গোলাম সামদানী চরিতামৃত: যতীন সরকার

 গোলাম সামদানী কোরায়শী আমার বন্ধু ছিলেন। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছিল। সে সূচনাই দিনে দিনে ক্রমপ্রসারমান হয়ে উঠেছিল। ডালপালা বিস্তার করে মহীরুহের রূপধারণ করেছিল। সে ছত্রছায়ায় অবস্থান করে আমি ধণ্য হয়েছিলাম।

তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গভীর ছিল বটে কিন্তু একমাত্রিক ছিল না। আমাদের দু’জনের মতের ঐক্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল মতভিন্নতাও। কখনও কখনও তীব্র মতদ্বন্দ্বেও পরিণত হত। তবে সে দ্বন্দ্ব আমাদের সম্পর্কেও মধুরতাকে সামান্য পরিমাণেও আবিল করতে পারত না। আমাদের মতান্তর কখনও মনান্তরের জন্ম দেয়নি।

১৯৬৮ সালের মাঝামাঝিতে সামদানী যখন নাসিরাবাদ কলেজে আমার সহকর্মী হয়ে এলেন, তখন তাকে একজন ‘অজ্ঞেয়বাদী’ বলে মনে হয়েছিল। আলীয়া মাদ্রাসা থেকে মমতাজুল মোহাদ্দেসীন হওয়ার পর আধুনিক ধারার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়ে বাঙলা সাহিত্যে এম.এ. পাস করে ষাটের দশকের গোড়ায় বাঙলা একাডেমিতে চাকরি নিয়েছিলেন, আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রণয়নে জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সহযোগী হয়েছিলেন। সে সময়ে কিংবা তার কিছু আগে থেকেই নাকি সামদানী সাহেব সকল প্রকার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিত্যাগ করেছিলেন, ধর্ম বিষয়ে ক্রিটিক্যাল হয়ে উঠেছিলেন। পরিচয়ের প্রথম পর্বেই আমি তার এই সমালোচনামুখর রূপটি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ধর্ম থেকে শুরু করে দর্শন পর্যন্ত নানা বিষয়েই তিনি নানা প্রশ্ন উত্থাপন করতেন। কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই নিঃসংশয় উত্তরে পৌছতেন না। ভাববাদ ও বস্তুবাদ উভয়ের প্রতি সে সময়ে তাকে আমি সংশয়তুর দেখেছি। আমি যে দ্বান্দ্বিক বস্তু বাদে বিশ্বাস করি সেটা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। আমার এই বিশ্বাস কে তিনি এক ধরনের মতান্ধতা বলেই মনে করতেন এবং এর জন্য আমাকে বিদ্রুপরাণে বিদ্ধ করতেও পিছপা হতেন না। নিজেকে তিনি মুক্তবুদ্ধির সাধক বলে পরিচয় দিতেই গৌরববোধ করতেন। যে কোনোও রূপ দার্শনিক বিশ্বাসের অনুগামীতাকেই মুক্তবুদ্ধির বিরোধী বলে মনে করতেন। অথচ কি আশ্চর্য, কয়েক বছরের ব্যাবধানেই তার চিন্তাচেতনার এমন সমপ্রসারণ ঘটে গেল যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মধ্যেই মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রশস্ত পথকে তিনি খুঁজে পেলেন। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এমন প্রত্যয়ী হয়ে উঠলেন যে তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে সমাতন্ত্রী শিবিরে যখন প্রচন্ড ধ্বস নামছিল, তখন এখানে ওখানে উচ্চ কন্ঠে তিনি বলতে লাগলেন, পৃথিবীর সব মানুষ যদি সমাজতন্ত্রকে মিথ্যা বলে, তবুও আমি একাই সমাজতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে যাব।

২। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও সমাজতন্ত্রে প্রত্যয়ী হয়ে উঠলেও, লক্ষ্য করেছি যে, সামদানী সাহেবের সে প্রথ্যয় ছিল একান্তই ব্যাক্তি বৈশিষ্টমন্ডিত। পরের মুখে ঝাল খাওয়া তিনি কখনই পছন্দ করতেন না, সবকিছুতেই যাচাই বাছাই করে নিজের মতটি গঠন করতেন। আনুষ্ঠানিক ধর্ম বিশ্বাস থেকে অজ্ঞেয়বাদে এবং অজ্ঞেয়বাদ থেকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে উত্তরণের ক্ষেত্রেও তিনি তার ব্যাক্তি বৈশিষ্টটিকে সমুজ্জ্বল রেখেছিলেন। জীবনের শেষ পর্বে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কে জীবন দর্শন হিসেবে গ্রহণ করবার পর নানা ঘরোয়া আলোচনায় ও সভা-সমাবেশে প্রায়ই তিনি বলতেন ‘আমার গুরু সাতজন। প্রথম গুরু সক্রেটিস, দিত্বীয় গুরু বুদ্ধ, তৃতীয় গুরু শ্রীকৃষ্ণ, চতুর্থ গুরু যীশুখ্রিস্ট, পঞ্চম গুরু হযরত মুহম্মদ (সাঃ), ষষ্ঠ গুরু কার্ল মার্কস এবং আমার সপ্তম গুরু হচ্ছেন একান্তই আমার নিজের, যিনি আর কারও গুরু নন, তিনি আমার জন্মদাতা পিতা।’

নানা প্রসঙ্গে তিনি তার এই গুরুদের শিক্ষার ব্যাখ্যাও দিতেন। সক্রেটিসকে প্রথম গুরু বলতেন এ কারণে যে, তিনিই তো মানুষ কে প্রথম আত্মসমীক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ‘অপরীক্ষিত জীবন কোনও মতেই যাপনের উপযুক্ত নয়’এমন কথা বলেই তো সক্রেটিসই প্রতিটি মানুষকে আত্মপরীক্ষায় প্রবৃত্ত হতে আহ্বান জানিয়েছেন। আমরাতো কোনও না কোনও ধর্ম মত অনুসারী হয়ে থাকি জন্মসূত্রেই। বয়সঃপ্রাপ্ত হয়ে নিজে পছন্দ অনুযায়ী ধর্ম মত বাছাই করে নেয়ার অধিকার সমাজ আমাদের দেয় না। গড্ডল প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েই ধর্মমত ছাড়া রাজনৈতিক বা দার্শনিক অন্য অন্য মতেরও অনুসারী হই আমরা। আত্মসমীক্ষা বা আত্মপরীক্ষায় প্রবৃদ্ধ হয়ে নিজের জীবন কে কেউই আমরা গড়ে তুলি না। এ কারণে সামদানী সাহেব বলতেন, ‘যাপিত জীবন কে অর্থবহ করে তুলতে হলে সক্রেটিসকেই প্রথম গুরু রূপে বরণ করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই’। এরকমভাবেই পরপর বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ ও যীশুর শিক্ষার গুরুত্বেও কথা তিনি তুলে ধরতেন। তার পঞ্চম গুরু হযরত মুহম্মদের শিক্ষা ও আদর্শ সম্পর্কে তো তার ছিল গভীর অনুধাবন। মাদ্রাসার মেধাবী ও কৃতী ছাত্ররূপে মুহম্মদ (সাঃ) ও ইসলাম সম্পর্কে তিনি অসাধারণ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। ঘরোয়া আলাপে কিংবা নানা আলোচনা সভায় তার সেই জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তার কি গভীর শ্রদ্ধাই না ছিল মহানবী মুহম্মদের প্রতি। সে শ্রদ্ধায় কোন সংস্কারান্ধতা ছিলনা, গতানুগতিকতা ছিলনা, বিচারহীনতা ছিলনা। বিচারশীল ঐতিহাসিক দৃষ্টি দিয়েই তিনি সব কিছু গ্রহণ করতেন। কার্ল মার্কসের প্রতিও এরকম সবিচার দৃষ্টি দিয়েই তিনি তাকিয়েছিলেন। নিজস্ব বিচারশীলতা ক্ষুন্ন হবে মনে করেই, মার্কসের অনুরাগী হয়েও, কমিনিস্ট পার্টির শৃংখলা সূত্রে নিজেকে তিনি আবদ্ধ করতে চাননি। তবে কমিউনিস্টদের সঙ্গে সবসময় তিনি অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এবং আগেও কিছু পরিমানে নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন কমিউনিস্টদের বিশ্বস্ত সহযাত্রী।

ষাটের দশকে আমরা ময়মনসিংহে এমন একটি সাহিত্যচক্র গড়ে তুলেছিলাম, যেটির কোনও সাংগঠনিক রূপ ছিলনা, সভাপতি-সম্পাদক কিছুই ছিলনা, এমনকি এর কোনও নামও ছিলনা। তখনকার গোপন ও নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিও অদৃশ্য পৃষ্ঠপোষকতা ছিল অনামি এই সাহিত্যচক্রটির প্রতি। ৬৮তে ময়মনসিংহে এসেই সামদানী সাহেব এই সাহিত্যচক্রটির মধ্যমণি হয়ে উঠেছিলেন। তখন আর সেটি অনামী রইলনা। সামদানী সাহেবই এর নামকরণ করলেন, ‘ঘরোয়া সাহিত্যচক্র’। মূলত এই সাহিত্যচক্রের সদস্যদের উদ্যোগেই ১৯৭১ – এর মার্চে ময়মনসিংহে ‘বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির’ গড়ে উঠেছিল। এই শিবিরেরও প্রাণস্বরূপ হয়ে উঠলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। ময়মনসিংহে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে ‘বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির’ – এর অবদান মোটেই হেলাফেলা করবার মত নয়। স্বাধীনতার পরও এই সংগঠনটি ময়মনসিংহের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে সক্রিয় ছিল। এরপর ৭৫ – এর ১৫ আগষ্টের অমানবিক হত্যাকান্ডের মধ্যদিয়ে সারা দেশে যখন এক ‘অদ্ভুত আঁধার’ নেমে এসেছিল, তখনও মুক্তচেতন সংস্কৃতির আলো জ্বালিয়ে রাখতে সামদানী সাহেব কে আমরা উদ্যোগী হতে দেখেছি। ৭৬ – এ ২১ ফেব্রুয়ারী ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনে গোলাম সামদানী কোরায়শীই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর ময়মনসিংহে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ এর শাখা গঠিত হলে সামদানী সাহেবই তার কর্ণধার হন। ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ কিংবা ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল সমন্বয় কমিটি’তেও সামদানী সাহেবের অবস্থান ছিল প্রথম সারিতে। ‘বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’র কেন্দ্রিয় কমিটির তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ময়মনসিংহের মতো মফস্বলের বাসিন্দা হয়েও সারাদেশের প্রগতিশীল শিক্ষা আন্দোলনে তার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। ময়মনসিংহ শহরে তো সামদানী সাহেব কে বাদ দিয়ে কোনওরূপ প্রগতিশীল কর্মকান্ডের কথা ভাবাই যেতো না।

আশির দশকে সৈরাচারী এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সম্পর্কীয় ঘোষণা যখন বাঙালী মুক্তিযুদ্ধকে ও লাখ শহীদের আত্মদানকে একান্তই বিদ্রুপবিদ্ধ করে তুললো, তখন স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে আত্মবিজ্ঞাপিত রাজনৈতিক দল গুলোও তেমন জোরে সোরে কোনও প্রতিবাদ করেনি। ময়মনসিংহ শহরে গোলাম সামদানী কোরায়শী কিন্তু ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণার প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, জ্বালাময়ী বক্তৃতায় প্রচন্ড ক্ষোভেরও প্রকাশ ঘটালেন, হিসেবী রাজনীতিকদের মতন ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ করে দায় সারলেন না। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই গোলাম সামদানী কোরায়শী ছিলেন এমন অকপট ও দৃঢ়।

৩। যদিও গোলাম সামদানী কোরায়শীর পৈত্রিক ভিটা ও জন্মস্থান ছিল গৌরীপুর থানার বীরআহমদপুরে, তবু সংগ্রামী জীবনের নানা ঘাটে জল খেয়ে খেয়ে তিনি ডেরা বেধেছিলেন ময়মনসিংহ শহরের উপকন্ঠে আকুয়া গ্রামে। জীবনের শেষ ২০/২২ বছর তিনি এখানেই কাটিয়েছিলেন। তার প্রতিবেশীদের গরিষ্ঠ সংখকই ছিলেন খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষজন। এদেও সকলের সুখদুঃখের সঙ্গে তিনি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। আপদে-বিপদে এরা গোলাম সামদানী কোরায়শীরই পরামর্শ ও সহযেগীতা গ্রহণ করতেন। সামদানীকে ছাড়া এদেও পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের কোন কাজই সম্পন্ন হত না। প্রতিবেশীসহ যে কোনও পরিচিত জনের বিপদকে নিজের বিপদ বলেই মনে করতেন তিনি। নিজের বিপদকে বরং অনেক সময় উপেক্ষাই করতেন। কিন্তু পরের বিপদে কখনও নির্লীপ্ত থাকতে পারতেন না। হিউম্যানিজম এবং হিউম্যানিটারিয়ানিজমের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছিল তার স্বভাবে।

ব্যাক্তিগত ভাবে আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণের সঙ্গে সামদানীর কোনও সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও প্রবিবেশীদের ধর্মীয় জীবনের তিনিই ছিলেন সহযোগী। গাঁয়ের মসজিদের কোষাধ্যক্ষও হতে হত তাকেই। কারণ প্রতিবেশীরা জানত সামদানী সাহেব মসজিদে না গেলেও মসজিদের তহবিলের তিনিই হতে পারেন বিশ্বস্ত সংরক্ষক। ঈদুল আজহার দিনে আকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সামনে তারই তত্বাবধানে গাঁয়ের সমস্ত লোকের পশু কোরবাণী হত। সকলকে মাংসের যথাযথ ভাগ বন্টন করে দিয়ে তিনি ঘরে ফিরতেন।

একজন আলেম হয়েও তিনি কেন ধর্মাচরণের আনুষ্ঠানিকতায় সামিল থাকেন না, এ নিয়ে অনেকেরই তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। আড়ালে সামদানীর ধর্মহীনতা নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বললেও সামনাসামনি কেউ তাকে অভিযুক্ত করতে সাহস পেত না, তার ব্যাক্তিত্বকে না করার ক্ষমতা কারুরই ছিল না। তিনিও অবশ্যই জনসমক্ষে ধর্ম সম্পর্কে কোনও কালাপাহাড়ী কথাবার্তা বলতেন না, নিজের চৈতন্য ও আচরণে দৃঢ় থেকেই তথাকথিত বিদ্রোহীর ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য কখনও কোনও রূপ অতিরেকের প্রশ্রয় নিতেন না। আপন আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়েও বাস্তববুদ্ধিকে তিনি বিসর্জন দেন নি।

অসাধারণ কান্ডজ্ঞান ও বাস্তববুদ্ধির সঙ্গে মুক্তচিন্তার যে সংমিশ্রন ঘটেছিল তার চরিত্রে, এ জন্য তিনি বারবার তার পিতার ঋণ স্বীকার করতেন। তার পিতা মৌলবি আব্দুল করিম কোরায়শী উত্তর ভারত থেকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। সেখান থেকেই পাঠ নিয়েছিলেন ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রেরও। চিকিৎসা ব্যাবসায়ী পিতার মুক্তচিন্তার প্রভাব পুত্রের উপর গভীরভাবেই পড়েছিল। এ কারণেই জীবন সায়াহ্নে তার সপ্ত গুরুও এক গুরু রূপে পিতার কথা বারবার স্মরণ করতেন।

তবে পিতাকে যে তিনি অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন এ কথা বোধ হয় নির্দিধায় বলা যেতে পারে। তিনি শুধু জ্ঞানসাধক ছিলেন না, ছিলেন সৃজনশীল সাহিত্যিকও। ছড়া-কবিতায় তার হাত ছিল চমৎকার, যদিও কোন মৌলিক কবিতার বই তিনি প্রকাশ করেননি। তবে ইকবালের হেজাজের সওগাত – এর কাব্যানুবাদে গোলাম সামদানীর কবি-কুশলতার পরিচয় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। অত্যন্ত সৃষ্টিশীল একটি মন ছিল তার। সেই মনেরই প্রকাশ দেখি সেমেটিক পুরাণের কাহিনী অবলম্বনে লিখিত তার কয়েকটি উপন্যাসে। এগুলোর মধ্যে ‘স্বর্গীয় অশ্রু’ ও ‘মহাপ্লাবণ’ তার জীবৎকালেই প্রকাশিত হয়েছিল। পান্ডুলিপি রেখে গেছেন এই ধারারই আরও দুটি উপন্যাসের ‘পুত্রোৎস্বর্গ’ ও ‘চন্দ্রাতপ’। মৌলিক গল্পের পান্ডুলিপি আছে দুটি ‘দেবাঃন জানন্তি’ ও ‘সংলাপ’।

অবশ্যই স্বীকার করতেই হবে যে গোলাম সামদানীর মননশীল রচনায় যে উৎকর্ষের পরিচয় আমরা পাই, তেমনটি পাই না তার গল্প উপন্যাস বা কবিতায়। বহুভাষাবিদ গোলাম সামদানী কোরায়শীর বিদ্যাবত্তা ও মননশীলতার পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে তার অনুবাদ কর্মগুলোতে। মূল ফার্সি থেকে ‘কালিলা ও দিমনা’ তিনি অনুবাদ করেছিলেন। ফার্সি থেকেই অনুবাদ করেন ক্লাসিক্যাল ইতিহাস গ্রন্থ ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’র। মূল আরবী থেকে অনুদিত ‘আল-মুকাদ্দিমা’ তার অনন্য সাধারণ কীর্তির স্মারক হয়ে থাকবে। ইবনে খালদুনের এ মহাগ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ বাংলা ভাষায় এর আগে কেউ করেন নি। ইবনে খালদুনকে তো আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় যারা সমাজবিজ্ঞানের চর্চা করবেন তাদের অবশ্যই গোলাম সামদানী কোরায়শীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। তার ‘আরবী সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ও একটি মূল্যবান পুস্তক।

সাহিত্য সম্পর্কে গোলাম সমাদানী কোরায়শীর ভাবনা-চিন্তার পরিচয়বাহী গ্রন্থ তার ‘সাহিত্য ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক সংকলনটি। তিনি আলাউল বিরচিত ‘তোহফা’ গ্রন্থটির সম্পাদনা করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলাভাষা ও সাহিত্যে যে দখল ছিল তারই প্রমাণ রেখেছেন ঐ সম্পাদিত পুস্তকটিতে। সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে যে তিনি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতেন তারই প্রকাশ ঘটেছে ‘বিশ্লেষক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রগতিশীল চিন্তাবিদ’ এ পুস্তকটিতে। প্রকাশিত এই পুস্তিকাটিতে এবং অপ্রকাশিত নিবন্ধগ্রন্থ ‘আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম’ এ তিনি মৌলবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গভীর ঘৃণারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

অন্তর্জগতের কোনও ছাপ নেই তার কোনও প্রকাশিত গ্রন্থেই। পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে থাকা কিছু কিছু ব্যাক্তিগত নিবন্ধে তার মানসলোকের কিছু কিছু ছাপ পড়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ নয়। তার আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব রূপে লেখা ‘সিন্ধুর এ বিন্দু’ পাঠ কওে বাঙালী পাঠক তার মানস বিবর্তণের প্রক্রিয়াটির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। এই বইটিতে তিনি যে শুধু তার মানস জগতকেই অনাবৃত করে দেখিয়েছেন তা নয়। কি চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন ও কি কঠিন সংগ্রাম করে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, এ বইয়ে তারই শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী পাঠ করে পাঠক চমৎকৃত হয়ে যাবেন।

বলার পরও কিন্তু বলতে হবে যে, তার জীবন ভাবনা তথা জীবন দর্শন ও ব্যাক্তি স্বরূপকে কোনও বইয়ে বা লেখায় পুরোপুরি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এজন্য প্রয়োজন ছিল একজন বসওয়েলের। গোলাম সামদানীর জীবৎকালে আমরা কেউই তার বসওয়েলের দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। যদি করতাম তাহলে বাঙালী পাঠক একজন এদেশীয় জনসনকে পেয়ে যেত। নানা আড্ডায় ও বৈঠকে তিনি যে সব সিরিয়াস কথা বলেছেন কিংবা হালকা চুটকি ঝেড়েছেন অথবা নানা ঘটনায় নানান ধরনের প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেসবের বিবরণ রেকর্ড করা থাকলে বর্তমান প্রজন্মের মানুষ একজন অনুসরণীয় ব্যাক্তিত্বের মডেল পেতে পারত।

কিন্তু আমরা তার সহকর্র্মী ও সহযোদ্ধা বন্ধুরা যথাসময়ে দায়িত্ব পালন করিনি বলে আমাদের পক্ষে এখন আপসোস করা ছাড়া আর করার কিছুই নেই।

অক্টোবর, ২০০২