পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের প্রতিবাদে স্মারকলিপি প্রদান

পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের প্রতিবাদে কর্মসূচি

পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের প্রতিবাদে
আগামী ৩১ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও এবং স্মারকলিপি প্রদান। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে সহজপাঠের নামে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি, সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর অপকৌশল, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়া, ধর্মান্ধতা ছড়ানোর চক্রান্তের প্রতিবাদ, ভুলে ভরা পাঠ্যবই প্রত্যাহার এবং এসব কর্মকা-ের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে আগামী ৩১ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করে স্মারকলিপি দেবে প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ।

পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের প্রতিবাদে স্মারকলিপি প্রদান
পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তারের প্রতিবাদে স্মারকলিপি প্রদান

একইদিন দেশের প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করা হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনসমূহ। এছাড়া, আগামীকাল ১৬ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ ও বিকৃতি সংশোধনের দাবি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলনে পাঠক্রম নির্ধারণ ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রগতিশীল রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনসমূহের সাথে মতবিনিময় করা হবে। একইসাথে পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা, জনমত গঠন ও বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক সমাবেশের আয়োজন করা হবে।

গত ১৫ জানুয়ারি’২০১৭ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সামনে আয়োজিত বিক্ষুদ্ধ অবস্থান সমাবেশ থেকে এসব কর্মসূচি ঘোষণা করে প্রগতিশীল গণসংগঠনসমূহ। রোববার সকাল সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংসদেরু সভাপতি ড. সফিউদ্দিন আহমদ। এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এ এন রাশেদা, হকার্স ইউনিয়নের উপদেষ্টা সেকেন্দার হায়াৎ, আদিবাসী যুব পরিষদের সভাপতি হরেন্দ্রনাথ সিং, সাবেক যুবনেতা কাফি রতন, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জীবনানন্দ জয়ন্ত, সাবেক ছাত্রনেতা আকরামুল হক, জনউদ্যোগের সাধারণ সম্পাদক তারিক হোসেন মিতুল, শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী রবিন আহসান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লাকী আক্তার, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের নেতা মনজুর মঈন, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হযরত আলী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসরের সংগঠক আতিকুল হক খান, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন এবং প্রগতি লেখক সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা রহমান মুফিজ প্রমুখ। সমাবেশটি সঞ্চালনা করেন- যুব ইউনিয়ন নেতা হাফিজ আদনান রিয়াদ। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, শিশু ও গণসংগঠন যেমন- বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, প্রগতি লেখক সংঘ, রণেশ দাশগুপ্ত চলচ্চিত্র সংসদ প্রভৃতি সংগঠন এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, রাজাকার সব সময়ের জন্য রাজাকার, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সবসময়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধা নন। সেই একই সূত্রে একসময়ের মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী দল নয়। আওয়ামী লীগ ও তার দোসরদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত করার সময় এসেছে। তারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় পরিচালিত করতে চায়। তাই তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হেফাজতে ইসলামসহ উগ্র ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোষ করে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক নানা উপাদান যোগ করেছে। সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন প্রজন্ম তৈরির মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে এগুচ্ছে মহাজোট সরকার।

বক্তারা আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত, হেফাজত, চরমোনাই পীরের অনুসারি ও ওলামা লীগ নামের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যপুস্তক থেকে তথাকথিত ‘বিধর্মীদের’ রচনা বাদ দেয়া, তথাকথিত ইসলামী মূল্যবোধের দোহায় দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি নানা উপাদান যুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছে। অপরদিকে বহুধারার শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে একই ধারার বিজ্ঞানভিত্তিক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম প্রণয়েনর দাবি জানিয়ে আসছে এদেশের প্রগতিশীল শক্তি। কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকার সাধারণ ও প্রগতিশীল মানুষের দাবি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র ভোটের সমীকরণ মাথায় রেখে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক সব উপাদান যুক্ত করেছে। এভাবে শিশুমনেই ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ। শিশুদের উদার, মানবিক ও অসাম্পদ্রায়িক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার বিপরীতে এ ধরনের ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তুর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় মুল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। সরকার পাঠ্যপুস্তককে সাম্প্রদায়িকীকরণ ও প্রগতিশীল লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাদ দিয়ে এদেশে বসবাসকারী অপরাপর ধমাবলম্বীদের অবজ্ঞা ও অসম্মান প্রদর্শনই করেনি, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সরকারের এ অবস্থানের তীব্র নিন্দা জানান তারা।

প্রগতিশীল সংগঠন সমূহের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রতিবাদে চলমান আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অবিলম্বে ভুলে ভরা ও সাম্প্রদায়িক উপাদানে ভরপুর সব পাঠ্যপুস্তক প্রত্যাহার করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের হাতে সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করতে হবে। ঘৃণ্য এ অপরাধের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।

এর আগে, গত ১১ জানুয়ারি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে আট দফা দাবি পেশ করে প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ। দাবিগুলো হলো:

১. হেফাজত-জামাত-চরমোনাই এইসব সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী অপশক্তি তোষণ বন্ধ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশের দর্শনের ভিত্তিতে পাঠ্য পুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।

২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালন শাহ, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, এস ওয়াজেদ আলী, হুমায়ুন আজাদসহ যে লেখকদের লেখাগুলো বাদ দেয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের মনন উদ্বোধনের পথ রুদ্ধ করার জন্যে, সেগুলো সংযোজন করতে হবে।

৩. ইতিহাস বিকৃতি ও সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানোর যে অপ-রাজনীতি তার সঠিক তদন্ত করে সেগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।

৪. শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে।

৫. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও বাংলা একাডেমির বানান বিধানের মধ্যে যে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, তা আমাদের শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে তুলছে। ফলে বাংলা বানানের বিষয়ে তারা একটি নৈরাজ্যের মধ্যে অবস্থান করছে। সৃষ্টিশীল সাহিত্য ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে এই অসামঞ্জস্যতা দূর করে একটি স্থিতিশীল বানান কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে।

৬. পাঠ্যপুস্তকের নির্লজ্জ দলীয়করণ, ব্যক্তিস্তুতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে শিক্ষার অধিকার রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব গ্রহণ করে কোনো রাজনৈতিক দল তার দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারে না।

৭. দেশের শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে তার মাধ্যমে সংবিধানে উল্লিখিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, গণমুখী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার জন্যে উপযোগি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে হবে।

৮. পাঠ্যপুস্তক জামাতিকরণ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রেরণকারী গণমাধ্যমকর্মীদেরকে চরমোনাইয়ের পীর যে হুমকি দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *