বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদীচীর ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত

“শিল্প-সংস্কৃতি-সংগ্রাম, আমাদের যুদ্ধ অবিরাম”- এ শ্লোগানকে ধারণ করে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। গতকাল ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছর অতিক্রম করে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াকু কণ্ঠস্বর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত ও সাম্যবাদী সমাজ গঠনে লড়াই-সংগ্রামের সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেন এবং সাহিত্যিক সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তসহ সেসময়কার কয়েকজন প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক ভাবধারার মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৈরি সংগঠন উদীচী নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সফলভাবে শুরু করেছে ৪৮তম বর্ষের যাত্রা।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আয়োজন করা হয় বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন ঘোষণার পর জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় সঙ্গীতের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য গোলাম মোহাম্মদ ইদু, আর সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচীর সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। এরপর দু’টি দলীয় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্প। তারা পরিবেশন করেন- “যুদ্ধাপরাধী মুক্ত করবো স্বদেশ, গড়বো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ” এবং “আরশির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে” গান দু’টি। এরপর ছিল বিশেষ যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনা। এরপর একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বেরিয়ে টিএসসি থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আবার অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে শেষ হয়। শোভাযাত্রা শেষে শুরু হয় আলোচনা পর্ব। উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান-এর সভাপতিত্বে এতে অংশ নেন উদীচীর প্রথম কমিটির আহবায়ক কামরুল আহসান খান, প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য আখতার হুসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা, উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাবেক সভাপতি কাজী মদিনা এবং উদীচীর সহ-সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ।

আলোচনা পর্বের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখতে গিয়ে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার বলেন, প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরে উদীচীর উপর বারবারই আঘাত হেনেছে প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী চক্র। ১৯৯৯ সালে যশোরে দ্বাদল জাতীয় সম্মেলন এবং ২০০৫ সালে নেত্রকোনা উদীচী কার্যালয়ে বোমা হামলায় শিল্পী-কর্মীরা প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু, সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, ন্যায়ের সংগ্রাম, মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে উদীচীকে কখনোই বিচ্যুত করা যায়নি। আর কখনো বিচ্যুত করাও যাবে না।

এরপর উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা বলেন, যে একবার জীবনে উদীচীর আঙ্গিনায় পা রেখেছেন, তিনি কখনোই সাবেবক হতে পারেননা। উদীচীতে কোন সাবেক নেই, সবাই বর্তমান। শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকলেও মানসিকভাবে কেউ কখনোই উদীচী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাবেক সভাপতি কাজী মদিনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির এই সর্বব্যাপী প্রভাবের যুগেও উদীচীর কর্মীরা এখনও বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এখনও সংগ্রাম করে যাচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য।

এরপর বক্তব্য রাখেন উদীচীর প্রথম কমিটির আহবায়ক কামরুল আহসান খান। তিনি বলেন, বিশ্বের সব প্রান্তেই উদীচীর কর্মীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তারা যেখানেই যান না কেন, সবসময়ই উদীচীর আদর্শকে ধারণ করে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছেন। এসময় তিনি উদীচীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের জন্য একটি স্থায়ী স্থান বরা দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। এরপর একে একে বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য আখতার হুসেন এবং উদীচীর সহ-সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন রাজনৈতিক নেতার চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে কাজী মোহাম্মদ শীশ বলেন, পৃথিবীতে দু’ধরনের মানুষ আছেন। একদল কর্ম করে যান, এবং আরেক দল তার ফল ভোগ করেন। উদীচী সবসময়ই প্রথম দলে থেকেছে এবং তারা এ দলেই থাকতে চায়। আখতার হুসেন উদীচীর প্রথম দিককার গড়ে ওঠার স্মৃতিচারণ করেন। বাংলাদেশের পথনাটকের ইতিহাসে উদীচীর অবিস্মরণীয় ইতিহাসের কথা তুলে ধরেন তিনি। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বদিউর রহমান বলেন, উদীচীর ৪৭ বছরের অর্জন অবিনশ্বর, অনির্বাণ। উদীচী তার অভিন্ন লক্ষ্যে পৌঁছাবেই। আর সে লক্ষ্য হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।

আলোচনা সভার পর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, সত্যেন সেন-এর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং উদীচীর সাবেক সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদুর হাতে সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা তুলে দেন উদীচীর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। সম্মাননা গ্রহণ করে গোলাম মোহাম্মদ ইদু উদীচীর বর্তমান নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি আমৃত্যু উদীচীর সাথে থাকার প্রতিজ্ঞা আবারো ব্যক্ত করেন। এরপর শুরু হয় গান-নৃত্য-আবৃত্তি পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, উদীচী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ এবং উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পীরা। এছাড়া, একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য তাজিম সুলতানা, সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম, ফকির সিরাজ এবং হাসান মাসুদ। ছিল বরেণ্য বাচিক শিল্পী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এবং উদীচীর সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেনের একক আবৃত্তি পরিবেশনা। এছাড়া, দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে লুবনা মারিয়ম পরিচালিত দল- ‘সাধনা’। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উদীচীর সহ-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *