উদীচীর ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ: আখতার হুসেন

১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম হয়েছিল উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর। সেই হিসেবে আজ উদীচীর ৪৬তম জন্মদিন, ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।

উদীচীর ভ্রুণের  সঞ্চার হয়েছিল ৩৬ নারিন্দা লেনের এক মেস বাড়ির চিলতে একটা ঘরে। পাশের ঘরেই থাকতেন ‘প্রেস শ্রমিকের জারি’ নামের পালাগান লিখে বিখ্যাত হওয়া প্রেস শ্রমিক নেতা সাইদুল ইসলাম। সস্ত্রীক থাকতেন তিনি।
এই মেসের ঘরেই ১৯৬৭ সালের একদিন বিকেলের দিকে এসে হাজির সাংবাদিক-সাহিত্যিক সত্যেন সেন। সঙ্গে গোলাম মোহাম্মদ (ইদু ভাই), মোস্তফা ওয়াহিদ খান, বদরুল আহসান খান, রিজিয়া খাতুন, আদমজির গায়ক-শ্রমিক নেতা আবদুল খালেক। আরও কেউ ছিলেন কী-না, এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে আমাদের রুমেই যে উদীচীর প্রথম দিনের গানের রিহার্সাল হয়েছিল, সে কথা মনে আছে। আমরাও সেদিন গানে গলা মিলিয়েছিলাম। সত্যেন দার লেখা ও তাঁরই সুরারোপিত ‘ওরে বঞ্চিত সবহারা দল’ গানটি দিয়েই শুরু হয়েছিল উদীচীর ভবিষ্যৎ যাত্রা।
মনে রাখা দরকার উদীচীর জন্মের ও তার কাজের পরিধি প্রসারের পথ সহজ ছিল না। সেই কালের পাকিস্তানি পুলিশ বিভাগের চরেরা আমাদের পেছনে লেগেই ছিল। বিশেষ করে সত্যেন দা আর ইদু ভাই তো মার্কা মারা মানুষ ছিলেন। ১৯৫৮ সালের আইউবের সামরিক শাসন জারির পর আগে-পিছে করে তাঁদের দুজনকেই জেলে নেওয়া হয়েছিল।
যাই-হোক, আমাদের নারিন্দার মেসের ঘরে প্রথমদিনের রিহার্সালের পর সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আমাদের গানের এই স্কোয়াডের রিহার্সাল চলবে। ফলে আমাদের এখানে দুদিন কি তিনদিন রিহার্সাল হওয়ার পর কী এক কারণে যেন রিহার্সাল বা মহড়ার জায়গার পরিবর্তন করা হয়। আমরা এরপর রিহার্সাল করার জন্য চলে যাই গোপীবাগ এলাকায়। সেখানে রিহার্সাল করি আমরা একে একে ঘুরেফিরে শাহেদ আলী সাহেবের বাসায়, শিল্পী হাশেম খান ও তাঁর বড় ভাই ডা. সোলায়মান খানের বাসায়, তৎকালীন ছাত্র ও শ্রমিক নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ভাই ও শামীমদের বাসাসহ আরও বেশ কয়েকজনের বাসায়। এদের কাছে উদীচীর ঋণের পরিমাণ কম নয়। তারপর উদীচী গিয়ে ঠাঁই গাড়ে ঢাকা শহরের উত্তর দিকÑচামেলীবাগে। এখানে বামপন্থীদের একটা মেস ছিল। তাতে থাকতেন পীর হাবিবুর রহমান ও মোনায়েম সরকারসহ আরও অনেকেই। এই মেসকে ঘিরেই উদীচী শুরু করে তার সাংস্কৃতির কর্মকাণ্ডের মহড়া। জোরেশোরে, আরেকটু খোলামেলাভাবে। এখানেই উদীচীর নামকরণ করা হয়। চামেলীবাগ ঢাকা শহরের উত্তর দিক বলে সত্যেনদা তার নাম রাখেন ‘উদীচী’। উদীচী মানে উত্তর দিক, যেদিকে থাকে কম্পাসের কাঁটা।
তারপর উদীচীকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গণমানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যের সঙ্গী হয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাই তার মুখ্য আদর্শ ও দায়িত্ব হয়ে পড়ে। সেই লক্ষ্যের বাস্তবায়নে ১৯৬৭ সালে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৮ সালে জšে§র পর থেকে উদীচী রায়পুরার বিশাল কৃষক সমাবেশে গান ও নাটকের দল নিয়ে গিয়েছে, গিয়েছে মুন্সীগঞ্জে, নবাবগঞ্জে, গিয়েছে চাঁদপুরে, গৌরনদীতে, গিয়েছে মনোহরদীতে, জয়দেবপুরে, গিয়েছে আদমজীতে, শ্যামপুরে।
১৯৬৮ সালের শেষ দিকে উদীচী প্রথম পথ-নাটক করে ঢাকা শহরব্যাপী। নাটকের নাম ছিল ‘রক্তের রং লাল’। সেই নাটক ছিল বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক। অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি আমরা এই নাটকটি করতে গিয়ে। পথ নাটক করেছি আমরা ১৯৬৯ সালে কিশোর মতিউরের শাহাদাত বরণের সাত দিনের মাথায়। নাটকের নাম ‘রক্ত শপথ’, পরে এর নাম বদল করে রাখা হয় ‘শপথ নিলাম’। মানুষজন আমাদের নাটক দেখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পাত্রপাত্রীদের বুকে জড়িয়ে ধরেছে। এসব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে কখনো ট্রাকের ওপরে, কখনো পথের পাশে, ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সব মোড়ে। উদীচীর এইসব পথনাটক ও সঙ্গীতিক তৎপরতার বিবরণ পাওয়া যায় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’-তে, এবং সুকুমার বিশ্বাসের ‘বাংলাদেশের নাটকের চর্চা ও নাটকের ধারা’ গ্রন্থের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়।
উদীচীর কিছু রেকর্ডও আছে। বঙ্গবন্ধুকে যেদিন জুলিও কুরি পদকে ভূষিত করা হয়, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর ভাই-বোনরাই সেদিন গান গেয়েছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের জীবনে সবচেয়ে বেশি শিল্পীকে সমবেত করে গান গেয়েছিল উদীচী। ওইসব শিল্পী ভাই-বোনের সংখ্যা প্রায় দেড় শ’ থেকে পৌনে দুশর মতো ছিল। এ সংখ্যা এখনো কেউ ভাঙতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ইতিহাস সঠিকভাবে রচিত হলে দেখা যাবে, উদীচীই এ দেশে প্রথম পথনাটক করার কৃতিত্বের অধিকারী, সে পাকিস্তান আমলেও, সমভাবে বাংলাদেশ আমলেও।
উদীচী আরেকটি দিক দিয়ে ভাগ্যবান। এই সংগঠনে যত উৎসর্গীকৃত গুণী মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, তার সমকালে তেমনটা অন্য কোনো সংগঠনের বেলায় দেখা যাবে না। এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন সাংবাদিক-সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী কলিম শরাফী, একুশের গানের সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ, সুখেন্দু চক্রবর্তী, শেখ লুৎফর রহমান, আবদুল লতিফ, অজিত রায় প্রমুখ। নেপথ্য থেকে শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, শহীদ জহির রায়হান ও ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন মরহুম ড. জহুরুল হক, ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুন প্রমুখ নানাভাবে সহায়তা করেছেন উদীচীকে।
উদীচীর এই এত দূর আসার পথ ফুলে ফুলে ছাওয়া ছিল না। ছিল না যে, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল যশোরে উদীচীর সমাবেশস্থলে বোমাবাজির ঘটনার ভেতর দিয়ে। এবং উদীচী যে তার পরও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, সেই স্বীকৃতি মিলেছে তার ‘একুশে পদক’ পাওয়ার ভেতর দিয়ে। জয় হোক উদীচীর।