নির্বাচন, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নৌকার জয় :যতীন সরকার

‘দশ নম্বর বিপদ সংকেত’ জানিয়ে দিয়েছিলেনে প্রবীণ রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, এ বছরের জানুয়ারির ৫ তারিখে জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। মূলত নির্বাচনে বিজয়ী দলটির উদ্দেশেই ছিল তাঁর সতর্কবার্তা- ‘নির্বাচন তরীটি কোনোমতে ঠেলেঠুলে তীরে নিয়ে আসতে পারায় আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ও তার নেত্রী শেখ হাসিনা যেন না ভাবেন, তাঁরা বিপদ ও সংকটমুক্ত হয়েছেন। সামনে আরো বড় বিপদ ও বড় লড়াই অপেক্ষা করছে।’ (‘কালের কণ্ঠ’ ৭ জানুয়ারি, ২০১৪)

লণ্ডন থেকে গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর লেখাটি পাঠিয়েছিলেন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরদিনই। সেই দিন থেকেই ‘বাংলাদেশে আরো বড় বিপদ’-এর সূচনা ঘটে গেছে। সেই দিনই ‘সংখ্যালঘুদের দুই শতাধিক বাড়ি ভাঙচুর, আগুন, লুট। তিন স্থানে হামলায় আহত নারীসহ ৪০’ এবং সেই দিনেরই প্রতিবেদন- ‘৪৫ মিনিটে গুঁড়ো হয়ে গেছে শত বছরের বিশ্বাস’। যশোরের অভয়নগর যেন হয়ে ওঠে হিন্দুদের ওপর হামলাকারীদের ‘অভয়াশ্রম’। এ রকমই অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে দিনাজপুরের সদর উপজেলা, সীতাকুণ্ড, বগুড়া, মাগুরা, সাতক্ষীরা ও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ। এর পরদিন থেকে দেশের আরো অনেক স্থানে সেই হামলা কেবলই ছড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই। বাংলাদেশের কোনো স্থানই বোধহয় হামলার বাইরে থাকবে না। সরাসরি হামলার শিকার না হয়েও প্রতিটি এলাকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরই তো হৃদয়ে অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সে রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে কিভাবে?

আমি জানি না, কে এ প্রশ্নের উত্তর দেবে। তবে দেশের সব মানুষই অবগত যে যারা নির্বাচন প্রতিহত করার ডাক দিয়েছিল, তাদের মধ্যে, বিশেষ করে পাকিস্তানের সক্রিয় সমর্থনপুষ্ট হয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যে অপশক্তিটি, এবার হিন্দুদের ওপর হামলার মূল হোতা তারাই। কিন্তু এ রকম হামলা সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই সতর্ক থাকার দায়িত্ব যাদের, তারা কেন সে দায়িত্ব পালন করল না- এ প্রশ্নের উত্তর কেউই খুঁজে পাচ্ছে না। ইতিমধ্যে ১৯টি বেসরকারি সংস্থার মোর্চা ‘হিউম্যান রাইটস ফোরাম’ এক বিবৃতিতে বলেছে- ‘ধারাবাহিকভাবে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিশেষ করে প্রতিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এ ধরনের আক্রমণ ও নির্যাতন হয়ে আসছে, তা জানা সত্ত্বেও এসব সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশন, আইন প্রয়োগে নিয়োজিত সংস্থা ও প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘সকল নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ ‘রাষ্ট্রের ব্যর্থতা’ মানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল কেন্দ্রে যাদের অবস্থান, মূলত তাদেরই ব্যর্থতা। এ কারণেই লন্ডনের ‘দি ইকোনমিস্ট’ বলেছে- ‘এই অস্থির পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগও দায়ী।’

এ রকম ‘ব্যর্থতা’ ও ‘অস্থির পরিস্থিতি’র জন্য যাঁদের দায়ী করা হয়েছে, তাঁরা যে সে দায় স্বীকার করেন না ও করবেন না, সে কথা আমরা সবাই জানি। ‘আত্মসমালোচনা’ শব্দটিই বোধহয় তাঁদের অভিধানে নেই। অপরের ওপর দোষ চাপানোর ও নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার ক্ষমতায় সবাই একান্ত দক্ষ। ইতিমধ্যেই সে দক্ষতার পরিচয় আমরা পেয়ে গেছি। সবাই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা। সেই সঙ্গে তাঁরা এও বলছেন যে, এসব দোষের জন্য যারা দায়ী, তাদের অচিরেই খুঁজে বের করে ‘কঠোর শাস্তি’ দেওয়া হবে। এ রকম ‘অমৃত বচন’ কিন্তু ভুক্তভোগীদের কানে অমৃত নয়, বিষ বর্ষণ করছে, তাদের সব সত্তাকেই বিষিয়ে তুলছে। ‘রোগী মারা যাওয়ার পর ডাক্তার আসিল’- সখেদে এই প্রবাদপ্রতিম বাক্যটিই তাদের বারবার স্মরণ করতে হচ্ছে।

বিভিন্ন স্থানেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের ‘নৌকা’য় ভোট দেওয়ার ‘পাপের শাস্তি’ ভোগ করতে হচ্ছে। আবার ঢাকার দোহার উপজেলায় ঘটেছে এর বিপরীত ঘটনা। সেখানে মানুষ আক্রান্ত ও নিহত হয়েছে নৌকায় ভোট না দেওয়ার অপরাধে। ‘কালের কণ্ঠের রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি খবর পাঠিয়েছেন- ‘নৌকায় ভোট না দেওয়ায় অবরুদ্ধ বেহুলার চরবাসী।’ নবম সংসদের সদস্য জাকির হোসেন ‘বিরোধী দলহীন দশম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়েও পিছিয়ে থাকায়’ তিনি নাকি প্রকাশ্যে তাঁর কর্মীদের নির্দেশ দেন- ‘বেহুলার চর গ্রামের মানুষকে বাজারে পাইলেই তাকে মারধর করবি।’ (‘কালের কণ্ঠ, ১২ জানুয়ারি, ২০১৪)।

নৌকাই কি তাহলে আজ সব বিপদের হেতু? অথচ নৌকাই তো একদিন বিপদমুক্তির বার্তা বহন করে এনেছিল, বিপদ সৃষ্টিকারী পাকিস্তানের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে আনার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই নৌকার কাণ্ডারিই। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এ রকমই সদর্থক ছিল নৌকার ভূমিকা। একাত্তরের পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু কুলাঙ্গার বাদে নৌকার ওপরই আস্থা রেখেছিল অন্য সবাই। তখন বরং সে আস্থা আরো দৃঢ়তর হয়েছিল। কারণ তখন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আবার হয়েছিলেন নৌকার কাণ্ডারি। কিন্তু হায়, এ দেশে পাকিস্তানের রেখে যাওয়া বরকন্দাজদের হাতে আমাদের সেই মহান কাণ্ডারিকেও প্রাণ দিতে হলো। নিহত কাণ্ডারির উত্তরাধিকারীরাও অবশ্যি নৌকার হাল ছাড়েনি, জনগণের একটি বৃহৎ অংশও নৌকাকে ধরে রেখেছে। সেই বৃহদংশের মধ্যেই যে একটি ক্ষুদ্র স্থান অধিকার করে আছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশটি, সে কথাও সত্য। কারণ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষান্ধ কোনো দল বা গোষ্ঠীকে সমর্থন জানানো তাদের জন্য একেবারেই আত্মঘাতী। সমর্থন জানানোর মতো আর কোনো বিকল্পই তারা এখনো দেখতে পাচ্ছে না।

কিন্তু প্রশ্ন, আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দল জেনেই সে দলকে সমর্থন দিয়ে তারা হামলার শিকার হয় কেন? হামলায় চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর কেন কেবলই বচনামৃত পান করে যেতে হয় তাদের? কেন ঠিক সময়ে বিভিন্ন স্থানের নৌকার কাণ্ডারিরা হামলার হাত থেকে তাদের রক্ষা করার কোনো গরজই বোধ করে না? তবে কি এখন নৌকার তলদেশে অজস্র ফুটো দেখা দিয়েছে, না নৌকায় অনেক দুর্জন দুর্বৃত্ত আরোহী হওয়ার ফলেই এমনটি ঘটেছে? নাকি নৌকার ক্ষেত্রে দুই রকম দুর্যোগই ঘটেছে?

এসব প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর কে দিতে পারবে, আমার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় যে এই নৌকায় এখানে-ওখানে ফুটোও আছে এবং নৌকার আরোহীদের মধ্যে অনেক দুর্জন দুর্বৃত্তেরও অবস্থান আছে। এমনটি ঘটে চলেছে সেই ১৯৫৪ সাল থেকেই। বঙ্গবন্ধু কাণ্ডারি হয়ে নৌকার ফুটোফাটা বন্ধ করে ও এর দুর্জন দুর্বৃত্ত আরোহীদের বের করে দিয়ে- অথবা নিষ্ক্রিয় রেখে- নৌকাটিকে স্বাধীনতার উপল উপকূলে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। তবু খন্দকার মোশতাকের মতো বেশ কিছু মোনাফেকই নৌকার ভেতর ঘাপটি মেরে বসেছিল। এই মোনাফেক ও তাদের সহযোগীদের হাতেই বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন এবং তারপর থেকে তাদের ‘সুযোগ্য’ উত্তরসূরিরা বাংলাদেশকে ক্রমে পেছন দিকে টেনে নিয়ে চলছে, ‘বাংলাদেশ’ নামটি বহাল রেখেই একে পাকিস্তান বানানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার বহনের দাবি করেন যাঁরা, তাঁরাও যে ক্ষমতা পেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সেই উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন, তা-ও নয়। বরং বেদনাদায়ক হলেও সত্য যে, বারকয়েক নৌকার হাল ধরেও, শত্রুদের সঙ্গে কৌশলগত আপসের অছিলায় তাঁরা অনেক পরিমাণেই নীতিভ্রষ্ট হয়েছেন।

তবে ২০০৮ সালে বিপুল সমর্থনে ধন্য হয়ে নৌকায় চড়ে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করে (এবং অন্তত একজন অপরাধীর শাস্তি কার্যকর করে)। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের বাহক জনগণের প্রশংসাভাজন হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে যদিও অনেক বিতর্ক কুটিল পথে তাঁরা চলেছেন, তবু ‘জামায়াতের সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়’- আওয়ামী লীগ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা সজ্জননন্দিত হয়েছে। নৌকার কাণ্ডারিরূপে তিনি বঙ্গবন্ধুর সদর্থক উত্তরাধিকারের ধারা বহন করে চলবেন মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকামী বিপুলসংখ্যক জনগণের এমনটিই তো প্রত্যাশা।

সে প্রত্যাশার প্রাপ্তি কিভাবে ঘটবে, কিংবা আদৌ ঘটবে কি না, সেসব নিয়ে এখনই জল্পনা-কল্পনা বা বাগ্বিস্তার করার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাটকে লেজেহুমু এরশাদ ও তাঁর দলবলের অভিনয়ে সব দর্শকই যে বেশ কিছুদিন ধরে বিমলানন্দ লাভ করতে পারবে- এটিই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি! নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রথম দিনেই তিনি দর্শকদের নতুন আনন্দদানের সূচনা ঘটিয়েছেন। সেদিন তিনি বঙ্গভবনে প্রবেশ করতেই ‘উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়।’ তাঁর দলের যুগপৎ সরকারি দল ও বিরোধী দলের ভূমিকায় অভিনয়ও তো রাজনৈতিক নাটকে এক অভিনব সংযোজন! মাত্র কিছুদিন আগে ‘এই আমার শেষ কথা’ বলেও যে শেষ করলেন না, কারণ তিনি একজন কবি। বাংলার এমন একজন কবিকে তো ‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সেই বাণীর মর্যাদা রক্ষা করতেই হবে। ‘শেষের মধ্যেই অশেষ আছে’- কবি এরশাদ সে কথাই আমাদের অনরবত স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবেন।