যতবার হত্যা করবে, জন্মাবো আবার, গড়বো নতুন ইতিহাস: কংকন নাগ

সন ২০০৫। বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কময় এক অধ্যায়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর বছর। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতাকারী ও স্বাধীনতার পরও নানাভাবে অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী মানুষকে যে গোষ্ঠী নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে, সেই জামায়াতে ইসলামী তখন এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ২০০১ সালে জামায়াত ক্ষমতায় যাওয়ার ফলশ্র“তিতে দেশে তখন মারাত্মকভাবে উত্থান ঘটেছে জঙ্গিবাদী মৌলবাদী গোষ্ঠীর, যার প্রমাণ তারা একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে রেখে যাচ্ছিল। এসব অপতৎপরতারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০০৫ সালে। ওই বছরই ১৭ আগস্ট সংঘটিত হয় সিরিজ বোমা হামলার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা, যার মাধ্যমে জঙ্গি, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী তাদের শক্তি সম্পর্কে পুরো দেশের মানুষকে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এরপর সংঘটিত হয় বিভিন্ন জেলার আদালতে ও সিনেমা হলে বোমা হামলা। এই সমস্ত হামলা ও সহিংসতার প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ। আর এ কারণেই তাদের সর্বশেষ হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল বাংলাদেশে একটি মৌলবাদমুক্ত, সকল ধরণের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী, প্রগতিশীল, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতার আগে থেকেই নিরন্তরভাবে কাজ করে আসা সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস হওয়াতে তখন দেশজুড়ে উদীচী’র সকল জেলা ও শাখা সংসদই ব্যস্ত ছিল বিজয় দিবস উদযাপনের নানা ধরণের প্রস্তুতিতে। কেউ আয়োজন করছিল সঙ্গীতানুষ্ঠান, কেউ বা নাট্যোৎসব আবার কেউ বা আয়োজন করতে যাচ্ছিল প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সারাদেশের মতো উদীচী’র নেত্রকোনা জেলা সংসদও ব্যস্ত ছিল ১৬ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনে। আর এসব আয়োজনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন উদীচী নেত্রকোনা জেলা সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক খাজা হায়দার হোসেন এবং সংগঠন বিষয়ক সম্পাদক সুদীপ্তা পাল শেলী।

২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টার দিকে নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের লাগোয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন শতদল গোষ্ঠীর কার্যালয়ে একটি বোমা পড়ে থাকতে দেখে এক টোকাই। বিষয়টি জানাজানি হলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উদীচী’র নেতৃবৃন্দও ভীড় করেন ঘটনাটি দেখতে। নাড়াচড়া করার এক ফাঁকে বোমাটি বিস্ফোরিত হলে তাতে তিনজন আহত হয়। ওই ঘটনায় আরো বেশি মানুষ ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যায়। উদীচীর কার্যালয়ের পাশেই বোমা বিস্ফোরিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সেখানে উপস্থিত হন খাজা হায়দার হোসেন এবং সুদীপ্তা পাল শেলীসহ উদীচী’র অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো এলাকায় নিরাপত্তা বেস্টনী দিয়ে ঘিরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রথম বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার ঘন্টাখানেক পর সাইকেল আরোহী এক যুবক নিরাপত্তা বেস্টনী পেরিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে যেতে চাইলে কর্তব্যরত পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ওই যুবক উদীচী নেতৃবৃন্দের কাছাকাছি পৌঁছেই তার সাইকেলে বহন করে আনা বোমা বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটালে ছিটকে পড়েন বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলেই মারা যান উদীচী’র সহ-সাধারণ সম্পাদক খাজা হায়দার হোসেন এবং রানী আক্তার। আর হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান যাদব দাস, রইস উদ্দিন, আখতার উদ্দিন ও ভিক্ষুক জয়নাল। আরো মারা যায় আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আল রাফি মোহাম্মদ কাফি।

বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হন নয়জন পুলিশ সদস্য এবং উদীচী’র বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীসহ অন্তত ৬০ জন। তাদের মধ্যে উদীচী’র তৎকালীন সংগঠন বিষয়ক সম্পাদক সুদীপ্তা পাল শেলী, সাধারণ সম্পাদক সানাওয়ার হোসেন ভূঁইয়া, সহ-সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান খান ভুট্টু, সহ-সভাপতি সুফিয়া বেগম, প্রচার সম্পাদক সুষমা বণিক মলু, কার্যকরী কমিটির সদস্য বিমল সাহা ও তুষার কান্তি রায়, উদীচী পরিচালিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিথুন সরকার এবং মুন্না দেবনাথ, টিটু ও রনি উল্লেখযোগ্য। আশঙ্কাজনক অবস্থায় শেলীসহ আহতদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পরদিন মারা যান সুদীপ্তা পাল শেলী।

নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথেসাথেই ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে উদীচীসহ সকল সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ। ঢাকায় তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ সমাবেশ। যাতে যোগ দিয়ে হাজারো জনতা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। এছাড়া, দেশের অন্যান্য জেলায়ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে উদীচী’র নেতা-কর্মীরা। দেশের আপামর জনতা দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন এ হামলার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি।

নেত্রকোনা বোমা হামলার ঘটনায় ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসেই মামলা দায়ের করা হয়। তবে, তৎকালীন সরকার মামলার তদন্ত নিয়ে শুরু থেকেই গাফিলতি ও অযথা কালক্ষেপণ করতে থাকে। পাশাপাশি চলতে থাকে উদীচী’র নেতা-কর্মীদের নানা ধরণের হয়রানি। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালের শেষ দিকে মামলার চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হলে বিচারকাজে গতি আসে। সবশেষ ২০০৮ সালে মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত বাংলা ভাই এবং জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সানির ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। একইসাথে বাংলা ভাইয়ের স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এই মামলার বিচারকাজ দ্রুত সম্পন্ন হওয়ায় স্বস্তি পেলেও ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচী’র দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলায় দশজন শিল্পী-কর্মীর মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এখনো না পাওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে শিল্পী-সাংস্কৃতিক সংগঠক ও কর্মীসহ সাধারণ মানুষের মনে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের ইতিহাসে জঘন্যতম ও বর্বরোচিত যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে যশোর ও নেত্রকোনার বোমা হামলার ঘটনা দু’টি অন্যতম। এ দু’টি ঘটনায়ই সরাসরি লক্ষ্যবস্তু ছিল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী এবং অপরাপর প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে বোমা হামলার যে নির্মম অপসংস্কৃতি শুরু হয়েছিল যশোরে উদীচী’র শিল্পী-কর্মীদের রক্তাক্ত করার মধ্য দিয়ে, সেই অপসংস্কৃতির সবশেষ শিকার ছিল নেত্রকোনার উদীচী’র শিল্পী-কর্মীরা।

ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী ও অপরাপর গোষ্ঠীর সাথে প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক সাম্যবাদী চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বিরোধ অবশ্যসম্ভাবী। উদীচী যেখানে গান, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্য ও শিল্পকলার অন্যান্য মাধ্যমকে ব্যবহার করে মৌলবাদী গোষ্ঠীর মুখোশ বারবার উন্মোচিত করেছে, সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বারবারই কাপুরুষের মতো গোপনে পেছন থেকে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে উদীচী’র কণ্ঠস্বর। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যতবার উদীচী’র উপর হামলা হয়েছে ততবারই স্তিমিত বা নিস্তেজ না হয়ে দ্বিগুণ শক্তিতে প্রবল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়িয়েছে উদীচী। আর, উদীচী’র এই শক্তি, এই মনোবলের প্রধান কারণ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এদেশের কোটি কোটি জনতা যারা হিংসা চায় না, ধ্বংস চায় না, চায় না কোন সহিংসতা বা সংঘাত। তাই এই শান্তিপ্রিয় জনগণকে সাথে নিয়েই স্বপ্নের সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে যাবে উদীচী। যত বাধাই আসুক উদীচী থামবে না, উদীচী থামতে পারে না।

১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে উদীচীর পঁয়তাল্লিশ বছরের সুদীর্ঘ ইতিহাস নানা চড়াই-উৎরাই, বাধাবিপত্তি, আনন্দ বেদনার ইতিহাস। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামে অনবদ্য ভূমিকা পালন এবং অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল জাতি গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে উদীচী।

দেশের রাজনীতিতে এখন যে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে তাতে উদীচী’র ভূমিকা আরো বেশি করে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। জামাতসহ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিসমূহের নৈরাজ্য জাতিকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। প্রতিনিয়ত মানুষ মারা যাচ্ছে, কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাসায় ফেরার কোন নিশ্চয়তা নেই কারোরই। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে সাধারণ খেটে খাওয়া নিরীহ মানুষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে চলছে তালবাহানা। যাদের বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে তাদের রায় কার্যকরের কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এরকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় উদীচী তার দীর্ঘদিনের লালিত ঐতিহ্য অনুযায়ী সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মাধ্যমে জাতিকে আবারও সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করবে নিশ্চয়।