রবীন্দ্রনাথকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্খা: গোলাম মোহাম্মদ ইদু

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথের সার্ধশত জন্মজয়ন্তি উদযাপিত হচেছ মহাসমারোহে দু’দেশেই ভারত এবং বাংলাদেশে। আমরা বাঙালি, তাই নিজের জীবনের তাগিদেই আমরা আমাদের আসল ঠিকানা খুঁজে নিতে চেষ্টা করছি। মাঝে মাঝেই কিছু না বুঝেই আমাদের চলার পথে বাধার সৃষ্টি করে এসেছে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা। ওরা ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্মান্ধতার জিকির তুলে বাঙালি সত্তা থেকে আলাদা করতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি রবীন্দ্রনাথকে। ব্যর্থ হয়েছে।
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এই দেশের গানটিকে (পরবর্তীতে যা আমাদের জাতীয় সংগীত হয়ে ওঠে) বিপ্লবী গান করে তুলেছিল। এই গানটিকে গাওয়ার জন্য আমরা উতলা হয়ে উঠতাম। মুক্তিযুদ্ধের মাঠে-পাহাড়ে জঙ্গঁলে মুক্তিওযাদ্ধা ক্যাম্পে এই গানটি আমাদের জয়ী হওয়ার প্রেরণা দিত।
আমার শিক্ষক এবং রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী জাহেদুর রহিমকে নিয়ে ওই গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়ার চেষ্টা আমরা এখন করেছিলাম। প্রথমে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক পানি ঘোলা করার চেষ্টা করে সরকার। এরপর বাঙালির মন থেকে রবীন্দ্রনাথকে ভুলিয়ে দিতে চেষ্টার ক্রুটি করা হয়নি, শেষে আইন করে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয় রেডিওতে।
১৯৬৪ সালে আইউব খানের রাজত্বে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তাড়া করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে নিষ্ক্রিয় করার কর্মকা- তো ’৬২ থেকেই শুরু করা হয়। জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানটি তখন পালন করা দুরূহ ছিল, তবু চেষ্টার ত্রুটি ছিল না রবীন্দ্রভক্তদের মধ্যে। জন্মশতবার্ষিকীরটি শিলাইদহের কুঠি বাড়িতে উৎযাপনের চেষ্টা স্বরুপ ছায়ানটের ২৫/৩০ জনের শিল্পী ব্যবস্থাপক দলটির হেস্তনেস্ত হবার স্মৃতি এখনো স্মৃতিতে জাগরূক।
পাকিস্তানি সরকারের লেলিয়ে দেয়া দুষ্কৃতকারীদের দলটি কুষ্টিয়া থেকেই রবীন্দ্রভক্তদের অনুষ্ঠান বানচাল করে দিতে চেষ্টা চালায়। শিলাইদহের কঠি বাড়ির মাঠ এড়িয়ে বিলকুনিতে অনুষ্ঠান করতে হয়। ঢাকায় ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়ায় কঠি বাড়িতে বিনা বিছানায় বসে বসে রাত কাটাতে হয়। আইয়ুব খানের রাজত্ব, কারো কোনো কথা খাটে না। তারা যে আইন করবে তাই মানতে হবে, এ হেন অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীর দিনগুলি কেটেছে।
এলো ’৬৭ সাল। বেতার মন্ত্রী হলেন খান আব্দুস সবুর খান। রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতায় তিনি এক হাত বেড়ে কথা বলতেন। তার সময়ই রেডিওতে ( রেডিওই তখন একমাত্র সরকারী বা বেসরকারী প্রচার মাধ্যম) রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। রবীন্দ্র সংগীত, কবিতা আবৃত্তিসহ রবীন্দ্রালোচনা সব বন্ধ। তখন জোরদার পাকিস্তানী আমল। রবীন্দ্র নিষিদ্ধের পক্ষে তখন নাকি ৪০ জন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এর পক্ষে বিবৃতিও দিয়েছিলেন। অন্য দিকে পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্র সংগীত লিখতে না পারার জন্য সবুর খানের ভর্ৎসনা করার কার্টুনও ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের অনেক খেলা এদেশের মানুষ এর আগে অনেক দেখেছে। এখনো কি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ স্বাধীনতার পর যা হবার কথা, তা হয়েছে? আমিনিরা এই বিংশ শতাব্দীর শেষে এসেও মানুষের সার্বিক উন্নতির পথ বন্ধ করে দিতে অমূলক কতগুলি পশ্চাদপদ চিন্তা কিছু মানুষের মনে ঢুকিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে সতেষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ধর্মান্ধরা নিজেদের দাঁড়ি গোঁফ অব্যহত রেখে বাউলদের দাঁড় চুল কর্তনে নেমেছে। উদীচী এর প্রতিবাদ করে এবং বাউলদের নিয়ে যারা এ খেলায় মেতেছে এর তীব্র প্রতিবাদ এবং হোতাদের আইনানুগ শাস্তি দাবী করছে।
উদীচী ১৯৬৮ সালে যে সংগীত সম্পদ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান কয়টি ছিল অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। শুধু রবীন্দ্রসংগীত হিসেবেই নয়, সেই গানগুলি ছিল পাকিস্তানী মন মানসে প্রতিবাদি আঘাত স্বরূপ। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন সেন এবং গণনাট্য সংঘের গান তো ছিলই। রবীন্দ্রনাথের গান গুলির মধ্যে ছিল- ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, ‘ ও আমার দেশের মাটি’, ‘পরে ঠেকাই মাথা’ এবং ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসী’ সম্পুর্ণ গানটিই। এটিই এখন বাঙালিদের জন্য একটি হাতিয়ার স্বরূপ। বঙ্গবন্ধুকে এ জন্য হাজারো ধন্যবাদ যে ওই গানটি আমাদের জাতীয় সংগীত হয়েছে।
দেশ স্বাধীন করার ৪০ বছর পরও রবীন্দ্রনাথকে আমরা সম্পূর্ণভাবে পাইনি। এখনো যেন কোনো দ্বিধঅ আমাদের দেশের অনেক মানুষেল মধ্যে বিরাজ করছে। এর একটি সংগত কারণও রয়েছে বলে আমি মনে করি। হা হলো ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে না পারা। তবুও আশা করবো যে অচিরেই ৭১-এর হায়নাদের নিরীহ মানুষের হত্যা লুন্ঠন, ধ্বংসের বিচার হবেই, বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের উপরও জয়ী হবে। এখন আমরা সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকেও অর্জন করতে পারবো।