? প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী দুজনেই নারী। সুরা ‘আন-নমল’-এর ২৭-৩২ আয়াতে সম্রাজ্ঞী বিলকিস এর উল্লেখ আছে। ‘আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়ে’ ‘নারীর জন্য বাদশাহ হওয়া অথবা কোনো সম্প্রদায়ের নেত্রী ও শাসক হওয়া জায়েজ কি না?’- প্রসঙ্গে বলা হয়েছে “সহীহ্ বোখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, পারস্যবাসীরা তাদের সম্রাটের মৃত্যুর পর তার কন্যাকে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। রসুল্লাহ (সা.) এই সংবাদ জানার পর মন্তব্য করেছিলেন ‘যে জাতি তাদের শাসনক্ষমতা একজন নারীর হাতে সমর্পণ করেছে, তারা কখনো সাফল্য লাভ করতে পারবে না।’ এ কারণেই আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, কোনো নারীকে শাসন কর্তৃত্ব, খেলাফত অথবা রাজত্ব সমর্পণ করা যায় না; বরং নামাজের ইমামতির ন্যায় বৃহৎ ইমামতি শাসন-কর্তৃত্বও একমাত্র পুরুষের জন্যই উপযুক্ত।” (উদ্ধৃতি : পবিত্র কোরআনুল করিম)। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম-এর জন্য আমাদের দুই নেত্রীই যখন একমত তখন রসুল (সা.)-এর মতের বিরুদ্ধে তারা দল ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে থাকেন কীভাবে? তাই বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নীতি নৈতিকতার বিবেচনায়- বিষয়টি বর্তমান সরকার ভেবে দেখবেন কি? না হলে একথাই প্রমাণিত হবে না কি- সংবিধান সংশোধন হলো পাকিস্তানী চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।