প্রসঙ্গ : গণসঙ্গীত উৎসব ও প্রতিযোগিতা: প্রবীর সরদার

গণসঙ্গীতের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। তবে, সাধারণত গণসঙ্গীত মূলত জনগণের সঙ্গীত। জনগণকে সচেতন, উৎসাহিত বা আন্দোলিত করার সঙ্গীত এই গণসঙ্গীত। কোন রাষ্ট্রে বা সমাজে গতানুগতিক বৈষম্য, অসামঞ্জস্য, অসংগতি, অসংলগ্নতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপামর জনসাধারণ যখন শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ জানায়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে সচেতন করার প্রয়াসে ওই বিষয়গুলো দিয়ে গান রচনা করে, তবেই সেটা গণসঙ্গীত। জীবনের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময়ে তা উপস্থাপিত হতে পারে। আবার অন্যভাবে বলতে গেলে, গণসংগ্রামের গণচেতনায় গণসঙ্গীত সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শোষিত-বঞ্চিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণে সম্পৃক্ত করে এবং স্বপ্ন পূরণের সার্থকতা খোঁজে।

উদীচী বলতে চায়, গণসঙ্গীত প্রগতিশীল চেতনাসম্পন্ন জেগে ওঠার গান, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা এবং অধিকার সম্পর্কে সচেতনতামূলক গান, সমাজের অত্যাচার-নিপীড়নের বর্ণনা এবং অবস্থানের দিকনির্দেশনামূলক গান, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গান, যুদ্ধবিরোধী গান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ গান, স্বৈরাচারবিরোধী গান, বিশ্বশান্তির পক্ষের গান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে গান।

উদীচীর গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা

সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা যেমন দেশাত্মবোধক, লোকসঙ্গীত, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি থাকলেও বহুযুগ আগে থেকে আজও চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াই সংগ্রামে যে সঙ্গীত মানুষকে উৎসাহিত করে, উদ্বুদ্ধ করে- সেটা হলো গণসঙ্গীত। আমরা চাই, গণসঙ্গীত পৃথক একটি ধারায় পরিচিত হোক। নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যবোধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। তাই, এই ধারাকে আরো বেশি জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে, আরো বেশি পরিচিত করার লক্ষ্যে আমরা দেশব্যাপী এর প্রতিযোগিতা পরিচালনা করছি। যা প্রতিযোগিতামূলকভাবে সবার কাছে সমাদৃত হয় এবং সামনের দিকে এগিয়ে যায়। উদীচীর প্রতিটি বিভাগে, প্রতিটি জেলার প্রতিযোগিতা শেষে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল ঢাকায়, যা রূপ নিয়েছে উৎসবে। যে উৎসবে দেশের বরেণ্য শিল্পী বা প্রতিষ্ঠানগুলোও গণসঙ্গীত পরিবেশন করেছে।

উদীচীর আয়োজনে এ উৎসব

সারাদেশে গণসঙ্গীতকে আরো বেশি জনপ্রিয় ও পরিচিত করার লক্ষ্যে আমাদের গণসঙ্গীত উৎসব। আর, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এ গানের অনেক শিল্পী তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় গণসঙ্গীত রচনা, সুরারোপ ও পরিবেশন করে। এসব শিল্পীকে খুঁজে বের করাও আমাদের অন্যতম কাজ। সারাদেশে গণসঙ্গীতের জোয়ার সৃষ্টি করতেই আমাদের এ উদ্যোগ। আর কিছুই না হোক, বেশকিছু নতুন বিষয় নিয়ে গণসঙ্গীত রচিত হচ্ছে এবং তা পরিবেশিত হচ্ছে- এটাই বা কম কিসের? উদীচী চায়, গণসঙ্গীতকে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করতে। যা নতুন নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

বিগত কয়েক বছরের সফলতা-ব্যর্থতা

গত কয়েক বছরে গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা ও উৎসব আয়োজনে সফলতা ও ব্যর্থতা দুটোরই অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সফলতা হলো, শহর-গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গণসঙ্গীতকার, গণসঙ্গীতের সুরকার ও শিল্পীদেরকে প্রেরণা দিয়ে আরো বেশি গণসঙ্গীত রচনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছি। তারাও দ্বিগুণ উৎসাহে উৎসাহিত হয়েছে। গ্রামের গ-ি পেরিয়ে যেতে চাইছে থানা পর্যায়ে, আবার থানা থেকে জেলা, জেলা থেকে বিভাগ এবং বিভাগ থেকে জাতীয় পর্যায়ে, রাজধানী ঢাকায়। সত্যিই এ প্রতিযোগিতা বড়ই আনন্দের, গর্বের।

ব্যর্থতা নেই সে কথাও বলবো না। অনেক জেলা বা থানায় আমরা প্রতিযোগিতা পরিচালনা করতে পারিনি। যোগ্য কোন শিল্পী খুঁজে পাইনি। আমাদের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিযোগী সংগ্রহ করেছে। তবে, প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার বেশি সফল হয়েছি, আবার দ্বিতীয়বারের চেয়ে তৃতীয়বার সফলতার মাত্রা ছিল বেশি। এবারে আরো নতুন নতুন সফলতা এবং প্রত্যাশা যোগ হয়েছে।

উদীচীর প্রত্যাশা

উদীচী গণসঙ্গীতকে স্বতন্ত্র ধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। একটি ছেলে বা মেয়ে যেন সদর্পে বলতে পারে, আমি গণসঙ্গীত গাই। বেতার-টেলিভিশনেও সঙ্গীতের আলাদা একটি বিভাগ বা শাখা থাকবে, তা হলো গণসঙ্গীত। এই শিল্পীরাও মর্যাদার সাথে স্বনামধন্য হবে এবং সাথে সাথে গণসঙ্গীত সত্যি সত্যিই বিকশিত হবে, প্রসার লাভ করবে।

সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা

শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেন মনে করতেন, সংস্কৃতিই প্রধান, রাজনীতি তার একটা অংশ মাত্র। দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে সমাজ সচেতন বা জীবন সংশ্লিষ্ট একটি গান বা গানের কলি মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। যা তারা বেশি মনে রাখে- তাদের চৈতন্যে নাড়া দেয়। আর এ কারণেই একজন রাজনীতিক হয়েও তিনি অনুভব করলেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের গুরুত্ব। গঠন করলেন ‘উদীচী’। তাঁর স্বপ্ন ছিল, গ্রামের মানুষ ধান রোয়া বা ধান কাটার তালে তালে গণমানুষের গান- গণসঙ্গীত গাইবে, শ্রমিকরা যখন হাতুড়ি-শাবল-গাইতি চালাবে, তাদের মুখে গীত হবে গণসঙ্গীত। মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দৃঢ় কণ্ঠে বৈষম্য আর অসংগতির বিরুদ্ধে গাওয়া হবে এই গান। উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক সাহিত্যিক কৃষকনেতা সত্যেন সেনের জন্মদিবসে তাঁর বিপ্লবী নামটি যুক্ত করেই প্রতি বছর আমরা পালন করে আসছি এ উৎসব ও প্রতিযোগিতা। আশা করি, এ উৎসব সফলতার সূর্য-মুখ দেখবে।