বর্ষা ও বাঙালি :প্রদীপ ঘোষ

সমুদ্র আর পাহাড়ের, সবুজ সমতলের জমাট বাধা পলির বুকে কবে কোন কালে হেঁটেছিলো আদি মানবেরা। নাতিশীতোষ্ণ জলহাওয়ায় সবুজের বুকে ফলিয়েছিলো শস্যদানা। সেই সকল আদিমানবেরা একটু একটু করে প্রকৃতিকে সাজিয়েছে নিজের মত করে, গড়ে তুলেছিলো প্রকৃতিক সংস্কৃতি। বলছি সেই সকল মানুষদের কথা যারা এ জনপদের প্রকৃতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণ করেছিলো। কালক্রমে একে একে বাইরে থেকে এলো নানা রক্তের ধারা। কখনো আদি অষ্ট্রিক, মঙ্গলীয় জনধারা, ইন্দো আর্য, পারস্য শক, পাঠান মোঘল সহ নানা জাতি। এই বিচিত্র মেলামেশার ফলে কালক্রমে বাঙ্গালির নিজস্ব এক গড়ন আমরা পেয়েছি। সেই সাথে পেয়েছি চাষাবাদের মত কৃষি সভ্যতা। ষড় ঋতুর অপার স্নেহে এই কৃষিই আমাদের দিয়েছে উর্বর এক সংস্কৃতি যার নাম বাঙ্গালি সংকৃতি। ঋতুবৈচিত্রের এই দেশে শ্রম আর ঘামের ভেতরে, পলি আর শস্যের আনন্দে, জীবিকার স্তরে স্তরে একটু একটু করে অর্জন আমাদের এই সং¯কৃতি। তাই বাঙ্গালী কোন হিন্দুয়ানী বা মুসলমানি সংস্কৃতি নয় বরং সকল সম্প্রদায়ের হাজার বছরের মিলিত এক ঐতিহাসিক সংস্কৃতি যার সাথে রয়েছে এই জনপদের জলআবহাওয়ার সুগভীর সম্পর্ক। রয়েছে নদনদী জলাশয় আর সাগরের সম্পর্ক। রয়েছে প্রকৃতির দান বর্ষা।
বাংলা বা বাঙলা নামটি এলো কোথা থেকে? বঙলা নামের উৎসে রয়েছে বর্ষা ঋতুর সম্পর্ক। এই ঋতুর অনুপস্থিতিই হয়তো আমাদের করে দিত অবাঙালি। এ বক্তব্যের সন্ধান পাওয়া যায় আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে। বঙ্গ শব্দের সাথে আল্ যুক্ত হয়ে আমরা পেয়েছি বঙ্গাল বা বাঙ্গালা। আল্ শব্দের অর্থ বাঁধ। বাংলাদেশ জল বৃষ্টির দেশ। বর্ষার জলের উপরই নির্ভরশীল ছিলো চাষাবাদ। আর তাই বর্ষার পানি ধরে রাখতে জমিতে দেয়া হতো আল্ বা বাঁধ। আল বলতে শুধু খেতের আল্ নয় বরং বড় বাঁধকেও বোঝানো হতো। জলবৃষ্টি আর বন্যার হাত থেকে ঘরবাড়ি, চাষের জমি রক্ষার জন্য দেয়া হতো এই আল্। তাই যদি মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত না হতো তবে ধরে নেয়া যায় বঙ্গ শব্দের সাথে আল্ শব্দের ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় হতো। সুতরাং বাঙ্গালির নামের সাথেই রয়েছে নিবিড় প্রাকৃতিক বন্ধন, রয়েছে বর্ষার বন্দনা। বর্ষাকে বলা হয় মঙ্গলময় ঋতু। তাইতো বাদল দিনে কৃষকের মাঠফাটা বুকে জেগে ওঠে চাষাবাদের আশাবাদ। ভেজা জমির বুকে লাঙলের ব্যবহার আর চাষাবাদের জমিন চাষ উপযোগি করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এই বর্ষার অঝোর ধারায় ভিজে থাকা মাটি কৃষকের গোলাকে করেছে শস্যের পূর্ণতায় সমৃদ্ধ। তাই বাঙালির শস্য বোনার সাথে, শস্য কাটার সাথে, শস্য জল ও স্থল পথে পরিবহনের সাথে সৃষ্টি হয়েছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি সারি গান। কখনো ক্লান্তি মোছাতে আবার কখনো জীবনের হাসি আনন্দের আধার সৃষ্টিতে।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির সবটুকু সজিবতাকে মানুষের মানবিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে শিখেছিলো মানুষ সেই কৌম সমাজ ব্যবস্থায়। প্রকৃতির বস্তুগত রুপান্তরের মধ্যদিয়ে মানুষ চেয়েছে সুন্দর সাম্যের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে। ঋতুনির্ভর সংস্কৃতির বাঙালি তাই চিরদিনই সৃজনশীল। কাব্য সাহিত্যে, সঙ্গীতে, চিত্রকলায় বারবার উঠে এসেছে মঙ্গলময় ঋতু বর্ষার বন্দনা। তবুও হিং¯্র শাপদের আক্রমনে বারবার আক্রান্ত প্রকৃতি। অর্থ আর মুনাফার হুংকারে একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির সবটুকু সবুজ। এই উর্বরা পলি আর জলহাওয়ায় সৃষ্ট প্রায় শতাধিক প্রজাতির নিজস্ব ধান ধ্বংস করে দিয়েছে মুসাফার চাদরে ঢাকা বন্ধ্যা বীজেরা। বহুজাতিক পুঁজির দাসত্ব আর রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম উদাসীনতায় আমরা রক্ষা করতে পারিনি সেই সব শস্যদানার বংশকূলকে যা প্রাগৈতিহাসিক কালের মানুষেরা আমাদের দিয়েছিলো। প্রকৃতিগত সংস্কৃতির উত্তোরাধিকার হিসেবে তাই আমাদের বাঙালি জাতির রয়েছে প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব। যে জাতির সংস্কৃতির উৎসমূল প্রকৃতি সে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই লড়তে হবে আমাদের। সংস্কৃতি গতিশীল। ক্রমাগত রূপান্তরের ভেতরে যার বসবাস। সেই রূপান্তরের সংস্কৃতি কখনোই মুনাফার জালে বন্দী হতে পারেনা। আমরা ঘটাতে চাই প্রকৃতির সেই সকল রূপান্তর যা মানবিক শোষণমুক্ত উৎপাদনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা হবে বন্ধ্যা বীজের বিপরীতে সেই সব বীজ রক্ষায় যা নিতান্তই এ মাটি আর মানুষের দান। সেইসব জলাশয় রক্ষার জন্য সাংস্কৃতিক লড়াই সৃষ্টি করতে হবে যেখানে প্রকৃতিক নিয়মে জলজ প্রাণীরা আশ্রয় গ্রহন এবং বিচরণ করবে বর্ষার বিপুল জলধারায়। আমাদের খাদ্যভ্যাসে এনে দেবে মাছেভাতে বাঙালির গৌরব। প্রকৃতির সহজ সরল শৃংখলাকে বিশৃংখল নির্মমতায় ঠেলে দিচ্ছে যে দানবেরা তাদের বিরুদ্ধে হাজার বছরের লালিত প্রাকৃতিক সাম্য চেতনার জাগরণ অনিবার্য ভাবেই রুখে দেবে দানবীয় হিং¯্রতাকে। যারা আজও পথের পাশে হত্যা করে ফেলে রাখে সবুজ বৃক্ষকে ধর্মের নামে আরার কখনো অর্থের টানে তাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ছাড়া অন্যকোন পথ নেই।