ভারি ব্যাকুল বর্ষা: সঙ্গীতা ইমাম

ক্যানভাসে রঙ বদলানোর মোহিনী ইশারাকে কখনোই উপেক্ষা করেনি আবহমান বাঙলার অনন্য প্রকৃতি। সুন্দরের মিহিন শামিয়ানার নিচে, সহজিয়া মধুশালার সুলুকে রাত-জাগানিয়া মন কতো বর্ষায় ভিজেছে আনমোনে, কতো বৃষ্টিতে হয়েছে অনাবিল। এখনও আষাঢ়ে হাওয়ার উজানে নেশাতুর ঠোঁটে এসে লাগে বর্ষারাণীর আতুর আসবতৃষ্ণার গোলাপি ছোঁয়াচ। মুগ্ধতার আকাশের নিচে বিলোল বর্ষার বাঙলা আর বৃষ্টিভেজা ছবিতায় তার অপরিসীম সীমানা পেরিয়ে যাওয়া। আবার শহুরে বর্ষার চোখে চোখ রাখলে দেখি কী আশ্চর্য শ্রাবণ-রাখালের যামিনী আড় ভেঙে চলছে! কুহু-কেকা আর মেঘমল্লার যতোই আড়মোড়া ভাঙে, কালিদাসের সঘন সঙ্গে শহীদ কাদরীর বিচিত্র কথকতা ততোই গড়িয়ে যায় অন্য এক স্নিগ্ধ কুঠুরিতে, প্রাণেশ্বরী সুরের মূর্ছনায়- বর্ষার সঘন সঙ্গীতে। আমাদের বর্ষা তাই কেবলই পঞ্জিকার পাতাতে নয়, হৃদয়ের গোপন অলিন্দে বাস করে চিরচেনা রাত-কুমারীর মতো, পাতার ভেলা ভাসিয়ে, নিশীথ রাতের বাদলধারায়।

বছর ঘুরে আবারও আষাঢ়ের প্রথম দিন, কৃষ্ণকলি মেঘের দিনের সংসার শুরু। ‘মেঘদূত’-এর ঘর ছেড়ে মেঘেরা নেমেছে বাংলার নিজস্ব নিখিলেও। বাংলার বর্ষা তাই কেবলই রূপ ছড়ায় না, গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনির মতো সে-ও সাহসের নন্দনে আঁকে প্রণয়ের সুর। তাই বাংলার প্রকৃতিতে আসা বর্ষার পরনে যেনো মেঘনীল শাড়ি, পাড়ে তার প্রগাঢ় আর হাল্কা নীল, কখনও বা ধূসরের সুর একটু বাজে মেঘের চরণে নূপুরের মতো। কোনো আরোপিত আড়ম্বর থাকে না বাংলার বর্ষায়, এক অকৃত্রিম প্রাকৃতিক সাজ যেনো। তবে তার হার-দুলের রাজেন্দ্রনন্দিনী বাহার! মেঘের পাখোয়াজে বৃষ্টির তানপুরা শুনতে শুনতে এমন দিনেই রবিঠাকুর দেখে ফেলেছিলেন কালো কাজল চোখের সেই মেয়েটিকে। ময়নাপাড়ার মাঠে নয়, বাঙালির হৃদয়ে; সে মেয়েটির নাম বাংলাদেশ। বাংলার বর্ষার তাই নানারূপ। সকালে কৃষ্ণকলি মেঘ কখনও বৃষ্টি ডেকে আনে ভর দুপুরে, প্রিয়দর্শিনী মেঘবালিকার হাত ধরে এই বর্ষাই সন্ধ্যের বাংলায় ফিরে আসে- এ যেনো টিপিস টিপিস বৃষ্টি জলে ভিজে ভালোলাগার ভালোবাসা। বাঙালি তাই বর্ষায় সকাল থেকে সজল বাতাসে ভাসিয়ে দেয় মেঘপিওনের চিঠি। কালিদাস থেকে রবিঠাকুর, নজরুল থেকে শামসুর রাহমান- সবগুলো আকাশই বাদল দিনের গানে সিক্ত হয়। কেবলই কবিতার খাতাতে নয়, সেলফোনে টেক্সট চালাচালি করতে করতে প্রতিটি বাঙালিরই একসময় মনে হয় ইনবক্স উপচে তুমুল শ্রাবণ নেমে আসে আমাদের ভালোবাসার দু হাতে।

বর্ষা উৎসবে নিখিলের নান্দীপাঠ করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। যে চোখ সাহসের, যে ¯্রােত হৃদয়ের, যে ঐশ্বর্য বাংলার মানুষের চেতনাপ্রসূত- তার প্রতিটি তারেই মায়াবী আঙুল ছোঁয়ায় উদীচী। মনে হয়, বাংলাদেশটা যেনো এক আকাশমুখী সেতার, তার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ভালোবাসার ফুল ফোটানোর সাধনায় ব্রত উদীচী। তাই ১৯৯৯ সাল থেকেই বর্ষা উৎসব শুরু করে উদীচী। আষাঢ়ের প্রথম দিনটিকে গানে-কবিতায়-নৃত্যে ভরিয়ে তোলে সৃজনের প্রতিটি আঁচড়ে। তবে ২০০৬ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে বিস্তৃত পরিসরে বর্ষা উৎসব উদযাপন করে আসছে উদীচী। তারই ধারাবাহিকতায় এবারের আয়োজন। একদিকে যুদ্ধাপরাধী ও জামাত-শিবিরমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গণজাগরণ মঞ্চ ও উদীচীর যুগপৎ সংগ্রাম চলছে, অন্যদিকে আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঋদ্ধতাকে বুকে নিয়ে চেতনার ফুল ফুটিয়ে চলছে উদীচী। এ সংগ্রাম আমাদের প্রেরণার আকর, আমাদের উৎসবের প্রাণ, আমাদের আগামী পথের সোপান।