রণেশ দাশগুপ্ত ও তাঁর সাংবাদিক জীবনের একটি ছায়াচিত্র: দীপংকর গৌতম

‘কেঁচোর মায়ের পুত্রশোক থাকে মাত্র একদিন। গরুর মায়ের আরেকটু বেশি। এই বেশি কম হয় শুধুমাত্র ঘিলুর তারতম্যের কারণে।’ -শম্ভু মিত্র
ঘিলুর এই তারতম্য শুধু কেঁচো এবং গরুর ক্ষেত্রে নয়Ñমানুষের বেলায়ও এ পার্থক্য ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে কারো নিদর্শন টেনে বললে ঘটনাটা তেতো হয়ে যায়। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ নামে যে প্রবাদটি রয়েছে-এখানে সেটি প্রযোজ্য। তবে এ গীত গাওয়া হচ্ছিল সাংবাদিক-সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্তের সাংবাদিক জীবন সম্বন্ধে কিছু বলার জন্য।
একটা সংবাদপত্র মানে একটা উপাসনালয়। একজন সাংবাদিক সেই উপাসনালয়ের উপাসক। ভারতীয় মিথলজিতে দেখা যায় সাপের দেবী মনসাকে চাঁদ সওদাগর উপাসনা করতে চায়নি। কিন্তু এবং একজন সাংবাদিক সত্যকে সেজদা করে। যদি সেই সাংবাদিক কোকিলের মতো ফড়িয়া না হয়, বাদুড়ের মতো জার্সি বদল না করে, একমুখে দুই কাজ না সারে। সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার এটাই মূল কথা। এই সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে পেশার দেয়াল টপকে যিনি ব্রতের জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি রণেশ দাশগুপ্ত্ সাহিত্য, সাংবাদিকতা কিংবা সংস্কৃতির পাঠ-এস ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক ব্রতচারী ঋষি। রণেশ দাশগুপ্তের তুলনা দ্বিতীয় আর কাউকে দিয়ে দেয়া যাবে না। সংবাদপত্রের জগতে তিনি ছিলেন এক আদমসুরত বা দিকচিহ্ন। একজন সাংবাদিকের জীবন গঠনের জন্য রণেশ দাশগুপ্ত এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
এই মহান রাজনৈতিক কর্মী ও দেশের স্মরণীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। তাঁর বাবা অপূর্বরতœ দাশগুপ্ত ও মা ইন্দুপ্রভা দাশগুপ্ত। তিনি বাবার কর্মস্থল আসামের ডিব্র“গড়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও তার বাস্তুভিটা ছিলো মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার গাউরদিয়া গ্রামে। তার বাবা ১৯৩৪ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলে তারা গাউরদিয়াতেই ফিরে আসেন। পরে ওই গ্রাম পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে গেলে তারা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
রণেশ দাশগুপ্তের কাকা নিবারণ দাশগুপ্ত ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও পেশায় শিক্ষক। আরেক কাকা ছিলেন গান্ধীবাদী স্বদেশী। পারিবারিক পরিমণ্ডল এমন হওয়ার ফলে ছোটবেলা থেকেই দেশ, পরাধীনতা, ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি এর সাথে সংবাদপত্রের সম্পর্ক ইত্যাদির সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটেছিল এবং পরবর্তী জীবনে এই রাজনৈতিক সচেতনতা তার পেশা নির্বাচন এবং জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়ক হয়েছিল। ১৯২৯ সালে রণেশ দাশগুপ্ত বিহারের রাঁচি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে বাঁকুড়ার কলেজে ভর্তি হন। এ সময় অনুশীলন দলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে এবং তিনি ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতিতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। বাঁকুড়া কলেজ কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানার পর থেকে তাকে কলেজ থেকে বহিস্কার করে দেন। এরপর তিনি কলকাতার সিটি কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু পুলিশের উৎপাতে লেখাপড়া বিঘœ হওয়ায় বরিশাল এসে ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হন। থাকতেন তার মাতুলালয় সত্যানন্দ দাশের বড়িতে। সত্যানন্দ দাশ কবি জীবনানন্দ দাশের বাবা। রণেশ দাশগুপ্তের সাথে জীবনানন্দ দাশের এই আত্মীয়তা এবং বরিশালে বাস আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে, তার জীবনের উপর জীবনানন্দ দাশের কাব্যময়তার প্রভাব রয়েছে। রণেশ দাশগুপ্ত নিজেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে বেশ আগে থেকেই পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তারপর আবার জীবনানন্দ দাশ ও তার পরিবারের প্রভাব তার সাহিত্য চেতনাকে আরো বেশি গতিশীল করে তুলেছিলো। যা রণেশ দাশগুপ্তের শিল্প ও সাহিত্য চর্চায় প্রভাব ফেলে। বিশেষত জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে তার ভাবনায় কবিতা সম্বন্ধে নতুন ধারার ছায়াসম্পাত করে। কারণ জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় তার কবিতা নিয়ে কবিদের বিরক্তির শেষ ছিলো না। যেমন ছিলো কবি এজরা পাউণ্ডের ক্ষেত্রে। কিন্তু রণেশ দাশগুপ্ত তখনই জীবনানন্দ দাশের কাব্যের যে ভূমিকা লিখেছেন তা আজকের বাস্তবতারও প্রতিনিধিত্ব করে। সাহিত্যের প্রতি অনেকেরই টান থাকে। কিন্তু পদ্য ও রাজনৈতিক গদ্য কিংবা গল্প অথবা বলা যায় রাজনীতি করেও সাহিত্যের সব শাখার বিচরণ এটা রণেশ গুপ্তের বেলায়ই শুধু সম্ভব। এবং তার এই যোগ্যতা তিনি আজীবন দেখিয়ে গেছেন।
যাই হোক রণেশ দাশগুপ্তের পরিবার যখোন ঢাকায় তার বাবা তখোন চাকরি থেকে অবসরে। গ্রামের বাড়ি পদ্মাগর্ভে বিলীন। তার পরিবার তখোন ভীষণ সংকটে। পরিবারের এই সংকটকালীন অবস্থায় রণেশ দাশগুপ্তকে পড়াশুনা ছেড়ে চাকুরি নিতে হয়। সাংবাদিকতাকে তিনি চাকুরি হিসেবে বেছে নেন।
তখোনকার বিখ্যাত পত্রিকা ‘সোনার বাংলা’য় সাংাবদিকতা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রণেশ দাশগুপ্তের সাংবাদিক জীবন। একই সাথে তিনি সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি তরুন সাহিত্যিক সোমেন চন্দ, সত্যেন সেন, অচ্যুত গোস্বামী, কবি কিরণশংকর সেন গুপ্তকে নিয়ে শুরু করেন নানা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে প্রগতি লেখক সংঘ গঠন একটি অন্যতম কাজ। প্রগতি লেখকসংঘ থেকে একটি সংকলন প্রকাশ করা হতো। রণেশ দাশগুপ্ত সেটি সম্পাদনা করতেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজনৈতিক কারণে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। শুধু তাই নয় গোটা পাকিস্তান আমলে তিনি বহুবার কারাবাস করেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি জেলেই ছিলেন। এবং সেখানেই তিনি মুনীর চৌধুরীকে তার যুগান্তকারী নাটক ‘কবর’ নাটকটি লিখতে উদ্বুুদ্ধ করেন। তার চেষ্টায় ‘কবর’ নাটকটি কারাগারে মঞ্চস্থ হতে পেরেছিল।
কারামুক্তির পর ১৯৫৫ সালে প্রথম কিছুদিন তিনি ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেন। পরে তিনি সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতার চাকুরি নেন। এই পত্রিকাকে ব্যাপক অর্থে প্রগতির মুখপত্র করতে তার অবদান ছিলো বিশালাকায়। এবং সংবাদ ও তিনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। সংবাদে যোগ দেবার পর সম্পাদক হিসাবে পান জহুর হোসেন চৌধুরীকে, পান শহীদ সাবের, শহীদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষ গুপ্ত প্রমূখ মহৎ প্রাণদের সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী মজা করে স্ল্যাং দিলেও তাতে মজা ছিলো এবং এতে অফিসও চাঙ্গা থাকতো। তবে এই স্ল্যাংয়ের তুবড়ি কখনো কখনো রণেশ দাশগুপ্তের উপর দিয়েও যেত। ও নিয়ে তার কোনো হাপিত্যেশ ছিলো না। রণেশ দাশগুপ্তের ঠাণ্ডা মেজাজের ভারিক্কি ও দার্শনিকোচিত একটা আবেশ ছিলো। যার মধ্যে মানবতা ছিলো, জ্ঞানের বৈভব ছিলো কিন্তু স্বস্তা রসিকতার সুযোগ ছিলো না।
বিশেষত পত্রিকায় তার চরিত্রটা ছিলো ভিন্ন, তাকে ‘সব্যসাচী’ বলা হতো। কারণ সাহিত্য-সম্পাদকীয়, সাবিং, এডিটিং থেকে প্র“ফ দেখা এককথা যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই জানতেন তিনি। পত্রিকায় রণেশ দাশগুপ্তের বেতন কতো ছিলো তা নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলে দেড়শ’, কেউ বলে তিনশ’ কেউ বলে চারশ। তখোন যেহেতু সংবাদপত্রে ওয়েজবোর্ড চালু ছিলো না সেহেতু বেতন এমন হওয়ারই কথা। তবে রণেশ দাশগুপ্তের এ টাকা তার খরচ বাদ দিয়ে অভাবী যারা তাদের নিঃশর্তে দিয়ে দিতেন। রণেশ দাশগুপ্তের এই মহানুভবতা একজন মার্কসবাদীকে আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। মানুষের সংকট, অভাব, অনাটন যাকে পীড়িত করতো যিনি নিজে পায়ে হেঁটে পথ চলতেন এবং তার জমা করা টাকা-পয়সা নিজের কাজে তিনি খরচ করতেন না। মার্কসবাদী সংগ্রামী জীবনকে দখল করেছিলেন এবং তা মানুষে মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। জীবনে কোনো বিলাসিতা ছিলো না। কমদামী পাজামা ও ফুলশার্ট পরতেন। কিন্তু তা ময়লা থাকতো না। রণেশ দাশগুপ্ত যেখানেই থাকতেন তার আশেপাশের মানুষদের আশ্রয় হয়ে উঠতেন তিনি। এক কথায় বলা যায় একটা আপদমস্ত কমিউনিস্ট ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ও ভারতে একই কায়দায় আজীবন একটি চৌকির একপাশে তিনি আরেকপাশে বই নিয়ে বাস করে গেছেন। বইয়ের পোকা ছিলেন তিনি। বই পড়তে পড়তে ঘুমাতেন আবার জেগেই বই পড়তেন। বইয়ের গন্ধ নিতে খুব পছন্দ করতেন। অফিসে কিংবা বাসঘরের আশেপাশে রণেশ দাশগুপ্ত প্রত্যেকটি মানুষকে কীভাবে যেন বাধ্য করে রাখতেন। তার এই জাদু আজও অনাবি®কৃত। কারণ তিনি খুবই স্বল্পভাষী ছিলেন। ঢাকায় থাকতেন তাতীবাজারের পানিটোলা লেনের একটি পুরনো বাড়ির সিড়িঘরে। সিড়িঘরে বড় একটা চৌকি ছিলো তার এক পাশে ঘুমাতেন তিনি অন্যপাশে বই রাখতেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি শাদা ফুলশার্ট ও পাজামা পরতেন, পায়ে থাকতো চটি তখোন পর্যন্ত তার দাড়ি ছিলো না। ১৯৬২ সালে জেল থেকে বের হওয়ার সময় তিনি যে দাড়ি মোচ নিয়ে বের হলেন আর ফেললেন না। রণেশ দাশগুপ্ত তখোন মাঝে মধ্যেই কবিতা লিখতেন একসময় তা বন্ধ করে দেন। তবুও এই কাব্যময়তা সারাজীবন তার কাজের মধ্যে ছিল। এবং এ কারণেই সম্ভবত তিনি জীবনানন্দ দাশের ও কবি সুকান্তের কবিতা সমগ্র সম্পাদনা করেছিলেন। জেলে আসা যাওয়ার মধ্যেই তার জীবন জেলবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। জেল থেকে বেরিয়ে আবার পত্রিকা অফিসে আসতেন লিখতেন সব রাজনৈতিক কলাম। পায়ে হেঁটেই বেশিরভাগ সময় চলাচল করতেন। তবে লেখার ব্যাপারে তিনি সিরিয়াস ছিলেন। লেখা সংগ্রহের ব্যাপারে নয়। ( গোলাম মোহাম্মদ ইদু, সভাপতি, উদীচী)
সংবাদের অফিস ছিলো তখোন বংশালে। সংবাদ অফিসে কোনো না কোনো কাজে যেতে হলে গিয়ে রণেশ দাশগুপ্তের ডেস্কে যেতাম। কখনো চা, কখনো চায়ের সাথে বিস্কুট এটার আয়োজন ছিলো। তবে রণেশ দাশগুপ্ত ভোজন বিলাসী ছিলেন না। খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন অথচ সাদাসিদে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। স্বল্পভাষী হলেও যেটুকু কথা বলতেন তা হৃদয়ের গহীন থেকেই বলতেন। তার প্রত্যেকটি কথায় চিন্তাশীলতা ও দার্শনিক চেতনা ছিলো। সমকালীন রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে তিনি লিখতেন ও বলতেন। তার লেখাগুলো সংগ্রহ করা হলে এ জাতি উপকৃত হতো। কারণ তার সেসময়ে লেখা রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলো আজকের বাস্তবতায়ও বহুলাংশে প্রযোজ্য। (ইকরাম আহমেদ (১৯৭১-৭৩) উদীচীর সাধারণ সম্পাদক)
১৯৬৪ সাল থেকে সংবাদই রণেশ দাশগুপ্তের ঠিকানা হয়ে ওঠে। অফিস থেকে বাসা পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতেন। দুপুরে আশ-পাশের হোটেল থেকে ডাল-রুটি বা সবজি খেতেন আবার কখনো না খেয়েও কাটাতেন। সাহিত্য সম্পাদক থাকার সময়ে তিনি ভালো লেখা ছাপাতেন। খুব øেহ করতেন নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, হুমায়ুন কবিরকে। এছাড়াও যে কেউ লেখা দিলে গুরুত্বের সাথে লেখাটি পড়তেন। নতুন কেউ লেখা নিয়ে আসলে তার সাথে লেখা, গদ্য-পদ্যের শব্দ চয়ন নিয়ে আলোচনা করতেন। ফুলশার্ট, পাজামা, চটি সাদা খদ্দরের চাদর গায়ে দিয়ে হেঁটে হেঁটে অফিসে চলে আসতেন। (আখতার হুসেন, লেখক-সাংবাদিক-গীতিকবি)
রণেশ দাশগুপ্তের সাথে যখোন দৈনিক সংবাদে চাকরি করি, তখোন আমি সংাবদের শিফট ইন চার্জ। রণেশ দাশগুপ্ত তখোন থেকেই একজন আদর্শবান সাংাবদিকের পথিকৃৎ। অত্যন্ত বিনয়ী, বহু ভাষাবিদ এই মানুষটির কাছে চেনা-অচেনা যেই আসতো সেই তার ভক্ত হয়ে যেতো। তার বিনয়ী আচরণের কোনো তুলনা হতো না। সংবাদকে তিনি ভালবাসতেন গভীরভাবে। আমার আজও মনে আছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতে সারা পাকিস্তানে ১৭ দিন ধর্মঘট হয়েছিলো। সব সাংবাদিকরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলো। এসময় সংবাদ ইউনিটে এক গোপন ভোট করা হয়। তাতে দুটি ভোটবাদে সবই আন্দোলনের পক্ষে পড়ে। এ দুটি ভোটের একটি রণেশ দাশগুপ্তর অন্যটি শহীদুল্লাহ কায়সার-এর। সংবাদ-কে তারা কতো ভালোবাসতো এটাই তার প্রমাণ। (কামাল লোহানী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব)
রণেশ দাশগুপ্ত নিজে একজন সংগ্রামী হয়েও তার কাজ ও কর্মস্থলের প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকে ওই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেননি। তাই বলে তিনি আন্দোলন বিমূখ ছিলেন তা, মোটেও নয়। দেশে তখোন গণসংগ্রামের একটা তীব্র প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। রণেশ দাশগুপ্ত এ সময় খেয়াল করলেন দেশে অনেক লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক থাকলেও তাদের কোনো সম্মিলিত মঞ্চ নেই। তাই অন্যান্য লেখক শিল্পীদের সঙ্গে আলোচনা করে অল্পদিনের মধ্যেই গড়ে তুলেছিলেন প্রগতি লেখক সংঘ। তিনি অনুভব করেছিলেন লেখক-শিল্পীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না। তাদের সবাইকে এক সাথেই আন্দোলন করতে হবে। যার জন্য তিনি মরিয়া ছিলেন। অন্যদিকে প্রগতি লেখক সংঘের মুখপত্র ক্রান্তি’র কয়েকটি সংকলন প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৩ সালে একই গোষ্ঠীর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় মাসিক সাহিত্য সাময়িকী প্রতিরোধ। তৎকালীন বহুভাষী অঞ্চলে এটিও নন্দিত হয়। এ ক্ষেত্রে রণেশ দাশগুপ্ত তার একটি লেখায় লিখেছেন, আমরা যারা এই ছিমছাম গণমূখী সংগ্রামী সাহিত্য পত্রিকাটি চালাতাম তারা সাধারণত নিজেরাই এর আদ্যোপান্ত লিখতাম। সুকান্ত ভট্টাচার্যের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে এই পত্রিকার সূত্রেই। এঁদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়-‘প্রতিরোধ পাবলিশার্স’।
চল্লিশের দশকে রণেশ দাশগুপ্ত নিজেকে বর্ণনা করেছেন কখনো সাহিত্যকর্মী কখনো রাজনৈতিক কর্মীরূপে (সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, ১৯৭৩) তবে এই দুই সত্ত্বার যুগল মিলন সহজসাধ্য ছিলো না; এমনকি রণেশ দাশগুপ্তের মতো আন্তরিক, নিষ্ঠাবান সৎ, সাহসী, নির্মোহ পরিশ্রমী ও সদা আশাবাদী মানুষের পক্ষেও নয়। এ বিষয়ে সন্তোষ গুপ্ত ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত তার এক লেখায় লিখেছেন, তাঁরমধ্যে সবসময়ই একটি দ্বন্দ্ব কাজ করতো, তাহলো বুদ্ধিজীবী ও শ্রমজীবীর মাঝখানে দেয়ালটা ভেঙ্গে ফেলা যায় অর্থাৎ এই সামাজিক অসাম্যজনিত সমস্যার সমাধান কোন পথে মিলবে। রণেশ দাশগুপ্তের লেখা পাঠ করে অনেক সময় মনে হয় যে, তিনি নিজেকে বুদ্ধিজীবী পরিচয় না দিয়ে ‘কলমজীবী’ বলতে চান, যার সঙ্গে শ্রমজীবীর দুরত্বটা কমে আসে সম্ভবত। যেমন দৈনিক লেখাও যে একটা হস্তশিল্প সেটা হয়তো অনেকে জানেন না বা মানেন না। এতে মাথা যতো খাটাতে হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি আদায় করতে ডান হাতের কবজী আর আঙ্গুলগুলোর কাছ থেকে। হাতের মাংসপেশীগুলোতে অলক্ষে টান পড়ে। যারা কলম পেশে, তাদের ডান হাত ঝুনো কাঠ হয়ে যায়। সাংবাদিকতায় এত সত্যবদ্ধ উচ্চারণ আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই।
রণেশ দাশগুপ্ত নিজেও এই দ্বৈত দায়িত্বে তৃপ্ত ছিলেন না। তাই তার একান্ত অনুভূতিÑ ‘এই দুই কাজকে কখনো ভালোভাবে মিলাতে পেরেছেন, কখনো কোনোটাই ঠিকমতো করতে পারেন নি। ( সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ১৯৭৩)। তারপরও প্রবন্ধ সাহিত্যের ধ্র“পদী শিল্পী রণেশ দাশগুপ্তের আবির্ভাব এই দশকেই। জীবনের সামগ্রিক সত্যকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন প্রবন্ধ। এর মধ্যে ক্রান্তিতে প্রকাশিত উপন্যাস সম্পর্কে একটি তাত্ত্বিক রচনা, যার মধ্যে ছিল পরবর্তী উপন্যাসের শিল্পরূপ-এর অংকুর, ঢাকার যোগেশ দাশ কর্তৃক রূপলাল হাউস থেকে প্রকাশিত মাসিক শান্তিতে প্রকাশিত ‘এ কী রকম কবিতা, সোনার হরিণ প্রভৃতি। ১৯৪৩-এর মন্বন্তরকে কেন্দ্রীয় বিষয় করে লেখেন কিশোর উপযোগী নাটক ‘বড়বাড়ী’, ‘জানালা’ ইত্যাদি। ক্রান্তি ও প্রতিরোধ এ মুদ্রিত হয় এগুলি। ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের পরে ১৯৬৩ সালে সংবাদ-এর মনে মনে কলামে তিনি আকালের উপর এক হৃদয়গ্রাহী লেখা লিখেছিলেন- ‘… একটি ছোটো মেয়ে রেশনকার্ড আর ব্যাগ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। … হয়তো ওর বড় আমারই মতো রেশন কার্ড নিয়ে দোকান থেকে ভালো চাল বাছাই করে ব্যাগে ভরতে অপরাগ। … মনে হয় এই মেয়েটিও বড় ভাইকে কিছুটা অপদার্থ বলে মনে করে। নতুবাতো বড় ভাইটি রেশনের চাল নিতে আসতো।’
মন্বন্তরকে ঘিরে এই লেখাটি পড়লে যেমন ভিন্ন এক বাস্তবতা নিজেকে পেয়ে বসে তেমনি রণেশগুপ্তের লেখক চেতনা দেখে অবাক হতে হয়। ১৯৪৩ এর আকালকে তিনি এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যাতে ১৯৬৩ সালে লেখা দেখে মনে হবে আমরা এখনও সেই মন্বন্তরের ভেতরেই আছি। রণেশ দাশগুপ্ত এমন একজন সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন যে তাঁর ভেতর থেকে দেখা কোনো ঘটনা থেকে পাওয়া কষ্ট তিনি বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন। যার প্রকাশ ঘটেছে ওই লেখায়। অর্থাৎ সংবাদপত্রে চাকরি করার সুবাদে একটি লেখা তৈরি করতে হবে-এ ধরনের সাংবাদিকতা রণেশ দাশগুপ্ত করতেন না। যে কারণে ১৯৪৩ সালের কষ্ট ১৯৬৩ সালে প্রকাশ করেছেন তিনি। আর বাকিটা দিন এ কষ্ট নিজে বয়ে বেড়িয়েছেন। এ ধরনের সাংবাদিকতা করতেন রণেশ দাশগুপ্ত। যার কাছে সাংবাদিকতা শুধুমাত্র একটি চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো না। একটা ব্রত ছিলো। তাই দায়বদ্ধতাও ছিলো। তারমধ্যে বসেও তিনি জীবন সংগ্রাম করতেন। করতেন রাজনীতি-সাংবাদিকতা। বারবার জেল, তবু কমরেড ক্লান্ত হবার নয়। ১৯৫৫ সালে ৭ বছর ৪ মাস কারাগারের ‘দেয়াল দিয়ে ঘেরা’ পৃথিবীতে বাস করে রণেশ দাশগুপ্ত মুক্তি পান। ‘সাত বছর আগে যখোন জেলে যান তখন মা ভাই বোনদের সঙ্গে তিনি থাকতেন তাঁতিবাজারের বাঁশি পোদ্দার স্ট্রিটে। ইতিমধ্যে তার পরিবারের সবাই ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে গিয়েছেন। জেল থেকে বের হয়ে তিনি পড়লেন আরেক বাস্তবতার মধ্যে। পরিবারের সবাই যে তাকে ছেড়ে চলে গেলেন এ নিয়ে তার কোনো দলন-পীড়ন ছিলো বলে মনে হয় না। এমনকি এজন্য তিনি কলকাতায় গিয়ে তাদের খুঁজে বেড়িয়েছেন এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। সারাবিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে তিনি বুকে ধারণ করতেন, তার আবার নিজের বলতে কী আছে। একজন মার্কসবাদী যেভাবে শ্রেণীচ্যুত হয়, রণেশ দাশগুপ্ত সেভাবেই শ্রেণীচ্যুত হয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন নি। এবং বিশ্বের মানুষ বুকে ধরে লেখালেখি করতেন বা বলতেন। তাঁর কাজ এবং বলার ভেতরে কোনো বৈপরিত্য ছিলো না। খাঁটি মানুষ বলতে যা বুঝায় তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি পার্টির সার্বক্ষণিক (হোলটাইমার) কর্মী ছিলেন না। জেল থেকে বের হবার পর ইনসিওরেন্স কোম্পানির কাজটাও হাতে নেই। এবারে তিনি যোগ দিলেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাকে, তবে বেশি দিনের জন্য নয়।’ (মতিউর রহমান) তাঁর পরবর্তী দু’বছর কাটে মূলত ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক হিসাবে। অর্থাৎ সাংবাদিকতার এমন কোনো ঘাট নেই যেখানে তিনি নৌকা ভেড়াননি।
যাহোক দৈনিক সংবাদে তিনি সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন। এর মধ্যে তার পেশাগত জীবনে একটি বড় পরিবর্তন ঘটে যায়। দৈনিক সংবাদ-এর সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম কর্মী শহীদ সাবের ১৯৫৮ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মানসিক বৈকাল্যে আক্রান্ত হন। তার প্রধান দায়িত্ব ছিলো সংবাদ-এর রবিবাসরীয় সাহিত্য পাতাটি সাজানো। তিনি অক্ষম হয়ে পড়লে রণেশ দাশগুপ্ত সংবাদের সাহিত্যপাতা সম্পাদনার পাশাপাশি গ্রহণ করেন সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় রচনার দায়িত্ব্। সত্যেন সেন সংবাদে যোগ দেন এর তিন বছর আগে। পরের বছর সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক সৈয়দ নুরুদ্দীন সরকারি কৃষি উন্নয়ন সংস্থায় যোগ দেন। সংবাদ-এ মধুব্রত ছদ্মনামে মনে মনে শীর্ষক একটি কলাম লিখতেন তিনি। রণেশ দাশগুপ্ত এই ছদ্মনামে কলামটি লেখা অব্যাহত রাখেন। এতে তিনি কোনো রকম হীনমন্যতা বোধ না করে বরং আনন্দিত হয়েছিলেন।
ষাটের দশকে একুশে ফেব্র“য়ারিকে কেন্দ্র করে অজস্র সংকলন প্রকাশিত হতো। যার প্রতিটিতে রণেশ দাশগুপ্তের লেখা থাকতো।
বিশেষত ছাত্র ইউনিয়নের প্রকাশনার নাম, এর পরিকল্পনা সব রণেশ দাশগুপ্ত করতেন।
সংবাদে এই ঋষিতুল্য মানুষটি কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো লেখা ছাপাতেন না। লেখার গুণেই লেখা ছাপা হতো। রণেশ দাশগুপ্তের সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে ১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর একটা লেখা অধুনালুপ্ত ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল, লেখাটির অনুলিখন করেছিলাম আমি। এই লেখাটির মধ্যে সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তকে যেভাবে আবিষ্কার করা যায় সেটা কোনো গ্রন্থের সম্ভব নয়। এই লেখা তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি রণেশ দাশগুপ্ত সম্বন্ধে একটা বইয়ের সন্ধান মেলেনি। যার মাধ্যমে রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কে সামান্য জানা যায়। যে মনীষী তাঁর সারাটা জীবন মানুষের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করে গেছেন তাঁর উপরে কোনো বড় লেখা লিখতে গেলে বাইরের সাহায্য পাওয়া যাবে না এটাই ধরে নিতে হবে। রণেশ দাশগুপ্ত পত্রিকা থেকে সংকলন এতে যে পরিমান লেখা লিখেছেন তাও সংগ্রহ করেনি কেউ। অথচ তিনি এই মানুষদের জন্য আলো দিয়ে আলো জ্বালাতে চেয়েছিলেন। অথচ তার সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে কোনো লেখায় এমন কোনো তথ্য নেই যা দিয়ে একটা প্রবন্ধ অন্তত: লেখা যায়।
রণেশ দাশগুপ্ত সম্বন্ধে-এ এক ধরনের তাচ্ছিল্য বলা যায়। রণেশ দাশগুপ্ত ‘স্মারকগ্রন্থ নামে যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে তাও এক-দুইটি লেখা ছাড়া রণেশ দাশগুপ্ত, উদীচী, কমিউনিস্ট পার্টি, জেল এসব নিয়ে একধরনের প্রশস্তি গীত গাওয়া। কারণ এখানেও তারকা লেখকদের দৌরাত্ম্য এতোই যার ফলে সাংবাদিকতা সংক্রান্ত নয় যেকোনো কাজ স্বাতন্ত্র্যভাবে করাই দুরূহ। অমিত দে’র তাড়া আর গীতিকবি সাহিত্যিক-সাংবাদিক আখতার হুসেন-এর সাহায্য ছাড়া যতটুকু লিখেছি তাও লেখা সম্ভব হতো না। এ লেখাটির মধ্য দিয়ে রণেশ দাশগুপ্তের সাংবাদিক জীবন সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা করি।
রণেশ দা সম্পর্কে আহমদ ছফার স্মৃতিচারণ রণেশ দাশগুপ্ত : একজন প্রেমে পড়া মানুষ’-এ লেখার মধ্য দিয়ে রণেশ দাশগুপ্তের সাংবাদিক চরিত্রটি ফুটে ওঠে।
রণেশদাকে প্রথম দেখেছিলাম উনিশ শ’ তেষট্টি সালে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। হরিণ শিশুর শিং গজালে যেমন মাটিতে গুঁতাগুঁতি করে, আমাদেরও সে অবস্থা। কলম থেকে দশলাইন বেরুলো কি না বেরুলো অমনি ছুটছি পত্রিকা অফিসে। হবু লেখকদের যন্ত্রণার প্রতি নিষ্ঠুর সাহিত্য-সম্পাদকের কোনো অনুকম্পা নেই। পত্রিকা অফিসে লেখা নিয়ে সাহিত্য-সম্পাদকের সামনে দুরুদুরু কম্পবক্ষে হাজির হচ্ছি। সর্বত্র একটাই জবাব। লেখা রেখে যাও। ছাপা হলে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবে। রবিবাসরীয় সংখ্যায় চোখ রাখছি, লেখা ছাপা হয় না। নিষ্ঠুর সাহিত্য-সম্পাদক হবু লেখকের মনের বেদনার কথা বুঝতে পারে!
একদিন জানতে পেলাম, ‘সংবাদ’ বলে একটি দৈনিক পত্রিকা আছে। বংশালে অফিস। তরুণদের মধ্যে একটা কথা চালু ছিলো, সংবাদের সাহিত্য পাতায় যদি কারো লেখা ছাপা হয় সে জাতে উঠে গেল। সংবাদের এই সুনামের জন্য যথাযথ কারণ ছিলো। সংবাদ মুখ দেখে লেখা ছাপাতো না বা তারকা লেখক হলেই তার যে কোনো লেখা ছাপাতে হবে সাহিত্য-সম্পাদকদের এমন মানসিকতাও ছিলো না। বয়স যেমনি হোক লেখা ভালো হলে তা দেরি করে হলেও ছাপা হতো। লেখায় সমস্যা মনে হলে পোস্টকার্ডে চিঠি দিয়ে বা খবর দিয়ে লেখককে ডাকা হোত সে যে বয়সেরই হোক। তারপর লেখাটি ছাপা হতো। স্বভাবতই এ লেখার উপরে সবার একটা টান থাকবে এটাই বাস্তবতা। তখন অন্যসব পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদকেরা আদর করে সব লেখা ছাপবেন। এককথায় ‘অল ক্লিয়ার’। আমার বন্ধুদের মধ্যে এরকম দুয়েকজন ভাগ্যবান ছিল। একদিন দুপুরবেলা গেলাম সংবাদ অফিসে। ভয়ে ভয়ে কাঠের সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলায় উঠে ‘সাহিত্য-সম্পাদক’ লেখা কামরাটিতে পা রাখলাম। দেখি একজন শ্যামলা লিকলিকে লম্বা ভদ্রলোক ফাইল থেকে ব্যস্তসমস্তভাবে কাগজপত্র ঘাঁটছেন। ভদ্রলোক এত লম্বা এবং এত কৃশ, মনে হচ্ছিল রাস্তায় হাটার সময় জোরে দমকা বাতাসের ধাক্কা লাগলে দু’টুকরো হয়ে যাবেন। তার গলায় সবুজ রঙের সাপের জিভের মত একখানা চিকন টাই। আমি একদৃষ্টে এই লম্বা ভদ্রলোকটির কপালের বিরক্তির রেখা এবং টাইটা দেখছিলাম। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, কী চাই? আমার মনে হলো খেঁকিয়ে উঠলেন। আমি পাঞ্জাবির পকেট থেকে কবিতাটা তাঁর সামনে মেলে ধরে বললাম, একটি কবিতা দিতে এসেছি। তিনি হাত বাড়িয়ে আমার হাত থেকে কবিতা বা কাগজটি গ্রহণ করলেন। চোখ বুলিয়েই আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন, আমি রীতিমত শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। তাঁর নাকটা উদ্যত খড়গের মত ঝুলে আছে। তিনি আমাকে বললেন, এই জিনিস আপনার লেখা? আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তিনি ফের জানতে চাইলেন, আপনার বাবা বেঁচে আছেন? আমি মাথা নাড়লাম, অর্থাৎ বেঁচে নেই। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার অভিভাবক কেউ নেই? আমি বললাম আছে। আমার বড় ভাই। তিনি ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে গল গল করে ধোঁয়া ছাড়লেন। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখে দেন। বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলাম কেন? তিনি বললেন, লিখে দেন তাড়াতাড়ি যেন বিয়ে করিয়ে দেয়, নইলে ঢাকা শহরে আরেকটা লম্পটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। সাহিত্য-সম্পাদক মহাশয়ের এবংবিধ সৎ পরমর্শ শুনে আমার তো ভিমরি খাওয়ার যোগাড়। ভয়ে ভয়ে বললাম, ওটা তো একটা প্রেমের কবিতা। তিনি বললেন, মেনি বিড়ালের সঙ্গীনি সন্ধানের চিৎকারকে প্রেমের কবিতা বলা যায় না। এই ধরনের জিনিস যে লেখে ‘বিবাহই’ হল তার একমাত্র দাওয়াই।
আমি সংবাদ অফিসে এসেছিলাম একটি কবিতা চালান করতে। সাহিত্য-সম্পাদকের কথা শুনে মনে হচ্ছে ভারি একটা অপকর্ম করার সময় ধরা পড়ে গেছি। এরপরেও যদি আমি কিছু একটা না করি আমার স্বর্গগত পিতৃদেব রাগে-ক্ষোভে কবরের মধ্যে শোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসবেন। অগত্যা আমাকে বলতেই হল, আপনি সোজাসুজি বলতে পারতেন, কবিতা ছাপাবেন না। এ সমস্ত বাজে কথা বলছেন কেন? ভদ্রলোক আরো চটলেন। আমার নিরীহ ভাবটা কাটতে আরম্ভ করেছে। বেশ ক’মিনিট উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলতে লাগলো।
আামদের এই তর্কাতর্কি শুনে পাশের রুম থেকে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। তার পরনে সাদা পাজামা এবং লম্বা শার্ট। দুপাশের পকেট দুটো ঢল ঢল করছে। ভদ্রলোকের ভরাট গলার স্বর। আমি ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, ভদ্রলোক দাড়ি কামানোর সময় কিছু ভুল করে ফেলেছেন। থুঁতনির নিচের দাড়ি কাটা পড়েনি। রসুনের শেকড়ের মত আকাটা দাড়ি অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। ভদ্রলোকের ভরাট আওয়াজের মধ্যে এমন কিছু ছিল, আমি গরম গরম জবাব দিতে গিয়ে আচমকা থমকে গেলাম। তিনি আমাকে পাশের ঘরে ডেকে নিলেন। আমি তাঁর কাছাকাছি আসতেই জামা-কাপড় থেকে একধরনের ঘ্রাণ পেলাম। সেটা পাঁচ শ, সায়ত্রিশ নম্বর কাপড় কাচা এবং রোদ্দুরের মিশ্রিত ঘ্রাণ। ভদ্রলোক যে জামা-কাপড় পরে এসেছেন সেগুলো পাঁচ শ’ সাইত্রিশ সাবানে ধুয়েছেন, কিন্তু ভাল করে নিংড়ানো হয়নি বলে সাবানের গন্ধটা যায়নি। আর রোদে বেশি শুকিয়েছে বলে রোদের গন্ধটাও তার সঙ্গে মিশেছে।
এই ভদ্রলোক আমার নাম জানতে চাইলেন, জানতে চাইলেন কি পড়ি, কোথায় থাকি এবং দেশের বাড়ির খবর। গড়গড় করে আমি অনেক কথা বলে ফেলেছিলাম। তিনি নীরবে শুনে যাচ্ছিলেন। আমার বাড়ি চাটগাঁ শুনে তিনি জানতে চাইলেন, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, সুধাংশু বিমল দত্ত, অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ এদের চিনি কি না। তখনো পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। সুধাংশু দত্ত ছিলেন যুক্তফ্রন্টের আমলে আমাদের এলাকার কমিউনিস্ট পার্টির টিকিটে নির্বাচিত এম এল এ।
সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব দোতলায় পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সকলে টের পেয়ে যেতেন। কারণ তাঁর মুখে স্ল্যাঙ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মত খেলত। একবার মুখ ছুটলে অনেকক্ষণ চালিয়ে যেতেন। স্ল্যাঙে চৌধুরী সাহেব এত আনন্দ পেতেন, ডানে বামে তাকাবার ফুসরত পেতেন না। কখনো কখনো রণেশদার সামনাসামনি পড়ে গেলে একটুখানি অপ্রস্তুত হয়ে যেতেন। বলতেন, রণেশ দা এরই মধ্যে আপনি এলেন কেন? আপনার সামনে কথা বলে সুখ কোথায়? রণেশ দা, হাত দুটোর বিশেষ ভঙ্গিটি করে বলতেন, না আপনার অপ্রস্তুত হওয়ার কারণ নেই, মনে করুন না আমি একটা দেয়াল। জহুর হোসেন চৌধুরী তাজিম করে বলতেন, এই সমস্ত হলো গিয়ে কড়া পাকের জিনিস, আপনি রস গ্রহণ করতে পারবেন না। রণেশদা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলতেন, আমার বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না, আপনি চালিয়ে যান। রণেশ দা প্র“ফ দেখা কিংবা সম্পাদকীয় লেখায় মন দিলে চৌধুরী সাহেব অধিকতর রসাল স্ল্যাং বলে রণেশদার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করতেন। তাঁর কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যেত না, মুখ নিচু করে তিনি লিখতেই থাকতেন। সংবাদের সে সময়ের কর্মীদের কাছে গল্পটা শুনেছিলাম। একবার জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব নানাভাবে উসকাবার পরও রণেশ দাকে তাঁর মনোযোগ থেকে তাকে ফেরাতে না পেরে বলে ফেলেছিলেন, আপনি এমনই পোড়া কপাইল্যা মানুষ সেই জিনিসটি ব্যবহার করতে পারলেন না। এ কথার মাধ্যমে রণেশ দা চিরকুমার ছিলেন জহুর সাহেব সেদিকে ইঙ্গিত করতেন। জহুর সাহেব একবার কোনো স্ল্যাং বলে মজা পেয়ে গেলে মজাটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করার জন্য বারবার পুনরাবৃত্তি করতেন। একদিন রণেশদাকে একথা যখন বলছিলেন, সংবাদের কোন এক ফাজিল কর্মী নাকি জহুর সাহেবের মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে বলে দিয়েছিলেন, ‘ভগবান তো বিশেষ জিনিস আপনাকেও দিয়েছিলেন, লাভ কী হলো। জহুর সাহেবের কোনো ছেলে-মেয়ে ছিল না। জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব স্ল্যাংকে প্রায় শিল্পকলায় পরিণত করেছিলেন।
আমি রণেশদার কাছে যাওয়া-আসা শুরু করলাম। নতুন লেখালেখি শুরু করার সময় কবিতা লেখার ক্রেজ সকলের থাকে। প্রায় তিন মাস পরে একদিন ডেকে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, তোমার তো বেশ ক’টা কবিতা সংবাদের সাহিত্য পাতায় গেল। তুমি খুশি? ততদিনে তার সঙ্গে আমার একটা øেহের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেছে। আমি বললাম, আরো ছাপা হলে খুশি হবো। রণেশ দা বললেন, ওটা লোভের কথা হলো। তাঁর কথা শুনে আমাকে চুপ করে যেতে হলো। রণেশদা বললেন, তোমার যখন কৃষক সমিতি করার অভিজ্ঞতা আছে বলছো শ্রমজীবী মানুষদের সম্পর্কে গদ্যে কিছু লেখ না কেন?
আমি একটু চমকালাম। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কি কবিতা লেখার ব্যাপারে আমাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছেন? রণেশদা বললেন, কবিতা অবশ্যই লিখবে। তুমি শ্রমজীবী মানুষ সম্পর্কে অনেক কথা লিখতে পার, যারা কবিতা লেখে, তাদের পক্ষে সেটা অনেক সময় সম্ভব নয়। সুতরাং গদ্যে শ্রমজীবী মানুষদের বিষয়ে কিছু লিখতে চেষ্টা কর। আমি চলে এলাম।
রণেশদার প্রস্তাবটি নিয়ে কয়েকদিন চিন্তা করলাম। একথাও আমার মনে এলো, রণেশদা কৌশলে আমাকে কবিতা লিখতে বরণ করছেন কিনা? আমি এভাবে ব্যাপারটি চিন্তা করলাম, রণেশ যখন শ্রমজীবী মানুষদের বিষয়ে গদ্যে কিছু লেখার কথা বলছেন, চেষ্টা করি না কেন। রণেশদার পরামর্শটা অমান্য করা ঠিক হবে না। তারপর ভাবতে আরম্ভ করলাম কী লেখা যায়।
এক সময় আমার উপর পুলিশের হুলিয়া ছিল। আমি গ্রেফতার এড়াতে কলেজের পড়াশুনা ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিয়ে গিয়েছিলাম। চন্দ্রঘোনা কাগজ কলের জন্য গভীর জঙ্গল থেকে ট্রাকযোগে কাটা বাঁশ ছড়ি পর্যন্ত বয়ে আনার প্রয়োজনে পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে রাস্তা কাটা হত। যেহেতু প্রতিবছরই বাঁশ সংগ্রহের জন্য নতুন নতুন জায়গা বেছে নেয়া হতো, সেই কাটা বাঁশ বয়ে আনার জন্য নতুন নতুন রাস্তাও কাটা হতো। পাঠান এবং পাঞ্জাবি ঠিকাদার সরকারের কাছ থেকে এই সকল রাস্তা তৈরির দায়িত্ব পেয়ে যেত। এই ঠিকাদারেরা বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে অধিক টাকার লোভ দেখিয়ে শ্রমিক সংগ্রহ করে গভীর জঙ্গলে নিয়ে যেত। পাহাড়ে ঝুপড়ি ঘর তৈরি করে এই সব শ্রমিকের থাকার ব্যবস্থা করত এবং নামমাত্র মজুরি দিত। শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের অন্ত ছিল না। আমি অত্যন্ত নিকট থেকে এই অবর্ণনীয় লোমহর্ষক অত্যাচার দেখেছি। আমি ঠিক করলাম এই দাস শিবিরের কাহিনীটা লিখে ফেলি। দেখি রণেশদা কী বলেন।
‘কর্ণফুলীর ধারে’ শিরোনাম দিয়ে প্রথম কিস্তির লেখাটি রণেশদার কাছে রেখে আসি। দুদিন না যেতেই দেখলাম আমার লেখাটি একেবারে উপসম্পাদকীয় কলামে ছাপা হয়েছে। আমি ভীষণ উৎসাহিত বোধ করলাম। তার পরদিন যখোন রণেশদার সঙ্গে দেখা করলাম, রণেশদা একগাল হেসে বললেন, তোমার লেখাটি দেখেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন সমস্ত বিষয়টা লিখে ফেল। আমি প্রতিশ্র“তি দিয়ে চলে আসছিলাম, রণেশ দা বললেন, একটু বসো। এককাপ চা খাও। আমি চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। রণেশ দা ক্যাশিয়ার আয়ুব সাহেবের ঘরে গিয়ে চুপি-চুপি আলাপ করলেন। আয়ুব সাহেব আমাকে পঁচিশটি এক টাকার নোট এনে দিলেন। রণেশদা হেসে বললেন তোমার লেখার যৎসামান্য সম্মানী। তখোনকার বাজারে পঁচিশ টাকা অনেক টাকা। ওই টাকা দিয়ে একটা হৃষ্ট-পুষ্ট খাসি কিনে ফেলা যেত। অথচ আমি দুঘন্টার বেশি পরিশ্রম করিনি।
ওই লেখাটি আমি লিখতে থাকলাম। সপ্তাহে দুদিন প্রকাশিত হতো। লেখাটি অনেকেই খুব পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু আমার কাছে নগদ পঁচিশ টাকার আকর্ষনটি প্রধান হয়ে দাঁড়ালো। ছয় কিস্তি পর্যন্ত আয়ুব সাহেব আমাকে লেখা ছাপা হলেই পঁচিশ টাকা দিয়ে ফেলতেন। কিন্তু তারপরেই ঘাপলা বাধলো লেখাটি দশকিস্তি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আয়ুব সাহেব আমাকে টাকা দিতে অস্বীকার করলেন। আগের কিস্তিগুলোর জন্য নগদ টাকা দেয়া হয়েছে, পরের চারটি কিস্তির টাকা কেন দেয়া হেব নাÑসে ব্যাপারটি নিয়ে আইয়ূুব সাহেবের সঙ্গে আমি দেন-দরবার করতে থাকলাম। আমার ধারণা হয়েছিল, বয়স নেহায়েত অল্প বলেই আয়ুব সাহেব আমার টাকাটা আটকে দিয়েছেন। আমার পীড়াপীড়িতে আবশেষে আয়ুব সাহেব বাধ্য হয়ে জানালেন, রণেশদার সে মাসের পুরো মাইনের টাকাটা আমাকে লেখার পারিশ্রমিক হিসেবে দিয়ে দিতে বলেছেন। রণেশদা সংবাদ থেকে মাসে এক শ’ পঞ্চাশ টাকা পান। ছ’কিস্তির মাথায় সে টাকা শেষ। তিনি আমাকে কোত্থেকে টাকা দেবেন? আর সংবাদে বাইরের লোককে টাকা দেবার কোনো নিয়ম নেই। দেবেও বা কেমন করে? কর্মীদের মাসিক মাইনে দেয়া সম্ভব হতো না।
আমার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’ লিখতে আরম্ভ করেছিলাম। প্রথম অধ্যায় লিখে যখন রণেশদাকে দেখালাম, তিনি বললেন, বেশ তো হচ্ছে, লিখে যাও। পরপর দুটো অধ্যায় লিখেছিলাম এবং রণেশদা সংবাদে ছেপেছিলেন। তারপর লেখাটা আর ধরিনি। রণেশদার তাগাদায় প্র্রায় দু’বছর পরে লেখাটা শেষ করি। সাতষট্টি সালে যখন বই হয়ে বেরুল রণেশদা একটি সুন্দর আলোচনা লিখেছিলেন। সে সময়ে রণেশদা জামিল শরাফী ছদ্মনামেও লিখতেন। ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কিছু উর্দু কবিতাও জামিল শরাফী নামে অনুবাদ করে সংবাদে ছেপেছেন। রণেশদা সংবাদে ‘মনে মনে’ শিরোনামে একটি নিয়মিত কলাম লিখতেন। লেখক হিসেবে ‘মধুব্রত’ নামটা ব্যবহার করতেন। এই সকল সংক্ষিপ্ত রচনার মধ্যে রাজনীতির কচকচি কদাচিৎ স্থান পেত। তার ব্যক্তিমনের ভাবনা-চিন্তাগুলো চূড়ান্ত নির্লিপ্ততাসহকারে প্রকাশ করতেন। এই রচনাগুলোতে ব্যক্তিমনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিস্ফোরণসমূহ এত সুন্দরভাবে প্রকাশ পেত, পাঠকের চমকে না উঠে উপায় ছিল না। আমার ধারণা, রণেশদার উৎকৃষ্ট রচনা তার এই কলামগুলো। তখন পত্রিকায় লেখা নিবন্ধ গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার কথা কেউ চিন্তা করতেন না। আজকের দিনে হলে হয়ত রণেশদাও ওগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে কুন্ঠিত হতেন না। সংবাদ কর্তৃপক্ষ ওই ছড়ানো বিক্ষিপ্ত রচনাগুলো প্রকাশ করার কথা কি চিন্তা করতে পারে না? রণেশদা তো সংবাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। মেধা, মনীষা, উপলব্ধি পূর্ণ দৈর্ঘ্য বি¯তৃত করে কোনোকিছু লেখা রণেশদার পক্ষে সম্ভব হয়নি। রণেশদার যে সমস্ত রচনা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রণেশদার অংশ বিশেষকেই পাওয়া যাবে। রণেশদা সব সময় চাপের মধ্যে থাকতেন। কোথাও না কোথাও ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন হচ্ছে সম্মেলনের জন্য রণেশদাকে লেখা দিতে হবে। সংবাদের কাজের ব্যাস্ততার মধ্যে সময় বের করে নিয়ে তিন স্লিপ কোনো রকমে লিখে শেষ করে রচনাপ্রার্থীকে বিদেয় করতে হতো। গোটা বছর জুড়ে ওই তিন স্লিপ, পাঁচ স্লিপ লেখার কাজটি রণেশদাকেই চালিয়ে যেতে হত। কারা নিচ্ছে, লেখা ঠিকভাবে ছাপা হবে কি না এ নিয়েও রণেশদা কোনোরকম চিন্তা-ভাবনা করতেন না। ছেলেরা লেখা চাইছে ওদের নিরাশ করা যাবে না। আমার সময় নেই, আমি ক্লান্ত, আমার লেখার মুড নেই ওই ধরনের কথা রণেশদাকে কোনোদিন কাউকে বলতে শুনিনি। কোনো কোনোবার কোনো উপলক্ষে ঠিক সময়ে লেখা না পাওয়ার উপক্রম হলে দুর থেকে আসা ছাত্রটির মুখ মলিন হয়ে যেত। রণেশদা সেই ছাত্রটির ক্লান্ত মলিন মুখ দেখে হেসে বলতেন, অমন অধৈর্য হলে কী চলে? এই তো লেখা হয়ে যাচ্ছে। তার হাসিটিও দেখার মত। তিনি হাসতেন না, মুখে ফুল ফুটিয়ে তুলতেন। নিউজপ্রিন্টের প্যাড টেনে নিয়ে ঘষ ঘষ করে লিখে যেতেন পাঁচ স্লিপ। রণেশদা একবার দু:খ করে বলেছিলেন, আমাকে সারাজীবন মুষ্টিভিক্ষা দিয়ে যেতে হল, গুছিয়ে কিছু লেখা সম্ভব হলো না।
শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী যে সমস্ত ব্যক্তি মার্কসীয় সমাজ বিপ্লবের প্রতি অঙ্গীকার সম্পন্ন ছিলেন তাঁদের মধ্যে রণেশদার মত কাউকে নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অতটা সিরিয়াস হতে দেখিনি। নন্দনতত্ত্বের উপর ইউরোপ আমেরিকায় যখনই কোনো নতুন গ্রন্থ প্রকাশিত হতো রণেশদা সেগুলো সংগ্রহ করতে চেষ্টা করতেন। সমকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকদের সম্বন্ধে, তিনি বিশেষজ্ঞের মতামত দিতে পারতেন। আমি তাঁকে আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে সম্পর্কে কথা বলতে শুনেছি। পবলো নেরুদা, পল এলুয়ার, রালফ ফক্স, ক্রিস্টেফার কডওয়েল এঁদের রচনা শুধু নিজে পড়তেন না, অন্যদের পড়তেও অনুপ্রাণিত করতেন। ধ্র“পদী রুশ-সাহিত্য সম্পর্কে তিনি বিশেষ জ্ঞান রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’, ‘মুক্তধারা’ এবং ‘রক্তকরবী’ এই নাটক তিনটি তাঁর খুবই প্রিয় ছিল। রণেশদার যদি অখণ্ড অবসর থাকত, শিল্প-সাহিত্যের নন্দনতাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে অত্যন্ত সমৃদ্ধ অবদান রাখতে পারতেন। এ ধরনের বিষয়ে একটি গভীর গ্রন্থ রচনা করার জন্য যে অখণ্ড অবসরের প্রয়োজন, তা তিনি সারাজীবন কখনো পাননি। আর তিনি এত বেশি খুচরো কাজের মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, হয়ত কোনো একটি বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিল না। তাঁর ‘শিল্পীর স্বাধীনতা প্রশ্নে’ গ্রন্থটিতে ‘আকর্ষিত শিল্পীচিত্ত’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। তিনি লেখাটি ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছিলেন। সমস্ত বাংলা-সাহিত্যে এই ধরনের গভীর মননসম্পন্ন রচনা অধিক নেই।
ফয়েজ আহমদ ফয়েজ রণেশদাকে উর্দুতে মেরে মেহবুব (আমার প্রিয়তম) সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। কোনো কোনো সময় ফয়েজ চিঠিতে এসেন্স মাখিয়ে দিতেন। রণেশদা চিঠিটা নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকতেন। ফয়েজের চিঠি পেলে রণেশদা একধরনের উতলা হয়ে উঠতেন। চিঠিটা বুক পকেটে রেখে দিতেন। যেদিন চিঠি পেতেন, অফিস থেকে একটু আগে কাঠের হাতলের ছাতাটি নিয়ে বেরিয়ে যেতেন। প্রিয়জন কারো সঙ্গে দেখা হলে অত্যন্ত সন্তর্পনে চিঠিটা বুকপকেট থেকে বের করে অত্যন্ত সন্তর্পনে চিঠিটা বুকপকেট থেকে বের করে অত্যন্ত সলজ্জ ভঙ্গিতে একগাল হেসে বলতেন, দেখ ফয়েজ কী লিখেছেন। বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে শোনাতেন।
চিত্তবৃত্তির দিক দিয়ে রণেশদা ছিলেন ক্রিস্টোফার কডওয়েল, আন্দ্রে মালরো, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের যে সমস্ত লেখক বুদ্ধিজীবী স্পেনের বিপ্লবী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং শহীদ হয়েছিলেন সে ধরনের মানুষ। এখন ভেবে দেখছি তাঁর দৈনন্দিন জীবনাচরণের মধ্যে শহীদ হওয়ার একটা আকাক্সক্ষা তিনি লালন করতেন। কোনো মালিন্য তাঁকে স্পর্শ করেনি। অনেকেই কলকাতার সুন্দরী মোহন এভিনিউর লেনিন স্কুলে যে জীর্ণদশার মধ্যে রণেশদা শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন তার উল্লেখ করেন। তাদের অনেকেই হয়ত জানেন না রণেশদা তাঁতিবাজারের যে ঘরটিতে থাকতেন, ওটার অবস্থাও লেনিন স্কুলের চাইতে বিশেষ ভাল ছিল না। রণেশদার একটা সমূহবিপ্লব ছাড়া কারো কাছে চাইবার কিছু ছিল না। একটা আদর্শের প্রতি তিনি নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করেছিলেন। প্রৌঢ়ত্বের চৌকাঠে পা রেখে একটা আত্মজিজ্ঞাসা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের মন ফুঁড়ে জন্ম নিয়েছিল, ‘এই জীবন লইয়া কী করিব।’ যৌবনের প্রতুষে একই প্রশ্ন রণেশ দাশগুপ্তের মনে উদয় হয়েছিল এবং একটি জবাবও খুঁজে পেয়েছিলেন। এই জীবনের বিনিময়ে আমি একটা বিপ্লব সম্পন্ন করিব। বিপ্লব না আসতে পারে, কিন্তু আমি ব্রতভঙ্গ করব কেনÑএটাই তো রণেশ দাশগুপ্ত। সাহিত্যের অঙ্গনটা এখন ভিন্ন হয়ে গেছে। সাহিত্য চর্চাটাও যেন দিন বদলের সাথে কীভাবে বদলে গেছে। এখন পরিচিত মুখ ছাড়া লেখা ছাপাতে রাজী হওয়া সাহিত্য সম্পাদক হাতে গোনা দু’ একজন। যারা লেখা নিয়ে আসে তারাও মেরুদণ্ড সোজা করে আসে কমজন। লেখক সম্পাদক কারোই বুঝি মেরুদণ্ড নেই। প্রায় সবাই তদবির করে লেখা ছাপানোর জন্য। এ সমস্যা শুধু যে সাহিত্যের তা নয়। এটা সামাজিক চিত্র। দেশের বাইরে বাঙালি লেখক কাঁচা টাকা এনে পাতলা জলের আসর বসিয়ে লেখা দিয়ে যাবেন এমন বাস্তবতাও আছে। রণেশ দাশগুপ্ত এ বাস্তবতা দেখলে হার্টফেল করতেন।
রণেশ দাশগুপ্ত এক অবিনাশী আগুন ছিলেন। যার লেখা পড়লে বোঝা যায় তিনি কোন ধারার মানুষ, তার প্রত্যাশা কী ছিলো। রণেশ দাশগুপ্ত একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী ছিলেন। বিপ্লব করা তার উদ্দেশ্য ছিলো। বিপ্লবী হোকা না হোক তবুও বিপ্লবী চরিত্র তিনি ধারণ করতেন। র‌্যালফ ফক্স বা আন্তোনিও গ্রামসি যে ভেতর থেকে মার্কসিস্ট হয়ে ওঠার কথা বলেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত আজীবন সে চর্চাই করেছেন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব হত্যার পরে বিশেষ কিছু কারণে তিনি ভারতে যান। আর ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর কলকাতা পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কলকাতার লেনিন স্কুলের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসেও তিনি কলকাতার কাগজে লিখতেন, সবশেষে রতনবসু মজুমদারের বাসায় স্থান হয়েছিল তার। বিষয়টি আজও জানি না কেন এই অবহেলা।
কী অভিমান নিয়ে আর দেশে ফেরেননি। উদীচী, কমিউনিস্ট পার্টির বহু অনুরোধ সত্ত্বেও আর ফিরতে চাননি তিনি। যখোন রাজী হয়েছিলেন তখোন লাশ হয়ে। রণেশ দাশগুপ্তের সাংবাদিকতা Ñআজ বিরল। এখোন সাংবাদিকতায় কতোটাকা! কি উজ্জ্বল জীবন। যার সামান্য আঁচ তিনি পাননি। পেলেও নিতেন কিনা সন্দেহ। তবে সাংাবদিকতার ইতিহাসে রণেশ দাশগুপ্ত সারাজীবন অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। কেঁচো গরুর ঘিলুর তারতম্যের বিষয়াদি আরো পরিস্কার হবে শুধু তাই নয় একজন মার্কসবাদী তার চর্চার মধ্য দিয়ে জীবনের কোন জায়গায় পৌঁছাতে পারে সাংবাদিক-সাহিত্যক-শিল্পীসংগ্রামী রণেশ দাশগুপ্ত তার বাস্তব প্রমাণ।

দোহাই
১. শিশু বিশ্বকোষ
২. গীতিকবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক আখতার হুসেন এর সাহায্য
৩. গোলাম মোহাম্মদ ইদু, কামাল লোহানী, নির্মলেন্দু গুণ, ইকরাম আহমেদ, নিয়ামত হোসেন-এর সাক্ষাৎকার
৪. রণেশ দাশগুপ্ত স্মারকগ্রন্থ- সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ এবং বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত
৫. উপলক্ষের লেখা-আহমদ ছফা