জঙ্গিবাদ বিরোধী সপ্তাহ

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখার প্রত্যয়

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখা এবং মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় জানিয়ে পালিত হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর দেশব্যাপী “জঙ্গিবাদ বিরোধী সপ্তাহ”। গত ২২ জুলাই শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এ সপ্তাহ শেষ হয় ২৮ জুলাই বৃহস্পতিবার। “জঙ্গিবাদ বিরোধী সপ্তাহ”-এর সমাপণী দিন ২৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ আয়োজন করে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ সমাবেশে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্র-যুব-পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন।

সমাবশের শুরুতেই গুলশান ও শোলাকিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার বিষয় নিয়ে লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন ঝর্ণা সরকার। এরপর উদীচী’র নৃত্যশিল্পীরা জাগরণমূলক গান “এসো ঘুম ভাঙাই এ পৃথিবীর হয়নি দেরি আজও” গানের সাথে নাচ পরিবেশন করেন। এরপর শুরু হয় আলোচনা সভা। উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভার শুরুতে বক্তব্য রাখেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম। তিনি বলেন. জঙ্গিবাদের এ সমস্যা একদিনে তৈরি হয়নি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাখাতে দীর্ঘ দিন ধরে চলা অসঙ্গতি, অবহেলা এবং নৈরাজ্যের ফলাফল হচ্ছে আজকের জঙ্গিবাদের উত্থান। তাই, একে নির্মূল করতে হলে সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আর এ কাজে সংস্কৃতি কর্মীদেরকেই প্রধান ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করেন সঙ্গীতা ইমাম।

উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সবগুলো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজাবী ও গণসংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে করতে হবে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে বারবার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সরাসরি বিরোধীতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ করার তীব্র নিন্দা জানান কামাল লোহানী। দেশের বেশিরভাগ স্কুলে বিশেষ করে একটা বড় সংখ্যক মাদ্রাসা এবং ইংরেজী মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন বা জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়া হলেও সরকার এসবের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় নিন্দা জানান। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে রাস্তায় না নামালে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়লাভ করা প্রায় অসম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। কামাল লোহানী আরো বলেন, গত কিছুদিনে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত হত্যাকা-ের বিষয়ে সরকার ও প্রশাসনকে বারবার সতর্ক করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে অদ্ভুত নিস্পৃহ মনোভাব দেখানো হয়েছে। কোন গণতান্ত্রিক সরকার এতোটা নিস্পৃহ হতে পারে না বলেও এসময় মন্তব্য করেন কামাল লোহানী। তিনি অবিলম্বে, সকল হত্যাকা-ের সুষ্ঠু ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান। ওইসব হত্যাকা-ের সাথে জড়িতরা কোন না কোন সময়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন মন্তব্য করে তিনি অবিলম্বে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। এসময় কামাল লোহানী সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর-খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির মিছিলে পুলিশের লাঠিচার্জের নিন্দা জানান।

প্রতিবাদী সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন আদিবাসী যুব নেতা হরেন সিং। তিনি জঙ্গিবাদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে বহু বছর ধরে চলমান আদিবাসী নির্যাতনের যোগসূত্র রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। সমাবেশে উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন দেশে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের উদাহরণ টেনে বলেন, সব ক্ষেত্রে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে। তিনি আরো বলেন, গত ০১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজান রেষ্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা এবং ঈদের দিন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় হামলার ঘটনায় দেশ আজ এক অভূবপূর্ব সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ব্লগার, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সংস্কৃতি কর্মী, ইমাম, পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ, বিদেশি অতিথিসহ সমাজের প্রায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষ নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনা সেইসব ঘটনারই ধারাবাহিকতা বলে মন্তব্য করেন জামসেদ আনোয়ার তপন।

সমাবেশে অন্য বক্তারা বলেন, গত কিছুদিনে সংঘটিত হত্যাকা-গুলোর সুষ্ঠু ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা গেলে গুলশানের মতো জঙ্গি হামলার ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো। এসময় স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বোমা হামলার ঘটনা, ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচী’র দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে নৃশংস বোমা হামলা ও হত্যাকা-ের বিচার আজও শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যথাযথ তদন্ত শেষে ওই হত্যাকা-ের সাথে জড়িত প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবিও জানান বক্তারা।

বক্তারা আরো বলেন, দেশের বর্তমান এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ধর্মের নামে কোন অপশক্তিকে সাম্প্রদায়িক দেশে রূপান্তরিত করতে দেয়া হবে না। বাংলার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা এবং সব ধরনের উগ্রতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাতেই উদীচী পালন করে “জঙ্গিবাদ বিরোধী সপ্তাহ”। তারা বলেন, দেশের প্রতিটি অঞ্চলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এদেশের আবহমান কাল ধরে চলে আসা অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে উদীচী কাজ করে যাবে। আর এর মাধ্যমেই সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শীশ, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার।

“জঙ্গিবাদ বিরোধী সপ্তাহ” কর্মসূচির অংশ হিসেবে উদীচীর প্রতিটি জেলা ও শাখা সংসদ নিজ নিজ এলাকায় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করেছে। ছিল জনসচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি। দেশের প্রায় ৫০টি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ আয়োজন করে উদীচী’র শিল্পী-কর্মীরা। এছাড়া, উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের অন্তর্ভুক্ত শাখাগুলোও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে জঙ্গিবাদ বিরোধী অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

আলোচনা সভার পর জঙ্গিবাদ সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে গান পরিবেশন করা হয়। উদীচী’র শিল্পীরা পরিবেশন করেন “এখন দুঃসময় আর নয় দেরি নয়”, “দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে”, “ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে”, “যখন একা থাকি দিশেহারা বড় অসহায় লাগে” প্রভৃতি গান। এছাড়া, কবিতা আবৃত্তি করেন বেলায়েত হোসেনসহ বিশিষ্ট বাচিক শিল্পীরা। সবশেষে উদীচী নাটক বিভাগের পরিবেশনায় ছিল নাটক “দানবকাল”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *