অনবদ্য গায়কীতে মুগ্ধ করলেন গণসঙ্গীত উৎসবের অতিথিরা

সঙ্গীত সন্ধ্যায় অনবদ্য গায়কীতে সবাইকে মুগ্ধ করলেন
উদীচীর গণসঙ্গীত উৎসবের অতিথিরা

অনবদ্য গায়কী আর সুরের মূর্ছনায় সবাইকে মুগ্ধ করলেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত ষষ্ঠ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা-২০১৫ এর আমন্ত্রিত অতিথিরা।

স্বপন কুমার হালদার, আমন্ত্রিত অতিথি ভারতের বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার এবং তাঁর মেয়ে শবনম সুরিতা ডানা।
স্বপন কুমার হালদার, আমন্ত্রিত অতিথি ভারতের বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার এবং তাঁর মেয়ে শবনম সুরিতা ডানা।

গত ৩০ মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত সঙ্গীত সন্ধ্যায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন এবারের গণসঙ্গীত উৎসবের উদ্বোধক বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত সাধক ও শিল্পী স্বপন কুমার হালদার, আমন্ত্রিত অতিথি ভারতের বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার এবং তাঁর মেয়ে শবনম সুরিতা ডানা।

সঙ্গীত সন্ধ্যার শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি কামাল লোহানী। এসময় তিনি মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িকত গোষ্ঠীর হামলায় ব¬গার ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। ক্ষোভ জানিয়ে তিনি অবিলম্বে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। এরপর একে একে মঞ্চে আসেন তিন গুণী শিল্পী। তাদেরকে উদীচীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান উদীচীর সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান, কাজী মোহাম্মদ শীশ এবং শিল্পী তানভীর আলম সজীব। এরপর তিন শিল্পীর সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন উদীচীর সহ-সভাপতি বেলায়েত হোসেন, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হালিমা নূর পাপন এবং কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য শিখা সেন গুপ্তা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উদীচীর সহ-সভাপতি শংকর সাওজাল।

এরপর মঞ্চে সঙ্গীত পরিবেশন করেন স্বপন কুমার হালদার, শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার এবং শবনম সুরিতা ডানা। বিজয় সরকারের গানসহ বাউল-বিচ্ছেদ ভক্তিগীতির অনবদ্য মিশ্রণে সবাইকে মুগ্ধ করেন স্বপন কুমার হালদার। জীবনমুখী নানা গান, গণসঙ্গীত এবং রবীন্দ্র সঙ্গীতের সংমিশ্রনে অসাধারণ পরিবেশনা উপস্থাপন করেন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। আর বাবার সাথে যোগ্য সঙ্গ দেন তাঁর মেয়ে শবনম সুরিতা ডানা।

স্বপন কুমার হালদার বাংলাদেশের খুলনা-যশোর অঞ্চলের লোকগানের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পী। বিজয় সরকারের সরাসরি স্নেহধন্য এই শিল্পী তাঁর অসাধারণ গায়কী ও সুরেলা কণ্ঠে বিজয় সরকারের অনন্য তত্ত্বভিত্তিক গানগুলোকে ফুটিয়ে তোলেন তিনি। তিনি খুলনা বেতারে যোগ দেন ১৯৯০ সালে। সেখানে ‘এ’ গ্রেডের শিল্পী হিসেবে এখনও গান করছেন। ভারতের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বেশ ক’বার গান গেয়ে প্রশংসা ও সম্মাননা পেয়েছেন। বাংলাদেশের ফরিদপুর,যশোর-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-গোপালগঞ্জ-বরিশাল-মঠবাড়িয়া, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে গান গেয়ে সুনাম অর্জন করেছেন।

ছোটবেলা থেকেই পালাগান-যাত্রা-নাটক, গ্রামের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অভিনয়সহ গান করে সবার নজর কাড়েন। তাঁর নিজের গড়া যাত্রাদলের নাম ‘মণিমালা যাত্রা সম্প্রদায়’। আর মতুয়া দলের ও গানের দলের নাম ‘মামা-ভাগিনা সম্প্রদায়’। এছাড়াও কীর্তন-রামায়ন-কবি, জারি-ধর্মীয় গান করে থাকেন। বিচ্ছেদ ও ভাবুক কবি শ্রী বিজয় সরকার কবিগানের বায়নাসহ প্রতি বছর গান করতে দল নিয়ে  আসতেন বাড়িতে। সাথে উনার শিষ্য রসিক, অনাদি, নারায়ণসহ আরো অনেকে। তখন বিজয়বাবুর কাছে বসে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গানের গুরু হিসেবে মেনে নেন। গুরুও তাঁর গান শোনেন।  গুরু দু’হাত মাথায় দিয়ে শিষ্য হিসেবে আশীর্বাদ করেন স্বপন হালদারকে । নিজের গানের একটি বই হাতে তুলে দিয়ে বলেন- “এই নাও। তুমি পারবে- আমার গান করো”। সেখান থেকে বিজয় সরকারের গান নিয়ে পথচলা। ৬ মার্চ ১৯৯৯ যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে যেদিন বোমা হামলা হয়, সেদিনও সন্ধ্যায় ওই মঞ্চে বিজয় সরকারের গান করেন।

শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার ১৯৭৩ সাল থেকেই সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে অল ইন্ডিয়া রেডিও (এ.আই.আর)-এর সাথে যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমানে রবীন্দ্র সঙ্গীতের একজন ‘এ’ গ্রেড শিল্পী হিসেবে নিবন্ধিত। এ.আই.আর-এর লোকসঙ্গীত দলের মুখ্য কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। ১৯৯৩ সাল থেকে দূরদর্শনের একজন নিয়মিত শিল্পী তিনি। কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, দিলি¬, ব্যাঙ্গালোর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পরিবেশনা করেছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর তিনটি গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আরেকটি সংগ্রহ এখনো প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বাংলা গানের অ্যালবামে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। আইপিটিএ, শিলচর-এর সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। দূরদর্শনের গানের জন্য তিনি সঙ্গীতায়োজন করেছেন, তথ্যচিত্রের পরিচালনা এবং ব্যালের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন।

১৯৯২ সালে জন্ম নেয়া শবনম সুরিতা ডানা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” বিষয়ে এম.এ পরীক্ষা দিয়েছেন। ১৮ বছর ধরে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিচ্ছেন। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে বাংলা সিরিয়ালে গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। নারী অধিকার সুরক্ষার সাথে যুক্ত থেকে জাতীয় মহিলা কমিশনে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেছেন। ভারতের বামপন্থী ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া, এস.এফ.আই-এর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাথে যুক্ত রয়েছেন। সাউথ এশিয়ান হিস্ট্রি এন্ড কালচার বিষয়ে পড়াশোনার জন্য ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে স্কলারশিপ পেয়েছেন। পিতা, বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের আদর্শকে অনুসরণ করে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যম হিসেবে গণসঙ্গীতকে বেছে নিয়েছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাবার সঙ্গে গেয়ে চলেছেন গণসঙ্গীত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *