সংখ্যালঘু নিপীড়ন, চলমান রাজনীতি ও ভবিষ্যতের আশা : যতীন সরকার

আমি হিন্দু। হিন্দু পরিবারে জন্ম নিয়েছি বলেই আমি হিন্দু। অর্থাৎ এটি আমার ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তবতা। তাই এই হিন্দুত্ব নিয়ে আমার কোনো গর্বও নেই, গ্লানিও নেই। হিন্দু হওয়ার জন্য পুরস্কার বা তিরস্কার কোনোটাই আমার প্রাপ্য বলে আমি মনে করি না। অথচ কী আশ্চর্য, প্রতি মুহূর্তেই এই হিন্দুত্বের দায় আমাকে বহন করতে হয়।

না। জীবনে আমি কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হইনি। তেমনটি যাতে আমাকে না হতে হয়, তার জন্যই বরং আমার শুভানুধ্যায়ীরা সর্বদা তৎপর থেকেছেন। তবু আমি যে হিন্দু সে কথা স্মরণ রাখতে আমাকে প্রতিনিয়তই বাধ্য করা হয়। শুধু শত্রুরাই নয়, বন্ধুরাও আমার হিন্দু পরিচয়টি সর্বদা মনে করিয়ে দেয়। শত্রুরা তেমনটি করে ভীতি প্রদর্শনের জন্য, বন্ধুরা করে আমার প্রতি প্রীতির বশে। এ রকম ভীতি ও প্রীতিই আমার অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে আমার হিন্দু পরিচয়কে প্রধান করে তোলে।

বিশেষ করে এমনটি ঘটে ভারতে বা বাংলাদেশে কোথাও সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হলে। তখন দেশের প্রায় সর্বত্র নানা রকম গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ওই সব গুজবকে আশ্রয় করেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উসকে দিয়ে মতলববাজের দল তাদের মতলব হাসিলের মওকা পেয়ে যায়। যে এলাকায় কোনোরূপ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা ঘটে না, সে এলাকায়ও সঞ্চার ঘটে টান টান উত্তেজনার। সে উত্তেজনার ধাক্কায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে নেমে আসে নিস্তেজনা। সে নিস্তেজনাই তাদের করে তোলে অবসাদগ্রস্ত। এ রকম অবসাদগ্রস্ত মানুষগুলোর ভেতর কোনো ব্যাপারেই কোনোরূপ সক্রিয়তা থাকে না। নিষ্ক্রিয়তার অন্ধকূপে ডুব দিয়ে থাকাকেই তারা আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় বলে ভাবে এবং এভাবেই তারা ক্রমে সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ রকম দুরবস্থার শিকার মানুষকে নিয়ে অনেক মনোবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসকই অনেক প্রকার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। একজন বিশিষ্ট মনোচিকিৎসকের মতে-

‘এটিকেই মনোবিজ্ঞান বলে মাইনরিটি সাইকোলজি। পৃথিবীর সব দেশে সব যুগেই এই মাইনরিটি সাইকোলজির সমস্যা ছিল, আছেও। কোনো দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশের মূল স্রোত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করে। দেশের মূল সত্তার সঙ্গে একাত্মবোধ করতে পারে না। মাটির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বোধ করে, শুধু গোষ্ঠীর আশ্রয়ে আশ্রয় নেওয়ার ফলে চিরকালীন মননের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার পথ অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সম্পূর্ণ একটা জাতি বা গোষ্ঠীর সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। আসে ক্ষোভ, অস্থিরতা, আগ্রাসী মনোভাব, অথবা হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব।’

(কলকাতার ত্রৈমাসিক ‘মানবমন’-এ জুলাই ২০১০) প্রকাশিত নিবন্ধ ‘মনোচিত্রকের ডায়েরি’।)

বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে এই মনোচিকিৎসকের অভিমতের বিরুদ্ধে অন্য রকম কিছু বলার আছে কি? শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু নয়, ভাষিক বা জাতিক কিংবা অন্য যেকোনো ধরনের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষও কি একই নিয়তির অধীন নয়?

ঘটনা পরম্পরায় আমিও যে কখনো কখনো এ রকম ‘মাইনরিটি সাইকোলজি’র অধীন হয়ে পড়ি, সে কথাও স্বীকার না করে পারছি না। বিশেষ করে অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক অপরাষ্ট্রের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশেই সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ- এমনটি তো ছিল স্বপ্নেরও অগোচর। কিন্তু হায়, স্বাধীন বাংলাদেশেই সব আশার স্বপ্ন হাওয়া হয়ে গেল। নানা ছদ্মবেশ পরে পাকিস্তানপন্থীরাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়ে বসে পড়ল স্বাধীনতার পর মাত্র তিনটি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রুখেও দাঁড়িয়েছে বইকি। তবু দুঃখ এই, দানবের সঙ্গে সংগ্রামরত মানবশক্তি এখনো পরাভূত হয়েই চলছে। সে পরাভবের হাত থেকে মুক্তির সঠিক পথ তো কেউই দেখাতে পারছেন না।

একুশ শতকের একেবারে গোড়ায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তথা মানবধর্মবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল যারা, তাদের শাসনামলে সংঘটিত ন্যক্কারজনক সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের কথা আমি ভুলেই থাকতে চেয়েছিলাম। কারণ ওদের পক্ষে এ রকমটি করাই তো স্বাভাবিক। এ রকম না করলেই বরং অবাক হওয়ার কারণ ঘটত।

কিন্তু বিপুল গণসমর্থন পেয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী শক্তিটি যখন ক্ষমতায় আসীন হলো, তখনো সে রকম কুকাণ্ড ঘটে যেতে দেখে একেবারেই বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। ২০১৩ সালে যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর পৈশাচিক হামলা নেমে এসেছে, তাদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হচ্ছে, তাদের নারীরা নিগ্রহের শিকার হচ্ছে, তাদের উপাসনালয় ও উপাস্য দেবতার প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে, তখন ‘বল্ মা তারা দাঁড়াই কোথা’ বলে হাহাকার করা ছাড়া আর কিছুই তো তাদের করার থাকছে না। হিন্দুদের মতো প্রায় একই অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকেও। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী তথা জাতিগত সংখ্যালঘুরা দীর্ঘদিন ধরে অনেক সংগ্রাম করেও আপন অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হচ্ছে না। অর্থাৎ ইচ্ছানিরপেক্ষ বাস্তবতার অধীন হয়ে কোনো না কোনো সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যারা, তাদের সবাইকেই সাম্প্রদায়িক হামলা অথবা বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে।

অন্যদিকে যাঁরা জন্মসূত্রে বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ হয়েও স্বাধীনভাবে অন্য রকম চিন্তা করেন ও সে রকম চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে চান, যাঁরা মুক্তবুদ্ধির সাধক কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায়নিরপেক্ষ চিন্তার ধারক, তাঁরা তো সংখ্যায় একেবারেই লঘু। যেকোনো দেশেই তাঁরা সংখ্যালঘিষ্ঠ। তবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশে বা সমাজে এই সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমান অধিকার ও মর্যাদা ভোগ করে, সমাজ ও রাষ্ট্রই তাঁদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়। বাংলাদেশকে কি আমরা সে রকম প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? আমাদের রাষ্ট্র কি মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষের বিবেকের স্বাধীনতা রক্ষার সুব্যবস্থা করে দিচ্ছে, না এর উল্টোটা করছে? কিংবা আমাদের সমাজটিকেই কি আমরা বহুমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারক একটি আদর্শ সমাজরূপে গড়ে তুলতে পারছি?

প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের সবারই জানা। যেসব বিবেকবান কবি-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী মুক্তবুদ্ধির আলোয় পথ চলে নিজেরা সংস্কারমুক্ত হয়ে অন্যকেও সংস্কারমুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, তাঁরাই ধর্মধ্বজীদের রোষের কবলে পড়ে নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। রাষ্ট্র তাঁদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেনি বা করতে পারেনি। ওঁদের অনেককেই আত্মগোপনে থেকে আত্মরক্ষা করতে হয়েছে। কেউ কেউ তো দেশত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় বা জাতিগত সংখালঘুদের মতোই বৌদ্ধিক সংখ্যালঘুদের অবস্থাও এখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

আমাদের সমাজটিকে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে চায় যারা, তারাই যেন আজ সর্বাধিক শক্তিমান। রাষ্ট্রশক্তিও এদের প্রতাপের সামনে একান্তই অসহায় কিংবা ম্রিয়মাণ। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ও গোপনে এদের মদদ দিয়ে চলছে। এ রকম মদদপুষ্ট হয়েই ক্রমবর্ধমান শক্তির অধিকারী হয়ে উঠছে ‘হেফাজতে ইসলাম’। অরাজনৈতিকরূপে আত্মবিজ্ঞাপিত এই সংগঠনটিই দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে চাইছে এবং সে চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করেও চলছে। এদেরই প্রবর্তনায় মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষ যখন তখন ‘নাস্তিক’ আখ্যা পাচ্ছে, আর কথিত নাস্তিকদের কারাবাস করতে হচ্ছে, কাউকে তো জীবনও দিতে হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেও হয়তো এ রকমই হতে থাকবে।

এসব দেখে-শুনে ‘নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর/ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর’- রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার এই দুটো পঙ্ক্তি আমি বারবার আবৃত্তি করছিলাম। কবিতার পরের কথাগুলো স্মরণ করে ভাবছিলাম : ‘শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো/শাস্ত্র মানে না মানে মানুষের ভালো’- এমন মানুষের কি ঠাঁই হবে এ দেশে? ‘ধর্ম মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভালো’- কবিগুরুর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে এমন কথা কে উচ্চারণ করতে পারবে এখানে? ‘ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে/অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।’ এই অন্ধদের হাতেই তো মার খেয়ে যেতে হচ্ছে দেশের সব সংখ্যালঘু মানুষকে। বৌদ্ধিক সংখ্যালঘুদের কোণঠাসা করে রেখেই ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বহুমুখী বিস্তার ঘটিয়ে চলছে তারা।

এ রকম এক অসুস্থ পরিবেশে আমাদের রাজনীতিতে যে কর্মকাণ্ড চলছে, তাতেও স্বভাবত অসুস্থতাই প্রকট হয়ে উঠছে কেবল। অসুস্থ রাজনীতি চলতে থাকবে এবং একই সঙ্গে দেশ ও সমাজ সুস্থ থাকবে- এ রকম আশা করা বাতুলতা মাত্র। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নিরপেক্ষ-নির্দলীয় সরকার, সর্বদলীয় সরকার, নির্বাচনকালীন সরকার, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন, সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষণ- এ রকম নানা শব্দবন্ধ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে খেয়োখেয়ি করে চলছে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো। এদের এই খেয়োখেয়ির হয়তো আপাত অবসান ঘটবে, এদেরই ভেতরকার এগোষ্ঠী বা ওগোষ্ঠী ক্ষমতার আসনে বসে যাবে অথবা তৃতীয় কোনো শক্তি (বামপন্থীরা যে রকম তৃতীয় শক্তির কথা বলে, সে রকমটি নয়) ক্ষমতা দখল করবে। এ রকম যা কিছুই ঘটুক, জনগণ যে তিমিরে আছে সে তিমিরেই থাকবে। ধর্মীয়, জাতিগত বা বৌদ্ধিক সব সংখ্যালঘুই আরো ঘন তিমিরে নিমজ্জিত হবে।

‘২০১৩ সালের ঘটমান রাজনীতি আর হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা শুধু সংখ্যালঘুদের জন্যই নয়, পুরো দেশের জন্যই হয়েছে আনলাকি থার্টিন। হাসতে হাসতেই বললেন আমার এক বন্ধু। আমি হাসলাম না। গম্ভীরভাবেই বললাম : ‘আনলাকি’ হলেও ‘থার্টিন’ চিরস্থায়ী নয়। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে আর বেশি কিছু বলার আগ্রহ আমার নেই। কারণ এই রাজনীতির ধাক্কাধাক্কিতে অদূর ভবিষ্যতে যারাই ক্ষমতায় আসীন হোক না কেন, তাদের শ্রেণীচরিত্রের কোনো বদল ঘটবে না। তাই তাদের হাতে সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষসহ নব্বই শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার কোনো মতেই প্রতিষ্ঠিত হবে না।

বন্ধুটিকে আরো বললাম : ‘থার্টিন’ চলে গিয়ে ‘ফোর্টিন’-এর আগমনের মধ্য দিয়ে অন্যতর অবস্থা সৃষ্টির অবশ্যই সূচনা ঘটবে। সূচনা করবে যারা, তারাই হলো বাংলাদেশের আসল মালিক। এ দেশের সংবিধানে অনেক কাটাছেঁড়াই করা হয়েছে; কিন্তু জনগণই যে এ দেশের মালিক সেই বিধানটি বাতিল করার সাহস কেউই দেখাতে পারেনি। তবে বাস্তবে জনগণের মালিকানা যে একটি বিশেষ শ্রেণী ছিনতাই করে নিয়ে গেছে- সে বিষয়টি তো একান্তই স্পষ্ট। ছিনতাই হয়ে যাওয়া সেই মালিকানা ফিরিয়ে আনাই হবে এ দেশের প্রকৃত রাজনীতি। যত বিলম্বেই হোক, সেই কাঙ্ক্ষিত রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ঘটবেই।