শহীদের রক্ত ঋণ শোধের আহবান জানিয়ে শুরু হলো উদীচীর সাংস্কৃতিক সম্মেলন

লাখো শহীদের রক্ত ঋণ শোধ করার আহবান জানিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত তিন দিনব্যাপী জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। ১৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে তিনটায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে “শহীদ স্মরণে আপন মরণে, রক্ত ঋণ শোধ কর, শোধ কর”- এই শ্লোগানকে ধারণ করে আয়োজিত সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রখ্যাত লোকশিল্পী আমান উল্লাহ গায়েন।

সাংস্কৃতিক সম্মেলন ২০১৫
সাংস্কৃতিক সম্মেলন ২০১৫, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ছবি: রতন কুমার দাস
সাংস্কৃতিক সম্মেলন ২০১৫
সাংস্কৃতিক সম্মেলন ২০১৫, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ছবি: রতন কুমার দাস

অসংখ্য জনপ্রিয় লোকগানের স্রষ্টা নিভৃতচারী আমান উল্লাহ গায়েনকে উদ্বোধক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলার আবহমান সংস্কৃতিকে সবার সামনে নতুন করে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছে উদীচী। লোকশিল্পী আমান উল্লাহ গায়েন ছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক শান্তনু কায়সার এবং সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তির নৃশংস হামলায় নিহত গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম কর্মী রাজীব হায়দার শোভন-এর বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী পর্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। আর শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সম্মেলন প্রস্তুতি পরিষদের আহবায়ক শংকর সাওজাল। উদ্বোধনী পর্বে বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিকল্প নেই। দেশের আবহমান সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং এর প্রতি নতুন প্রজন্মকে উদ্বুব্ধ করার মাধ্যমেই সত্যিকারের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে বাউলদের উপর হামলা, যাত্রাপালায় বোমা হামলা প্রভৃতি ঘটনার নিন্দা জানিয়ে উদীচীর সভাপতি কামাল লোহানী অবিলম্বে এসব াপরাধের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান।

উদ্বোধন ঘোষণার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী গণসঙ্গীত নিয়ে একটি আলেখ্যানুষ্ঠান পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা। এরপর ছিল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সারাদেশ থেকে আগত উদীচীর শিল্পী-কর্মীদের উচ্ছ্বল অংশগ্রহণে মুখরিত শোভাযাত্রাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হয়ে টিএসসি-শাহবাগ হয়ে আবার শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এরপর সন্ধ্যায় শুরু হয় উদীচীর বিভিন্ন জেলা ও শাখা সংসদ থেকে আগত শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এসব পরিবেশনায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে তুলে ধরা হয়। উদীচীর এবারের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের উদ্বোধক আমান উল্লাহ গায়েনের অসাধারণ পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় এ পর্ব। এরপর একে একে মঞ্চে নানা পরিবেশনা তুলে ধরেন উদীচীর সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, গোপালগঞ্জ, বান্দরবান এবং অন্যান্য শাখার শিল্পী-কর্মীরা। উদীচী সিলেটের লাখ্যাতুরা চা বাগান শাখার শিল্পীরা পরিবেশন করেন চা বাগানের গান। যুদ্ধাপরাধীদেও বিচারের দাবির পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষার দাবি নিয়ে বিভিন্ন গান পরিবেশন করেন তারা। বান্দরবান জেলার শিল্পীরা পরিবেশন করেন আদিবাসী নৃত্য। নরসিংদী উদীচীর শিল্পীরা পরিবেশন করেন জারি গান। এছাড়া, দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া শাখার শিল্পীরা। গীতি নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন গোপালগঞ্জ জেলার শিল্পীরা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের আত্মত্যাগ ও মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের প্রয়াসকে সামনে রেখে উদীচীর এবারের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্নের সাথে প্রতি মূহুর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করা হচ্ছে। যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন বাংলার আপামর জনগণ দেখেছিলেন তা পূরণের থেকে এখনও অনেকটাই দূরে রয়েছি আমরা। বারবার সংবিধানকে কাঁটাছেঁড়া করার মাধ্যমে বারবারই ভূলুষ্ঠিত করা হয়েছে ৭২’র সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে। তাই, শহীদদের কাক্সিক্ষত স্বদেশের জন্য আজ আবারো লড়াই করার সময় এসেছে। লাখো শহীদের রক্তের যে ঋণ মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু তা পরিশোধ করার সবচাইতে উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে তাদের স্বপ্নকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। অর্থাৎ সংবিধানের চার মূলনীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। আর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সে লক্ষ্যেই সাংস্কৃতিক লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে উদীচী। তাদের ত্যাগের প্রতি যে বিশ্বাস, তাকে প্রমাণ করার জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে। যত বাধাবিপত্তি আসুক না কেন, শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও তাদের রক্ত ঋণ শোধ করতে প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। আর সে আহবান রাখতেই উদীচীর এবারের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- “শহীদ স্মরণে আপন মরণে, রক্ত ঋণ শোধ কর, শোধ কর”।

উদীচীর জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আগামীকাল ১৮ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ১০টায় শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে “দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক সংগ্রাম” বিষয়ক সেমিনার। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অধ্যাপক ড. শফিউদ্দিন আহমেদ, সিপিবি’র প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো, প্রগতি লেখক সংঘের কার্যকরী সভাপতি কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের নেতা ডা. লেনিন চৌধুরী এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি হাবিবুল আলম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। সেমিনারটি সঞ্চালনা করবেন উদীচীর সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। আর এ পর্বটি সভাপতিত্ব করবেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী। এরপর সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এছাড়া, তৃতীয় ও শেষ দিন ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ও গান, নাচ, আবৃত্তি, নাটক, নৃত্যনাট্যসহ নানা বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন উদীচীর বিভিন্ন জেলা ও শাখা সংসদ থেকে আগত শিল্পীরা।

নিপীড়িত মানুষের গান গাইবার অঙ্গীকার নিয়ে, গান-কবিতা-নাটক তথা জীবনবাদী সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে, যে উদীচীর সংগ্রামী যাত্রা শুরু- সেই সংগ্রাম আজও বহমান। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় উদীচী অংশ নিয়েছে স্বাধীনতার সংগ্রামে, লড়াই করেছে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, লড়াই করেছে প্রাণপ্রিয় স্বাধীনতার সকল অর্জনসহ গণতন্ত্র রক্ষার পবিত্র প্রত্যয়ে। একইসাথে বাংলা ভূখ-ে বহমান হাজার বছরের সংস্কৃতির সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসারে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি নিয়েছে উদীচী। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও উদীচী আয়োজন করেছে জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *