রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যভূমি: নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

রবীন্দ্রনাথকে একজন আধুনিক মানুষ ও যুগের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আন্তরিক ইচ্ছের কথা সুবিদিত। কিশোর পুত্রকে ভারতবর্ষের নানা স্থানে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বৈচিত্রময় ভারতভুমির সংগে শৈশবেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তারপর কৈশোর না পেরোতেই রবীন্দ্রনাথকে বিলাত পর্যন্ত পাঠিয়েছেন। পিতার প্রত্যাশা ছিল রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টারি পড়ে এসে আইন ব্যবসা করবেন। আবার সিভিল সার্ভেন্ট হতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ আবেদন করেছিলেন দেখা যায়। শেষপর্যন্ত তিনি ব্যারিস্টার কিংবা সিভিল সার্ভেন্ট কোনোটাই হন নি। হন নি যে তাতেই বাঙালী, বাংলাদেশ আর বাংলা সাহিত্যের জন্য মঙ্গল হয়েছে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লিখিত কোনো পেশা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন নি বলেই হয়ত তিনি বাঙালির রবীন্দ্রনাথ হতে পেরে ছিলেন। আমলা হলে তিনি হয়ত বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সাহেব লেখক হতেন, কিন্তু বাঙালীর এতো কাছের মানুষ হতেন না।

আদতে রবীন্দ্রনাথ সাহেব হতে চান নি বলেই সেদিকে যান নি। এমন কি বিলেতি আদব-কায়দা রপ্ত করার জন্য শিক্ষানবীশ করে ইংরেজ পরিবারের সাথে রাখা হলো তবু তিনি সাহেব হলেন না। তিনি যে ইচ্ছে করেই সাহেব হলেন না, সাহেব হওয়ার জন্য তাঁর আকাক্সক্ষা ছিল না। বরং মানসিক অনীহাই ছিল। তিনি সাহেব না হয়ে বাঙালি হতে চাইলেন। আধুনিক বাঙালি, মানুষ বাঙালি। আন্দাজ করা যায়, তিনি বিলেতে গিয়ে, বিলেতি কায়দাকানুন দেখে, শিখে হয়ত বুঝেছিলেন তাঁকে সাহেব হলে চলবে না। বাঙালি সত্যিকার সাহেব হতে পারে না, কেবল পোষাকী সাহেব হতে পারে। বাইরের পোশাক যতই বদলানো যাক না কেন ভেতরের বাঙালিকে বদলানো যায় না। বদলাতে চাইলে সেটা না হবে বাঙালি, না ইংরেজ। আর সেটা হলে তাকে বাদুর প্রজাতির মতো আলাদা হয়ে যেতে হবে। না ঘরকা না ঘাটকা হবে তার অবস্থান। ইউরোপের অভিজ্ঞাতাহৃদ্য রবীন্দ্রনাথ যৌবণেই ইংরেজদের আধুনিক দর্শন, চিন্তাচেতনার পরিচয় লাভ করেও আধুনিক বাঙালী হয়ে মাটির কাছে ফিরে এলেন, এসে আরসব মানুষ না হওয়া বাঙালিকে পথ দেখাবার দায়িত্ব নিলেন। রবীন্দ্রনাথ সাহেব না হওয়ায় বাংলাদেশের মাটির কাছে ফিরে আসায় বাঙালির যে কতটা লাভ হয়েছে সেটা সমসাময়িক পশ্চাদপদ বাঙালির মতো একালের বাঙালীও বুঝতে পারে বলে মনে হয় না।
নেপাল মজুমদার বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ভ্রমণ করলেও ইউরোপের আলোড়ন তাঁকে স্পর্শ করে নি। ইউরোপের আলোড়ন রবীন্দ্রনাথকে কতটা স্পর্শ করেছিল আজ আর সেবিষয়ে তেমন বিতর্ক নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ইউরোপের প্রতি মোহাবিষ্ট হতে পারেন নি সেটা তখনও যেমন এখনো আমাদের অনুধাবন করতে কষ্ট হয়। বাঙালির মোহ এখনো কাটে নি। কারণ, ইংরেজ আসার পর থেকেই ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার মাধ্যমে বাঙালি তাঁদের তাবেদার হয়ে বিনা খাটুনিতে দুটো পয়সা উপার্জনের মুখ দেখেছে। আর পয়সার মুখ দেখতে পেয়ে বাঙালির সন্তানদের বোধে বিবেচনায়ও নগদনারায়ণ প্রাধান্য পেতে শুরু করেছে। ইংরেজি চালে চলবার, বলবার এবং ভাবভার জন্য বাঙালি শিক্ষার ধরণই পরিবর্তন করে নিয়েছে। কী করে ইংরেজের মনযোগ আকর্ষণ করা যায়, ইংরেজের অধীনে চাকুরি পাওয়া যায়, দুটো কাচা পয়সা হাতে পেয়ে ইংরেজের বাণিজ্যে দালালি করা যায় সে শিক্ষা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষার মূল যে লক্ষ্য মনুষত্ব অর্জন, তাকে বাঙালী শিকেয় তুলে রেখে দিয়েছে। মনুষত্ব অর্জনের শিক্ষা এখনো শিকে থেকে নামানো হয় নি। নামানো হবে এমন কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। যা হোক, এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী এবং মোতাহের হোসেন চৌধুরী বহুকাল আগে যা বলে গেছেন সেই অবস্থার কোনো হের ফের হয় নি। প্রসঙ্গ ছিল নেপাল মজুমদার, রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণ ও তাঁর উপর ইউরোপের প্রভাব।
ইউরোপীয় চাকচিক্য রবীন্দ্রমানসকে রবীন্দ্রনাথের তা কাক্সিক্ষত ছিল না। অন্যরা ইউরোপ না গিয়েই ইউরোপের প্রেমে পড়ে যান কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সেও ইউরোপের মোহে পড়েন নি। অথচ সেটাই হওয়া যেন স্বাভবিক ছিল। ইউরোপীয় রীতিনীতি শেখার জন্য, সাহেব বানানোর জন্যই তাঁকে বিলাত পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সাহেবদের আচার আচরণ, জীবনধারা, পৃথিবীজুড়ে ইউরোপের আধিপত্য তাঁর মনে পাশ্চাত্য সম্পর্কে কোনো সমীহ জাগিয়ে তোলে নি।
প্রশান্তকুমার পাল নেপাল মজুমদারকে উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে মজুমদার লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ যখন ইউরোপ ভ্রমণ করেন উনবিংশ শতকের শেষভাগে ইংলন্ড ইউরোপ তথা পৃথিবীর চিন্তাজগতে এক দারুণ বিপ্লব এসেছে। তখন ডারউইনের উবংপবহঃ ড়ভ গধহ এবং ক্রপটকিনের গঁঃঁধষ অরফ তত্ত্ব লইয়া উত্তেজনাপূর্ণ সমালোচনা চলছে। ১৮৮৭ সালেই কার্ল মাকর্সের উধং ঈধঢ়রঃধষ ইংলন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৮৮ সালে স্যামুয়েল মূর-এর ঈড়সসঁহরংঃ গধহরভবংঃড়-এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ১৮৮৯ সালে এঙ্গেলস-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা হয়। বানর্ড শ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার প্রচার করছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে এগুলো স্পর্শ করে নি। প্রশান্তকুমার পাল নেপাল মজুমদারের সঙ্গে একমত হতে পারেন নি। তিনি রবিজীবনীতে ইউরোপ ভ্রমণের কালে রবীন্দ্রনাথের অধ্যয়ন ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণের তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেছেন। প্রশান্তকুমার পাল বলেছেন, ইউরোপীয় আলোর নিচে যে মানুষের শ্রম শোষণের অন্ধকার পুঞ্জিভুত হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথ তা যথাযথভাবেই অবলোকন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঞযড়সধং ঐড়ড়ফ-এর কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “এই (ইউরোপীয়) সুখ-সমৃদ্ধির অন্তরালে কী অসহ্য দারিদ্র্য আপনার জীবনপাত করছে সেটা আমাদের চোখে পড়ে না, কিন্তু প্রকৃতির খাতায় উত্তরোত্তর তার হিসেব জমা হচ্ছে। প্রকৃতিতে উপেক্ষিত ক্রমে আপনার প্রতিশোধ নেবেই।… যেখানে অন্ধকার জমা হচ্ছে, বিপদ সেখানেই গোপনে বল সঞ্চয় করছে. সেখানেই প্রলয়ের গুপ্ত জন্মভূমি।”
সুতরাং ইউরোপ তাঁকে স্পর্শ করে নি একথা বলার আর কোনো যুক্তি থাকে না। বরং তরুণ বয়সেই তাঁর দৃষ্টি ছিল খুবই স্বচ্ছ, নির্মোহ আর বাস্তবানুগ। তিনি ইউরোপকে নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছিলেন। সেটা কোনো তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভিত্তিতে নয়, বাস্তব পর্যবেক্ষণ থেকেই কবির ইউরোপের সমাজ, অর্থনীীত, সভ্যতার বিকাশ এবং তার দুর্বলতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথর ইউরোপকে কেবল পর্যটকের চোখে পর্যবেক্ষণ করছিলেন একথা বলার আগে তাঁর সেই সময়ের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, চিঠিপত্র আর পরবর্তীকালে স্বদেশ নিয়ে তাঁর ভাবনা, কর্মযজ্ঞ এবং সাহিত্য পর্যালোচনা করলে নেপাল মজুমদারের উল্লিখিত মূল্যায়ন যথাযথ বিবেচনা করার অবকাশ থাকে না। তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় ইউরোপ ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে স্পর্শ করেছিল? সমকালীন সভ্যতার পাঠ থেকে তিনি কী বোধ নিয়ে দেশে ফিরছিলেন? এর উত্তর রবীন্দ্রনাথ সহজভাইে দিয়েছেন। যদিও কারো প্রশ্নের জবাবে নয়, আত্ম উপলব্ধি থেকেই একান্ত ব্যক্তিগত একটি চিঠিতে তিনি ইউরোপের সভ্যতার মূল্যায়ন করেন।
রবীন্দ্রনাথ ৩ অক্টোবর ১৮৯০ বিলাত অবস্থানকালে এক চিঠিতে উল্লেখ করেন, “এদেশে এসে আমাদের সেই হতভাগ্য বেচারা ভারতভূমিকে সত্যি সত্যি আমার মা বলে মনে হয়। এদেশের মতো তার এত ক্ষমতা নেই, এত ঐশ্বর্য নেই, কিন্তু আমাদের ভালোবাসে। আমার আজন্মকালের যা-কিছু ভালোবাসা, যা-কিছু সুখ, সমস্তটাই তার কোলের উপর আছে। এখানকার আকর্ষণ চাকচিক্য আমাকে কখনোই ভোলাতে পারবে নাআমি তার কাছে যেতে পারলে বাঁচি। সমস্ত সভ্যসমাজের কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত থেকে আমি যদি তারই এক কোণে বসে মৌমাছির মতো আপনার মৌচাকটি ভরে ভালোবাসা সঞ্চয় করতে পারি তা হলেই আর কিছু চাই নে।” তরুণ রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ইউরোপ ভ্রমণকালে ইউরোপের বাস্তবজীবন, সমাজ ব্যবস্থা, সভ্যতা এবং সমসাময়িক অগ্রগতি অবলোকন কওে একথা বলেছিলেন। তিনি ইউরোপ ও ভারতবর্ষের কেবল তুলনামূলক পর্যবেক্ষণই করেন নি বরং ইউরোপের মানদন্ডে ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির তুলনামূলক মূল্যায়ন করেন এবং তাঁর নিজের অবস্থান এবং বিবেচনা প্রকাশও করেন। প্রথমত তাঁর এবারের বিলাত ভ্রমণে ভারতভুমিকে নতুন করে চেনার অবকাশ পান। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রদীপের নিচে যে অন্ধকার তা আর কেউ দেখতে না পেলেও রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছিলেন। প্রদীপের নিচের এই অন্ধকার অক্টোবর মাসের দ্বিতীয়ার্ধে দেশে ফেরার জন্য জাহাজে চড়েন। রবীন্দ্রনাথ ২৩ অক্টোবর ১৮৯০ সালে এই রকম আকাক্সক্ষা নিয়ে ইউরোপ থেকে ফিরছিলেন। আর এশিয়ার সীমান্তে সুয়েজখাল অতিক্রম করতে করতে তাঁর মনে এরকম ভাবের উদয় হয়েছিল। ইউরোপীয় সভ্যতার গৌরব, জীবনের উন্মাদ আবর্ত এবং অপর্যাপ্ত যৌবনের প্রবল উত্তেজনা তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে অর্থহীন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এর পরিবর্তে তাঁর আকাক্সক্ষাও তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে: “আমি প্রাচ্য, আমি আসিয়াবাসী, আমি বাংলার সন্তান, আমার কাছে য়ুরোপীয় সভ্যতা সমস্ত মিথ্যেআমাকে একটি নদীতীর, একটি দিগন্তবেষ্টিত কনকসূর্যাস্তরঞ্জিত শস্যক্ষেত্র, একটুখানি বিজনতা, খ্যাতিপ্রতিপত্তিহীন প্রচেষ্টাবিহীন নিরীহ জীবন এবং যর্থার্থ নির্জনতাপ্রিয় একাগ্রগভীর ভালোবাসাপূর্ণ একটি হৃদয় দাও।”
একজন জমিদারপুত্রের স্বদেশের জন্য এমন আবেগ এবং একই সঙ্গে বাস্তববোধের সমন্বয়, এমন অতুলনীয় অভিজ্ঞতা এর আগে লক্ষণীয় নয়। এত সাধারণ একটি জীবনের আকাক্সক্ষা, দরিদ্র বাংলার বাংলার সন্তানরূপে নিজেকে চেনাই শুধু নয়, তার কোলের কাছে স্থান লাভের বাসনা তরুণ রবীন্দ্রনাথের পরবর্তীকালে চিন্তানায়ক রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠার প্রস্তুতিপর্বই ছিল সেকথা হয়ত তাঁর সাহিত্য ও শিল্পসত্ত্বার আলোচনার মাতামাতির কারণে আড়ালে পড়ে আছে। আরো যে কারণটি উল্লেখ করবার মতো সেটা হচ্ছে, যেখানে ভদ্রলোক বাস করেন, কর্মী রবীন্দ্রনাথ সেখান থেকে বহু দূরে অবস্থান করেন। কবি রবীন্দ্রনাথও সঙ্গত কারণেই কলকাতায় অবস্থান করেন, সেখানেই তাঁকে ঘিরে শত আয়োজন, আলোচনা, মাতামতি। অন্যদিকে গণমানুষের রবীন্দ্রনাথ সভ্যতা থেকে অনেক দূরে, একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে অবস্থান করেন। তাই নাগরিক চিন্তাবিদগণ শহরের বাইরে রবীন্দ্রনাথের বিচরণ দেখতে পান না।
যে নদীতীর, দিগন্তবেষ্টিত কনকসূর্যাস্তরঞ্জিত শস্যক্ষেত্র, একটুখানি বিজনতা’ময় স্থান কাঙ্খিত হয়ে প্রবাসে থাকাকালেই উদীয়মান সুর্যের মতো আলোকোজ্জ্বল ও খ্যাতিমান তরুণ কবি-চেতনায় ধরা দিয়েছে সে কোন মর্ত্যভূমি? এই ভূমি কি নিতান্তই কবি কল্পনাপ্রসূত? সেটি কি কেবল কাব্যলক্ষীর সঙ্গে সাক্ষাতের উপযুক্ত স্থান হিসেবে তিনি কল্পনা করেন? যথার্থ নির্জনতাপ্রিয় একাগ্র গভীর ভালোবাসাপূর্ণ একটি হদয়’ সমর্পণের জন্য কবির কল্প-মনোভুমিই যথার্থ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু খ্যাতিপ্রতিপত্তিহীন নিরীহ জীবন যখন কামনা করেন তখন অন্যরকম ভাবতে হয়। তিনি খ্যাতি নিয়ে তখনই বিড়ম্বনায় ভুগছেন একথা কিছুতেই বলা যায় না। তাহলে কবি যে ইউরোপের জীবনপাঠের নির্যাস থেকে বাংলার একটি নিভৃত স্থানের আকাক্সক্ষায় ব্যকুল হয়ে ফিরছিলেন সেটাই তাঁর জন্য সত্য ছিল, আর সেরকম একটা ব্রত নিয়েই তিনি দেশে ফিরছিলেন।
সুতরাং আবারো ভাবতে হয়, কাক্সিক্ষত মায়ের মুখ কোথায়? রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে অবস্থানকালেই তাঁর মাকে নিয়ে ভাবছিলেন আর তখন তাঁর মনে একটিই মুখ ভেসে উঠছিল, সে বাংলামায়ের মুখ। ইউরোপে অবস্থানকাল কবির অন্তরে যে স্বদেশের মুখ ভাস্বর ছিল ইউরোপ থেকে লেখা চিঠিগুলোতে সে সাক্ষ্য উজ্জ্বল হয়ে আছে। প্রকৃত পক্ষে, ইউরোপে অবস্থাকালে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নিজেকে তৈরি করে তুলছিলেন। সে প্রস্তুতি কেবল কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা নয়, মানুষ হিসেবে তিনি কোথায় পা রাখবেন সে ভাবনাই তাঁর কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। অন্য কথায় বাংলার মুখ আলোকিত করার জন্য আধুনিক চিন্তা অন্তরে ধারণ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। এরই পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথের মর্ত্যভূমির জীবন রচিত। পল্লীর মানুষের কল্যাণচিন্তায়, তাদের কাছাকাছি াবস্থান করে কর্মজীবনের পরবর্তী অধ্যায়সমূহ কেটেছে। রবীন্দ্রনাথ অভিজ্ঞতা দিয়ে পল্লী আর পল্লীর মানুষকে দেখলেন, জানলেন, বুঝলেন এবং অনুভব করলেন বাংলার পল্লীতেই তাঁর দেশ প্রতিদিন নতুন করে জন্মগ্রহণ করছে। কালীগ্রাম-পতিসর-শাহজাদপুর-শিলাইদহের মানুষের জন্য নিবেদিত যে রবীন্দ্রনাথকে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের প্রকৃতি আর সাধারণ মানুষ মিলেমিশে তৈরি করেছিল সেই রবীন্দ্রনাথই এখনও বাঙালির পথিকৃত এবং প্রাণের মানুষ। যে নদীমাতৃক সমভূমিতে অবতরণ করে তার উদার প্রকৃতি-জল-বাতাস আর এসবের সমতুল সাদামাটা মানুষগুলোকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ মর্ত্যভূমিতে অবতরণ করেছিলেন তার নাম বাংলাদেশ।