অসুর বিনাশী সুরের আগুন ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয়ে শুরু হলো উদীচী’র গণসঙ্গীত উৎসব

Gonosongeet Utsob_1st Dayঅসুর বিনাশী সুরের আগুন সবখানে ছড়িয়ে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত “সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা’২০১৪”। গত ২৮ মার্চ শুক্রবার বিকেলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী কামরুদ্দিন আবসার। উদ্বোধনের আগে সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ের গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা। জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা শেষে দেশের আটটি বিভাগীয় পর্যায়ের (ঢাকা পূর্ব ও পশ্চিমসহ) প্রতিযোগিতায় ‘ক’, ‘খ’ ও ‘গ’Ñ এই তিনটি বিভাগের প্রথম তিনটি স্থানাধিকারীরা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতিযোগিতার ‘ক’ বিভাগে ২০ জন, ‘খ’ বিভাগে ১৮ জন এবং ‘গ’ অর্থাৎ দলীয় বিভাগে মোট সাতটি দল অংশগ্রহণ করে।

প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার পর বিকেল সাড়ে ৪টায় শুরু হয় গণসঙ্গীত উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই উদীচী সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে পরিবেশন করেন জাতীয় সঙ্গীত, তাদের সাথে সুর মেলান অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সাথে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন উৎসবের উদ্বোধক কামরুদ্দিন আবসার এবং উদীচী’র পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কামাল লোহানী। পতাকা উত্তোলনের পর কয়েকটি গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী’র শিল্পীরা। এর পরপরই উৎসব উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন কামরুদ্দিন আবসার। এসময় তিনি তিন দিনব্যাপী এ উৎসব সফল করতে সকলেল সহযোগিতা কামনা করেন। উদ্বোধনের পর ঢাক আর ঢোলের তালে উচ্ছ্বল উদীচী’র নেতা-কর্মীরা নেচে গেয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন।

Gonosongeet Utsob_1st Day 02

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে প্রখ্যাত শিল্পী সায়ানের একক সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। সায়ান একে একে পরিবেশন করেন “ও আল্লাহ তোমার কাছে কই”, “কি করেছে তোমার বাবা, কি করেছে স্বামী” প্রভৃতি চারটি জনপ্রিয় গান। এরপর উদীচী’র সভাপতি কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা শুরু হয়। আলোচনা সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন গণসঙ্গীত উৎসব প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক ও উদীচী’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি শংকর সাঁওজাল এবং উদীচী’র সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। এতে অন্যান্যের মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত গবেষক ও শিল্পী শুভেন্দু মাইতি, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর, উদীচী’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ড. চন্দন দাস ও হাবিবুল আলম উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী’র স-সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন।

আলোচনা সভার পর প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। ‘ক’ বিভাগে যুগ্মভাবে প্রথম হয়েছেন শাহরিয়ার অভিক অতনু ও অর্ণব কান্তি সিংহ, দ্বিতীয় হয়েছে মীল মোবাশ্বিরা ইবনাত নদী, তৃতীয় স্থান পেয়েছে জিহাদ খান। ‘খ’ বিভাগে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন বিপ্লব রায়হান। যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হন আশরাফুল আলম এবং মানিক মোহন চন্দ। আর তৃতীয় হন নুশিন আদিবা ও জ্যোতিষ চন্দ্র বর্মণ। ‘গ’ অর্থাৎ দলীয় বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে উদীচী যশোর জেলা সংসদ। যৌথভাবে দ্বিতীয় হয় উদীচী চট্টগ্রাম, নওগাঁ এবং সিলেট জেলা সংসদ। তৃতীয় স্থান অর্জন করে তিনটি দল। এরা হলো- রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ, সাউন্ড টাচ রংপুর এবং অগ্নিবীণা শিল্পকলা বিদ্যালয়।

বিজয়ীদের নাম ঘোষণা পর সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বের শুরুতে উদীচী নৃত্য বিভাগের শিল্পীরা পরিবেশন করেন দলীয় নৃত্য। এছাড়াও, গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন দেশের প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী ও দলগুলো। এ পর্বে ছিল গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার বিভাগীয় পর্যায়ের আটটি বিভাগে প্রথম স্থান পাওয়া শিল্পীদের একক পরিবেশনা। এছাড়া, দলীয়ভাবে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে বিভাগীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারী আটটি দল এবং ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। আর, আমন্ত্রিত শিল্পী হিসেবে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন তুষার দে, ফকির আলমগীর, হাবিবুল আলম ও ঐশিকা নদী।

উদীচী আয়োজিত সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ২৯ মার্চ বিকাল ৪টায় শুরু হবে আলোচনা সভা। উদীচী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সাবেক সভাপতি গোলাম মোহাম্মদ ইদুর সভাপতিত্বে এতে উপস্থিত থাকবেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, উদীচী’র সাবেক সভাপতি সৈয়দ হাসান ইমাম, আমন্ত্রিত অতিথি শুভেন্দু মাইতি এবং উদীচী’র সহ-সভাপতি মাহমুদ সেলিম। আলোচনার পর চারণ শিল্পী ও উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের অন্যতম সদস্য সিদ্দিক মোল্লার গানের সিডি “গরীব দুঃখীর আপন কেহ নাই”-এর মোড়ক উন্মোচন করবেন গোলাম মোহাম্মদ ইদু। এরপর জাতীয় পর্যায়ের গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে সনদপত্র ও ক্রেস্ট তুলে দেবেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয় পর্বে একক গণসঙ্গীত পরিবেশন করবেন শুভেন্দু মাইতি, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বুলবুল মহলানবীশ, কফিল আহমেদ, নিবেদিতা তপু, শায়ান ও কৃষ্ণকলি। এছাড়াও, দলীয়ভাবে গণসঙ্গীত পরিবেশন করবে উদীচী কাফরুল শাখা, বহ্নিশিখা ও সাংস্কৃতিক ইউনিয়ন। উৎসবের তৃতীয় ও শেষ দিন ৩০ মার্চ সন্ধ্যা ৬টায় জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে অতিথি শিল্পী শুভেন্দু মাইতি’র একক সংগীত সন্ধ্যা আয়োজিত হবে।

দেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে গণসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দেয়া এবং গণসঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সত্যেন সেনের জন্মদিবস উপলক্ষে প্রতিবছর ২৮ ও ২৯ মার্চ “সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা” আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্র, শ্রমজীবীর বিরুদ্ধে শোষক, অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা, সত্যের বিরুদ্ধে অসত্য সর্বোপরি শুভ ও সুরের বিরুদ্ধে অশুভ ও অসুরের শক্তি দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাই, অশুভ আর অসুর শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সক্রিয় করার লক্ষ্যে উদীচী’র এবারের গণসঙ্গীত উৎসবের শ্লোগান হলোÑ “অসুর বিনাশী সুরের আগুন, ছড়িয়ে দাও সবখানে”।