তেরো সংখ্যা কি অশুভের প্রতীক? মযহারুল ইসলাম বাবলা

১৩ সংখ্যাকে অশুভরূপে কম-বেশী আমরা সবাই ভেবে থাকি। কেবল আমরা একা নই। বিশ্বের প্রায় দেশেই ১৩ সংখ্যাকে আন লাকি থার্টিন রূপে বিবেচনা করা হয়। পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকেই বিষয়টি আমাদের উপমহাদেশে চল হয়েছে। প্রতিটি নতুন বছরের আগমনে আমরা নানা প্রত্যাশা করে থাকি। চলতি বছর শুরুতেও আমাদের নানা প্রত্যাশা নিশ্চয় ছিল। কিন্তু বছরের দ্বিতীয় মাস হতে আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি-তাতে ঐ অশুভের প্রতীক রূপেই ২০১৩-কে বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছি। কাকতালীয়ভাবে হলেও ২০১৩ আমাদের জাতীয় জীবনে শুভবার্তা নিয়ে আসেনি। একমাত্র প্রত্যাশা পূরণ বা সাফল্য বলতে স্বাধীনতার দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর পর হলেও ঘৃণিত কতিপয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় প্রদান জাতির কলঙ্ক মোচনের পথ উন্মুক্ত করেছে। আমাদের প্রত্যাশা পূরণে এছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে সাফল্যের দেখা আমরা পাই নি।

সাভারের রানা প্লাজা ধসে অগণিত মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ-আমাদের জাতীয় জীবনে সর্ববৃহৎ মর্মান্তিক ঘটনা। ঘটনাটি মোটেও প্রাকৃতিক ছিল না। এই নারকীয় ঘটনা স্বার্থবাদী মানুষের সৃষ্ট। আমাদের পোষাক শিল্পের শ্রমিকেরা আগুনে পুড়ে-ভবন ধসে প্রাণ দিলেও; রাষ্ট্র তাদের নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা দিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। অপর দিকে মুনাফাবাজদের কারণে পোষাক শ্রমিকদের জীবন এবং পোষাক শিল্প পর্যন্ত হুমকির মুখে। সামগ্রিক বিবেচনায় রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ব্যর্থতার দায় রয়েছে নারকীয় এই ঘটনায়।
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থ লোপাটের কেলেঙ্কারীর ধারাবাহিকতা এবছরেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। সাধারণের জন্য সামান্য ঋণ গ্রহণে নানা প্রতিবন্ধকতা আরোপের বিধান থাকলেও; হাজার-হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় যারা যুক্ত তাদের ক্ষমতার রাজনীতির সংশ্লিষ্ঠতা নিশ্চয় রয়েছে। নয়তো এতো সহজ উপায়ে এধরনের ঘটনা ঘটানোর সুযোগ থাকার কথা নয়। জনরায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাওয়া দ্বিদলীয় ব্যবস্থার প্রতিটি সরকারের আমলে রাষ্ট্রের-জনগণের অর্থ লোপাটের কাহিনীর ধারাবাহিকতা অতীতের আদলে বিদ্যমান। এ যেন ক্ষমতাসীন শাসক শ্রেণির প্রাপ্য অধিকার। রাষ্ট্রের ম্যানেজারির দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারগুলো নিজেদেরকে রাষ্ট্রের মালিক রূপে বিবেচনা করে থাকে। ফলশ্রুতিতে হেন কোনো অপকীর্তি নেই যা তারা করেনি কিংবা করছে না। প্রকৃত দেশপ্রেমী রাজনীতিকদের স্থলে চাটুকার এবং লুটেরাদের আধিক্য প্রধান দুইদলে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে বলেই আর্থিক কেলেঙ্কারী সহ নানা অপকীর্তির ধারাবাহিকতা অক্ষণ্œ রয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে হঠাৎ আবির্ভাব ঘটেছে হেফাজতে ইসলাম নামক ওহাবী মতবাদের ধর্মান্ধ দলটির। তাদের কর্মসূচীতে সরকারের আপস রফার নানা উদ্যোগ আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। অপর দিকে জামায়াত-বিএনপি জোট হেফাজতে ইসলামকে হেফাজতের দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশ্যে তাদের মদদ যুগিয়েছে। হেফাজতের ঢাকার প্রথম কর্মসূচীকে সফল করতে বিএনপি-জামায়াত জোট আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল। তাদের সমাবেশ সফল করতে সাংগঠনিক তৎপরতার পাশাপাশি সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সভামঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছিল। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি পর্যন্ত সংহতি প্রকাশ সহ খাদ্য-রসদ যুগিয়েছিল। গণমাধ্যমের অধিক প্রচারণা এবং ক্ষমতাহারা রাজনৈতিক দলের আস্কারায় হেফাজত বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের রাজনৈতিক মতলবের লক্ষ্যে ঢাকা অবরোধের ঘোষণা এবং যথাসময়ে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচীর পাশাপাশি সরকারের নমনীয়তার সুযোগে শাপলা চত্ত্বরে সমাবেশের অনুমতি লাভ করে। দিন-রাত্রী ব্যাপী হেফাজতের তা-ব-নৈরাজ্যে ধ্বংসস্তুপে পরিণত মতিঝিল অঞ্চল। ঢাকায় প্রবেশের পথগুলো পর্যন্ত অক্ষত রাখে নি। অক্ষত রাখেনি সরকারি- বেসরকারি সম্পদ, স্থাপনা, যানবাহন। পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় অগণিত যান ও স্থাপনা। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে দেয়া আগুনে-পুড়ে যায় অফিস, স্থাপনা, লিফট, জেনারেটর, ছয়-সাতটি গাড়ি। গাড়িগুলো মুক্তি ভবনের ভাড়াটে নিরপরাধ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। হেফাজতের নৃশংস তা-বে দেশবাসী আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ওঠে। অথচ হেফাজতের তা-বকে চলমান রাখার উদ্দেশ্যে স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়া হেফাজতের পাশে দাঁড়াতে ঢাকাবাসীকে নিলর্জ্জ আহ্বান পর্যন্ত জানিয়েছিলেন। সরকারের যথাপুযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণে হেফাজতের নৃশংস তা-ব থেকে দেশবাসী সেদিন রক্ষা পেয়েছিল।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান শেষে হাজার-হাজার হেফাজত কর্মীর নিহতের মিথ্যে রটনা দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। বিএনপি-জামায়াত জোট পল্টনে গায়েবানা জানাজা নাটক শেষে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা গণমাধ্যমে ঘোষণা দেন- “আমরা ক্ষমতায় এলে হেফাজতের সমস্ত দাবি পূরণ করে তাদের খুশী মনে ফেরত পাঠাবো”। ক্ষমতার রাজনীতি এরূপ নীতিবর্জিত নিলর্জ্জতা দেশের রাজনীতিতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
হেফাজত যে রাজনৈতিক মতলব নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে, এতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তাদের প্রতিটি দাবি রাজনৈতিক। মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা জাতির ওপর চাপানোর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। ধর্মের মুখোশধারী হেফাজত প্রধান নারীদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিতে এবং ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশ প্রমাণ করেছে-তাদের উদ্দেশ্য দেশ-জাতিকে বর্বর মধ্যযুগে ফিরিয়ে নেবার কুমতলব। হেফাজতের পক্ষে নিলর্জ্জ অবস্থানকারী বিএনপি যদি হেফাজতের দাবি সমূহ পূরণ করে; তবে তাদের দলনেত্রীর পরিণতি কি হবে? দলের নারী নেতৃবৃন্দ কোথায় দাঁড়াবে? সে বোধ-বিবেচনা তাদের চিন্তায়-মনে কি একবারও আসেনি? ক্ষমতাহারা বিএনপি ক্ষমতা ফিরে পেতে দিশেহারা এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার নিলর্জ্জতায় দেশবাসী হতবাক।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিএনপির অবস্থানে অবাক-বিস্ময়ের কারণ নেই। সঙ্গত কারণেই বিচারিক কার্যক্রম নিয়ে তারা অহেতু প্রশ্ন তুলছে। বিচার বানচালে জামায়াত-শিবিরের সাথে একযোগে কর্মসূচী পালন করছে। সামরিক ক্ষমতার বলয়ে জন্ম নেয়া বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেইে স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গী করেছিল। যার ধারাবাহিকতা আজও অটুট রয়েছে। সে কারণে বিএনপি-কে মোটেও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দল বলা বা ভাবার উপায় নেই। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে বাড়তি ফায়দার দৃষ্টান্ত দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে আমরা পূর্বে যেমন দেখেছি। এখনও তেমনি দেখছি। পরিণতি যে-কি পরিমাণ ভয়াবহ হতে পারে, পাকিস্তানের দিকে তাকালেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে। রাজনীতিতে ধর্মযোগের কারণে মহাত্মা গান্ধীকে ধর্মান্ধদের হাতে প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়েছিল। অথচ গান্ধী মোটেও ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যুক্ততার চরম পরিণতি তাকেই দিতে হয়েছিল। আমাদের শাসক শ্রেণি ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি ফায়দার মোহে বারংবার রাজনীতিতে ধর্ম টেনে এনেছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সমূহের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংকোচ করেনি। সে কারণে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক চক্রের বিকাশ উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। হেফাজত সাম্প্রতিক সময়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তো বটেই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় প্রদানের পর মুহূর্ত হতে জামায়াত-শিবিরের নৃশংস নৈরাজ্য-তা-ব। এতে বিএনপির সমর্থন ও শামিল আগুনে ঘি বর্ষণের সমতুল্য হয়েছে। তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। হরতাল নামক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের চূড়ান্ত অস্ত্রটি কি পরিমাণ ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ হতে পারে জামায়াত-শিবিরের নৃশংস তা-বে দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, সম্পদ, যানবাহন ধ্বংসের এরূপ ধ্বংসাত্বক তা-ব অতীতে দেখার সুযোগ দেশবাসীর হয়নি। নিরপরাধ পথচারী সহ অনেক মানুষ প্রাণ দিয়েছে জামায়াত-শিবির সহ ১৮ দলীয় জোটের হরতাল পালন নামক তা-বে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত এদের তা-ব থেকে রেহাই পায় নি। গণতন্ত্রের বাতাবরণে সংঘঠিত ফৌজদারী অপরাধ সমূহ টিভি চ্যানেলে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করলে-ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদানে রাষ্ট্র এবং সরকারের নিষ্ক্রীয়তা আমাদের হতাশ করেছে। সে কারণে হরতাল পালনে সন্ত্রাসের মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণের জান-মাল রক্ষায় শক্ত হাতে দমনের ব্যর্থতার দায় সরকার এড়াতে পারে না।
একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দেশে মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে যারা দ্বিমত পোষণ করবে কিংবা যারা বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানানোর মতলব করছে-তাদের স্বাধীন দেশে রাজনীতির অধিকার থাকার কথা নয়। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে রাজনীতির অধিকার দেয়ার কারণে স্বাধীনতা বিপন্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা প্রশ্নের সম্মুখীন। রাষ্ট্র এবং সরকারকে অবশ্যই অনতিবিলম্বে বিষয়টিকে বিবেচনায় নিতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব নিষিদ্ধ করতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির। এবং তাদের দোসরদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধেও যথাপুযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চলতি বছরেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কার অধীনে নির্বাচন হবে? সে নিয়ে বিভক্তি ও মতপার্থক্য নির্বাচনকে শঙ্কার মুখে ফেলেছে। সংবিধানের সংশোধনীর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উপায় নেই যেমন সত্য। তেমনি সত্য বিচারকের দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ। চূড়ান্ত রায়ের পূর্বে পর্যবেক্ষণ আমলে নেয়া-না নেয়া জাতীয় সংসদ তথা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। কাজেই নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা দেখা যাচ্ছে তাতে আগামী আক্টোবর মাসের পর দেশের সার্বিক অবস্থা কোন্ দিকে মোড় নেয় বলা কঠিন। শাসক বদলের নির্বাচনে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনের উপায় নেই সত্য। তবে দেশের স্থিতিশীলতা নিয়ে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অনভিপ্রেত কোনো ঘটনা দেশ-জাতি; এমনকি রাজনীতিকদের জন্যও শুভ ফল বয়ে আনবে না। বছরটির মাঝামঝিতে নানা অনভিপ্রেত ঘটনা প্রমাণ করছে আমরা শঙ্কা মুক্ত নই। তবে কি তেরো সংখ্যাটি আসলেই অশুভের প্রতীকরূপে আমাদের জন্য অশুভ বার্তা বয়ে এনেছে?