শত অজানার খ-চিত্র : গোলাম মোহাম্মদ ইদু

যুগের দাবি মেটাতে রণেশ দাশগুপ্ত যুগের কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলায়। নিজের দেশকে ইংরেজদের জোয়ালমুক্ত করার আন্দোলনে সে যুগের আন্দোলকারী বিপ্লবীদের সাথে তিনিও একাত্ম হয়েছিলেন। তখন দেশকে মুক্ত করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনের ধাক্কাও ভারতের গায়ে তখন লাগতে থাকে। কিন্তু বিপ্লবীদের একই উদ্দেশ্য ভারতকে স্বাধীন করা। এ ব্যাপারে কাজ হচ্ছিল দুটি ধারায়। একটি ধারা ছিল গান্ধিজীর অহিংস আন্দোলন, দ্বিতীয় ধারা ছিল নেতাজী সুভাষ বসুর সশস্ত্র সংগ্রাম। দ্বিতীয় ধারার এই বিপ্লবীরা আবার দুটি ধারায় বা দুটি দলে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। এ দুটি দল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতকে মুক্ত করে স্বাধীন হতে চায়। এদের একটি যুগান্তর, অন্যটি অনুশীলন দল। রণেশ দাশগুপ্ত অনুশীলন দলের হয়ে বহুদিন সশস্ত্র সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন।

১৯৩০ সাল। রণেশ দাশগুপ্তের বয়স ১৮-১৯ বছর। বাকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজের ছাত্র। ইংরেজদের অত্যাচার শাসন শোষণ তাকে ক্ষুদ্ধ করে। যোগ দিলেন ব্রিটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। শান্তশিষ্ট রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন তখন আগুন। বক্তৃতায় ঝড় তুলতেন। ইংরেজ শাসকদের দেশছাড়া করতে সক্রিয় ছাত্রনেতা হয়ে উঠলেন। তাঁর কথায় হাজারো ছাত্র তাঁর সহযোগী হয়ে উঠেছিল। ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে উঠলো। কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রমাদ গুণলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় হলেন। তাঁকে শেষমেস কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলো।
সরকারের হিসাব বিভাগের কর্মচারী পিতা অপূর্ব দাশগুপ্ত ছেলের কলেজ থেকে বহিষ্কার হওয়ার ব্যাপারটি সাংসারিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেন এবং ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে তোলার জন্য বরিশালস্থ তার অবস্থাপন্ন আত্মীয়দের নিকট রণেশ দাকে পাঠিয়ে দিলেন। কলকাতায় পাঠাবার ভরসা তিনি পাননি। এ কারণে যে, কলকাতায় তখন জমজমাট আন্দোলন চলছিল। ছেলে যদি তাতে আবার জড়িয়ে যায়? বাকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে আইএ পাস করার পরই তার বহিষ্কার ঘটেছিল। বরিশাল এসে তাঁর কাক্সিক্ষত আসল পার্টিরই তিনি সন্ধান পেয়ে গেলেন। যে পার্টি সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম সফল করবে। তখন ১৯৩২ সাল। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় হলেন। আর অপরদিকে বরিশালে তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে ফিরিয়ে দিলেন। জানালেন, এই পোলারে দিয়া তাদের কাম নাই। রণেশদা চলে এলেন ঢাকায়। ঢাকার লৌহজং-এর ছেলে রণেশ দাশগুপ্ত রাঁচি, বাকুড়া, কোলকাতা, বরিশাল হয়ে ঢাকার তাঁতি বাজারে এসে স্থিতিশীল হয়েছিলেন।
দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়েই তাঁর যত চিন্তা ভাবনা। তাঁর শৈশবের কিছু দিন কেটেছিল লৌহজং-এর গাওদিয়া গ্রামে। গ্রামটি তার শৈশবেই পদ্মায় বিলিন হয়ে যায়। তাঁর পরিবার চলে আসে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। এখান থেকেই পিতা চাকরি সূত্রে ব্যাপদেশে রাঁচি চলে যান। রাঁচির প্রখ্যাত ফুটবল টিমের প্রতিষ্ঠাতা, সারা ভারতের বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড় পিতা অপূর্ব দাশগুপ্তের মৃত্যুর (১৯৩৮) পর রণেশ দাকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় কাঁধে। একদিকে সংসার দেখা অন্যদিকে পার্টির কাজ- এই নিয়ে চলছিল তার দিন। এ সময় গঠিত হয় ঢাকা ‘প্রগতি লেখক সংঘ’। এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন রণেশদা। এই সংগঠনের অন্যতম ছিলেন তিনি। এরপর থেকেই শুরু হয়ে যায় তাঁর জেলে যাওয়া আর মুক্ত হয়ে ফিরে আসা। ব্রিটিশ সরকার তীক্ষè নজরে রাখলেও তাঁকে কোনোভাবেই ছাড় দিতে নারাজ। একদিন ভারত স্বাধীন হয়। আর এ অংশে পাকিস্তান জেঁকে বসে। তিনি হচ্ছেন অসম্প্রদায়িক প্রগতিবাদী একজন দরদী মানুষ। যার তুলনা তিনিই। পাকিস্তান সরকার এই শান্তশিষ্ট মানুষটিকে মানুষের প্রতি তাঁর দরদী কর্মকা-ের জন্য বারবারই জেলে নিত। ’৫২র ভাষা আন্দোলনেও তিনি জেলে যান। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গী হয়েছিলেন। জেলে বসে তারা দেশের সমস্যা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। এছাড়া আরো অনেক ভাষা সৈনিক তার সাথে অবস্থান করেছেন জেলে।
জেল থেকে বেরিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত দৈনিক সংবাদ-এ যোগ দেন। সংবাদ-এ তাঁর সাথে অনেক প্রগতিবাদী চিন্তা চেতনার মানুষ সামিল হন। তাদের নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনা। লেখনির মাধ্যমে প্রগতিবাদী চিন্তা-চেতনা প্রচার, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পক্ষে সংবাদ-কে দাঁড় করাবার কাজে তিনি সক্রিয় ভূমিকা নেন। আজকের প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক কর্মী, প্রাবন্ধিক, কবি, সাংবাদিক তার হাত ধরে এগিয়েছিলেন দেশ মাতৃকার মুক্তি অর্জনে। সংবাদ-এ তিনি জামিল শরাফী নামে পোস্ট এডিটরিয়াল লিখতেন। এডিটরিয়ালসহ তাঁর শত শত লেখা পত্রিকায় বেরিয়েছে।
রণেশদা সম্পর্কে অনেক কথা বলা যায়। এখানে তা সম্ভব নয় এবং তাঁর সম্পর্কে বলার মত তাঁর সুহৃদরা রয়েছেন। বড় মাপের লেখক কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর সাথে সাথে মিলের শ্রমিক, গ্রামের কৃষক, ছাত্র, মহল্লার সব রকমের মানুষ ছিল তার বন্ধু। সংবাদ-এ তারা আসতেন তাঁর সাথে সব রকমের সমস্যার কথা বলতেন, অনেকে অসময়ে এসে বিরক্তের কারণও হতেন। রণেশদা স্বচ্ছন্দে তাঁদের সাথে হেসে কথা বলতেন, সমস্যার সমাধান বলে দিতেন।
অফিসের কারো কারো এই সখ্যতা মোটেই পছন্দ হতোনা। তাদের থেকে তিনি এই শ্রমিকদের রক্ষা করতেন নিজের ওপর দায়দায়িত্ব নিয়ে। তাঁর বেতনের টাকা থেকে তিনি অনেককে চাঁদা দিয়েছেন। মাসে মাসে নিয়মিত কয়েকজন আসতেন মহিলা, বৃদ্ধ। তাঁদের অর্থ সাহায্য করতেন। পাকিস্তানের প্রগতিবাদী কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজকে প্রগতিশীল বাঙালি সমাজে রণেশদাই প্রথম পরিচিত করিয়েছেন তাঁর উর্দু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে। রণেশদার উর্দু জ্ঞান একজন শিক্ষিত জাত উর্দু ভাষির চাইতে কোন অংশে কম নয় বলে আমার মনে হয়েছে। পিইউজে সভাপতি সালাউদ্দিন মোহাম্মদ, প্রফেসর ইউসুফ হাসানসহ পাকিস্তানের অনেক উর্দু সাহিত্যিক তার বন্ধু। এ প্রসঙ্গে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখিত ‘গুবারে খাতির’ (বিদীর্ণ হৃদয়) বইটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই বইটি উর্দু ভাষার রচিত। রণেশদা বলেছেন, ‘গুবারে খাতির’ বইটিকে ‘বেদনার্ত হৃদয়ের ছিন্নপত্র ডালি’ নামেও অভিহিত করা যায়। মওলানা আজাদ-এর এই বইয়ের উপর রণেশদা একটি প্রবন্ধ লিখেছেন যা তাঁর লেখা বই ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা : আত্মজিজ্ঞাসা’য় উদ্ধৃত হয়েছে এবং রাহুল সাংস্কৃত্যায়নের ‘নয়ে ভারতকে নয়ে নেতা’ এই হিন্দি বইটির উপরও তার এক বিস্তৃত প্রবন্ধ রয়েছে বইটিতে।
রণেশ দাশগুপ্ত হচ্ছেন আন্তর্জাতিক মানের একজন লেখক, সারা দুনিয়ার মেহনতি কৃষক শ্রমিকদের নিয়ে যারা ভেবেছেন, কর্ম করেছেন, মানুষের মঙ্গলামঙ্গল নিয়ে লিখেছেন তাদেরকে বাঙালি সমাজে পরিচিত করিয়েছেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন, ফ্রান্সের রমা রলাঁ, চিলির পাবলো নেরুদা, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ল্যাটিন আমেরিকার আলেজো কার্পেনটিয়ার, মার্কোয়েজ, লিখেছেন নাজিম হিকমতকে নিয়ে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আরো কত নামের মানব দরদী মানুষকে নিয়ে রণেশদা লিখেছেন তার হিসাব কে করে। কোন ধর্মের মানুষকে তিনি ছোট করে দেখননি। এ ব্যাপারে তিনি উদার। সংবাদ অফিসকে মৌলভী সাহেবদের আক্রমণ থেকে তিনি রক্ষা করেছেন, ধর্মের মানবিক দিকটি তাদের কাছে তুলে ধরে। এ ব্যাপারে আমাদেরকে তিনি আক্রমণাত্মক হতে বারণ করেছিলেন। মনে পড়ে ’৬১তে আজিমপুরের জনগণের বাপ-দাদার আমলের দীর্ঘ দিনের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে নতুন কবরস্থান করার ডিআইটির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তার পরামর্শ ফলদায়ক কাজ করেছিল। পুরনো বস্তি রক্ষা পেয়েছিল।
নদী সিকস্তি হয়ে রণেশদারা ঢাকায় আসেন। লক্ষ্মীবাজার হয়ে তাঁতি বাজারে বসবাস করেন। সে অনেক দিন আগের কথা। তাঁতিবাজার মহল্লায় তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ছিল। লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক হিসেবে তার সামান্যতম অহমিকা ছিলনা। তার প্রমাণ তাঁতি বাজারের তখনকার সময়ের জনগণ। তিনি অতি সাধারণ একজন লোক হিসেবে সারা জীবন কাটিয়েছেন। অথচ তিনি সাধারণ লোকপ্রিয় একজন মানুষ। তাঁতিবাজার মহল্লার সবাই ধরলেন তাকে পৌরসভা নির্বাচনে দাঁড়াতে হবে। লোকপ্রিয় দেখে পার্টিও তা সমর্থন করলো। তিনি দাঁড়ালেন। তার পক্ষে কর্মীগণ বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন, ভোট চাইছেন। সরকারি এবং অন্যান্য প্রতিপক্ষ চাইতো যে রণেশদা প্রতিযোগিতা না করুন। জনগণের চাহিদাÑতাকে দাঁড়াতেই হবে। তাই তাঁর পক্ষে সবাই আমরা কাজ করতে যাই। কমিউনিস্ট পার্টি বরাবরের মত তখনো নিষিদ্ধ। তার নাম মুখে নেয়া যেন অপরাধ। জেলের ভয়। এ ব্যাপারে সবাই সাবধান। কিন্তু রণেশদা সেই ধাঁচের মানুষ নন। এক এলাকায় রণেশদা নির্দ্বিধায় বলে গেলেন জনগণকে তার সেবা করার কথা এবং তিনি একজন কমিউনিস্ট, একথাও তিনি বলতে ভুললেন না, অথচ তখন এভাবে খোলাখুলি বলা আমরা কল্পনাও করিনি। তখন পার্টি নিষিদ্ধ। কমিউনিস্ট কর্মীরা বিভিন্ন নামে কাজ করছিলেন, সবার মনেই ভয় কমিউনিস্ট হিসেবে ধরাপড়ার। গেরুয়া রং পাঞ্জাবি পরলে তখন কমিউনিস্ট ভাবা হতো! এ হেন পাকিস্তানি আমলে নির্বাচনে অনেক ভোটে তিনি জিতে যান। কমিশনার নির্বাচিত হন। কিন্তু মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রে বেশি দিন কমিশনার থাকতে পারলেন না। উচ্চতর কর্তাদের আদেশে তাঁকে ডিসমিস করা হয়েছিল অন্যায়ভাবে।
রণেশদার ছিল একটা দৃঢ় এবং স্বচ্ছ মন। কারো অন্যায়ের কাছে তাঁর পরোয়া নেই। তিনি নিজের কাজে পরিষ্কার, তিনি যা বোঝেন অনেক ভেবে চিন্তেই বোঝেন। তিনি যে ভাল এবং সঠিক অবস্থানে আছেন এখান থেকে কেউ তাঁকে সরাতে পারেনি। কিন্তু তাঁর একটি দয়ার্দ্র মনও আছে। শিশু সংগঠন খেলাঘরের তিনি সুহৃদ। শিশুদের মত গলায় লাল রুমাল বেঁধে শিশু জমায়েতে তিনি অনেকবার বক্তব্য রেখেছেন। তিনি খেলাঘরের উপদেষ্টাও ছিলেন। সাদা লং ক্লথের পায়জামা আর সাদা ফুলহাতা সার্ট, পায়ে কমদামি স্যান্ডেল এবং বগলে ছাতা নিয়ে পায়ে হেঁটে তিনি বিভিন্ন সভায় যাতায়াত করতেন। অসুস্থ অবস্থায় যা খাচ্ছেন সুস্থ অবস্থায়ও এরকমই খেতেন। সামান্য ভাত, সিদ্ধ বা সামান্য মসলা সহকারে তৈরি মাছ বা ডিমের ঝোল, ডাল, তরকারির ভাজি। মাছ মাংস সব সময় খেতেন কখনো খেতেন না। সকালে ২টি পাতলা রুটি চিনি বা গুঁড়ো দুধ মিশিয়ে খেতেন। অথচ আমাদের খাদ্যে কমতি দেখলে ধমকে ওঠতেন।
’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি চিকিৎসার্থে কলকাতা যান। সেখানে ছিলেন ২২ বছর। দেশে তিনি বহুবার আসতে চেয়েছেন। কিন্তু তার ওপর একটি অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা ছিল, যা প্রত্যক্ষ করা না গেলেও অনুভব করা যেতো। তার নিকট পাঠানো কারো কারো চিঠি পৌঁছতো না, ক্রমে হতোদ্যম হয়ে চিঠি আর লিখতেনই না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মেজর বা জেনারেলরা ক্ষমতায় এলেন। এসেই প্রথম আক্রমণটা চালালেন স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠকদের উপর। অসাম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী লেখক শিল্পী সাহিত্যিকদের উপর। তারা দেশের এমন অবস্থার সৃষ্টি করলেন যার ফলে আমাদের সমস্ত কাজেই একটি করে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল খাড়া ছিল। পাসপোর্ট দেয়া যাবেনা। কারণ? কারণ নেই। তাহলে রণেশদার কাছে যাব কিভাবে? সব কিছু এভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল তখনকার সরকারের অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে। রণেশদাই বা কি করে আসবেন ঢাকায়। পাসপোর্ট ছাড়া আসতে গেলে নির্ঘাত জেল। অথচ ভারতীয় পাসপোর্ট তিনি নেবেন না। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেখানে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা রয়েছে, রণেশ দা তা নেবেন না, তিনি ভারতীয় হবেন না, বাংলাদেশীই থাকবেন। দেশের মিলিটারি সরকারের কাছে তো তিনি ছিলেন নিষিদ্ধ। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সহৃদয় বুদ্ধিজীবী এবং উদীচীর পক্ষ থেকে টিম পাঠানো হয়েছিল তাঁর নিকট। হার্টের রোগী বিধায় প্লেনে ফিরতে তাঁকে অনেক ভাবতে হবে। মৃত্যুভয় ছিল। সুস্থ হয়ে তিনি দেশে ফেরার আকাক্সক্ষা জানিয়েছিলেন। সরকারের কোলকাতাস্থ হাই কমিশনের এক অফিসার রণেশদার নিকট গিয়েছেন। তাঁকে বলেছেন তিনি বাংলাদেশে যেতে চাইলে তারা নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন। শরীর একটু সুস্থ হলেই রণেশদা ১/২ দিনের জন্য হলেও ঢাকায় আসবেনই। কিছুদিন পরই তাঁকে পেসমেকার পরার জন্য হাসপাতালে যেতে হয়। এর পনের দিন পরই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি দেশে ফিরেছেন ঠিকই, তবে মৃত।
রণেশ দাশগুপ্ত সাহিত্যের বেশ কটি ক্ষেত্রে তার অবদান রেখেছেন। সারা জীবন তিনি লিখে কাটিয়েছেন। কাজের তুলনায় তার বইর সংখ্যা অল্পই বলা যায়। তিনি মূলতঃ প্রবন্ধ লিখেছেন বেশি। ছোট গল্প, ইংরেজি এবং উর্দু-হিন্দি থেকে অনুবাদ রয়েছে। তার লেখার খোঁজ খবর নিলে প্রচুর লেখা পাওয়া যাবে। এ পর্যন্ত তিনি ১২টি বই লিখেছেন, সবশেষ ছাপার মত কিছু প্রবন্ধ রয়েছে যা বই আকারে বের হতে পারে।
তাঁর লেখা বইয়ের তালিকা (১) আলো দিয়ে আলো জ্বালা (২) উপন্যাসের শিল্পরূপ (৩) সেদিন সকালে ঢাকায় (৪) রহমানের মা ও অন্যান্য (৫) সাজ্জাদ জহির প্রমুখ (৬) মুক্ত ধারা (৭) শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে (৮) আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ (৯) ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম (১০) ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা (১১) জীবনানন্দ, সুভাষ সুকান্তের কাব্য সংকলন (১২) সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা ঃ আত্মজিজ্ঞাসা। রণেশদা হচ্ছেন উদীচীর আত্মার আত্মীয়। উদীচীর জন্ম থেকে তিনি আমাদের সঙ্গী। এত বড় মাপের একজন তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদকে আমরা উদীচীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘোরাবো এখানে সেখানে নিয়ে যাবো এ চিন্তা করিনি, তবুও সত্যেন দার পাশে আমরা তাঁকে পেতাম। আমাদের এই বাংলাদেশে গ্রামীণ সকল মানুষের সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনার প্রতিফলন উদীচীর দ্বারা ঘটানোর প্রয়াস এই রণেশদা দান।
সত্যেনদার অসুস্থ হয়ে শান্তি নিকেতনে যাবার পর রণেশদাই উদীচীর সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। উদীচীর ঘোষণা পত্র রণেশ দাশগুপ্তরই লেখা।