চারণসম্রাট মুকুন্দদাস

চারণসম্রাট মুকুন্দদাস
শেখ রফিক

ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে,
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।।
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।
দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী,
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।।
সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ।।
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান,
নিতে হয় মুকুন্দে-রে নিও রে সঙ্গে।।
‘যারা গান বা বক্তৃতা দ্বারা দেশের জাগরণ আনতে চেষ্টা করেন তারা সকলেই চারণ। আপনি, আমি, আমরা সবাই চারণ, তবে আপনি আমাদের সম্রাট। অর্থাৎ চারণসম্রাট। বাংলা মায়ের দামাল ছেলে চারণকবি মুকুন্দদাস’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুকুন্দদাসের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে (সরাসরি সাক্ষাতে) বলেছিলেন।
গণমানুষের গান, স্বাধীনতার গান, সমাজ বদলের গান কেন গাইতে হয়! কেমন করে গাইতে হয়! কবি কেন চারণ হয়! চারণসম্রাট মুকুন্দদাসের জীবন, সময় ও সৃষ্টি জানলে পরে ‘চারণকবি’ শব্দটির স্বরূপ-প্রকৃতি যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায়। সকল কবিই ‘চারণকবি’ নন। যিনি চারণ, তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্ম দিয়ে সমাজের সকল অসঙ্গতি দূর করার জন্য গণমানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে প্রগতি, সাম্যের বিপ্লবকে অগ্রসর করে নেন।
মাটি ও মানুষের সাথে চারণকবি মুকুন্দদাসের সম্পর্ক ছিল সুনিবিড়। তাঁর গান, যাত্রাপালা-অভিনয় এবং ভাষা, সুর, ছন্দ ও ভঙ্গি ছিল বাঙালির নিজস্ব জীবনবোধ ও সংস্কৃতির। তাঁর গান গণমানুষের অন্তরকে অতি সহজেই অনুরণিত করে তুলতো। জাগরিত করতো অধিকার বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে। অনুপ্রেরণা যোগাতো স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের।
স্বরাজ স্বরাজ স্বরাজ করিস তোরা,
স্বরাজ কি রে গাছের ফল?
অবহেলে তায় পেড়ে খাবি তোরা,
পরপদলেহী ভীরুর দল।।
ধনির দুয়ারে ধরনা দিয়া স্বরাজ তোরা ভিক্ষা চাস,
কপট বৈরাগ্যের মুখোশ পরিয়া,
ভাইয়ের কাছে ভাই করিস ছল-
কি করে স্বরাজ মিলিবে বল।।
পারিস যদি রে হতে লীলাচারী,
সোমরস আবার করিতে পান;
রক্তগঙ্গার পূণ্য সলিলে, পুজিতে মায়ের মূরতিখান।
রুধিরাসত্তা পানেতে মত্তা,
মা আজ ছেলের রক্ত চান-
দিতে হবে তাই মনে রাখিস ভাই,
স্বরাজ পথের যাত্রীদল;
মরণ দিয়েই বরণ করিতে,
হইবে তোমাদের মুক্তির ফল।।
চারণকবি মুকুন্দদাস দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার প্রতীক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সফল সংস্কৃতিবিদ। তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টি মানুষকে পরাধীনতার শিকল ছিড়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে শেখায়। মানুষের কাঙ্খিত সাম্যের সমাজ ও মানুষের পৃথিবী নির্মাণে বিপ্লবীদের আরো সাহসী করে তোলে।
চারণ বিপ্লবী মুকুন্দদাসের জন্ম ১৮৭৮ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) বানরী গ্রামে। বাবা গুরুদয়াল দে। মা শ্যামসুন্দর দে। ১৮৮৫ সালে অর্থাৎ মুকুন্দদাসের বয়স যখন ৭ বছর তখন তাঁর বাবা স্ব-পরিবারে বিক্রমপুর থেকে বরিশালে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাল্যকালে মুকুন্দদাসের নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। এ সময় সকলে তাঁকে আদর করে যগা বলে ডাকতো। মুকুন্দদাসের পিতা-পিতামহ দু’জনেই ছিলেন কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণব। তাঁদের সুরেলা কন্ঠে সব সময় কীর্তন গান ধ্বনিত হতো। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই মুকুন্দদাস শৈশবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ১৮৯০ সালে শারদীয় পূঁজার সময় তিনি সাধু রামানন্দ ওরফে হরিবোলান্দরের কাছে বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষাগুরু তাঁর পৈত্রিক নাম যজ্ঞেশ্বর পরিবর্তন করে মুকুন্দদাস নামকরণ করেন। মুকুন্দদাস অর্থাৎ কৃষ্ণের দাস।
মুকুন্দদাসের পিতা বরিশালে আসার কিছুদিন পর আলেকান্দায় একটি মুদি দোকান চালু করেছিলেন। এই মুদি দোকানে বসে মুকুন্দদাসের বাবা কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সুরেলা কন্ঠে সুমধুর গান গাইতেন। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বরিশালের এক ডেপুটি মেজিস্ট্রেট তাঁকে আদালতপাড়ায় আর্দালির চাকুরি দেন। এই চাকুরির পাশাপাশি তিনি মুদি দোকানটিও চালু রেখেছিলেন। এক পর্যায়ে মুকুন্দদাস এই দোকানটি পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।
মুকুন্দদাসের সুরেলা কন্ঠের সুর তাঁর বংশ প্রদত্ত। মা-বাবাকে অনুসরণ-অনুকরণ করে ছোটবেলা থেকেই তিনি মুখে মুখে গান বাঁধতেন এবং তা সুরেলা কণ্ঠে নিজে সুর করে গাইতেন। কিন্তু পড়াশুনা তাঁর ভাল লাগতো না।
যখন যা মনে চাইতো তখন তা-ই করতেন। পাঠ্য-পুস্তক পড়াশুনার প্রতি তার মনোযোগ ছিল না বললেই চলে। স্কুলে যাওয়ার কথা বলে পাড়ামহল্লার ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো কখনো চলে যেতেন গ্রামের মধ্যে। মাছ ধরা, পাখির বাসা ভাঙ্গা, জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোসহ নানারকম খেলাধূলায় মেতে থাকতেন। কিন্তু সবকিছুর সাথে তার মুখে সবসময় গান থাকতো। বাউণ্ডুলে স্বভাবের এই ছেলেটি সমাজের কথিত বখাটে ছেলেদের সাথে বেশি সময় কাটাতেন। বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে ৬ বছর পড়াশুনা করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে একজন ছাত্রের এ ধরনের অবনতি দেখে মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। পূর্ব থেকে তিনি অনেকবার মুকুন্দদাসের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটি অসাধারণ প্রতিভাবান। মুকুন্দদাসকে তিনি দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর স্নেহ ভালবাসার সহচর্য দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তুললেন।
১৯০১ সালে কীর্তন গান রচনা ও পরিবেশনার মাধ্যমে মুকুন্দদাসের শিল্পী জীবনের যাত্রা শুরু হয়। এই গানের মাধ্যমে তখন তিনি বেশ পরিচিতি পান। যে পরিচিতির মধ্য দিয়ে তিনি বরিশালের সংস্কৃতিমনা মুক্ত চিন্তার মানুষের সান্নিধ্য ও ভালবাসা পেয়েছিলেন।
১৯০৪ সালে মুকুন্দদাস বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জ্বীবিত বরিশালের সোনাঠাকুরের সাথে পরিচিত হন। ধীরে ধীরে তিনি সোনাঠাকুরের বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এসময় সোনাঠাকুরের কালী বাড়িতে অশ্বিনীকুমার, জগদীশ মুখোপাধ্যায়, সেবাব্রতী, কালীদাস চন্দসহ শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবকরা আড্ডা জমাতেন। আর মুকুন্দদাসও প্রায়ই এই সমস্ত লোকের আড্ডায় যোগ দিতেন। এদের সংস্পর্শে আসার ফলে মুকুন্দদাস ক্রমশ সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। যার ফলে মানুষ ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে প্রভাবিত হয়ে তিনি বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। একই সময় তিনি সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলের সাথে পরিচিত হয়ে ওই দলের যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তিনি সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হন। তিনি ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’তেও যুক্ত ছিলেন।
১৯০৫-০৮ সাল পর্যন্ত সময়ে “বরিশাল স্বদেশী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ও পীঠস্থান হইয়া উঠিয়াছিল। অশ্বিনীকুমারের জীবনব্যাপী লোকসেবা ও দেশসেবার ফলে, বরিশাল এই অনন্য সাধারণ মহিমা লাভ করিয়াছিল। অশ্বিনীকুমারই, সত্য বলিতে গেলে, দেশ একমাত্র লোকনায়ক ছিলেন”- বিপিন চন্দ্র পাল।
১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তার উপলব্দির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে’।

অশ্বিনী কুমার দত্তের এই বক্তব্য মুকুন্দদাস খুবই গুরুত্বসহকারে নিলেন। নিজেই মনে মনে চিন্তা ও প্রতিজ্ঞা করলেন গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা পরিবেশন করে মানুষকে সচেতন ও সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলবেন। যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করবে, যারা ব্রিটিশকে ভারত উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করবে। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কাজ। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে রচনা করলেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূঁজা’। মাতৃপূঁজার মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা অর্জন।  দেশমাতৃকাকে একত্রীকরণের লক্ষ্যে তার সন্তানরা প্রয়োজনে জীবন দিবে। ভারতমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে। তাঁর এই যাত্রাপালায় ভারতকে স্বাধীন করার অনুপ্রেরণাই প্রাধান্য পেয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে গড়ে তুললেন যাত্রাদল। নাম দিলেন স্বদেশী যাত্রাদল।
অশ্বিনীকুমার দত্তের আশির্বাদ মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে হাটে মাঠে গঞ্জে তিনি এই যাত্রাপালা পরিবেশনের মাধ্যমে সকলের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনা জাগ্রত করে তুলতে শুরু করেন। ‘মাতৃপূঁজা’ যাত্রাপালায় তিনি তাঁর কালজয়ী জাগরণী সঙ্গীত ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/ মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে-গানটি অন্তর্ভূক্ত করেন। যা আজও আমরা আমাদের দু:সময়ে নিজেদেরকে অগ্নিমন্ত্র জাগরিত করার জন্য গেয়ে থাকি। ১৯০৬ সালে মুকুন্দদাস দক্ষিণ বাংলার বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাপালা পরিবেশন করে তার যাত্রাদল নিয়ে নোয়াখালী, কুমিল্লা যান। এখানে যাত্রাপালা পরিবেশন করে বর্ষার মৌসুমে বরিশালে ফিরে আসেন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তার অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূঁজা’ মানুষকে স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে জাগরিত করেছে।
ওই বছর জুন মাসে বরিশালে স্বদেশী উৎসবের সময় তিনি ‘মাতৃপূঁজা’ যাত্রাপালা পরিবেশন করেন। এসময় বরিশালের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুকুন্দদাসকে উচ্চ প্রশংসা জানিয়ে আর্শিবাদ করেন। অক্টোবর মাসে তার ‘মাতৃপূঁজা’ যাত্রাপালার দ্বিতীয় বর্ষে তিনি যাত্রাপালা পরিবেশনের জন্য মাদারীপুরে যান। এখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় যাত্রা গান পরিবেশন শেষে ১৯০৭ সালের এপ্রিলে বরিশালে আসেন। ১৬ এপ্রিল মুকুন্দদাস রাজবাহাদুরের হাবেলিতে যাত্রাগান পরিবেশন করেন। দর্শকরা সবাই মুগ্ধ, আবেগে আপ্লুত। মাঝে মাঝে বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম স্লোগান চলছে। গান শেষে অশ্বিনীকুমার আবেগে আপ্লুত হয়ে মুকুন্দদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
মুকুন্দদাসের ‘মাতৃপূঁজা’ পালার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে তৎকালে কয়েকটি পত্রিকা বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দেমাতরম’, বারীণ ঘোষ ও ভূপেন দত্তের ‘যুগান্তর’, ব্রাহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সান্ধ্য’, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার ‘নবশক্তি’, অশ্বিনীকুমার দত্তের স্বদেশবান্ধব সমিতি’ রামানন্দ চট্টপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ ও ‘মর্ডান রিভিউ’ উল্লেখযোগ্য।
এই ‘মাতৃপূজা’পালার মাধ্যমে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণ সৃষ্টি হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার পূর্ব-বাঙলার জাগরণ সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ হতে পূর্ব-বাঙলার জেলাগুলোতে ‘শান্তিভঙ্গের কারণ’ দেখিয়ে মুকুন্দদাসের গানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে মুকুন্দদাস সরকারি বাধার সম্মুখীন হন। যেখানে তিনি গান করতে যেতেন, সেখান থেকেই পুলিশ তাকে বিতাড়িত করে দিত। এভাবে এক এলাকায় নিষেধাজ্ঞা হলে অন্য এলাকায় তিনি গান করতে চলে যেতেন।
১৯০৮ সালে তিনি আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে খুলনার কিছু অঞ্চলে গান করার পর বাগেরহাট গান করতে গেলে পুলিশ তার উপর চড়াও হয় এবং পালা পরিবেশন বন্ধ করে দেন। ওই সময় মুকুন্দদাস গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে তার দলবল নিয়ে গোপনে বরিশালে চলে আসেন।  ১৯০৮ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয় মুকুন্দদাসের যাত্রাপালা পরিবেশনের চতুর্থ বর্ষ। এ বছরও তিনি আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে তার যাত্রপালা অব্যাহত রাখেন। ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট ক্ষুদিরাম বসুকে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। বিপ্লবী ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি চেতনার আয়নায় চিত্রায়ন করে, একটি রচনা করেছিলেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস। একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি/ হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী/ কলের বোমা তৈরি করে/ দাঁড়িয়েছিলেম রাস্তার ধারে মাগো/ বড়লাটকে মারতে গিয়ে/ মারলাম আরেক ইংল্যান্ডবাসী/ শনিবার বেলা দশটার পরে/ জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো/ হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি/ দশ মাস দশদিন পরে/ জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো/ তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি’।
এসময় তিনি পালা পরিবেশনের শুরুতে ও শেষে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর সম্পর্কে বক্তৃতা ও গান করেন। যে বক্তৃতা শুনে উপস্থিত জনতা ব্রিটিশকে উৎখাত করার জন্য অগ্নিশপথ গ্রহণ করেন।
বরিশালে অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে উঠে তা বাংলার সর্বত্র উপচিয়ে পড়ে। এমন কি বাংলার বাইরেও অনেক প্রদেশে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে এবং অন্যান্য প্রদেশের নেতৃত্ব জনসভায় অশ্বিনীকুমার ও বরিশালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উদাহরণ দিতেন। বয়কট আন্দোলনকে সফল করার জন্য অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে স্বদেশবান্ধব সমিতি শহরে ও গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত। ফলে সরকার ভীত হয়ে ১৯০৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের ৯ জন নেতাকে (অশ্বিনী কুমার দত্তসহ) গ্রেফতার করে বিনা বিচারে জেলখানায় আটক করে রাখে।
অন্যদিকে মুকুন্দদাস গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা পরিবেশনের সময় এই গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ করেন। যে প্রতিবাদের কারণে পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার জনতা সংগঠিত হয়ে ৯ নেতার মুক্তির জন্য আন্দোলন জোরদার করে। এভাবে স্বদেশবাসীকে জাগাতে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য মুকুন্দদাস গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা পরিবেশন অব্যাহত রাখলেন।
মুকুন্দদাস তাঁর যাত্রা দল নিয়ে বরিশালের পূর্বাঞ্চল উত্তর শাহাবাজপুরের দিকে রওনা করলেন। অন্ধকার রাত। মাঝ নদীতে নৌকায় বসে মুকুন্দদাস তাঁর দল নিয়ে জোরগলায় গান ধরলেন ‘মায়ের নাম নিয়ে ভাসান তরী, যেদিন ডুবে যাবে’। হঠাৎ একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দ (টলার) শোনা গেল। কিছুক্ষণ পরেই ওই নৌকাটি তাদের নৌকার কাছাকাছি চলে আসল। এসে বলল, নৌকা থামাও। দু’জন ইংরেজ পুলিশ নৌকায় উঠে এসে মুকুন্দদাস ও তাঁর  সহযোগী সকলকে গ্রেফতার করল। নিয়ে গেল বরিশাল। পরেরদিন আদলতে তাদের জামিন মঞ্জুর করে মামলার পরবর্তী তারিখ পড়ল।
জামিন পাওয়ার ক’দিন পর মুকুন্দদাসকে ‘দেশের গান’ সংকলন প্রকাশ করার জন্য রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করে। এই মামলায় আদালত তাঁকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। এ মামলায় তাঁর ৩ জন সহযোগী বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ভোগ করেন। যে গানটির জন্য মুকুন্দদাসকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, তা হল ‘বাবু বুঝবি কি আর ম’লে/ কাঁধে সাদা ভূত চেপেছে/ সাহেবি চালটি ছাড়, যদি সুখ চাও কপালে’। জেলখানার মধ্যে মুকুন্দদাস কয়েদীদের গান শুনাতেন। তাদেরকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাগরিত করতেন।
১৯১১ সালের মার্চ মাসে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই শুনতে পান, তাঁর স্ত্রী শতদলবাসিনী কলেরা রোগে বহুদিন পূর্বে মারা গেছেন। পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে জেলে ঢুকানো হয়েছে। অর্থের অভাবে মুদি দোকানটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ সব শুনে মুকুন্দদাস খুবই ভেঙ্গে পড়লেন। এ অবস্থায় অশ্বিনী কুমার দত্তসহ অনেকেই মুকুন্দদাসকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। সকলেই আর্থিক সহযোগিতাও করেন। সে অর্থ দিয়ে মুকুন্দদাস শহরের কালীবাড়ি রাস্তায় একটি মুদি দোকান চালু করেন। অভাব, দারিদ্র ও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়েও কখনো তিনি আদর্শ ও দেশপ্রেম থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত হননি।
কিছু দিনের মধ্যে মুকুন্দদাস যাত্রা দলকে পুনর্গঠিত করে যাত্রাপালা পরিবেশন করা শুরু করলেন। এরমধ্যে নতুন যাত্রাপালা লিখে ফেললেন। এভাবে তিনি জীবদ্দশায় ৫ টি যাত্রাপালা লিখেছিলেন। ১৯১২-২৫ সাল পর্যন্ত তিনি ‘পল্লীসেবা, ব্রহ্মচারিণী, সমাজ ও পথ’ যাত্রাপালাগুলো পরিবেশন করে বেড়িয়েছেন। ব্রিটিশ সরকারের জেল, জলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে জনগণকে সচেতন করে তুলতেন। যাতে ওই জনগণই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করে। অবশেষে জনগণ তাই করেছিল।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সমস্ত ভারতব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে যাত্রাপালা পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এ সময় মুকুন্দদাস তাঁর দল নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ওই সময় মাতৃপূঁজা যাত্রাপালাটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। মুকুন্দদাস তখন সরাসরি ব্রিটিশ বক্তব্য বাদ দিয়ে সামাজিক সমস্যাবলী নিয়ে রচিত যাত্রাপালা পরিবেশন করতে থাকেন। ব্রিটিশ সরকার মুকুন্দদাসের এই অভিনব কৌশল বুঝতে পেরে ১৯৩২ সালে তাঁর সকল যাত্রাপালা নিষিদ্ধ করে।
১৯২৬ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাঁর মেয়ের বিয়েতে গান গাইবার জন্য মুকুন্দদাসকে কলকাতায় নিয়ে যায়। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সামনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করলেন। সকলেই তাঁর গান ও যাত্রাপালার আকর্ষণীয় অভিনয়, বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ওই সময় প্রখ্যাত কবি প্রিয়ংবদা দেবী মঞ্চে উঠে তাঁকে সোনার সেফটিপিন উপহার দিয়েছিলেন।
১৯৩৪ সালে পালাগানের বায়না পেয়ে দল নিয়ে কলকাতায় যান। ছোট একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানে বসবাস শুরু করেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গানের বায়না আসতে থাকে। এ সময় মুকুন্দদাস শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীর নিয়ে কোনোমতে গান গেয়ে যান। কারণ গান না গাইলে সাথীদেরকে বেতন দিবেন কি করে! ওই বেতনে তাদের সংসার চলে।
১৯৩৪ সালে ১৭ মে তিনি তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। গভীর রাতে বাসায় ফেরেন। দলকে ১ ঘন্টা তালিম দিলেন পরের দিন গান গাইবার জন্য। তারপর বিশ্রামে গেলেন। এটাই তাঁর অনন্ত বিশ্রাম।
মুকুন্দদাসের রচনা নিদর্শন: “একদিন বরিশাল ব্রাহ্মসমাজ থেকে বক্তৃতা দিয়ে রাত ৯টা অশ্বিনীবাবু বাসায় চলছেন, সঙ্গে সেদিন অপর কোনো লোক ছিলেন না। সেদিন বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘সত্য’(১৯৮৯ সাল)।
রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তিনি ভাবছেন এইতো আজ বক্তৃতা দিয়ে এলুম, আমাদের সকলকে সত্যবাদী হতে হবে, সত্যকে অবলম্বন করেই আমাদের কর্মের পথে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু কাল পড়ঁৎঃ-এ গিয়ে আমাকেই আবার মিথ্যা নিয়ে দাড়াতে হবে, বিবেকের অনিচ্ছায়ও মিথ্যাকে সমর্থন করে পড়ঁৎঃ-এ বক্তৃতা করতে হবে।
আচ্ছা আমি কি মিথ্যা না বলে পারি না? টাকা উপার্জনের জন্যই তো আজ আমায় ওকলাতী করতে হচ্ছে, বাবা যা রেখে গেছেন তাতেই তো আমার মোটা ভাত মোটা কাপড় হতে পারে? মিথ্যা কথার ব্যবসা করতেই কি আমি সংসারে এসেছি, ঠাকুর কি আমায় এই জন্যই সংসারে পাঠিয়েছেন? এত ঘৃণিত জীবন কি আমার?
উপদেষ্ঠার আসনে বসে আজ আমি যে বাণী প্রচার করে এলুম, আমার ব্যক্তিগত জীবনে যদি তা বাস্তবায়িতই না হলো তবে সমাজকে এ প্রতারণা করে আমার ভবিষ্যৎ ম্লান করে তুলছি কেন?-সত্যের বিমল রশ্মিতে প্রাণ উজ্জল হয়ে উঠলো, প্রাণ তার কর্তব্যের পথ চিনে নিল, তাই তখনই সঙ্কল্প করলেন “ আর আমি পড়ঁৎঃ-এ যাব না, জগতের সেবায় প্রাণ উৎসর্গ করবো”-মুকুন্দদাস।
তথ্যসুত্র:
১। জীবনী গ্রন্থমালা মুকুন্দদাস: স্বরোচিষ সরকার। প্রকাশক বাংলা একাডেমী। প্রকাশকাল-নভেম্বর, ১৯৯৯।
২। চারণকবি মুকুন্দদাস: জয়গুরু গোস্বামী। বিশ্ববানী প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল-১৯৭৮।
৩। মুকুন্দদাস রচনাসমগ্র: সম্পাদক- শেখ রফিক। প্রকাশক: র্যা মন পাবলিসার্স, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল-২০০৮।
৪। স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল: হীরালাল দাশগুপ্ত। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। প্রকাশকাল, ডিসেম্বর-১৯৯৭।
৫। িি.িনরঢ়ষড়নরফবৎশড়ঃযধ.পড়স : শেখ রফিক