গণসঙ্গীতের তুলিতে উদীচীর সাহসী আঁচড় : সঙ্গীতা ইমাম

‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’- লড়াই আর সংগ্রামের অনন্য মণিকাঞ্চণে এমন এক সংগঠন, যা সমাজের চোখ হয়ে মানুষের দুঃখে কাঁদে, আনন্দ-অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে যে কোনো আনন্দ বা উত্তরণে, প্রাণিত হয় মানুষের স্বপ্নময় উদ্বোধনে।

শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও গণমানুষের ক্যানভাসে অধিকারের এক অপূর্ব প্যাস্টেল চিত্র সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১) স্বপ্ন দেখেছিলেন হাসি-গানে মুখর এক বাংলার; ছিলেন বিপ্লবী ও কৃষক আন্দোলনের সংগঠক। সময়ের পলিমাটিতে হেঁটে কিছু মানুষ হয়ে ওঠেন সময়ের দর্পন- সত্যেন সেন ছিলেন তেমনই এক মানুষ। সত্যেন সেন ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ তারিখে বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) জেলার টঙ্গীবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের সেন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলায় তাঁর ডাক নাম ছিলো লস্কর। তাঁর পিতার নাম ধরনীমোহন সেন, এবং মাতার নাম মৃণালিনী সেন। চার সন্তানের মধ্যে সত্যেন ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সোনারং গ্রামের সেন পরিবার ছিলো শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এক অনন্য উদাহরণ। সত্যেনের কাকা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তাঁর আরেক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশু-সাহিত্যিক। এই পারিবারিক পরিবেশের মধ্য থেকেই তিনি তাঁর মনোজগতের বিকাশ ভিত রচনা করেন। তিনি ঠিক বুঝেছিলেন, মানুষের সত্যিকারের মুক্তি কখনোই সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯৬৮ সালে কয়েকজন তরুণের উদ্যোগে সত্যেন দার নেতৃত্বে পথ চলা শুরু হয় ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র। চামেলিবাগে মহড়া চলে গণসঙ্গীতের, সভ্য হন শিল্পী সংগঠক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। সেই থেকে শুরু গণসঙ্গীত দিয়ে গণমানুষকে অধিকার সচেতন করা এবং তা আদায়ের জন্য মানুষের সূর্যমুখী যূথবদ্ধতায় আন্দোলনের পথ নির্মাণ করা।

‘উদীচী’র পরিচয় গণসঙ্গীতের সংগঠন হিসেবে; যদিও শিল্পকলার প্রতিটি মাধ্যমে সমান বিচরণ আছে এই সংগঠনের শিল্পীদের। ‘উদীচী’ লোকসঙ্গীত উৎসব, নাট্যোৎসব, আবৃত্তি উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসবসহ দেশব্যাপি নানা ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও ২০০৯ সালে শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিবসকে উপলক্ষ করে তাঁরই নামানুসারে শুরু হয় দেশের প্রথম গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা- ‘সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব’। এই উৎসবের একটি বড়ো অংশ প্রতিযোগিতা। তবে সাধারণত প্রতিযোগিতা বলতে যা বোঝায়, সে অর্থে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় না। গণমানুষের সম্পৃক্ততায় গণসঙ্গীতের বাতায়নে চোখ রেখে নিজেদের শাণিত করে তোলাই এ আয়োজনের লক্ষ্য। হয়তো প্রতিযোগিতার সাধারণ নিয়মাবলী অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বা নানা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করা হয়; কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। প্রতিটি অংশগ্রহণকারীর মাঝে বোধের নান্দনিক স্ফূরণ ঘটিয়ে তার সঙ্গে বিচারকদের চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সুরসত্ত্বার বন্ধন তৈরি করাটাই মুখ্য। আর এ সার্বিক আয়োজন যেনো শেষ পর্যন্ত কেবল কয়েকটি কাঠের মঞ্চেই নয়, বরং ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পলিমাটির হৃদয়ে- তার জন্যই নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র সকল কর্মীবৃন্দ। জেলা পর্যায়ে সমমনা সংগঠন, বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিযোগী আহবান করা হয় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ ৩০৬টি শাখাসহ জেলা শহর সেজে ওঠে প্রতিযোগিতায়। জেলা পর্যায়ের বিজয়ীরা বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। বিভাগীয় পর্যায়ের বিজয়ীরা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেন রাজধানী ঢাকায়। প্রতিযোগিতা হয় তিনটি বিভাগে। ‘ক বিভাগ’- এ অংশ নেন ৭ থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রতিযোগীরা, ‘খ বিভাগ’- এ ১৫ উর্ধ্ব বয়সী প্রতিযোগীরা এবং ‘গ বিভাগ’- এ দলীয় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা বয়সী শিল্পীরা এই প্রতিযোগিতা উপলক্ষে গণসঙ্গীত চর্চায় নিজেদের নিয়োজিত করেন। সত্যেন সেন গণ-সঙ্গীত উৎসবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দেশের প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী ও সংগঠনসমূহের পুনর্মিলনী; তাঁদের গান শোনার সুযোগও ঘটে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পীরাও এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাঁদের অনবদ্য পরিবেশনায় ঋদ্ধ হন বাংলার সঙ্গীত পিপাসু মানুষ, আরও প্রোজ্জ্বল হয় আমাদের অধিকার আন্দোলনের বাতিঘর, রচিত হয় এক অপূর্ব মেলবন্ধন- যার ভিত্তি বাংলা গান।

২০০৯ সালে সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবে অতিথি হিসেবে আসেন ভারতের প্রবাদ প্রতিম গণ-সঙ্গীত শিল্পী অজিত পাণ্ডে যিনি তাঁর জীবদ্দশায় গণসঙ্গীত ও গণমানুষের জন্য কাজ করেছেন নিষ্ঠার সাথে। জীবন কাটিয়ে গেছেন গণসঙ্গীত রচনা, সুরারোপ ও হাটে-মাঠে-ময়দানে পরিবেশনের মাধ্যমে গণমানষুকে অধিকার আদায়ে সচেতন ও সোচ্চার করার কাজে। অসাধারণ বন্ধুবৎসল, স্নেহপ্রবন, সাহসী, সাপ্নিক মানুষ ছিলেন অজিত পান্ডে। তাঁর প্রজন্মের সকল বাঙালির মতো এই বাংলার প্রতি তাঁরও জন্মভূমির টান, যদিও তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের মানুষ। পদ্মা তাঁর কাছে ছিলো দুই বাংলার বন্ধনের সেতু।

২০১০ সালে সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবে অতিথি হিসেবে আসেন কিংবদন্তী গণসঙ্গীত শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। যাঁর নিজের লেখা, সুরারোপ করা গান কোনো যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়াই মুগ্ধ করে বাংলাদেশের মানুষকে। তাঁর কিছু অভিমান ছিলো এ দেশের সঙ্গীত শিল্পীদের প্রতি। এই আতিথ্য গ্রহণের ফলে তা-ও দূরীভূত হয়। তিনি নিজেই বলেছিলেন- “ভেবেছিলাম অভিমানের কারণে ‘দাড়ি’ দেবো; কিন্তু এমন আকুল টান, পারলাম না, শেষে ‘কমা’ দিয়ে আবার এলাম”। তিনি আসেন তাঁর জন্মভূমি এই বাংলায় আর লেখেন- “দুই জনায় বাঙালি ছিলাম দেখ দেখি কা-খান, তুমি এখন বাংলাদেশি, আমারে কও ইন্ডিয়ান”। এই গানের এক পর্যায়ে তিনি বলেন- “দুঃখ কিছু ছিলো মনে দুঃখেরে কই যাওরে ভাই, সাঁঝবেলার আদরের ডাকে কেমনে বলো মুখ ফিরাই”। তাই ‘উদীচী’ ও তার শিল্পী-কর্মীরা তাঁর কাছে বড়োই আদরের, যেমন তিনি আমাদের কাছে। এই সময় প্রতুল মুখোপাধ্যায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, যশোরে অগণিত অনুষ্ঠান করে মুগ্ধ করেন হাজারো শ্রোতাকে। কতোজনের যে অতৃপ্তি থেকে যায়, রেখে যান প্রতিশ্রুতি আবারো আসবার। তাঁর জন্মভূমি বরিশালে যাবেন, ঘুরে দেখবেন এই বাংলাকে। শরীর তেমন ভালো না থাকায়, এখনও তা সম্ভব হয়নি। তবুও তাঁর স্নেহধন্য হয়ে রয়েছি আমরা- বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী।

২০১১ সালে সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় এ সময়ের জীবনবাদী সঙ্গীতের অন্যতম নাম, যাঁর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণার সম্পর্ক অনেকদিনের, তিনি-মৌসুমী ভৌমিক। মৌসুমী ভৌমিক তাঁর বহু গান, বিশেষত, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে অ্যালেন গিন্সবার্গের লেখা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটির ছায়ায় নান্দনিক ও হৃদয়ছোঁয়া ‘যশোর রোড’ গানটির জন্য বাংলার শ্রোতাদের প্রাণের মানুষ। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর সাথেও গড়ে ওঠে সখ্য। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয় ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ।

২০১২ সালে ভারতের অন্যতম গণসঙ্গীতের দল ‘ক্যালকাটা কয়্যার’-কে আমন্ত্রণ জানানো হয় সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য। প্রখ্যাত শিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক কল্যাণ সেন বরাট এর নেতৃত্বে ২৭ জনের বিশাল এক দল উৎসবের পরিবেশকে সত্যিকারের উৎসবমুখর করে তোলেন। প্রত্যেকের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছাড়াও তাঁদের পরিবেশনার কৌশল ‘উদীচী’র শিল্পী তথা বাংলাদেশের গণসঙ্গীতের শিল্পীদের ঋদ্ধ করেছেন। ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারে তাঁরা অনুষ্ঠান করেন। ফিরে যান স্বদেশে কিন্তু এক অক্ষয় মেলবন্ধনে গ্রন্থিত হয় দু’টি সংগঠন, সংস্কৃিতর জগতে আলোর মশাল নিয়ে হেঁটে যাবার প্রতিজ্ঞায় বদ্ধ পরিকর হয়। সে প্রতিজ্ঞার সূত্র ধরে আবারো আসেন উদীচী’র শিল্পীদের প্রশিক্ষিত করার জন্য।

গত বছরটি ছিলো উত্তাল গণআন্দোলনের। বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত গবেষক শুভেন্দু মাইতির সঙ্গে যোগাযোগ করি কোলকাতায় গিয়ে কিন্তু ঐ সময়ের বাস্তবতার আন্দোলনকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছে ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’। ফলে গত বছর সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব আয়োজন থেকে বিরত থেকেছি আমরা। এবার তাই বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী শুভেন্দু মাইতি আসছেন পঞ্চম সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবের অতিথি হিসেবে। একজন নিভৃতচারী মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এইসব যোগাযোগ অসম্ভব ছিলো। তিনি আমাদের আরেক সুহৃদ আপনজন রতন বসু মজুমদার।

বিদেশি অতিথিরা ছাড়াও প্রত্যেক বছর সর্বজন শ্রদ্ধেয় অজিত রায়, সুধীন দাশ, সন্জীদা খাতুন, শিমুল ইউসুফ- এর মতো দেশের বরেণ্য গণসঙ্গীত শিল্পীরা সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসবে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থেকেছেন। এ বছর অনুষ্ঠানের উদ্বোধক সংগ্রামী গণসঙ্গীত শিল্পী কামরুদ্দীন আবসার।

সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব দেশের শিল্পীদের গণসঙ্গীত চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে। যার ফলশ্রুতিতে আজকাল আমরা সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গণসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারে কিছু উদ্যোগ দেখছি। দুই বাংলার শিল্পীদের মধ্যে আদান প্রদান হচ্ছে গণসঙ্গীতের ভাবনা, গাইবার ধরণ, সিম্ফোনির জোয়ার, তালের মাত্রা, ভাষার আকাশ, লেখনির স্ফূলিঙ্গ, সুরের শ্রাবণ। ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র একজন কর্মী হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের জন্য এই গণসঙ্গীত উৎসব এক পরম পাওয়া।

‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ একটি দর্শন নিয়ে কাজ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের ব্রতই উদীচীর পথচলার ইশতেহার। আমার চোখে এই আয়োজন উদীচীর দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার একটি পদবিক্ষেপ মাত্র। আগামী এক শতাব্দি পর হয়তো কোনো তরুণ গণসঙ্গীতশিল্পী বিচার করবেন, এই আয়োজনে আমরা কতোটুকু ব্যর্থ হয়েছি।