মহান বিজয়ের মাসে মনুষত্বের মহাবিপর্যয়: এএন রাশেদা

ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালে সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের দ্বরপ্রান্তে পৌছেছিলাম। পাক বাহিনী ৪:৩১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে মিত্র বাহিনীর কাছে তাদের সহযোগী বাহিনী (অক্সিলারি ফোর্স) অর্থাৎ জামাত রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ আত্মসমর্পন করেছিল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীন দেশে সেই সহযোগি বাহিনী কারাগারে অন্তরীণ হয়েছিল এবং মুসলিম লীগ, নিজামে ইসলাম ও জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছিল। তাদের বিচার কাজ শুরু হয়েছিল, যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল। যাদের সে ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল না শুধু তারাই ছাড়া পেয়েছিল। অপরাধীদের মধ্যে একজনের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু ৭৫ পরবর্তীতে সামরিক জান্তা সে সব রাজাকার, আলবদরদের মুক্ত করেছিল। আজ তারাই সারা দেশে তা-ব করছে। ২০১০ সালে সেইসব যুদ্ধাপরাধীদের নতুন করে বিচার কাজ শুরুর কারণে। ইতোমধ্যে বিচারালয় কর্তৃক জামাতকে ক্রিমিনাল দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচন অযোগ্য ঘোষণা করেছে। এইসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই তারা হরতাল ও অবরোধের মত কর্মসূচি দিয়ে জঘন্যতম অপরাধ সংঘটিত করে নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত করেই চলেছে। একটি হরতাল শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আরেকটি হরতাল আহবান করছে। এবং হরতাল শুরুর আগেই ট্রাক বা সিএনজি চালকদের জোর করে দরজা বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে- নৃশংসতার শেষ সীমা আর কী হতে পারে! ১ ডিসেম্বর অবরোধ শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টা আগে রাজশাহীতে ধান বোঝাই চারটি ট্রাক ও ওষুধের গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হলো। হরতাল শুরুর আগেই বিশাল বিশাল গার্মেন্টস বোঝাই লরিতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে, রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে মোটর সাইকেল থেকে পেট্রোল বের করা হচ্ছে আগুন দেবার জন্যই, আবার কেউ কেউ পেট্রোল ঢালছে, কেউ দিয়াশলাই জ্বালাচ্ছে- সবই সচিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, টিভিতে প্রদর্শিত হচ্ছে- কিন্তু তারা আটক হচ্ছে বলে প্রকাশিত খবর বলছে না। খবরে বলা হচ্ছে সন্দেহে ধরা হচ্ছে। এতে অনেক নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে আর পুলিশের পকেট ভরছে। ‘চোর চাই, যে-ই হোক চোর’। আর দেশ ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষক তার কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারছে না কারণ ব্যবসায়ীরা তা কিনতে যাচ্ছে না। গোয়ালারা দুধ ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছে, শ্রমিক তার কাজ হারাচ্ছে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে একই সঙ্গে দশটি ফ্লোরেই আগুন দিয়ে শত শত কোটি টাকা নি:শেষ করা হচ্ছে-সারাদেশ আজ অগ্নিশিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। জ্বলছে খেটে খাওয়ার মানুষের পেট। এ আগুন ব্যবসায়ী, বড় শিল্পপতিসহ ছোট, মাঝারি সবার গায়েই লেগেছে। একদিকে খাদ্য পরিবহনে বাধার কারণে তা সর্বত্র গমনাগমন করতে পারছে না। অন্যদিকে মানুষ যথেষ্ট খাদ্য পাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সাধারণ মানুষ দুই দল এবং তাদের নেত্রীদেরই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। এ বিষয়ে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছেন ১ ডিসেম্বর শাহবাগে বাসে অগ্নিদগ্ধ গীতা সেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনার হাত ধরে বলেন, “আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।” ‘আমরা খালেদারেও চিনি না, হাসিনার কাছেও যাইনা।’ ‘আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। […] আমরা ভাল সরকার চাই […] অসুস্থ সরকার চাই না।’ ‘ওরা যারা বোমাগুলো মারে বা যাই মারে, ওদের শনাক্ত করুণ এবং যারা অর্ডার দেয় তাদের পরিবারের লোককে ধরে ধরে আগুনে পুড়িয়ে দেন।’ আর ঐ বাসেই ঢাকা কলেজের ছাত্র ওহিদুর রহমান বাবু পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়ার পর তার মা বললেনÑ‘সরকার রাজনীতি করে/পাবলিকের ঘর ভাঙে’ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেত্রী কি তাদের বক্তব্য বুঝতে পারছেন? বা সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন? প্রধানমন্ত্রী ‘ভাল সরকার’ করবেন কিভাবে? দশম জতীয় সংসদ নির্বাচনে ১২ জন বিতর্কিত প্রার্থীকে এমপি হিসেবে নির্বাচনে জিতিয়ে নিয়ে এসে? যারা গডফাদার হিসেবে পরিচিত? সুস্থ্য সরকার গঠনের কোনো নিশ্চয়তা কি দিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? কি সান্তনা এসব আগুনে অঙ্গার হওয়া, তিলে তিলে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষগুলোর জন্য? শুধু আগুনে পোড়াই তো না, প্রতিদিন যারা ট্রেনে কাটা পড়ছে, মারা যাচ্ছেÑতাদের কে দেবে সান্তনা? রেলগাড়ির এতবড় ক্ষতি পৃথিবীর কোথাও কেউ করেছে বলে কেউ বলতে পারবে না। যারা দিনের পর দি এই অবরোধ ডাকছে, যাদের ডাকে এই ক্ষতি সাধিত হচ্ছে, তাদেরকেই এই ক্ষতিপূরণ করতে হবে-এমন আইন প্রণয়নের দাবি সংসদের ভেতরে বাইরে উত্থাপিত হলেও হাসিনা সরকার তা করে নাই। কারণ হয়ত তারা যখন বিরোধী দলে যাবে-তারা তো এর চাইতে বেশি নাশকতা করবে এই ভেবে ক্ষতিপূরণের জন্য কোনো আইন পাশ করে নাই।
তাই দুই দলই জনগণের কথা ভাবে না-একদল শুধু ক্ষমতায় যেতে চায় আর এক দল ক্ষমতায় থাকতে চায়-লুটপাট, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল আর হিন্দু সম্পত্তি ও আদিবাসীদের সম্পত্তি দখলে নিতে চায়। জনগণের সেবার লক্ষ্যে নয়, নিজেদের ভোগের নিমিত্তে। গণতন্ত্রের সুফল বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মধ্যেই তো নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকতে হবে গ্রামে, ইউনিয়নে, উপজেলায়, জেলায় স্বযত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান সর্বত্র। ২৩-২৪ বছর ধরে ডাকসু, বাকসু বা বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানের নির্বাচন না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকেনা। এই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা উঠে যাওয়া এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা-বিএনপি, জামাত, আওয়ামীলীগ সবারই সমান দায় আছে। এই সব অপকর্ম কোনো দেশের রীতিনীতি বা সংস্কৃতি হতে পারেনা, এ-সব সভ্যতার মানবিকতার ধারক বাহক হতে পারে না।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি। ৪২ বছর ধরে এ দেশের জনগণ এই সব রাজনৈতিক দলসমূহকে দেখে আসছে। আর এখন দেখছে আগুনের লেলিহান শিখা। প্রতিদিন রেল লাইন উপড়ে ফেলা আর মানুষ নামের প্রাণীগুলোর ট্রেনের ভারি ভারি লোহা-লক্কড়ের মাঝে কাটা পড়া। গ্রামের মানুষ শুনছে আর্তনাদ বাঁচাও বাঁচাও, লা-ইলাহা ইল্লাহর লা ইত্যাদি কলেমা। উদ্ধার কাজ অতি দ্রুত করা অত সহজ নয়। কিন্তু প্রতিদিন যখন দুর্ঘটনা ঘটানো হচ্ছে তখন দূরবীন দিয়ে ড্রাইভারের পাশ থেকে লাইন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা কি করা যায় না? না, জনগণের ভাবনা তেমনভাবে কেউ ভাবছে না। আসামীকে গাইবান্ধার জনগণ পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে-কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে মামলা হবে এ বিষয়ে সন্ধিহান সাক্ষী স্বয়ং-এভাবেই চলছে। তাই বোঝা যায় সাধারণ মানুষ নষ্ট হয়নি। হয়েছে রাজনৈতিক দলসমূহ ও তাদের প্রশাসন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সব মানুষের সমান অধিকার দানের জন্য সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাধারণ মানুষই ভরসা। যেতে হবে তাদের কাছেই। নতুন করে শুরু করতে হবে-সাম্যের দেশ, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ গড়ে তুলতে ৪৫ বছর ধরে উদীচী কাজ করছে। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছে। স্বাধীন করেছে- এখন উদীচীর দায়িত্ব সাম্যের দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে এগিয়ে আসার। সে লক্ষ্যে কাজ করার। মহান বিজয়ের মাসে মনুষত্বের এই মহাবিপর্যয় ঠেকাতে উদীচীকে অকুতভয়ে এগিয়ে আসতে হবে।