রণেশ দাশগুপ্তের চিন্তার দিগন্ত: যতীন সরকার

এক
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝিতে যখন আমি কলেজের ছাত্র, তখন থেকেই রণেশদাশগুপ্তের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয়। কঠিন কঠিন লেখার অনেক কিছুই তখন বুঝতাম না যদিও, তবু তাঁর লেখা আমাকে ভীষণভাবে টানত। বারবার পড়তাম। পড়তে পড়তেই কঠিনের প্রতি একটা ভালোলাগা জন্মে গিয়েছিল। কঠিন লেখার এই লেখকটিকে দেখবার ও তাঁর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে জেগেছিল তখনই। কিন্তু সে-ইচ্ছা পূরণ হতে লেগেছিল দীর্ঘদিন। একে তো আমি একজন মফস্বলবাসী নিরীহ ছাত্র- ঢাকায় গিয়ে এত বড় মাপের একজন মানুষের সঙ্গে দেখা করার মতো সাহসই সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি- তার উপর ওই মানুষটির দেখা পাওয়াও তখন খুব সহজ ছিল না। কারণ, কারা প্রাচীরের বাইরে খোলা হওয়ায় তিনি খুব কম সময়ের জন্যই অবস্থান করতে পারতেন।
তার সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় আটষট্টিতে।
ছেষট্টিতে ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশের জন্য একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম। লেখাটি মনোনীত হয়নি, অখ্যাত এক মফস্বলী লেখকের লেখা বলেই হয়তো। কিন্তু হঠাৎ বছর আড়াই পরে একদিন ‘রোববারের সংবাদ’-এর প্রায় পুরো এক পাতা জুড়ে ছাপা হতে দেখলাম আমার সেই লেখাটি- ‘পূর্বপাকিস্তানের কাব্যসাহিত্য’, বেশ বড় ছিল বলে সম্পূর্ণ লেখাটি ছাপা হতে লাগল পরপর তিন রোববার। খোঁজ নিয়ে জানলাম : জেল থেকে বেরিয়ে ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্ব নিয়েই পুরনো ফাইলে রণেশদা আমার লেখাটি দেখতে পান, পড়ে তাঁর পছন্দ হয়, এবং ছেপে দেন। এর পরপরই ‘সংবাদ’ অফিসে গিয়ে আমি রণেশদা’র সঙ্গে দেখা করি। প্রথম পরিচয়েই তিনি আমাকে একান্ত আপন করে নেন, তাঁর স্নেহলাভে আমি ধন্য হয়ে যাই।
এর কয়েকদিন পরই তিনি ময়মনসিংহে আসেন। আমরা প্রেসক্লাবে তাঁকে সংবর্ধনা জানাই, ময়মনসিংহ শহরের সঙ্গে রণেশদা’র একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এরপর অনেকবার অনেক উপলক্ষে তিনি ময়মনসিংহে এসেছেন, কয়েকবার আমার বাসাতেই রাত্রিযাপন করেছেন। তাঁর স্নেহসান্নিধ্য আমাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর সঙ্গে দেশের নানাস্থানে সভা-সমিতিতে যোগ দিতে গিয়েও আমি অনেক উপকৃত হয়েছি, তাঁর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতে পেরেছি।
কিন্তু পচাঁত্তরের আগস্টের পরে তিনি দেশত্যাগ করে কলকাতা প্রবাসী হওয়ার পর থেকে তাঁর সাক্ষাৎ বা সান্নিধ্য লাভের সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাঁর মৃত্যু তো সে-সৌভাগ্য থেকে আমাকে চিরবঞ্চিতই করেছে তবে তাঁর চরিতামৃত থেকে স্মৃতির স্বর্ণপাত্রে যা ধরে রাখতে পেরেছি, তা কেড়ে নেয়ার সাধ্য কারো নেই। সেটুকুই আমার পরম সম্পদ।
দুই
রণেশ দাশগুপ্তের মৃত্যুটাকে আকস্মিক বলা যাবে না নিশ্চয়ই। তবু পঁচাশি বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসানকে যেন অকাল প্রয়াণ বলেই মনে হয়। কারণ ‘কাল’ তাঁর দেহে জরার সঞ্চার করলেও মনের ওপর একটুও আঁচড় কাটতে পারেনি। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি ছিলেন জাগ্রত-চৈতন্য মহাপুরুষ, ছিলেন জাড্যমুক্ত চিন্তার অধিকারী ত্রিকালজ্ঞ কালপুরুষের মতো। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ইতিহাস দর্শন তাঁকে যেমন অতীতকাল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছিল, তেমনি বর্তমানকালের বিশ্লেষণে দিয়েছিল স্পষ্টতা। আবার ভাবীকালের রূপটিও তাঁর কাছে ছিল একান্ত স্ফটিক স্বচ্ছ। মানব ইতিহাসের ছন্দজ্ঞান তিনি খুব ভালোভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক আস্তিকতা ছিল তাঁর সত্তার গভীরে প্রোথিত। তাই সংশয় ও হতাশা কখনো তাঁর ধারেকাছে ঘেষতে পারেনি। দুঃখে অনুদ্বিগ্ন ও সুখে বিগতস্পৃহ এই স্থিতধী মানুষটি মাবনজাতির উজ্জল ভবিষ্যতের প্রতি সবসময় নিশ্ছিদ্র আশাবাদ পোষণ করতেন। তাই বলে তার সে আশাবাদ মোটেই নিস্ক্রিয় কিংবা দৈবনির্ভর ছিল না। ছিল না একমাত্রিকও । বাস্তবের বহুমাত্রিকতার প্রতি তার দৃষ্টি ছিল বলেই প্রতি ঘটনাকে তিনি সনিষ্ট ও বস্তনিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন, কোন কিছুর প্রতিই অকারণ মোহ পোষণ করতেন না। প্রতি নিহত তিনি আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতেন। তাই সমাজতন্ত্রের প্রতি অবিচল প্রত্যয় সম্পন্ন রণেশ দাশগুপ্ত জীবনের গোধুলী বেলায় যখন সমাজতন্ত্রের অচিন্তিত-পূর্ব বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করলেন, তখনও তিনি বির্পযস্ত বা বিচলিত হলেন না, অথচ বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে উল্টো রথের টান দেখে বাঘাবাঘা সমাজতন্ত্রীদের অনেকেই সীমাহীন চিত্তবৈকল্যে আক্রান্ত হলেন, অনেকেই বিশ্বাসের দিক থেকে একেবারেই দেউলিয়া হয়ে পড়লেন। অনেকেই সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদ তথা মার্কসবাদের মতো একটি ‘বোগাস’(!) ধারণা নিয়ে এতদিন মোহাচ্ছন্ন ছিলেন বলে এবার মরমে মরে গেলেন। অনেকে ‘থুক্কু’ বলে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে আশ্রয় নিলেন, অনেকে হতাশার অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে রইলেন। কিন্তু, কী আশ্চর্য, রণেশ দাশগুপ্তকে এরকম কিছুই করতে হলো না। সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের মুখে সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদের প্রতি তাঁর আস্থা বরং আরো দৃঢ় হয়ে উঠলো, হতাশার বদলে তাঁর আশাবাদ আরো অনেক গভীরে শিকড় ছড়িয়ে দিল, ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা’ তাঁর বার্ধক্য-জীর্ণ শরীরে যৌবনের নতুন জোয়ার নিয়ে এলো।
১৯৯৪-এর এপ্রিলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত তাঁর বই ‘সাম্যবাদী উত্থান-প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’র মুখবন্ধটি পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়লাম। তিনি লিখেছেন-
“…শতাব্দীর শেষের মুখে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়কর পরিস্থিতি। এই বিপর্যয়ও আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়োজনও আজই দেখা দিচ্ছে না।
১৯৯৪-এর হিসাবের খাতাগুলি সামনে রেখে দেখা যাবে, দু’শ বছর আগে ফরাসী বিপ্লবে যে জাতীয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই লোকরাষ্ট্র শুধু ইউরোপে নয় পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশেও গণপ্রজাতন্ত্র ও সাম্যমৈত্রী স্বাধীনতার আদর্শ এবং মুক্তবুদ্ধির বিদ্রোহী বিপ্লবী জয়বার্তাকে পৌঁছে দিয়ে নিজে ভেঙে পড়েছিল দু’দশক পরেই। ফিরে এসেছিল ফরাসি রাজবংশ ও রাজতন্ত্র মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রীদের সহায়তা ও সহযোগিতায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই রাজতন্ত্র অধিষ্ঠিত থাকে। ১৮৪৮ সালে প্যারি নগরীর শ্রমিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিরে আসে প্রজাতন্ত্র। দ্বিতীয় পর্বে রাশিয়ায় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সারা পৃথিবীতে তার চিন্তাভাবনা ও নির্মাণের ধারার জয়বার্তাকে বিশ্বের কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণভাবে পৃথিবী জুড়ে ফরাসি ধরনের গণপ্রজাতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতা ও লোকায়ত গণতন্ত্রকে প্রকৃতপক্ষে বর্তমান শতাব্দীতে বিশ্ব বিজয়ী হতে সাহায্য করলেও চুয়াত্তর বছরের মাথায় এসে নিজে বিপর্যস্ত হয়ে গেল। আত্মপ্রত্যয়ের মতোই আত্মজিজ্ঞাসার একটা পরস্পরা লক্ষণীয়।
ফরাসি বিপ্লবী প্রজাতন্ত্রের পতনের পর পুনরুত্থানের বিভিন্ন প্রয়াসের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এবং বহুজনের বহুমাত্রার বহুমুখী চিন্তাভাবনা ও উত্তরণের প্রয়াসের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছিল সাম্যবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার তথা সমাজতন্ত্রের চিন্তাভাবনা ও প্রয়াস কার্ল মার্কস ও এঙ্গেলসের এবং তাঁদের সাথীদের উদ্যোগ। এই মার্কসীয় সাম্যবাদী লোক উত্থানের ধারক-বাহক লেনিন ও তাঁর সাথীরা লোক-উত্থানের মাধ্যমে যে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র স্থাপন করেন তার সমূহ বিপর্যয় সাম্যবাদী চিন্তাভাবনা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও নির্মাণের প্রশ্নে আত্মজিজ্ঞাসার যে ধারা, রুশ বিপ্লবের পরে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উত্থাপিত হয়েছে তাকে মার্কসীয় চিন্তা ও প্রয়োগে নূতনতর উত্তরণে নিয়োজিত করতে হবে।”
কথাগুলো পড়তে পড়তে রণেশদা’র শান্ত অথচ দৃঢ় মুখচ্ছবিটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। প্রচণ্ড ঝড়-ঝাঞ্ঝা-বজ্রপাতেও অনুদ্যম বা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা এই মানুষটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়েও তিনি নির্লিপ্ত চিত্তে আত্মসমীক্ষা করতে পারেন, অন্যকেও আত্মসমীক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। সবসময়ে ও সব অবস্থায় রণেশ দাশগুপ্ত মানুষের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দৃঢ় প্রত্যয়ী।
অবাক হয়ে ভাবি: কী করে এমনটি হতে পারল?
এমটি হতে পারার কোনো একটি বিশেষ হেতু নিশ্চয়ই নির্দেশ করা চলে না। বহু হেতুর শৃঙ্খলা ও পরম্পরা এর পেছনে সক্রিয় ছিল। সর্বপ্রধান হেতুটি, আমার মনে হয়েছে, জীবনের কোনো পর্যায়েই উপর-চালাকি কিংবা পল্লবগ্রাহিতাকে প্রশ্রয় না দেয়া। রণেশ দাশগুপ্ত পরের মুখে ঝাল খাননি কখনো। সব কিছু নিজে যাচাই-বাছাই করে গ্রহণ করেছেন, তত্ত্বের বাস্তব রূপ প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছেন। এ-কারণেই ‘মার্কসবাদ’ নামে পরিচিতি দর্শনটিকে তিনি গায়ের ওপর আবরণের মতো জড়িয়ে রাখেননি, কিংবা শৌখিন আভরণ বা অলংকারের মতোও ব্যবহার করেননি। কঠোর অনুশীলন ও সনিষ্ঠ অনুসরণের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ তাঁর জীবনদর্শনে পরিণত হয়েছিল। সেই দর্শনটিকে আত্মস্থ করেই তিনি সাচ্ছা কমিউনিস্ট হয়েছিলেন, হুজুগে পড়ে শখের কমিউনিস্ট হননি।
কমিউনিস্টদের কঠোরভাবে পার্টির ‘গণতান্ত্রিককেন্দ্রিকতা’র নিয়ম মেনে চলতে হয়। গণতান্ত্রিককেন্দ্রিকতা মানতে গিয়ে অনেক সময়েই ব্যক্তিগত বিবেচনা ও প্রতয়কে বর্জন করতে হয়, অন্তত স্থগিত রাখতে তো হয়ই। স্বাধীন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ববান মানুষের পক্ষে এমনটি করা প্রায়শই খুব কঠিন হয়ে পড়ে। তাই দেখা গেছে, অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীই কমিউনিস্ট পার্টিতে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। এরকম কেউ কেউ তো স্বাধীন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে পার্টির বিরোধী অবস্থানেও চলে গেছেন। রণেশ দাশগুপ্ত এক্ষেত্রেও বিস্ময়কর ব্যতিক্রম। তিনি গণতান্ত্রিককেন্দ্রিকতার নিয়ম মেনে পার্টির প্রতি আনুগত্য রক্ষা করে চলেছেন সারাজীবন, কিন্তু স্বাধীন চিন্তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি এক মুহূর্তের জন্যও। ষাটের দশকে ‘পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন ধরিয়ে একদল লোক ‘পিকিংপন্থি’ নামে পরিচিত হলেন। পিকিংপন্থি পরিচয়েও তাঁরা অবশ্যি একত্রে থাকতে পারেননি, অচিরেই পরষ্পর বিরোধী অজস্রখণ্ডে বিভক্ত হয়ে যান। রণেশ দাশগুপ্ত পার্টি ভাঙার প্রক্রিয়াকে ঘৃণা করতেন বলেই কখনো পিকিংপন্থিদের সাথে যুক্ত হননি, পার্টির মূলধারাতেই থেকে গিয়েছিলেন। তাই তাঁর নামের সঙ্গেও পিকিংপন্থির বিপরীতে ‘মস্কোপন্থি’ লেবেলটি জুড়ে গিয়েছিল। আসলে কিন্তু তিনি ছিলেন প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদী কমিউনিস্ট, তথাকথিত মস্কোপন্থা কিংবা পিকিংপন্থার বালখিল্যতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিবার মনোবৃত্তি তাঁর ছিল না। মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বের ব্যাপারে কোনো এক পক্ষকে সঠিক বা বেঠিক বলতে তিনি রাজি ছিলেন না। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে তখনকার সেই বিরোধ তাঁর চিত্তে গভীর বেদনার সঞ্চার করেছিল। সে-সময়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমি এরকমই উপলব্ধি করেছি। সোভিয়েত ও চীন দু’দেশের কমিউনিস্ট পার্টিই যথেষ্ট পোড় খাওয়া, দুটো পার্টিই বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। অথচ এই দুটো পার্টির ভেতরেই যে নানা ধরনের বিচ্যুতির প্রবেশ ঘটেছে এবং তার ফলে বিশ্ববিপ্লব প্রক্রিয়ায় যে সংকট ও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে, সেজন্য রণেশ দাশগুপ্ত’র কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ত। তবে চীন-সোভিয়েত বিরোধের তীব্রতার দিনগুলোতে তিনি গড়পরতা কমিউনিস্টদের মতো এদের কারো সম্পর্কে অসংযত বাক্য উচ্চারণ করতেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মস্কোপন্থি’দের অন্তর্ভুক্ত থেকেও তিনি চৈনিক বিপ্লবের নেতাদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবান ছিলেন। মাওয়ের ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ নীতির একান্ত অনুরাগী রণেশ দাশগুপ্ত হাঙ্গেরির লুকাচ, ইতালির গ্রামসি ও পোল্যান্ডের অ্যাডাম শাফের মতবাদ অনুধাবনেও যথেস্ট মনোযোগী হয়েছিলেন। ষাটের দশকে এঁদের সম্পর্কে আমাদের দেশে আর কোনো মার্কসবাদী সচেতন ছিলেন বলেই মনে হয় না। তাই মার্কসবাদের নামে এদেশের কমিউনিস্টরা এক ধরণের যান্ত্রিক জীবনদৃষ্টিরই আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। এই যান্ত্রিকতা পরিহার করার মধ্যেই রণেশ দাশগুপ্তে’র স্বাতন্ত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি যা অবলোকন করতে পারতেন, অন্যেরা তা পারতেন না। কারণ রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন দ্বান্দ্বিক দৃষ্টির অধিকারী, অন্যদের দৃষ্টি নিতান্তই যান্ত্রিক। একারণেই সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির ‘অফিসিয়াল’ মতের সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের নিজস্ব ভাবনার একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল বলে আমার মনে হয়। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে রণেশ দাশগুপ্তের একটি লেখায় পার্টির অভিমতের সঙ্গে তাঁর অনৈক্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার ‘মূল্যায়ন’ পত্রিকায়। ‘মূল্যায়ন’ ছিল একটি মার্কসবাদী তাত্ত্বিক পত্রিকা। সেই পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাটিতে তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট’র মত ও পথের অনেক দিকেরই সমালোচনা করেছিলেন। পার্টির জনগণের জন্য ‘বাসি খাবার পরিবেশন’ করেছে- অর্থাৎ অনেক ব্যাপারেই অনেক বিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে- এমন অভিযোগ তিনি উত্থাপন করেছিলেন। পার্টির নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এ লেখাটির একটি জবাব ‘মূল্যায়ন’-এরই পরবর্তী সংখ্যায় ছাপা হলেও রণেশ দাশগুপ্তের বক্তব্যই আমাদের কাছে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয়েছিল।
তিন
রণেশ দাশগুপ্ত আমরণ বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যদিও, তবু সাহিত্য-সংস্কৃতিই ছিল তাঁর আসল বিচরণ ক্ষেত্র। তাঁর রাজনীতি ছিল সংস্কৃতি সাধনারই অঙ্গ। ‘সংস্কৃতিই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, রাজনীতি সে লক্ষ্যসাধনের একটি উপায় মাত্র’- লুকাচের এই প্রত্যয়ের সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তের ছিল একান্ত একাত্মতা। সংস্কৃতি সাধনাই ছিল তাঁর জীবন সাধনা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদভিত্তিক জীবনদর্শনই ছিল তাঁর জীবনসাধনার চালিকাশক্তি।
বৈপ্লবিক সংস্কৃতি সাধনায় দেশের শিল্পী সমাজকে উদ্ধুদ্ধ করে তোলার তাগিদেই রণেশ দাশগুপ্ত, স্বাধীনতার পরে, “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’র হাল ধরেছিলেন। রণেশ দাশগুপ্তই সত্যেন সেন-প্রতিষ্ঠিত ‘উদীচী’র বেড়ে ওঠার ও শক্ত হয়ে ওঠার কাজটি পরম নিপুণতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন। পঁচাত্তরের আগষ্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশে যে-সময়ে বর্বরতার অন্ধকার নেমে এসেছিল, সে-সময়েই দেশান্তরী হয়েও রণেশদা বাংলাদেশকে যেমন ভোলেননি, তেমনি ভোলেননি ‘উদীচী’কেও। মনে পড়ে, আশির দশকের গোড়ায় রণেশদা একটি চিঠিতে ‘উদীচী’কে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত একটি লোকগাথার নায়ক জৈত্যা হিরালি’র প্রতি। গ্রামীণ লোকসমাজের বিশ্বাস: হিরালিরা (‘শিরালি’ কথাটিই আঞ্চলিক উচ্চারণে প্রথমে ‘হিলারি’ ও পরে ধ্বনি বিপর্যয়ের ফলে ‘হিরালি’ হয়ে যায়) মন্ত্রের সাহায্যে শিলাবৃষ্টিজনিত বিপর্যয়ের হাত থেকে ক্ষেতের শস্যকে বাঁচাতে পারে। তাই হিরালির প্রতি গ্রামের কৃষকদের একান্ত নির্ভরতা। হিরালিরাও গ্রামসমাজের মানুষদের আস্থা ও নির্ভরতার যথাযথ মর্যাদা দেয়, মন্ত্রের প্রতি অসীম বিশ্বাস নিয়েই প্রাণপণ প্রয়াস গ্রহণ করে শিলাবৃষ্টি প্রতিরোধের জন্য। ‘জৈত্যা’ ছিল এমনই একজন হিরালি। জৈত্যা হিরালি মন্ত্র দিয়ে কৃষকদের ক্ষেতের ফসল বাঁচাতে পারেনি বটে, কিন্তু সে নিজের জীবন উৎসর্গ করে তার কমিউনিটির সঙ্গে একাত্মতা রক্ষা করেছিল। সেই মর্মস্পর্শী গাথাটির প্রতি রণেশদা ‘উদীচীর’র তরুণ শিল্পীদের মনোযোগী করে তুলতে চেয়েছিলেন এবং উপদেশ দিয়েছিলেন সেই গাথাটির নবরূপ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মানুষদের সামনে তুলে ধরতে। ‘উদীচী’র তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকের কাছে লেখা সেই চিঠিটিতে তিনি আমার মতো অভাজনের কথাও স্মরণ করেছিলেন, কারণ আমি ময়মনসিংহের লোক।
ময়মনসিংহের ‘উদীচী’ রণেশদা’র উপদেশ পালন করতে চেষ্টা করেছিল। উদীচীর শিল্পী তাপস চক্রবর্তী জৈত্যা হিরালির গাথা অবলম্বনে একটি নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন। তাঁরই পরিচালনায় ও অংশগ্রহণে ময়মনসিংহে সেটি মঞ্চস্থ হয়েছিল উদীচীর জেলা সম্মেলনে। সে সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ডক্টর মুস্তাফা নূর-উল ইসলাম। তিনি নৃত্যনাট্যটির অকুন্ঠ প্রশংসা করেছিলেন।
রণেশদা’র ওই চিঠিটির সূত্র ধরে আমি বলি: বাংলাদেশের সকল প্রগতিকামী সাংস্কৃতিক সংগঠনেরই উচিত জৈত্যা হিরালির অনুরূপ লোকগাথাগুলো খুঁজে বের করে সেগুলোকে নৃত্যনাট্যসহ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমে জনগণের সামনে উপস্থিত করা। চিরায়ত লোকসংস্কৃতির নবরূপায়ণ ঘটানোর যে দায়িত্বের কথা রণেশদা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সে দায়িত্ব পালনে ব্রতী হলেই আমরা সর্বদা চিরঞ্জীব রণেশদা’র স্নেহ-সান্নিধ্য অনুভব করে ধন্য হতে পারব।
রণেশদা’র একটি বইয়ের নাম ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালা।’ নামটি খুব ইঙ্গিতবহ ও তাৎপর্যময়। আলো দিয়ে আলো জ্বালানোই তো মানুষ হিসেবে মানুষের প্রধান কাজ। এই কাজের মধ্য দিয়েই তো মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রবহমান থাকে।
রণেশদা সারাজীবন ধরে আলো দিয়ে আলো জ্বালানোর কাজটিই করে গেছেন। দেশ-বিদেশের সকল যুগের সকল মহান শিল্প-সাহিত্যিক-লেখকদের জ্বালিয়ে দেয়া আলোকে আমাদের আলোকিত করে তোলাকেই রণেশদা তাঁর লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য করে নিয়েছেন।
তাঁর সেই উদ্দেশ্যের ধারাবাহিকতার সঙ্গে আমাদের যুক্ত থাকতেই হবে। সে-যুক্ততার দায় আমরা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারি না।
কিন্তু আমরা কিসে দায় বহনের তাগিদ অন্তর থেকে অনুভব করেছি। যে ‘আত্মজিজ্ঞাসা’র গুরুত্বের কথা রণেশদা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন, আমরা কি সে আত্মজিজ্ঞাসা’র মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছি! আমরা কি রণেশদা’র জ্বেলে দেয়া আলোকশিখাটিকে অনির্বাণ রাখার এবং এর থেকে আরো আলো জ্বালাবার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছি?
এসব প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। এসব প্রশ্নই আমাদের ঘা মেরে জাগিয়ে তুলবে।