রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত জয়ন্তী: তরুণ প্রাণের সন্ধান: অমিত রঞ্জন দে

বাংলার মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং সুকান্ত চির জাগরুক থাকবে। এ তিন কবি বাংলা সাহিত্যে কেবল ঐতিহ্য হিসেবে নয়, ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক হিসেবেও বরণীয়। এদের একজন উদার মানবিকতাবাদের কবি, আরেকজন মেহনতী মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী স্বাধীনতা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কবি। অন্যজন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার আদর্শে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবে বিশ্বাসী কবি। বলা চলে একই উজানে চলা নৌকার হাল ধরে থাকা তিন কা-ারী। রবীন্দ্রনাথ যে কবির জন্য কান পেতে ছিলেন এবং নজরুল যার আগমন আকাক্সক্ষায় প্রহর গুনেছেন সুকান্তই সেই কবি প্রতিভা। তিনজনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আবির্ভূত হয়েছেন সবার আগে। তিনি তার সমগ্র রচনা শৈলীর মধ্য দিয়ে বাঙালির ধমনি তথা রক্ত কণিকায় চেতনার বীজ বপন করেছেন। যে কারণে যে কোন সংকটে-সম্ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। বিশেষ করে আমরা যদি আমাদের মুক্তি সংগ্রামের দিকে তাকায় তাহলে বরংবার রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি টের পাব। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এবং গণজীবনের প্রতি পরতে পরতে রবীন্দ্রনাথের গানের বৈপ্লবিক দেশাত্মবোধকে সামনের দিকে অগ্রসর করে নিয়েছে। মুক্তিসংগ্রামী মানুষের মনে রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকবেন যুগ-যুগান্তর ধরে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যেমন রবীন্দ্রনাথের সরব উপস্থিতি টের পাওয়া যায় তেমনিভাবে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্বেই নব যাত্রার অভিযাত্রী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্য দিয়ে নৈসর্গিক বোধ যেমন বাঙালির শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়েছে ঠিক তেমনিভাবে বঞ্চিত মানবমানবির ছবিও মুর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, শত শত বছর ধরে যারা ধান কাটে, হাল টানে কিন্তু সোনারতরীতে নিজের ধানের সাথে উঠতে পারে না সে সমস্ত মানুষের কথা। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহ ছিল বাংলার আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ তরুণ-তরুণীদের প্রতি এবং তা যে অমূলক ছিল না তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বহুবার। বাহান্নের ভাষা আন্দোলনে ফুঁসে উঠেছে যে তরুণ, ‘৬৯ সে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ‘৭১ এর মুক্তিসংগ্রামে, ‘৯০-এর গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে যে তরুণ সে আবার ২০১৩ তে দেখিয়ে দিল তারুণ্যের শক্তি কত দুর্বার, বাধা-বন্ধনহীন।
কেবল রবীন্দ্রনাথ নয় নজরুলও দীপ্তকন্ঠে তারুণ্যের জয়গান করেছেন। তিনি অরুন প্রাতের তরুন দলকে উষার দুয়ারে আঘাত করে রাঙা প্রভাতকে ছিনিয়ে আনার আহবান জানিয়েছেন। এই রাঙা প্রভাত বলতে শোষণ-বঞ্চনার শিকার মানব মানবীর জীবনের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের কথা বলা হয়েছে। নজরুল শোষণমুক্ত সমাজে এক মেঘমুক্ত নীলাকাশ রচনা করতে চেয়েছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার জন্য হিন্দু-মুসলিমকে হ্যা-সেক করাতে চেয়েছেন, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। আজকে যখন আবার সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন দেখি তখন নজরুলই আমাদের শক্তি, প্রেরণার উৎস।
অসহায় জাতী তথা মানুষকে রক্ষা করার জন্য নজরুলের যে গগন বিদারী আহবানÑ‘কা-ারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ, হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসী কোন জন? বল ডুবিছে মানুষÑসন্তান মোর মার।’ আর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মধ্য দিয়ে আহবান জানিয়েছেন সমাজের সকল কুসংস্কার-অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার। নজরুল স্বপ্ন দেখতেন এক শোষণমুক্ত শ্রেণীহীন সমাজের। আর তাই নজরুলকে কোন সময়ের বা দেশের গতিতে আবদ্ধ রাখা যাবে না। যুগ-যুগান্তর ধরে তিনি আমাদের পথ দেখাবেন এবং যুগেযুগে কালে কালে তিনি মানুষের জ্ঞাতি হয়েই রইবেন।
নজরুল যে স্বপ্ন দেখতেন, চিন্তাকে লালন করতেন বলা চলে তাকে একক প্রচেষ্টায় অগ্রসর করে নিতে চেয়েছিলেন কবি ‘সুকান্ত’। সুকান্ত সাহিত্যের মূল উপজীব্য হলো ‘মেহনতী মানুষ’। তাই তিনি তার স্বল্পায়ু জীবনে মেহনতী মানুষের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন। তবে তিনি নিজেকে কোন নির্দিষ্ট সীমারেখায় আবদ্ধ রাখেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন আন্তর্জাতিকতাবাদে, বিশ্বাস করতেন রাজনীতিতে। তাইতো সুকান্ত রাজনীতি ও কবিতা, সংগঠন ও সাহিত্য সেবা এবং কবি ও কর্মীর ভূমিকাকে জীবনাদর্শে ও শিল্পাদর্শে এক করে নিয়েছিলেন। সুকান্তের কবিতায় তাই স্থান পেয়েছে ঔপনিবেশিক ও শ্রেণী শোষণের ফলে দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশের নির্মম নিষ্ঠুর চিত্র, উপনিবেশ দখলের প্রতিযোগিতা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে শক্তির দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ভয়াবহতা। আরও স্থান পেয়েছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি শোষিত শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আন্দোলনে তরুণ সমাজের অগ্রবর্তী ভূমিকা। সুকান্তর কবিতা বিশ্ব বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ, শ্রেণীহীন শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে রচিত। তাই সুকান্ত যেমন আমাদের, তেমনি সারা দুনিয়ার মেহনতী মানুষের কবি।
তারুণ্যের প্রতাকাবাহী ও সমাজ সচেতন নতুন সৃষ্টিতে প্রত্যয়ী এ তিন কবিকে তাইতো আমরা বারংবার স্মরণ করি। এরা যেন একই বৃন্তে ফুটে থাকা তিনটি কুসুম। একজন আরেকজনের পরিপুরক। আমরা যদি আমাদের নিজের প্রয়োজনেই এ তিন কবিকে অন্তরে ধারণ করতে পারি তাহলে সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কায়েমী স্বার্থবাদী তথা যে কোন ধরনের অশুভ শক্তি আমাদের মাঝে আসন গাড়তে পারবে না। চারিদিকে নাগিনীরা যে বিষাক্ত নি:শ্বাস ফেলার চেষ্টা করছে তা প্রতিহত করা সহজ হবে। দানবের সাথে সংগ্রাম করার জন্য প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম নেবে দুর্বার-দুর্জেয় তারুণ্য। আমরা পথ চেয়ে রইলাম সে তারুণ্যের প্রতিক্ষায়।