সমকালিন বাংলাগানঃ প্রগতির প্রত্যাশা মাহমুদ সেলিম

প্রগতি শব্দটির মধ্যে ‘গতি’ শব্দটি থাকলেও প্রগতি আর গতি এক নয়। গতির মধ্যে আগ্রগতি, পশ্চাৎগতি সবই রয়েছে। আবার শুধু অগ্রগতি আর প্রগতিও এক নয়। কোটি কোটি বছর ধরে প্রকৃতিরাজ্যে বিবর্তন ঘটেছে। জীবজগত জটিল থেকে জটিলতর স্তরে উন্নীত হয়েছে। এটি একটি অগ্রগতি বটে। কিন্তু প্রগতি নয়। প্রগতি হচ্ছে প্রকৃষ্ট গতি। এ গতি আপনা আপনি সূচিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রগমনের জন্য মানুষের সচেতন প্রয়াস। লক্ষ্যটি হচ্ছে একটি পূর্ণবিকশিত মানব সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে এমন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ যে, মানুষ থাকবে চিন্তায় ও কর্মে স্বাধীন। তার সার্বিক বিকাশের পথ থাকবে সম্পুর্ণ কণ্টকমুক্ত।

সেই বিকশিত সমাজে পৌঁছানোর জন্য সচেতনভাবে তার ভিত্তি রচনা, ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, মানসিক ও শারীরিকভাবে মানুষকে সংগঠিত করা, বাধাবিঘ্ন জয়ের জন্য সংগ্রাম করা থেকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রতিটি পদক্ষেপই প্রগতি। মনে রাখতে হবে, অর্জনটি প্রগতি নয়, অর্জনের জন্য চলাটিই প্রগতি। এই পদক্ষেপসমূহ নানাভাবে হতে পারে। নানা মাধ্যমে হতে পারে। সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে শিল্প (Art) আমরা বলে থাকি যে, সংস্কৃৃতিই সমাজ বদলের হাতিয়ার। কিন্তু কথাটি সর্বাংশে শুদ্ধ নয়। সংস্কৃৃতি হচ্ছে একটি বিদ্যমান প্রপঞ্চ (Prevailing phenomenon)। সংস্কৃৃতির উপকরণগত অংশটি সমাজ বদল করেনা। বরং পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেই পালটে যায়। আচরণগত অংশটিও পাল্টায়। কিন্তু সংস্কৃৃতির ক্রিয়াশীল অংশটি হচ্ছে মানস সংস্কৃৃতি, বিশেষকরে শিল্পকলা (Art)। একমাত্র Art এরই ক্ষমতা আছে মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন ও বিকাশ সাধন করা। এই মনোজগতের পরিবর্তনই আবার উপকরণগত ও আচরণগত সংস্কৃৃতির পরিবর্তন ঘটায়। এইভাবেই মানব সংস্কৃৃতির অগ্রগমন ঘটে।

প্রশ্ন উঠতে পারে রাজনীতি কি সমাজ পরিবর্তন করেনা? নিশ্চয়ই করে। লুকাচ বলেছেন, মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সংস্কৃৃতি (পূর্ণবিকশিত মানব সংস্কৃৃতি)। রাজনীতি হচ্ছে সেখানে পৌঁছার একটি মাধ্যম মাত্র। কিন্তু রাজনীতিও যতক্ষণ না Art হয়ে ওঠে ততক্ষণ সে এই কাজে সফল হতে পারে না। লিওন ট্রটস্কি বলেছিলেন- “Insurrection is an art”। বিদ্রোহও একটা শিল্প। বক্তৃতা বা বাগ্মিতাকেও Art হতে হবে, নইলে মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবেনা। বলাই বাহুল্য বক্তৃতার শিল্পগুণ আর কবিতার শিল্পগুণ নিশ্চয়ই এক পাল্লায় বিচার্য হবে না।

শিল্প যেমন কেবলমাত্র স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশ নয়। যথাযথ কৌশল এবং পরিমিতি বোধ দিয়ে শিল্পকে রচনা করতে হয়। নচেত শিল্পসৃষ্টি হয়না। তেমনি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়, কৌশল অবলম্বন করতে হয়, পদক্ষেপগুলো পরিকল্পনা করতে হয়। আবার এই স্বতঃস্ফূর্ততাকে যথাসময়ে নিয়ন্ত্রণও করতে হয়। নইলে বিপ্লব ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই, যেদিক দিয়েই বিবেচনা করা হোক, শিল্প বা অৎঃ এর ভূমিকা ছাড়া সমাজ প্রগতি সম্ভব নয়।

শিল্পের নানা শাখা। সাহিত্য, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, কথিকা, চারুকলা, সংগীত, নৃত্য, নাটক, বাচিক শিল্প ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের আলোচনা সংগীত শাখার একটি অংশ বাংলা গান নিয়ে এবং সেটিও সমগ্র বাংলা গান নয়। সমকালিন বাংলা গান। বাংলাগানকে সমকালে উপনীত হতে অনেক পথ পেরিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক গ্রহণ বর্জন পরীক্ষণ শেষে বাংলা গানের নিজস্ব চারিত্র্য গড়ে উঠেছে। বাংলাগান বাণী প্রধান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- “বাংলাদেশে সংগীতের স্বতন্ত্র পংক্তি নয়, বাণীর পাশেই তার আসন”। তিনি অন্যত্র বলেছেন- “কাব্যকে অন্তরের মধ্যে ভালো করিয়া ধ্বনিত করিয়া তুলিবার জন্যই এদেশে সংগীতের অবতারণা হইয়াছিল”। প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে গদ্যের বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র সাহিত্যই ছিল কাব্য এবং তা সুরের মাধ্যমেই জনসমক্ষে পঠিত হতো। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডীমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল সবই সুরে গীত ও পঠিত হতো। চতুর্দশ শতকে বাংলা সাহিত্যে দেবদেবী ও ঐশী বন্দনার শৃংখল ভেঙ্গে মানবিক প্রেমকে উপজীব্য করে যে আধুনিকতার ধারা সূচিত হয়েছিল, শাহ মুহাম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ জুলায়খা’ এবং আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের মাধ্যমে, সেসব কাব্যও সুরে গীত হতো।

বাংলাগানের মূলধারা বাউল, কীর্তন, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাংলার পুঁথিসাহিত্য, লোকগাথা, পালাগান, যাত্রা, পাঁচালি, টপ্পা, ধামাইল, মুর্শিদী, মারফতি, পটগান, ব্রতগান সকল ক্ষেত্রেই বাণীর সাথে সুরের অঙ্গাঙ্গী অবস্থান। কাব্যের সংগে সংগীতের মিলনের এই ধারাটিকে রবীন্দ্রনাথ বাংলার নিজস্ব ধারা বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন- “বাংলাদেশের কাব্যের সাথে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে একটি অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগ রাগিণীর প্রথাগত বিশুদ্ধতা থাকবেনা, যেমন কীর্তনে তা নেই। অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবেনা। নিয়মের স্খলন হতে থাকবে। কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্য উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না। এই জন্য গানের বাণীকেও সুরের খাতিরে কিছু আপস করতে হয়, তাকে সুর উপযোগী হতে হয়।”

এই ধারাতেই বাংলা কাব্য সংগীতের মুখ্য ধারাটির বিকাশ ঘটেছে এবং এই ধারার সর্বোৎকৃষ্ট রূপটি পাই রবীন্দ্রনাথের গানে। রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণীর গানকে বলেছেন ‘আধুনিক’ শ্রেণীর গান। রবীন্দ্রনাথের পরেই বাংলা আধুনিক গানের বিকাশে যাদের নাম করতে হয় তারা হলেন, কাজী নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত। বাংলা গানের জগতকে এই পঞ্চকবি সমৃদ্ধির উচ্চতর স্তরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। আধুনিক বাংলাগানের বিকাশের ক্ষেত্রে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করলেন নজরুল। পঞ্চকবির প্রত্যেকেই ছিলেন একাধারে কবি এবং সুরস্রষ্টা। কিন্তু এই দুই গুণ একসাথে না থাকলে ভালো গান হবেনা- এ ধারণাটি নজরুল ভেঙ্গে দিলেন। কেউ কেবলমাত্র ভালো কবি হতে পারেন, আবার কেউ শুধুমাত্র ভালো সঙ্গীতজ্ঞ বা সুরস্রষ্টা হতে পারেন। তাই নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানিতে চাকুরির সুবাদে বাংলাগানের শ্রম বিভাজনের সূচনা করেন। একজন লিখবেন, অন্যজন সুর করবেন।

ফলে বাংলাগানের ইতিহাসে স্বতন্ত্রভাবে বহু গীতিকবি এবং সুরস্রষ্টার জন্ম হলো। বাংলাগান নতুন গতি পেল। বাংলা গানকে সমৃদ্ধতর, গতিশীল ও ক্সবচিত্র্যময় করে তোলার ক্ষেত্রে বিদেশি সংগীত, বাদ্যযন্ত্র, ভাব, সুরোপকরণ ও নানা প্রকরণের ব্যবহার একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে এ কথা অস্বীকার করা যাবেনা। বাংলা সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃৃতির সংস্কৃারমুক্তি ঘটেছিল- রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- “বিদেশি সোনার কাঠির ছোঁয়ায়”। তিনি বলেছেন “বিদেশের সোনার কাঠি যে জিনিসকে মুক্তি দিয়েছে সে তো বিদেশি নয়; সে যে আমাদের প্রাণ।…….আপনার পূর্ণ শক্তি পাবার জন্য বৈষম্যের আঘাতের অপেক্ষা তাকে করতেই হয়। কোন সভ্যতাই একা আপনাকে আপনি সৃষ্টি করে নাই। গ্রিসের সভ্যতার গোড়ার অন্য সভ্যতা ছিল। গ্রিস বরাবর ইজিপ্ট ও এশিয়া থেকে ধাক্কা খেয়ে এসেছে। ভারতবর্ষে দ্রাবিড় মনের সঙ্গে আর্য মনের সংঘাত ও সম্মিলন ভারত সভ্যতা সৃষ্টির মূল উপকরণ।

য়ুরোপিয় সভ্যতায় যেসব যুগকে পুনর্জন্মের যুগ বলে সে সমস্ত অন্য দেশ ও অন্যকালের সংঘাতের যুগ। মানুষের মন বাহির হতে নাড়া পেলে তবে আপনার অন্তরকে সত্যভাবে লাভ করে, এবং তার পরিচয় পাওয়া যায় যখন দেখি সে আপনার বাহিরের জীর্ণ বেড়াগুলোকে ভেঙ্গে আপনার অধিকার বিস্তার করেছে। এই অধিকার বিস্তারকে একদল লোক দোষ দেয়, বলে ওতে আমরা নিজেকে হারালুম, তারা জানেনা নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া নিজেকে হারিয়ে যাওয়া নয়, কারণ বৃদ্ধিমাত্রই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া।”

এ সত্য সহজভাবে গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং নজরুল। আর তাতেই বাংলাগানে এলো নতুন নতুন সৃজশীলতার জোয়ার। প্রতিটি আলাদা গান হয়ে উঠলো একেকটি আলাদা সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের এই যে বিশ্বমুখীনতা, সেটি বাংলা সাহিত্য ও সংগীতকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং নজরুল এই তিনজনই বিদেশি সুরোপকরণকে আত্মস্থ করে বাংলা গানে ব্যবহার করেছেন, বাংলা গানের স্বকীয়তা বজায় রেখেই। অনুকরণ করেননি। পুনঃসৃজন করেছিলেন। এই দেয়া নেয়ার সপক্ষে রবীন্দনাথ যে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তা তাঁর বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি বলেছেন- “দ্বিজেন্দ্রলালের গানের সুরের মধ্যে ইংরেজি সুরের স্পর্শ লেগেছে বলে কেউ কেউ তাঁকে হিন্দু সংগীত থেকে বহিস্কার করতে চান। যদি দ্বিজেন্দ্রলাল হিন্দু সংগীতে বিদেশী সোনার কাঠি ছুঁইয়ে থাকেন, তবে সরস্বতী নিশ্চয়ই তাকে আশির্বাদ করবেন। হিন্দু সংগীত বলে যদি কোন পদার্থ থাকে তবে সে আপনার জাত বাঁচিয়ে চলুক, কারণ তার প্রাণ নেই, তার জাতই আছে। চিত্তের সঙ্গে চিত্তের যে সংঘাত আজ লেগেছে। সেই সংঘাতে সত্য উজ্জ্বল হবে না, নষ্টই হবে, এমন আশংকা যে ভীরু করে,- যে মনে করে সত্যকে সে নিজের মাতামহীর জীর্ণ কাঁথা আড়াল করে ঘিরে রাখলে তবেই সত্য টিকে থাকবে- আজকের দিনে সে যত আস্ফালনই করুক, তকে পথ ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে”। এই পঞ্চকবির প্রেরণায় বাংলা আধুনিক গানে বিংশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই যে সুবর্ণযুগের সূচনা হয়, নানা উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সে ধারা আজও প্রবহমান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আর একটি ধারা বাংলা সঙ্গীত জগতে প্রাবল্য লাভ করে। সেটি হচ্ছে পাশ্চাত্য প্রভাবিত ধারা। একে কেউ পপসংগীত, কেউ ব্যান্ড সংগীত ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করে থাকেন। একদিকে নতুন কিছু করার উদগ্র বাসনা অন্যদিকে স্বাধীনতার পর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান জনিত হতাশা এবং পাশাপাশি সেই হতাশাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত ও নেশাগ্রস্ত করার সচেতন অপপ্রয়াস- এমনি জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে পপ সংগীতের এই ধারাটির সূচনা।

শুরু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আজম খান, ফিরোজ সাঁই, লাকি আকন্দ প্রমুখ শিল্পীদের হাত ধরে। শুরুটা ছিল চিৎকৃত এবং দুর্বল বাণী আশ্রয়ী। কিন্তু তরুণচিত্ত আকর্ষক। এক অর্থে জনপ্রিয়। ‘ওরে সালেকা,ওরে মালেকা’ গানটির কাব্যবিচার করতে যাওয়া নিরর্থক। কিন্তু এর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশস্পর্শী। ‘ইস্কুল খুইলাছে রে মাওলা’ গানটি একটি ভাণ্ডারী ভাবাপন্ন গান, গিটার ও ড্রাম সহযোগে গায়নের কারণে এটি উদ্দাম জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রারম্ভিক এলোমেলো অবস্থা কাটিয়ে এই ধারাটি পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সংহত হতে থাকে। একে একে রক এন্ড রোল, কান্ট্রি, ল্যাটিন, স্প্যানিশ, ফ্লামিংগো, সালসা, সাম্বা, হিপ হপ, ব্লুজ, জ্যাজ প্রভৃতি বিভিন্ন পশ্চিমা সংগীতের প্রকরণ এই তরুণ সমাজের হাত ধরে বাংলা গানের ভুবনে স্থান করে নেয়। পাশাপাশি চলতে থাকে এইসব গানের বাণীর উন্নয়ন প্রচেষ্টা। যার ফলে ব্যান্ড শিল্পীদের হাতে বহু শিল্পগুণসম্পন্ন গান রচিত হয়েছে। তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা এমন বহু কাব্যগুণ সম্পন্ন গান রচনা করেছেন যা বাংলা আধুনিক গানের ধারাকেও সমৃদ্ধ করেছে। সমকালিন বাংলাগানের জগতে আধুনিক ধারার একই পংক্তিতে পাশ্চাত্য প্রভাবিত ধারার গানও তার স্থান করে নিয়েছে।

বাংলাগানের আরেকটি ধারা হচ্ছে লোকগানের ধারা, যেটি অত্যন্ত শক্তিশালী। কোন নতুন ধারার আগমনই একে দুর্বল করতে পারেনি। বরং নতুন ধারার অভিঘাতে চিরায়ত লোক ধারা বারবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। সমৃদ্ধ হয়েছে। বাংলায় রচিত সকল গানের ধারার ওপর তার প্রবল প্রভাব সঞ্চারিত হয়েছে, কি সুরে, কি ভাবসম্পদে, কি গায়ন ভঙ্গিতে।

সমকালিন বাংলাগান বলতে সমকালে প্রবহমান সকল ধারাকেই ধরতে হবে। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে শিল্প (অৎঃ) ই হচ্ছে সমাজ বদলের হাতিয়ার। সুতরাং প্রগতির প্রত্যাশা তো শিল্পের এবং শিল্পীর কাছেই করব। রণেশ দাশগুপ্ত উদীচীর গঠনতন্ত্রের মুখবন্ধে বলেছেন- “শিল্পীর কাজ হচ্ছে মানুষকে নিরন্তর প্রগতি অভিমুখে নিয়ে যাওয়া।” প্রকৃতপক্ষে শিল্পী এবং শিল্পই প্রগতির আকাক্সক্ষার জন্ম দেয়, প্রগতির পথ রচনা করে মানুষ নিজেই শিল্পী হয়ে ওঠে, বাধা এলে শিল্পী এবং শিল্প তা থেকে উত্তরণের জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং সংগঠিত করে। গান একটি শক্তিশালী মাধ্যম। সংগীতের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে প্রগতির জন্য কাজ করে যাওয়ার। তবে সে সংগীত অবশ্যই বাণীপ্রধান। কেবলমাত্র সুরের কালোয়াতি, তানকারি, লয়কারি মানুষকে হতবাক করে, চমৎকৃত করে, কিন্তু কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায়না, তেমনি কেবলমাত্র তাল আর উদ্দাম নৃত্য মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য নেশাগ্রস্ত রাখে, ভাবায় না। এক মাত্র বাণীসমৃদ্ধ গানই পারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে, কল্পনাশক্তি জাগিয়ে তুলতে।

খুব সংক্ষেপে প্রগতির পক্ষে বাংলাগানের ভূমিকা তুলে ধরতে গেলে বলতে হয়- ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতবর্ষের মুক্তি, বাঙালির পাকিস্তানি শাসন শোষণ থেকে মুক্তি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতি চেতনায় এদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণ, সকল ক্ষেত্রেই বাংলাগানের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশ গড়ার সংগ্রামের পক্ষে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, জঙ্গী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এবং নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমাজ ও রাজনীতি-সচেতনামূলক বহু গান রচিত হয়েছে। পাশাপাশি গীটার হাতে তরুণ প্রজন্মের গানেও এসেছে সমৃদ্ধ বাণী, এসেছে সমাজসচেতনতা, সমাজের অসংগতিগুলোকে তুলে ধরার প্রবণতা। এসকল গানকে আমরা প্রগতিমুখী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

কিন্তু সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতা প্রগতির ভাবনাকে দিনদিন দুরূহ থেকে দুরূহতর করে তুলছে। সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক লুণ্ঠনকে সহায়তা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় সারাবিশ্বে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে। ঘটেছে নৃশংস জঙ্গীবাদের উত্থান। যার প্রবল প্রভাবে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে উপমহাদেশের তথা বিশ্বের সমাজ-মানসিকতায়। মানুষ ক্রমাগত পারলৌকিকতা আর অন্ধবিশ্বাসের বিবরে তলিয়ে যাচ্ছে, জীবনবিমুখতার পুনরাবর্তন ঘটছে, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি প্রকট আকার ধারণ করছে, হতাশা আর ভাগ্যনির্ভরতা প্রবলতর হচ্ছে। তার অভিঘাত এসে পড়ছে গানেও। সমকালিন বাংলাগানে একদিকে যেমন সমাজ সচেতনতা যোগ হয়েছে, অন্য দিকে সমাজের কূপমণ্ডূকতা, অন্ধবিশ্বাসের পুনরাবর্তন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি, সুবিধাবাদ, হতাশা, ভাগ্য নির্ভরতা সমকালিন গানকেও কলুষিত করছে।

তাই, লড়াইটি কঠিন হয়ে গেলেও, সমকালিন গানের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, গান হবে গণমুখী, জীবনমুখী, আরও লড়াকু এবং প্রগতিমুখী যা মানুষকে সচেতন করবে, কুসংস্কৃার থেকে মুক্ত করে বিজ্ঞানমনস্ক করবে, স্বাধীনতার বোধ জাগ্রত করবে, পরমতসহিষ্ণুতা ও অসাম্প্রদায়িকতা শেখাবে, মানবিক করবে, নারী-পুরুষ বৈষম্য থেকে শুরু করে সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে শেখাবে, সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা শেখাবে আর শেখাবে অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করতে।

সমকালীন গান হোক মানুষের সচেতনতার আর মানুষের মুক্তি রচনার অন্যতম হাতিয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *